সম্পৃক্ততা পর্ব ৮

0
606

৮ম পর্ব

রিফাত হোসেন।

২০.
গনগনে রোদ কুয়োতলায়। পেয়ারা গাছের ফাঁকা দিয়ে শরীরে এসে আঘাত করছে তীব্র রোদের উত্তাপ। তৃষ্ণা এবং আসমা, দু’জনেই সবেমাত্র স্নান সেড়ে এখানে এসে বসেছে মাথার চুল শুকোতে। দু’জনের হাতে দু’টো আধভেজা গামছা৷ চুল মুছছে, আর শীতল শরীরে উষ্ণতার স্পর্শ উপভোগ করছে। তৃষ্ণা একবার কুয়োর দেয়ালের উপরে গিয়ে বসল। ভয় পেয়ে আবার নিচে নেমে এলো৷ আসমা আড়চোখে ওকে দেখছে, আর মিটমিট করে হাসছে।
হুমাইরা তাগাদা দিচ্ছে; দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় হয়েছে। আসমা, তৃষ্ণাকে কয়েকবার বলেছে এ-কথা। কিন্তু তৃষ্ণা পাত্তা দেয়নি। নিজের ছটফটানি পরিহার না করে, উল্টো আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

– ‘ তৃষ্ণা, খাবে না নাকি?’ আসমা নিচু স্বরে আবার জিজ্ঞেস করল।
তৃষ্ণা কোনো উত্তর দিলো না। আসমা প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে আবার বলল,
– ‘আচ্ছা, তোমার কোন নামটা বেশি পছন্দের; তৃষ্ণা, না তুলি?’
তৃষ্ণা সোজাসাপটা বলল – ‘দু’টোই আমার পছন্দের।’
– ‘আমি কোন নামে তোমাকে ডাকলে, তুমি বেশি খুশি হবো।’
– ‘নাম ধরে না ডাকলেই আমি বেশি খুশি হবো।’
– সেকি! কেন?’ হকচকিয়ে উঠল আসমা।
– ‘নাম শুনতে আর ভালোলাগে না।’
আসমা আরও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, – ‘ তাহলে কী বলে ডাকবো?’

কথাটা বলে কপাল ভাজ করে তাকিয়ে রইল তৃষ্ণার দিকে।
তৃষ্ণা প্রথমে ভ্রুক্ষেপ দেখাল না৷ কিন্তু কী যেন ভেবে পরক্ষণেই আবার উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, – ‘ তুমি আমাকে আপু বলে ডাকবে। তৃষ্ণা আপু, বা তুলি আপু, এইরকম না। জাস্ট বলবে, আপু, শোনো। ঠিক আছে?’
ভীমড়ি খেলো আসমা। নিজের মনেমনে বিড়বিড়িয়ে বলল, বলে কি মেয়েটা! আমি ওর কতবড়। অথচ আমাকে বলছে, ওকে যেন আপু বলে ডাকি! এ তো দেখি ভাইয়ের মতো পাগল।
আসমা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, – ‘ তুমি যে আমার ছোট, সে কথা কী ভুলে গেছো?’
– ভুলব কেন? ভুলিনি আমি। তাছাড়া বড়রা কী ছোটদের আপু ডাকতে পারে না? তোমাদের এইসব নিয়ম আমার একদম সহ্য হয় না। বাড়ির সবাই বড় বলে আমাকে সারাক্ষণ তুলি অথবা তৃষ্ণা বলে ডাকে। অথচ আমাকে কখনো ভাবীকে ভাবী বলতে হয়, কখনো আবার ভাইয়াদের ভাইয়া। আমিও তো ওদের বোন। আমাকে কী আপু ডাকা যায় না? আমি আগে দু’টো বাচ্চাটাকে পড়াতাম। ওরা আমাকে সবসময় তুলিপু বলতো। আমার রাগ হতো খুব। আরে ভাই, আমি তোদের টিচার। আমাকে ম্যাডাম ডাকলে কী তোদের জাত চলে যাবে?’ তৃষ্ণা একনাগাড়ে কথাগুলো বলে একটু নিঃশ্বাস নিলো।
আসমা শুধু মুখ চেপে হাসল একটু। কিছু বলল না এখন। তৃষ্ণা আবার বলতে লাগল,
– ‘তুমিই বলো, তোমার ছাত্রটা যখন তোমাকে ম্যাডাম বলে ডাকে, তখন কী তোমার ভালোলাগে না?’
আসমা মাথা ঝাঁকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। তৃষ্ণা আবার বলতে শুরু করর, – ‘ম্যাডাম শব্দটা খুব সম্মানের। কেউ যখন আমাকে ম্যাডাম ডাকে, তখন আনন্দে আমার চোখ ভিজে যায়। কিন্তু আফসোস, এখন পর্যন্ত সেই সৌভাগ্য আমার হয়নি। ওদের আপু ডাকে আমি ক্লান্ত। তাই চেঞ্জ করার প্রয়োজন ছিল। তোমাদের মুখে তৃষ্ণা নাম শুনে আমি ক্লান্ত, তাই এখন আমায় আপু ডাকবে।’
– ‘তুমি তো ওদের বললেই পারো, যে তোমরা আমাকে তুলিপু না ডেকে ম্যাডাম বলে ডাকবে।’ আসমা উচ্চস্বরে কথাটা বলল।
তৃষ্ণা নিরাশ গলায় বলল,
– ‘আরে ধুর! ওভাবে বলা যায় নাকি? ওরা যদি ওদের বাবা-মাকে বলে দেয়; তাহলে ব্যাপারটা আমার জন্য কত লজ্জার হবে একবার ভাবো! দেখো, আমি চাই, আমাকে ওরা ম্যাডাম বলে সম্মান করুক। তাই বলে কী আমি বেহায়ার মতো বলব, ‘ওই, তোরা আমায় ম্যাডাম বলে ডাক!’
আসমা হেসে বলল,
– ‘ওরা তো বাচ্চা মানুষ। অতকিছু বুঝবে কীভাবে? তাছাড়া তুমিও খুব বেশি বড় নও। আর সেভাবে প্রফেশনাল শিক্ষিকাও নও। সেজন্যই বোধহয় ওদের মা বলে দিয়েছে, তোমাকে যেন আপু বলে ডাকে। তাছাড়া অনেকেই আছে, যারা ম্যাডাম শুনতে পছন্দ করে না।’
– ‘অনেকের সাথে তো আর আমার তুলনা হয় না। তাছাড়া আমি ম্যাডাম শুনতেই পছন্দ করি। এই শব্দে খুব সম্মান আছে। যা ওই আপা-টাপা তে নেই।’
– ‘ তুমি কি ওদের এখনো পড়াও?’
– ‘ না। অনেকদিন আগেই বাদ দিয়ে দিয়েছি। যে কাজে তৃপ্তি নেই, তৃষ্ণা সেখানে কাজ করে না। তাছাড়া আমার তো টিউশনি করার প্রয়োজন নেই। ওদের মা কোত্থেকে যেন খবর পেয়েছিল, আমি খুব ভালো স্টুডেন্ট। তাই তাঁর মনে হয়েছে, উনার বাচ্চাদের আমি ভালোবাসে পড়াতে পারব। সেজন্য বাচ্চাদের নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে এসেছিল। শিক্ষিকা হওয়ার প্রতি আমার একটা ঝোঁক আছে। তাই আমি সহজেই রাজি হয়ে গেছিলাম। আগে তো আর জানতাম না ওরা আমাকে ম্যাডাম বলে ডাকবে না। জানলে আগেই না করে দিতাম।’
– ‘ তোমার কী মনে হয়, ওরা ম্যাডাম ডাকলেই তুমি শিক্ষিকা হয়ে যেতে; আর আপু বলে ডাকলে তুমি শিক্ষিকা হতে পারতে না?’
– ‘অবশ্যই। কেউ যদি আমাকে ম্যাডাম না-ই ডাকে, তাহলে আমি শিক্ষিকা হলাম কীভাবে? একজন ইঞ্জিনিয়ারকে যখন মানুষ ইঞ্জিনিয়ার বলে ডাকে, তখনই সে নিজেকে একজন ইঞ্জিনিয়ার ভাবে। তাঁর আগে নিজেকে সেরকম কিছু ভানতে সংকোচবোধ করে। ডাক্তারকে মানুষ ডাক্তার বলে। সাংবাদিককে মানুষ সাংবাদিক বলে। লেখককে মানুষ লেখক বলে। কবিকে বলে কবি। সবাইকেই যদি ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, লেখক, কবি বলে ডাকা যায়, তাহলে একজন আমাকে কেন ম্যাডাম বলে ডাকা যাবে না? ছোট হোক কিংবা বড়, টিচার ইস টিচার৷ আমি তো অনেক জায়গায় দেখেছি স্কুলের শিক্ষিকাকেও দিদিমনি, আপামনি বলে ডাকে অনেকে। অথচ সেই দিদিমনি আর আপামনি স্টুডেন্টদের জন্য দোয়া করে বলে, ‘অনেক বড় হও মা/বাবা।’ একবার জাস্ট কল্পনা করো, যে মানুষটা একজন স্টুডেন্টকে সন্তানের মতো স্নেহ করে দোয়া করছে, সেই বাচ্চারাই আবার তাকে দিদিমনি, আপামনি বলে ডাকছে। এটা কিছু হলো? এরা তো সম্পর্কের ১২টা বাজিয়ে দিচ্ছে।’

আসমা খিলখিল করে হেসে উঠল এবার। তাঁর হাসির শব্দে হুমাইরা আর রাইশা ঘর থেকে উঠোনে এসে দাঁড়ালো। তাহমিদও বাঁকা চোখ করে জানালা দিয়ে তাকালো কুয়ো তলায়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হুমাইরা আর রাইশা আবার চলে গেল ঘরের ভিতরে। তাহমিদও অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলো।
আসমা হাসি থামিয়ে দিলো। সজল চলে যাওয়ার পর এই প্রথম সে মনখুলে হাসল। ঘটনাটা ঘটিয়ে সে সে নিজেও অবাক হলো খুব! সজলের সাথে ইদানীং তাঁর খুব ঘনঘন কথা হচ্ছে। ভিডিও কলে একে অপরকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে৷ তবুও যেন মনের তৃপ্তি মেটে না কারোরই। সেজন্য আসমা সারাক্ষণ মনখারাপ করে বসে থাকতো। আরও একটা কারণ আছে। সজল তাঁর কাছে কী যেন লুকোচ্ছে! ঘনঘন ফোন দিলেও খুব একটা কথা বলতে পারে না সজল। তাড়াহুড়ো দেখায় শুধু। আসমার সবসময় মনে হয়, সজল কী নিয়ে যেন দুশ্চিন্তা করছে খুব। সেরকম একটা কালো ছাপ সবসময় যেন সজলের মুখে ফুটে উঠে। মাঝে মাঝে লক্ষ্য করে, সজলের মুখ ফেঁকাশে হয়ে আছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যায়। এই নিয়ে গত কয়েকদিনে আসমার অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু আজ হঠাৎ করেই তৃষ্ণার কথা শুনে মনখুলে হাসতে বাধ্য হয়েছে। মনে হলো যেন, তৃষ্ণা তাকে আনন্দ দেওয়ার জন্যই এসেছে এখানে।
আসমা দীর্ঘক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল,
– ‘আচ্ছা, এইরকম কঠিন যুক্তিগুলো তুমি কীভাবে আবিষ্কার করলে?’
– ‘ আবিষ্কার করিনি তো; কপি করেছি। তাহমিদ ভাইয়ার থেকে।’
– ‘তাই নাকি।’ আসমা চমকালো কিছুটা।
তৃষ্ণা হেসে বলল,
– ‘ হ্যাঁ। তাহমিদ ভাইয়া সেই একটা জিনিস। ওর মতো মানুষই হয় না। আমি তো সবসময় চাই ওর মতো হতে। কোনো ঝামেলা নেই, কোনো পিছুটান নেই। জীবনটা নিজের মতো করে কাটাচ্ছে। আহ্ কী সুখ!’
তৃষ্ণার কথা শুনে তৃতীয় বারের মতো ভীমড়ি খাওয়ার উপক্রম হলো আসমার। কিছুটা রাগী কণ্ঠে বলল,
– ‘ কোনো মেয়ে মানুষ যে ওইরকম এলোমেলো জীবন প্রত্যাশা করতে পারে, তা আমার ভাবনার বাইরে ছিল।’
– ‘ হোক এলোমেলো। তাতে কী? ভাইয়া বলে, এলোমেলো জীবনের থেকে সুখের জীবন আর হয় না। যে ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন ভাবতে পারবে, সে দেশকে স্বাধীন ভাবতে পারবে। নিজে যদি পরাধীন হয়ে থাকে সারাজীবন, তাহলে দেশের স্বাধীনতা তাকে তৃপ্তি দিবে না।’
– ‘তা অবশ্য ঠিক। দেশ যতই স্বাধীন হোক, নিজে স্বাধীন না হলে শান্তি পাওয়া যায় না। মনের কথা শুনে কিছু করা যায় না, বলা যায় না। দেশের প্রতিটি মানুষ স্বাধীন হলে দেশ এমনিতেই স্বাধীন হবে।’
– ‘ তাহলে বলো, যে মানুষটা এতকিছু জানে, সে অবশ্যই অনেক জ্ঞানী একজন মানুষ। আমি কী তাহলে ওর মতো হতে চেয়ে অন্যায় করেছি?’
– ‘না করোনি।’ একটু চুপ থেকে আসমা আবার বলল, – ‘ আচ্ছা, আমি যদি উনাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি, তাহলে উনি কী সেটার উত্তর দিতে পারবেন?’
– ‘নিশ্চয়ই পারবে। শুধু একটু সময় দিতে হবে। যেমন, এখন যদি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করো, সে উল্টো পাল্টা বলবে। কাল আবার নিজেই তোমাকে উত্তর দেবে।’ তৃষ্ণা দৃঢ় কণ্ঠে আশ্বস্ত করল আসমাকে।
আসমা একটু ভেবে আবার বলল,
– ‘এইরকমটা কেন?’
– ‘জানি না। ভাইয়া বলে, রাতে সে একান্তে এই নিয়ে ভাববে। তাঁরপর সকালে উত্তর দিবে। আমি তো খুব কৌতূহলী মেয়ে; তাই বারবার যেকোনো বিষয়ের প্রশ্ন ভাইয়াকে করি। ওর থেকে পরামর্শ নেই। সবসময় একরাত সময় নেয়। এরপর আমাকে উত্তর দেয়।’
আসমা ফিক করে হেসে বলল,
– ‘ উনি কী রাতে গুগুল থেকে সেই প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করে?’
– ‘না। ভাইয়ার তো ছোট মোবাইল।’ তৃষ্ণা গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো।
আসমা আবার ফিক করে হেসে বলল,
– ‘তাহলে নিশ্চয়ই কোনো বই ঘেটেঘুটে প্রশ্নের উত্তর বের করে।’
– ‘ এটাও করে না। ইনফ্যাক্ট ভাইয়ার ঘরে কোনো বই নেই। বই তো বড় ভাইয়ার ঘরে আছে। তবে একটা ব্যাপার আছে। ভাবীর কাছে শুনেছি, ভাইয়ার একটা সমস্যা আছে। ‘009’ নিয়ে কী যেন বলছিল। আমার মনে নেই।’

আসমা কোনো উত্তর দিলো না। সে অলরেডি ফাতেমার থেকে তাহমিদের সম্পর্কে অনেককিছু জেনেছে। সকালে বৃষ্টি নামার আগেই ঘরে ফিরে এসেছিল সে। তারপরই গিয়েছিল বড় আপার কাছে। ‘009’ নিয়ে আসমার মনে নানান চিন্তা বিরাজ করছে। এই সংখ্যাটা কোথায় যেন দেখেছে!

২১.
জানালা খুলে দিতেই দমকা হাওয়া প্রবেশ করল ঘরের ভিতরে। শরীরে শীতলতা ছুঁইয়ে দিয়ে গেল। সকাল ৮টা। বসন্তে প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়াবাড়ি রকমের বৃদ্ধি পেয়েছে। আশপাশ থেকে বাতাসের সাথে ভেসে আসছে তীব্র সুবাস। সূর্য উদয় হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। কিন্তু কার উপর দয়া করে যেন সেভাবে উত্তপ্ততা ছড়াচ্ছে না। নাহলে ভ্যাপসা গরম লাগল শরীরে। বাতাস গায়ে লাগতো না। আকাশপটা মেঘলা না হলেও খুব সুন্দর দেখাচ্ছে এ সময়।

জানালার কাছ থেকে সরে এলো তানিশা। গোল টুলটা আয়নার সামনে রাখল। চুলগুলো ভেজা। কিছুক্ষণ আগে গোসল করেছে। আজ অফ ডে। নাহলে তাকে আরও আগে ঘুম থেকে উঠতে হতো। অফ ডে তে তাকে অলসতায় আঁকড়ে ধরে। সেজন্য ফজরের নামাজও পড়তে পারে না। প্রতি শুক্রবারে তাঁর ঘুম ভাঙে ৮ টার একটু আগে। যেন কেউ একজন নিয়ম করে দিয়েছে! এরপর ওয়াশরুমে যায়। সকালেই গোসল করে সে। তারপর ঘরের জানালা খুলে আয়নার সামনে বসে। প্রতি শুক্রবারে সকালের রুটিন এটা। অন্যদিনে এত সময় থাকে না তাঁর হাতে। সারাক্ষণ দৌড়ের উপর থাকতে হয়।
তানিশা তোয়ালে দিয়ে চুল মুছল। কিছুটা শুকনো হওয়ার পর হাতে তুলে নিলো চিরুনি। বরিশাল থেকে ফাতেমা ফোন দিচ্ছে বারবার। ফাতেমার বোনের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছে। তানিশা বারবার বলেছে, ‘ভাবী, এখানে কাজের খুব চাপ। আমি যদি যেতে পারতাম, তাহলে তোমাদের সাথেই যেতাম।’ বেশ কিছুদিন ধরে তাহমিদের সাথে তানিশার দেখা হয় না। শুধু ফোনে কথা হয়। কাল রাতেও কথা হচ্ছিল তাহমিদের সাথে। তানিশা জিজ্ঞেস করছিল,
– ‘ তাহমিদ, এখনও কী রাতে ওইরকম কোনো নম্বর থেকে ফোন আসে?’
– ‘ হ্যাঁ। গতকাল রাতেও ফোন এসেছিল।’
– ‘কী বলছিল?’গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল তানিশা।
তাহমিদ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
– ‘ অনেক কিছুই তো বলছিল।’
– ‘ শুধু কি ও বলছিল? না তুইও কিছু বলেছিস।’
– ‘ আমার কিছু বলার সুযোগ নেই তো। প্রথম কয়েকদিন বলার চেষ্টা করেছি। তখনই ফোনটা কেটে যেতো।’ কথাটা বলার সময় তাহমিদ কিছুটা দুঃখী দুঃখী ভাব করল।
তানিশা আবার জিজ্ঞেস করল,
– ‘তাহলে তুই ওকে কোনো প্রশ্ন করতে পারিস না, তাই তো?’
– ‘না। ও আমাকে সেই সুযোগ দেয় না।’
– ‘তাহলে তুই যে বলিস, ও তোর সমস্যার সমাধান করে দেয়। তুই যদি ওকে তোর সমস্যার কথা না-ই বলিস, তাহলে ও সেসব সমস্যার কথা কীভাবে জানলো? আর সমাধানই বা কীভাবে দিলো?’
– ‘জানি না। বোধহয় ও আগে থেকেই আমার মনের সব প্রশ্ন বুঝে ফেলে। ফোন দিয়ে নিজেই কথা বলতে থাকে। আর কীভাবে যেন আমি নিজের সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাই। এখন আর ভয়ে প্রশ্ন করি না। কারণ প্রশ্ন করলেই ও চলে যায় খুব তাড়াতাড়ি।’
তানিশা অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
– ‘ এই কথাটা তো আমায় আগে বলিসনি।’
– ‘ সব কী আর তোকে বলতে হবে? কে তুই?’ কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করল তাহমিদ। তানিশা মেয়েটা ইদানীং তাকে একটু বেশিই জ্বালাচ্ছে।
তানিশা কাতর কণ্ঠে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। তাঁর গলা গিয়ে কথা বের হচ্ছে না। তাহমিদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
– ‘ তানিশা, তোকে একটা কথা বলব।’
– ‘কী কথা?’ খানিকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে ছাড়া ছাড়া গলায় জিজ্ঞেস করল তানিশা।
তাহমিদ দৃঢ় গলায় বলল,
– ‘ আমার মনে হয়, মেয়েটা আমাকে ভালোবাসে।’
প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও পরক্ষণেই মৃদু হেসে দিলো তানিশা। নিম্নস্বরে বলল,
– ‘ওহ্।’
– ‘ আমিও বোধহয় ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।’ কথাটা বলার পর তাহমিদের কণ্ঠে ভয়ার্ত ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠল।
তানিশা আবারও স্বাভাবিক ভাবে বলল,
– ‘ ওহ্।’
– ‘ ওহ্ মানে? তোর খারাপ লাগছে না? আমি তো জানতাম মেয়ে মানুষ খুব হিংসুটে হয়। বিশেষ করে প্রেম-ভালোবাসার দিক দিয়ে৷ তুই বলিস, তুই আমাকে ভালোবাসি, অথচ আমি বলছি, আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি৷ এর জন্য কী তোর মধ্যে কোনোরকম ইর্ষা কাজ করছে না?’
– ‘ ওমা, কার সাথে হিংসে করব আমি? একটা অবান্তরের সাথে! যার কোনো অস্তিত্ব নেই। বরং আমার এটা ভেবে ভালোলাগছে যে, ওই ভ্রান্তিটা তোর মধ্যে ভালোবাসার সৃষ্টি করছে।’
তাহমিদ চমকানো কণ্ঠে জানতে চাইল,
– ‘কীভাবে?’
– ‘ তুই কী নিজের মধ্যে এখন ভিন্ন কিছু উপলব্ধি করিস? এই যেমন, কোনো মন মুগ্ধকর দৃশ্য’র প্রতি আকৃষ্ট হওয়া৷ বা আগে যে জিনিসটা অতি সাধারণ মনে হতো তোর কাছে, এখন তা অসাধারণ মনে হচ্ছে।’ কথাগুলো বলে তানিশা মৃদু হাসল আবারও।
তাহমিদ অবাক কণ্ঠে বলল,
– ‘ হ্যাঁ। ঠিক বলেছি তুই। এখানে আসার পর থেকে আমি নিজেকেই যেন অন্যভাবে ভাবতে শুরু করেছি। এই যেমন একটা মেয়ের হাসি। আগে এটাকে খুবই সাধারণ মনে হতো। কিন্তু সেদিন হঠাৎ করেই ভাবীর মেজো বোনের হাসিমাখা মুখটা আমার নজরে এলো। আমি মুগ্ধ চোখে দেখলাম ওর হাসি। শব্দ করে হাসছিল ও। তুইও তো এভাবেই হাসিস, তাই না? আমার মনে হঠাৎ তোর প্রতি মায়া জন্মালো। ভাবলাম, আমার উচিত ছিল তোর হাসিমাখা মুখটার দিকে একটিবারের জন্য অন্তত তাকানো। তোর হাসির শব্দ সেসময় আমার কানে ভাসছিল। আমার মধ্যে হঠাৎ আবেগ, অনুভূতি কাজ করতে লাগল।’
– ‘ওয়াও। তোর মস্তিষ্কের তৈরি ওই ভ্রান্তি মেয়েটাকে সামনে পেলে একটু চুমু দিয়ে দিতাম! ও তোর মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করছে, আবেগ, অনুভূতি সৃষ্টি করছে৷ একদিন চট করে সবার সামনে তোকে প্রপোজ করে বসব। তুই ‘না’ শব্দটা উচ্চারণই করতে পারবি না৷ তারপর তোর মাথা থেকেই ওই মেয়েকে কীভাবে তাড়াতে হয়, তা আমি জানি। আহ্! তোকে বরিশাল পাঠানো সার্থক হচ্ছে বোধহয়।’ তানিশার কণ্ঠে উত্তেজনা প্রকাশ পেলো।
তাহমিদ আর কিছু বলেনি। ফোন কেটে দিয়েছিল।

দরজার ঠকঠক আওয়াজ হচ্ছে। তানিশার ভাবনায় ছেদ পড়ল। আয়নার সামনে থেকে থেকে সরে দরজা খুলে দিলো। দরজার বাইরে মা’কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একগাল হাসল। দরজার সামনে থেকে সরে এসে বলল,
– ‘ এসো মা, ভিতরে এসো।’

আফসানা বেগম ভিতরে গেলেন। চুপচাপ বিছানায় বসলেন। তানিশা আবার টুলে বসল। এখন বাজে ৮ টা ৩০ মিনিট। তানিশা ঘুরে মায়ের দিকে তাকালো। আবারও একগাল হেসে বলল,
– ‘কী ব্যাপার মা, তুমি এখানে এলে। রান্নাবান্না শেষ বুঝি?’
আফসানা বেগম জবাব দিলেন,
– ‘ হ্যাঁ শেষ। তোকে ডাকতেই এলাম।’
– ‘ ঠিক আছে, চলো তাহলে। খাওয়াদাওয়া করে আবার আমাকে বের হতে হবে।’
– ‘কোথায় যাবি? ওই চায়ের দোকানে? কী লাভ ওখানে গিয়ে? আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছে, বন্ধুদের বাড়িতে নিয়ে আয়।’
– ‘ ওখানে যে মজাটা হয়, এখানে তা হয় না। মা, তুমি একজন ইয়াং লেডি হয়ে এইরকম কথা বলতে পারো না। বন্ধুবান্ধবদের সাথে সবজায়গায় ইনজয় করা যায় না। তাছাড়া মাত্র একটা দিনই তো যাই। ওই দোকানদার কাকার বয়স কতো জানো তুমি? ৭০ এর উপরে। যুদ্ধের সময় ছিলেন একজন টগবগে যুবক। যুদ্ধ করেছেন তিনি। কিন্তু কপাল খারাপ ছিল বলে দেশের কাছে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর সৃকৃতি মেলেনি। উনার সাথে গল্প করলে জ্ঞান সমৃদ্ধ হয়। উনার দেওয়া কত ইনফরমেশন যে আমার কাজে লেগেছে, তা শুধু আমিই জানি। সাধেই কী আমরা শুধুমাত্র ওখানেই যাই? এখনো শক্তপোক্ত মানুষ উনি। শুধু চামড়াটা একটু ঝুলে গেছে।’
আফসানা বেগম হাসলেন শুধু। বললেন,
– ‘ এই একই বকবক আর কত পারবি মা? কিছু বললেই তুই এই বকবক শুরু করে দিস। ওই দোকানদারের কথা শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি।’ এ-কথা বলে আবারও হাসলেন আফসানা বেগম।
তানিশা আর কিছু বলল না।
আফসানা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললেন,
– ‘ বলছিলাম কি, আজ একজন ঘটক এসেছিল। তোর বাবার পরিচিত সে। তোকে নাকি একটা ছেলে দেখেছে বাইরে কোথাও। দেখে পছন্দ করে ফেলেছে। পেশায় ডাক্তার। তোর বাবা বলছিল, একবার সামনাসামনি দেখা করতে। তুই যদি বলিস, তাহলে আমি ঘটককে বলে ওদের বাড়িতে আসতে বলব।’
তানিশা কিছুক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর বলল,
– ‘ মা, আমি তাহমিদকে পছন্দ করি।’
– কোন তাহমিদ? তোর বন্ধু তাহমিদ নাকি?’ চমকে ওঠে জানতে চাইলেন আফসানা বেগম।
তানিশা মাথা ঝাঁকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। আফসানা বেগম আবার বললেন,
– ‘ আগে তো কখনো এইরকম কিছু বলিসনি।’
– ‘ বিয়ের প্রসঙ্গ আসেনি বলেই আমি বলিনি।’ তানিশার সোজাসাপটা জবাব।
– ‘ তাহলে কী আমি ঘটককে চলে যেতে বলব?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘ তোর বাবা যদি কিছু বলে, তাহলে কী করব?’
– ‘ তাহমিদ তো আর খারাপ ছেলে নয়। তাছাড়া এমনও নয় বাবা তাহমিদকে অপছন্দ করে।’
– ‘ মানুষ হিসেবে পছন্দ করা আর মেয়ের জামাই হিসেবে পছন্দ করা তো আর এক নয়।’
– ‘ তোমার কী মনে হয়, তাহমিদ আমার স্বামী হিসেবে অযোগ্য?’
– ‘ না, আমি সেটা বলছি না। ছেলেটা খুব ভালো। অনেকদিন থেকেই তো চিনি ওকে। শুধু একটু অন্যরকম।’
– ‘প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিত্ব আলাদা হয় মা। তাহমিদ একটু নীরব প্রকৃতির মানুষ। অযৌক্তিক কথা বলে না। একটু অগোছালো। ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো ভাবনাচিন্তা নেই। এটাই তো সমস্যা, তাই না?’
আফসানা মাথা নাড়ালো।
তানিশা আবার বলল,
– ‘ এগুলো বিয়ের আগের জীবন। বিয়ের পর মানুষ চেঞ্জ হয় মা। সংসারের প্রতি..।’ মায়ের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল তানিশা।
আফসানা বেগম হেসে বললেম,
– ‘ মা গো, আমি জানি আপনি এখন কী বলবেন। বয়সটা আমরা পাড় করে এসেছি তো। আপনার জ্ঞান এখন আমার হজম হবে না।

মায়ের মুখে ‘আপনি’ শব্দটা শুনে ফিক করে হেসে দিলো তানিশা। আফসানা নিজেও হাসলেন। আবার বললেন,
– ‘ এখন খাবার টেবিলে গিয়ে আমাকে উদ্ধার করুন দয়া করে। ঘটককে আমি ‘না’ বলে দিবো।’

তানিশা মাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে আত্মাহারা হয়ে বলল,
– ‘ থ্যাঙ্কিউ সো মাচ মা। তুমি খুব ভালো মা।’
– ‘ হু, আবদার মেনে নিলে তো মা ভালোই। যদি বলতাম, না, এটা হবে না, তখনই বলতি, তোমার মতো খারাপ মা এই পৃথিবীতে নেই।’

তানিশা শব্দ করে হাসল মায়ের কথা শুনে৷ পরক্ষণেই হাসি থামিয়ে সতর্ক গলায় বলল,
– ‘ খবরদার, বাবাকে এইসব বলো না।’
– ‘ ওমা, তাকে না জানালে হবে কীভাবে? আমি একাই কি তোর অভিভাবক?’ আফসানা বেগম তাজ্জব গলায় বললেন কথাটা।
তানিশা লজ্জায় লাল হয়ে বলল,
– ‘ ইশ, বাবার সামনে আমি যাবো কীভাবে? খুব লজ্জা লাগবে আমার! বাবা যে মানুষ, আমাকে আরও লজ্জা দিবে।’
আফসানা বেগম হেসে উঠলেন উচ্চস্বরে।

খাওয়াদাওয়া করে বিশ্রাম নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো তানিশা। বাড়ির সামনে থেকে রিকশায় উঠতে যাবে, তখনই একজনকে দেখে তাঁর চোখ কপালে উঠে গেল!

৮ম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক- https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=555886145356090&id=100028041274793

ছবি: Umme Rokshana Akther

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে