সম্পৃক্ততা ১৮ পর্ব এবং শেষ পর্ব

0
837

সম্পৃক্ততা – ১৮তম পর্ব / শেষ পর্ব।

রিফাত হোসেন।

৩৯.
সজল দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে বলল, ” দেখেছ আসমা, আমি বলেছিলাম না খুব শীঘ্রই তোমাকে আমার কাছে আসতে হবে।”
আসমা দুই হাত বুকের নিচে জড়ো করে নড়েচড়ে দাঁড়ালো। হেসে বলল, ” হুম, বলেছিলেন তো।”
” আমি কিন্তু আগেই জানতাম তুমি নিজেই আমার কাছে আসবে। আসতে বাধ্য হবে। বাধ্য হয়েছ না?”
” হয়েছি।” মিটমিট করে হাসল আসমা।
দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে তাকালো মাথার উপরে থাকা চাঁদের দিকে। আশ্চর্য ; চাঁদও মিটমিট করে হাসছে! আসমা উৎকণ্ঠাযুক্ত গলায় কিছুটা চেঁচিয়ে বলল, “তাকিয়ে দেখুক, চাঁদ হাসছে; মিটমিট করে।”
সজল উপরের দিকে তাকালো না। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে পিছনে তাকালো একবার। আসমা আড়চোখে সজলের হাবভাব দেখল; তাঁর মনে হলো, আকাশের দিকে তাকানোর থেকেও পিছনের দিকে তাকানোটা সজলের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আসমা অস্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। বলল, ” প্লিজ, একবার উপরের দিকে তাকান।”
সজল তাকালো না এবারও। আসমা ক্ষিপ্ত গলায় চেঁচিয়ে বলল, “বিলিভ মি, দ্যা মুন ইস স্মাইলিং।”
সজল ভড়কে গেল। আসমার দিকে এগিয়ে এসে গা ঘেষে দাঁড়ালো। এরপর আসমার মতো করে মাথাটা সামান্য তুলে চোখ রাখল খোলা আকাশের দিকে; আকাশের গায়ে আষ্টেপৃষ্টে থাকা চাঁদের দিকে। চাঁদটা কী সুন্দর দেখতে! সাদা রঙের গোলাকার ফুটবলের মতো দেখতে চাঁদটাতে কালো দাগ আছে । তবুও কত সুন্দর তাঁর রূপ! মানুষের গায়েও কখনো কখনো কালো দাগ থাকে। কিন্তু তাকে কখনোই সুন্দর বলা হয় না। মুখে কালোর ছাপ আছে মানেই তাঁর রূপ নেই। অথচ তাঁরা বুঝে না, কালোতে কত মায়া আছে! কত মততা, কত সৌন্দর্য আছে!

অবাক কাণ্ড! সজল স্পষ্ট দেখলো, চাঁদ হাসছে! ঠিক যেভাবে বলল আসমা, সেভাবেই হাসছে; মিটমিট করে। যেন সে প্রেমে পড়েছে! সজল উত্তেজনায় আসমাকে চেপে ধরল। আসমা বাধা দিলো না। সে তাকিয়ে আছে মিটমিটিয়ে হাসতে থাকা চাঁদের দিকে। সজল, আসমার সাথে ঘেষে দাঁড়িয়ে, আসমার শরীর চেপে ধরে কানে কানে বলল, ” এই সময় আমাদের পাশে তৃতীয় ব্যক্তি থাকলে কী বলতো জানো?”
আসমা ঘোরলাগা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ” কী?”
” বলতো, এই দু’জন নির্ঘাত প্রেমের সমুদ্রে ডুব দিয়েছে। তাই গম্ভীর চাঁদকে বলছে, মিটমিট করে হাসছে।”
আসমা চোখ নামিয়ে পাশে থাকা সজলের দিকে তাকালো। দু’জনের মধ্যে দূরত্ব এক ইঞ্চি কিংবা আরো কম হবে। আসমা সেই সামান্য দূরত্বটুকু মাড়িয়ে সজলের একটা হাত ধরল। আবারও আকাশের দিকে তাকিয়ে হাত উঁচু করে দেখালো, ” ওই দেখুন চাঁদ। শুধু যে মিটমিট করে হাসছে, তা না, মুচকি হাসিও দিচ্ছে।”
সজল নিজের হাত গুটিয়ে নিলো; সাথে আসমাও। কারোর মুখে খানিকক্ষণ কথা থাকলো না। সাহসা সজল একটা ভয়ঙ্কর প্রস্তাব দিয়ে বসল। বলল, ” আসমা, তোমার গালে একটা চুমু দিবো?”
আসমা হতভম্ব! সজলের মুখে এ ধরণের কথা শোভা পায় না। আসমার রাগ হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু অদ্ভুতভাবে সে লজ্জা মেয়ে গেল। সজলের চোখের দিকে আর সরাসরি তাকালো না। বলল, ” এটা যে পাপ, তা কী আপনি জানেন না?”
” জানি। কিন্তু খুব লোভ হচ্ছে।”
” সবাই তো কপালে অথবা ঠোঁটে চুমু দেয়। হাতেও দেয়। আপনি গালে দিতে চাচ্ছেন কেন?”
” জানি না। শুধু এটা জানি, আমাকে তোমার গালে একটা চুমু দিতেই হবে।” সজলের মধ্যে থেকে তীব্র অস্থিরতা বেরিয়ে এলো।
” আপনার চোখে আমি কামনা দেখতে পাচ্ছি সজল সাহেব। শান্ত হোন।”
” মিথ্যা কথা। তুমি এখনো আমার চোখের দিকে তাকাওনি ভালো করে। আমার চোখে কী আছে, তা তোমার জানার কথা না।”
” তবুও আমি বলব, আপনার মধ্যে কামুকতা প্রকাশ পাচ্ছে।”
” বিপরীত সত্তার দু’টো মানুষ এই রাতেরবেলা এত কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। কামুক যন্ত্রণা হবে না? এটা কী খুব অস্বাভাবিক কিছু?”
” নিজেকে সংযত করুন। যে ব্যক্তি সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও নিজেকে সংযত রাখতে পারে; সেই ব্যক্তিই একজন প্রকৃত এবং আদর্শবান পুরুষ।”
” যে আদর্শতা আমাকে ভালোবাসার মানুষকে স্পর্শ করতে বাধা দেয়, সেই আদর্শতা আমি চাই না। আমি একজন সাধারণ পুরুষ। এটাই আমার পরিচয়। এবং একজন সাধারণ পুরুষ হয়ে বলছি, তোমাকে স্পর্শ করতেই হবে। একটা চুমু দিতেই হবে।”
“শুধুমাত্র একটা চুমু দিবেন?” মুখ টিপে হাসল আসমা।
সহজ হেসে বলল, ” খুব বেশি লোভ হলে দু’টোও দিতে পারি। আবার না-ও দিতে পারি।”
আসমা নিঃশ্বাস আটকিয়ে বলল, ” দিন।”
চোখ বন্ধ করল আসমা। সজল নিজের ঠোঁট জোড়া আস্তে আস্তে আসমার গালের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। আসমার বুক বিদ্যুৎ গতিতে ধুপধাপ করছে। দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে বুকের ভিতর। চিনচিন ব্যথা করছে। শরীর কাঁপছে। কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। আসমার মনে হচ্ছে, চাঁদও ওর মতো কাঁপছে; ঘামছে! চোখ মেলে চাঁদের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। এই বুঝি উষ্ণতা তাকে স্পর্শ করবে! প্রথম কোনো পুরুষ কামুকতা থেকে তাকে স্পর্শ করছে! অনুভূতিটা যেন অন্যরকম!

সজল অনেকটা সময় স্থির দাঁড়িয়ে থেকেও আসমার গালে ঠোঁট ছোঁয়াতে পারল না। শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে দ্রুতবেগে কয়েকপা পিছিয়ে গেল। এটা পাপ করা হচ্ছে। খুব বড় অন্যায় করা হচ্ছে। অন্যদিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, ” আসমা, চলো একটু হাঁটাহাঁটি করি। এই ছাঁদের কার্নিশ ঘেষে। যান্ত্রিক আলো দেখি, প্রাকৃতিক আলো দেখি। শরীর ভেজাই, মন ভেজাই, একে অপরকে ভিজিয়ে দিই।”
আসমা নিঃশ্বাস ছাড়ল বড় করে। চোখ মেলে দেখল, সজল তাঁর বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে; অন্যদিকে তাকিয়ে। ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই নিলো আসমা। কেঁশে বলল, ” আচ্ছা।”
দু’জনে ছাদের কোণা ঘেষে হাঁটতে লাগল। মাঝের দূরত্ব খুব বেশি না হলেও আবার ভুল করার মতো না। নিজেদের কন্ট্রোল করার মতো দূরত্ব বজায় রেখেছে দু’জনে।

রাত আনুমানিক ১০ টা। ছাদের এপার-ওপার হাঁটছে দু’জন মানুষ; নির্ভয়ে। বাড়িটার দু’তলায় থাকে আসমার বড় বোন ফাতেমা; নিজের পরিবার নিয়ে। আজ তাহমিদের বিয়ের দাওয়াতে এসেছে আসমা। সজলও বিয়ের দাওয়াতে এসেছে। সব কিছু যেন স্বপ্নের মতো লাগছিল আসমার কাছে। যেদিন তানিশা আসমাদের বাড়ির কুয়োতলায় বসে সবাইকে তাঁর আর তাহমিদের সম্পর্কের কথা বলেছিল, সেদিনই আসমা, তানিশা আর তাহমিদের গল্প করছিল সজলের কাছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সজল জোর গলায় বলেছিল, খুব শীঘ্রই আসমা তাঁর কাছে আসতে বাধ্য হবে। ঠিক তাই হয়েছে। তাহমিদের বিয়েতে দাওয়াত পেয়ে আসমা নিজের গোটা পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। সাথে আসে রাইশা এবং ওর স্বামী। আসমা তখনও বুঝতে পারেনি, ঢাকায় সজলের সাথে তাঁর দেখা হবে। সজল জানতো। সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিল আসমার জন্য। ফাতেমার সাথে সজলের যোগাযোগ আগে থেকেই ছিল। ফাতেমা যখন ঢাকায় স্বামীর বাসায় থেকে পড়াশোনা করতো, সজল তখন নিজের মামার বাসায় থেকে পড়াশোনা করতো। একই ইউনিভার্সিটিতে না হলে দু’জনের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। মাঝে মাঝেই দেখা হয়ে যেতো, কথা হতো। এই ব্যাপারটা আসমা জানতো না। সময়টা অনেকদিন আগের ছিল। সেসময় আসমার আর সজলের সম্পর্কের শুরু হয়। ফাতেমা এটা জানতো না। তাই সজলের বিষয়ে কোনোরকম আলোচনা সে করেনি আসমার সাথে। ঢাকায় একই এলাকাতে বসবাস না অবশ্য; তবে খুব বেশি দূরে না। রাইশার বিয়ের পর আসমা ঢাকায় ফিরেই আবার যোগাযোগ করে সজলের সাথে। তাহমিদের বিয়েতে ইনভাইট করে সজলকে। আসমা সবাইকে নিয়ে বিয়ের তিনদিন আগে ঢাকায় আসে। সেদিনই দেখা হয়ে যায় দু’জনের। একান্ত কিছুটা সময় কাটানোর সুযোগ হয়। সজলের মামার বাড়িতে যায় আসমা। সবার সাথে আলাপ করে। নুপুরে বাবা, সজল আর আসমাকে আশ্বস্ত করে এই বলে, তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকেই ওদের বিয়েটা দেবেন। সেই থেকেই নিশ্চিন্ত দু’জনে। এরপর আস্তে আস্তে দু’টো দিন কেটে গিয়ে আজ তাহমিদের বিয়ের দিন চলে এলো। সজল পুরোপুরি ভাবে বিয়েতে যোগ দেয়। তাহমিদ আর ফাতেমা, সজলকে অনুরোধ করে, বিয়ের শুরু থেকে শেষ, সারাক্ষণ যেন সাথে থাকে। সজল থেকেছে, থাকছে। অন্তত আসমার জন্য থাকতেই হবে। এর মধ্যে আসমার বাবার সাথে কয়েকবার মুখোমুখি হয়েছে। তিনি কয়েকবার বাঁকা চোখে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেছেন। বিয়ের ঝামেলা আজকের মতো শেষ হতেই কিছুটা সময় কাটানোর জন্য সবার দৃষ্টির অগোচরে ছাদে আসে আসমা আর সজল।

৪০.
অনিক আর তৃষ্ণা ইউনিভার্সিটি থেকে একসাথে বাড়িতে ফিরছে। অনিকের বাড়ি আর তৃষ্ণার বাড়ি খুব কাছাকাছি না হলেও একই এলাকায়। দু’জনে সাভার স্ট্যাণ্ডে নেমে হাঁটতে লাগল। হঠাৎ তাহমিদের সামনে পড়ে গেল। আচমকা তাহমিদকে দেখে হতবাক হয়ে গেল তৃষ্ণা। মুখ দিয়ে কথা বেরুলো না। অনিক ঢোক গিলে ইতস্ততভাবে ভাবে তাহমিদকে সালাম দিলো, ” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”
” ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছো অনিক?”
” ভাইয়া আপনি আমার নাম জানেন?” অনিকের চোখ জোড়া বড় গোলাকৃতি হয়ে গেল।
” জানবো না? যে আমার বাড়িতে গিয়ে, একতলা টপকিয়ে দু’তলায় গিয়ে চিঠি দিয়ে আসে, তাঁর নাম না জানলে যে অন্যায় হবে। তাছাড়া, ইদানীং আমার বোনটার সাথে তোমাকে অনেকটা বেশি সময়ই দেখা যাচ্ছে৷ তোমার ব্যাপারে সবরকম খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে আমার।”
অনিকের মনে হলো, সে তাহমিদকে যতটা সাদামাটা ভেবেছে, লোকটা আসলে ততটা সাদামাটা না। অনেকটাই বুদ্ধিমান মানুষ। এই মানুষটার সাথে ভেবেচিন্তে কথা বলাই শ্রেয়।
অনিক আড়চোখে তৃষ্ণার দিকে তাকালো একবার। দেখল, সে ভয়ে চুপসে আছে। ছটফট করছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে বারবার। দৌড়ানোর রাস্তা খুঁজতে কি-না, কে জানে! অনিক কী বলবে, খুঁজে পেলো না। মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
তাহমিদ, দু’জনের দিকে একবার তাকিয়ে পরিবেশ সহজ করতে হেয়ালি গলায় বলল, ” অবশ্য, আমি চিঠিটা পড়তে পারিনি। পরে পড়ব বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু সকালে শার্টটা ধুয়ে দিয়েছি। চিঠিটা যে আমার শার্টের পকেটে ছিল, গোসল করার সময় সেটা স্মরণে ছিল না। থাকলে অবশ্যই আমি চিঠিটা সরিয়ে রাখতাম। নিজে না পড়লেও অন্যকে দিয়ে পড়াতাম। উল্টো পাল্টা কিছু শুনলে ভাবতাম, লোকজন তো মানুষকে নিয়ে নিন্দাসূচক কথা বলবেই। এইসবে কান দিলে তো চলবে না। নিজে পড়লে তো আর এই ভাবনাটা ভাবতে পারতাম না।”
তৃষ্ণার ফেকাসে মুখটা সাহসা উদ্ভাসিত হয়ে গেল। চমকে যাওয়ার মতো করে চোখদুটো গোল করে জিজ্ঞেস করল, ” তারমানে তুমি চিঠিটা পড়োনি? ওটা ছিঁড়ে গেছে। ওয়াও।”
তৃষ্ণার উত্তেজনা দেখে গম্ভীরমুখে তাকালো তাহমিদ। হাতের তালু কপালে ঠেকিয়ে ছোট ছোট চোখ করে আকাশের দিকে তাকালো। মধ্যদুপুরের উত্তপ্ত সূর্য শরীর যেন ঝলসে দিচ্ছে। সে তানিশাদের বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি যাচ্ছে। বিয়ের আজ তৃতীয়দিন। তানিশা নিজের বাড়িতে আছে এখনো। বিকেলে আবার ওই বাড়িতে যাবে তাহমিদ।

তাহমিদ খানিকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল, ” তৃষ্ণা, এত খুশি হচ্ছিস কেন? চিঠিটা বেশ কয়েকদিন আগে দিয়েছিল। তুই তো আমাকে এই প্রসঙ্গে কিছুই জিজ্ঞেস করিসনি। তাই আমিও আগ-বাড়িয়ে কিছু বলিনি।”
” তুমি কিছু জিজ্ঞেস করোনি বলেই আমিও আর নিজের বিপদ ডেকে আনতে চাইন। আসলে ভাইয়া, ওটা কোনো চিঠিই ছিল না। জাস্ট একটা সাদা কাগজ। যার মধ্যে লেখা ছিল কয়েকটা নাম। আমরা তো ক্যাম্পাসে প্রায়ই অনুষ্ঠান করি। সেখানে আমরা গান গাই, নাচ করি। কে কে এইসব করবে, সেগুলোরই একটা লিস্ট ছিল ওখানে। আমরা যে বাড়িতে ছিলাম না, সেটা ও জানতো না। কারণ আমার নম্বর ওর কাছে ছিল না। ও এটাও জানতো না, আমার ঘর কোনটা। তাই তো দু’তলায় একটা ঘরের বারান্দায় লিস্টটা রেখে চলে গেছে।”
তাহমিদ হেসে বলল, ” তা, তোদের কোন বান্ধবীর নাম ‘প্রিয় রূপবতী’, শুনি একটু? আমি এই লেখাটাই শুধুমাত্র স্পষ্ট দেখেছিলাম।”
তৃষ্ণা কোনো উত্তর দিলো না। চুপসে গেল সে। অনিকেরও একই অবস্থা।

তাহমিদ কিছুক্ষণ পর গলা খাঁকারি দিয়ে অনিককে বলল, ” তোমার বাড়িটা কোন দিকে যেন?”
অনিক ঘুরে একটা মোড়ের রাস্তা দেখিয়ে বলল, ” এই রাস্তায় দিয়ে সামনে গেলেই আমার বাড়ি।”
” ওহ্ আচ্ছা। ঠিক আছে, তুমি আপাতত বাড়িতে যাও। আমি তৃষ্ণার সাথে যাচ্ছি।”
অনিক একবার তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে, আবার তাকালো তাহমিদের দিকে। সালাম দিয়ে উত্তরের অপেক্ষা না করেই দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। তাহমিদ হেসে, তৃষ্ণার কাধের উপর হাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ” ছেলেটা খুব একটা খারাপ না, তাই না? আমি খোঁজখবর নিয়েছি। বেশ ভদ্র ছেলে। পরিবারও খুব ভালো। আমাদের মতোই সাধারণ জীবনযাপন করে। এটাই তো সেই ছেলে, যে ভুল করে আমার ঘরে চিঠি দিয়েছিল।”
তৃষ্ণা উত্তর দিলো না। এড়িয়ে গেল, তাঁর ঘরেও একটা চিঠি দিয়েছিল। তাহমিদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার জিজ্ঞেস করল, ” তুই কি ওকে পছন্দ করিস?”
উত্তর দিলো না তৃষ্ণা। হাসল একটু। তাহমিদ যেন এতেই বুঝে গেল। আবার প্রশ্ন করল, ” খুব বেশি ভালোবাসিস?”
লজ্জা পেলো তৃষ্ণা। হেসে তাহমিদের পেটে খোঁচা মেরে বলল, ” তুমি চুপ করো তো ভাইয়া। ক্ষিধে পেয়েছে, তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলো। আর দুপুরবেলা শ্বশুরবাড়ি থেকে এলে কেন? খেতে দেয়নি বুঝি?

তাহমিদ হাসল। তৃষ্ণার কাধের উপর হাত রেখে দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগল।

পরিশেষঃ
আসমা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল, গেইটের সামনে লোকজনের ভীড়। সজলকে দেখা যাচ্ছে না এই ভীরের মধ্যে। তবুও মন শান্ত রেখেছে সে। তাঁর কল্পনায় সজল উপস্থিত আছে। পরণে পাঞ্জাবি আর পাজামা। ঠোঁটের কোণে হাসি। উদ্ভাসিতমুখে এগিয়ে আসছে ভিতরের দিকে। আসমার পাশে আছে তানিশা আর তৃষ্ণা। ওরাও জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দেখছে বাইরের দৃশ্য।

রাইশা হঠাৎ দৌড়ে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। আসমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ” আপু, ওখান দিয়ে দেখছ কেন? উঠোনে এসো।”
রাইশার কথা শুনে তাজ্জব দৃষ্টিতে তাকালো আসমা। দরাজ কণ্ঠে বলল, ” পাগল হয়েছিস নাকি? মা মাইর দিবে না?”
রাইশা পাল্টা কঠিন মুখ করে জবাবে বলল, ” মা বকবে কেন? তোমার বরকে তুমি যেখান থেকে ইচ্ছে, সেখান থেকে দেখবে। এখানে মা বকবে কেন?”
“তুই চুপ করবি? যা এখান থেকে।” ধমকালো আসমা।
” না এলে মিস করবে কিন্তু। বাইরে এসে দেখো, সজল মাস্টারকে বর বেশে কী দারুণ লাগছে! মনে হচ্ছে ২২ বছরের তরতাজা যুবক। কে বলবে, এই মানুষটার বয়স ৩০ পেরিয়ে গেছে।” রাইশা খিলখিল করে হেসে উঠল কথাটা বলে৷
আসমা ভাবতে লাগল চুপচাপ। সজলকে দেখার খুব লোভ হচ্ছে তাঁর। কিছুক্ষণ পরেই দেখতে পাবে; তবুও ইচ্ছে করছে এখন তাকে দেখতে।
আড়চোখে একবার তানিশা আর তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে রাইশার দিকে এগিয়ে গেল। রাইশাকে বাইরের দিকে ঘুরিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে পিছনে দাঁড়ালো আসমা। যেন রাইশা একটা দেয়াল! আর সে দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে হবু বরকে দেখার চেষ্টা করছে।

নুপুরের বাবা যে এত তাড়াতাড়ি চমকপ্রদ একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবেন, তা কেউ বুঝতে পারেনি আগে। বুদ্ধিটা নুপুর দিয়েছিল তাঁর বাবাকে। সে বুঝে গিয়েছিল, অন্যের ভালোবাসায় হস্তক্ষেপ করে নিজে সুখী হওয়া যায় না। এটাই বাস্তবতা। সেজন্য মনেপ্রাণে চাচ্ছিল, সজলের সাথে যেন আসমার বিয়ে হয়। নুপুরের বাবা অনেকটা সজলের বাবা-মায়ের অভিভাবক হিসেবে ছিলেন। তিনি বেশ সিনিয়র মানুষ। সেজন্য সজলের বাবা-মা তাঁর কথা আদেশের মতোই গ্রহণ করতেন। তিনি সজল আর আসমার বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে প্রথমে দ্বিমত পোষণ করলেও শেষমেশ সবদিক ভেবে রাজি হয়ে যায়। তাছাড়া যেখানে নুপুর, নুপুরের বাবা-মা, এবং সবাই চাচ্ছে সজল আর আসমার বিয়ে হোক, সেখানে শুধুমাত্র তাঁদের দ্বিমত করাটা বেমানান হয়ে যায়। তাঁরা অচিরেই আসমার বাবা-মায়ের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যায়। আসমার মা রাজি হলেও আসমার বাবা বেঁকে বসেন। ওইরকম পরিবারে তিনি মেয়েকে বিয়ে দেবেন না। বড়লোক হোক, বড় মনের মানুষ তো না৷ সবার মুখটা তখন মলিন হয়ে যায়। আসমার বাবাকে বাধ্য করার মতো কেউ নেই এই পৃথিবীতে। আসমা অন্যসব ব্যাপারে বাবার প্রতি জোর খাটাতে পারলেও নিজের বিয়ের ব্যাপারে কোনো শব্দ করতে পারছিল না। প্রথমত, আসমার বাবা খুব কষ্ট পাবেন। দ্বিতীয়ত, আসমার কাছে রুচিসম্মত লাগছিল না ব্যাপারটা। তাই চুপ করে যায়। এখানেও নুপুরের বাবা চলে আসেন। তাকে দেখে আসমার বাবা শান্ত হয়। ভাবে, মানুষটা ভদ্রলোক। সৎ মানুষ। শান্ত হয়ে তাকে বিশ্বাস করা যায়।
নুপুরের বাবার অনুরোধে, আসমার বাবা রাজি হয়। নুপুরের বাবা তাকে আশ্বস্ত করে বলেন, আসমা আর সজলের সাথে সুখে থাকবে। সব মানুষের মধ্যেই দোষত্রুটি থাকে। এটা ভেবে ছেলে-মেয়েদের আলাদা করে দেওয়া ঠিক না।

এরপরই সবাই গ্রামে আসে। গ্রামেই পারিবারিক ভাবে বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়।

সজল আর আসমার বিয়ে সম্পন্ন হয় সন্ধ্যায়। তাঁদের ভালোবাসা পূর্ণতা পায়, এই ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে দু’জনে।
সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে