সম্পৃক্ততা – চতুর্থ পর্ব।
রিফাত হোসেন।
৯.
অফিসে তাহমিদের খুব একটা কাজ নেই; সে শুধু পত্রিকার রিপোর্ট লিখে। তবুও যখন এই রিপোর্টের কাজটা করে, তখন খুব মনোযোগ দিয়ে করে। ১ মাস আগে নির্বাচিত হওয়া এমপি সাহেবের মেয়ের বিয়ে আজ। মহাকালের রিপোর্টার তাহমিদ-এর সহযোগী কিছুক্ষণ আগেই এমপি সাহেবের বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছে। কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছে এমপির সাথে কথা বলে। তাঁর বর্ণনানুযায়ী সেখানকার উজ্জ্বল দৃশ্য এবং ঝমকালো আয়োজনের উপর একটা রিপোর্ট লিখতে হবে তাহমিদকে। সে লিখছে মনোযোগ দিয়ে।
এমনসময় হঠাৎ ডেস্কের পাশে এসে দাঁড়ালো এক ভদ্রলোক। তাহমিদ বাঁকা চোখে দেখল তাকে। সাজ-বেশ ভদ্রলোকের মতো বটে; কিন্তু আসলে সে একটা পাক্কা হারামজাদা। অবশ্য প্রতিটি অফিসেই এইরকম দুই একটা থাকেন। এটা খারাপের কিছু না। লোকটার চেহারা ছিপছিপে বর্ণের। গালভরতি আধপাকা দাড়ি। ঠোঁটটা কালচে। দেখেই মনে হচ্ছে, দিনরাত এক করে শুধু সিগারেটের ধোঁয়া টানে। অবশ্য অন্য কারণেও ঠোঁট কালো হতে পারে।
– তাহমিদ সাহেব, কী করছেন আপনি?
লোকটার কথায় তাহমিদ এর ভাবান্তরে ছেদ পড়ল। এইমাত্র তাকে দেখল, এইরকম একটা ভাব ধরে তাহমিদ ওঠে দাঁড়াল। সালাম দিলো তাকে।
– আসসালামু আলাইকুম স্যার।
লোকটা তাহমিদের সিনিয়র রিপোর্টার। তাই সৌজন্যের খাতিরে একটু ভদ্রতা দেখালো।
লোকটা নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে উত্তর দিলো।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। কী অবস্থা ?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো স্যার।
– আমি আপনার অবস্থা জানতে চাইনি, আমি রিপোর্টের অবস্থা জানতে চেয়েছি।
তাহমিদ নাক ফুলিয়ে তাকালো। মেনশন করে জিজ্ঞেস করলেই হতো। তাহমিদের প্রতি যে লোকটার সাংঘাতিক রাগ, তা সে ভালো করেই জানে। প্রায় কয়েক বছর হতে চলল দু’জনে এখানে আছে। অনেক সময় অনেক কারণেই লোকটা রেগেছে ওর উপর।
লোকটা আবার বলল,
– ম্যাডাম আপনাকে ডাকছে। রিপোর্টটা দেখতে চেয়েছে।
তাহমিদ লেখায় মনোযোগ দিয়ে বলল,
– কোন ম্যাডাম?
– বড় ম্যাডাম।
– নাম বলুন?
– আমি তো আর আপনার মতো বেয়াদব না; যে অফিসের বসদের নাম ধরে ডাকবো। সম্পাদক ম্যাডাম আপনাকে ডাকছে। এবার হয়েছে?
লোকটার ধমক শুনে হকচকিয়ে উঠল তাহমিদ। কেঁশে চারদিকে চোখ বুলালো একবার। এই বদমেজাজি লোকের উশৃংখল কণ্ঠ শুধু তাহমিদকে না, অন্যদেরও বিরক্ত করেছে। তাহমিদ আর কথা বাড়ালো না। ইচ্ছে করছে লোকটাকেও একটা ধমক দিয়ে দিতে। কিন্তু দিলো না। মানুষকে কষ্ট দেওয়ায় তাঁর অনীহা আছে। রিপোর্টটা হাতে তুলে নিয়ে গম্ভীর মুখ করে সামনে থেকে সরে গেল। এখন সে যাচ্ছে সহকারী সম্পাদকের রুমে। সে সম্পর্কে বান্ধবী হয়। নাম তানিশা। দেখতে আহামরি সুন্দরী না হলেও মোটামুটি প্রেমে পড়ার মতো চেহারা আছে তানিশার। এছাড়াও দেশের বিখ্যাত পত্রিকা ‘মহাকালের’ সহকারী সম্পাদক সে। হাজারখানেক ছেলেপেলে তাঁর জন্য মরিয়া হয়ে আছে।
উপরতলার দক্ষিণ দিকে তানিশার রুম। তাহমিদ দরজায় টোকা দিলো। বলল,
– তানিশা আসবো?
তানিশা ল্যাপটপ স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,
– তাহমিদ, আয়, ভিতরে আয়। রিপোর্টটা আমাকে মেইল করিসনি কেন?
তাহমিদ ভিতরে গেল। চেয়ারে বসে হাতে থাকা কাগজটা এগিয়ে দিলো তানিশার দিকে। তানিশা কাগজের লেখা রিপোর্টটা দেখেই রাগে ফেটে পড়ল। রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
– ওই হারামি, তোকে না কতবার বলেছি রিপোর্ট কম্পিউটারে লিখবি। সবার ডেস্কেই তো একটা করে কম্পিউটার আছে। সবাই যদি কম্পিউটারে রিপোর্ট লিখতে পারে, তাহলে তুই কেন পারবি না?
তাহমিদ হাত নাড়িয়ে বলল,
– কম্পিউটারে লিখলে আমার ঠিক ইমোশনটা আসে না।
– রিপোর্টের সাথে ইমোশনের কী সম্পর্ক?
– আহ্! আমি যেটা লিখবো, সেটা যথাযথভাবে লেখার জন্য ইমোশন থাকাটা প্রয়োজনীয়। কম্পিউটার একটা যন্ত্র মাত্র। ওর সামনে আমি নিজের ইমোশনকে প্রকাশ করতে পারি না। রিপোর্ট লেখাটা ক্রিয়েটিভ ব্যাপার। এটা যেমন সবাই পারে না, তেমনি সবাই সবভাবে পারে না। অন্যদের রিপোর্ট দেখ; আর আমার রিপোর্ট দেখ। ওরা শুধুমাত্র তা-ই লিখে, যে তথ্যগুলো অন্যজন জোগাড় পরে দেয়। আমি যখন একটা বিখ্যাত লেখককে নিয়ে রিপোর্ট লিখতে যাবো, তখন সেটা এমনভাবে লিখবো, যাতে সবাই পড়ে মুগ্ধ হয়। সুতরাং বাকিদের সাথে আমার তুলনা চলে না।
তানিশা চোখ-মুখ আগুন গরম করে বলল,
– তোকে কী আমি বলেছি; তুই রিপোর্টে কাব্যিক সব কথাবার্তা, বা মুগ্ধ হওয়ার মতো কিছু লেখ? তোকে সে বিষয়টা দেওয়া হয়েছে, তুই শুধু সেটার উপর সংক্ষিপ্ত একটা বক্তব্য লিখবি। এখন এটা আবার টাইপ করতে হবে। ধুর বাল! একই কাজ দু’বার করার কোনো মানে আছে? তোর হাতে লেখা তো আর আমি ছাপানোর জন্য দিতে পারব না। ইচ্ছে করছে তোকে কাঁচা চিবিয়ে খেতে। সবসময় এই একই কাজ করিস তুই। আচ্ছা, নিজস্ব ফোন বা ল্যাপটপ, কিছু কিনেছিস?
তাহমিদ হেসে উঠল তানিশা কথা শুনে। পকেট থেকে নিজের বাটন মোবাইলটা বের করে বলল,
– এটা এখনো অক্ষত আছে। এটা পুরোপুরি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত ফোন কেন কিনবো? আর ল্যাপটপ; ওরে আল্লাহ! এগুলো কিনে আমি টাকা অপচয় করতে পারব না।
তানিশা মাথায় হাত দিয়ে বিরক্তির গলায় বলল,
– আরে ইয়ার, এটা না। তোকে না বলেছিলাম একটা স্মার্ট ফোন কিনতে। আর তুই খবরের কাগজে কাজ করিস। তোর কাজটাই লেখালেখি। অর্থাৎ যখনতখন লেখালেখির জন্য একটা মাধ্যম তোর প্রয়োজন। অন্তত ল্যাপটপটা তোর প্রয়োজন। ধর, যেকোনো কাজে কোথাও গিয়েছিস। বা কোথাও আটকে পড়েছিস। এবার তোর জন্য তো আর অফিসে একটা প্রজেক্টের কাজ অফ থাকবে না। দূরে থাকলেও ল্যাপটপ এর সাহায্যে তুই রিপোর্ট লিখে আমাকে মেইল করতে পারবি।
– ঠিক এই কারণেই আমি ওইসব কিনছি না। ওইসব কিনে আমি টাকার সাথে সাথে নিজের ঘুমটা নষ্ট করতে পারব না। আমার বাড়ি কাছেই। সুতরাং কোথাও আটকে পড়ার সুযোগ নেই। পাশের ডেস্কের সুমন ভাই তো প্রায়ই আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে। এই চাকরি নাকি তাকে ঘুমাতেও দেয় না।
তানিশা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
– কেন কেন?
– কারণ, ওর সিনিয়র নাকি ওকে মাঝরাতেও ফোন দিয়ে বলে, একটা প্রতিবেদন তৈরি করে সকালের আগে আমাকে দেখাও। এবার তুই বল, আমি যদি ল্যাপটপ কিনি, তাহলে ওই আধবুড়ো দিনরাত এভাবেই আমাকে জ্বালাবে।
তাহমিদের কথা শুনে তানিশা খিলখিল করে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে বলল,
– আচ্ছা শোন, তুই যদি রিপোর্টটা টাইপ করে লিখে দিস, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি, আগামী মাসে তোর বেতন আমি ১৫ হাজার করে দেবো। মানে পাঁচ হাজার বাড়িয়ে দিবো।
তাহমিদ চমকে ওঠে বলল,
– ৫ হাজার টাকা! মানে আমার বেতনের প্রায় অর্ধেক বাড়িয়ে দিবি।
– হ্যাঁ, দিবো; কথা দিচ্ছি।
– যেই এই টাইপ করার কাজটা করবে, তাকেই কী বেতনের অর্ধেক বাড়িয়ে দিবি? ধর, কাজটা তুই করলি, তাহলে কী অফিসের মালিক তোমার বেতনের অর্ধেক টাকা বাড়িয়ে দিবে? তোর বেতন যদি ৫০ হাজার টাকা হয়, তাহলে তখন ৭৫ হাজার টাকা হয়ে যাবে। যদি ১ লাখ টাকা বেতন হয়, তাহলে দেড় লাখ টাকা হয়ে যাবে। ওয়াও!
তানিশা হাসল তাহমিদের কথা শুনে। বলল,
– আরে বোকা, তা আবার হয় নাকি! আমি শুধু তোরটাই বাড়িয়ে দিবো। তোর রিপোর্ট সবসময় ভালো হয় সবার থেকে। যদি সেটা কাগজে না লিখে, বা কাগজে লেখার পর আবার কম্পিউটারে টাইপ করে দিস, তাহলে আমি তোর বেতন ৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিবো।
তাহমিদ ঠোঁট বাঁকা করে বলল,
– তুই দিবি?
– হ্যাঁ, আমি দিবো। কেন, সেই ক্ষমতা কী আমার নেই? অবশ্যই আছে।
– তাহলে বরঞ্চ আগামী ১০০ বছরের বেতন আমাকে অগ্রীম দিয়ে দে। যদি বেঁচে থাকি, তাহলে কথা দিচ্ছি, মহাকাল ছাড়বো না কখনো। ১০০ বছর তোদের এখানেই চাকরি করব।
তানিশা চোখ বড় করে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
– বলিস কী! এত টাকা দিয়ে তুই কী করবি? ১০০ বছরের বেতন কতগুলো টাকা তুই জানিস? কী করবি এত টাকা দিয়ে?
– আমার একটা গোপন কাজ আছে। সেখানে ইনভেস্ট করব।
– আরে বাহ্! বিজনেস করার প্ল্যান করছিস নাকি।
– না। আমার জন্য না। একটা ইচ্ছা আছে আমার। সেটাই পূরণ করব। যদিও এত টাকার প্রয়োজন নেই। ঠিক আছে, ৫০ বছরের বেতন দিলেই হবে।
– তোর ইচ্ছেটা আমায় বল। দেখি, পূরণ করতে পারি কি না। বন্ধু হিসেবে তো আমার দায়িত্ব এটা।
– বন্ধু হিসেবে আমার ইচ্ছা পূরণ করবি?
– কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না? ঠিক আছে, ভেবে নে আমি তোর বউ। এবার নিশ্চয়ই বিশ্বাস হচ্ছে। বউ তো স্বামীর ইচ্ছে পূরণ করতেই পারে। অস্বাভাবিক কিছু না।
তাহমিদ চমকানো কণ্ঠে বলল,
– বউ!
– হ্যাঁ, বউ। পড়াশোনা, চাকরিবাকরি অনেক করেছি। আর ভালো লাগছে না। বাকি জীবনটা সংসার করে কাটাবো ভাবছি। বিয়ের পর তোকে আমার চাকরিটা দিয়ে দিবো। তুই বাইরে চাকরি করবি, আমি সংসার করব।
তাহমিদ হেসে উঠল। তানিশা সিরিয়াস ভঙ্গিতে অনুনয়ের কণ্ঠে বলল,
– সত্যি বলছি। তোকে আমার খুব ভালোলাগে। সহজ-সরল মানুষ তুই। যদিও একটু উদ্ভট টাইপের, অগোছালো। বাট তোর মন ভালো। তুই মানুষ হিসেবে খুব ভালো। সম্পর্কে একে অপরকে বুঝতে পারাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তোকে বুঝতে আমার একটু সময় লাগলেও আমাকে বুঝতে তোর একটুও সময় লাগবে না। তোর মধ্যে এমন একটা গুণ আছে, যার দ্বারা সহজেই অন্যকে বুঝতে পারিস। আনন্দে রাখতে পারিস। আমার মনে হয়, আমি তোর কাছেই ভালো থাকবো। বিয়ে করবি আমায়, প্লিজ।
তাহমিদ আবার হাসতে চাচ্ছিল। কিন্তু তানিশার চোখ-মুখ দেখে মনে হলো, তানিশা খুব সিরিয়াস। তাই সেও কিছুটা সিরিয়াস হওয়ার ভান ধরল। একটু চুপ থেকে বলল,
– তোকে তো আমি সবসময় বোনের নজরে দেখে এসেছি।
তানিশা রেগেমেগে বলল,
– মাইর খাবি কিন্তু। এটা কেম্নে সম্ভব? আমি কোনোকালেই তোর বোন ছিলাম না; এবং থাকবোও না। আমি আগে তোর বন্ধু ছিলাম। এখন তোর বউ হবো। তুই বন্ধু বলেই বলছি, অন্য কেউ হলে বেহায়ার মতো এভাবে অন্তত বলতে পারতাম না।
– দেখ, আমার বাবা ‘টি’ অক্ষরটাকে চিরকাল নিজের সন্তানের নামকরণের ব্যবহার করেছে। আমার ভাইয়ার নাম তুহিন, আমার নাম তাহমিদ, আর আমার বোনের নাম তৃষ্ণা। আমি তুলি ডাকি। এটাও ‘টি’ অক্ষরের। তোর নাম তানিশা। সুতরাং ‘টি’ অক্ষর দিয়ে শুরু এমন সব নামের মানুষকে আমি নিজের ভাই-বোন মনে করি।
তানিশার মাথা গরম হয়ে গেল। এখানে যে তাঁর নামটা ভিলেন হয়ে দাঁড়াবে, তা আগে কল্পনাও করেনি। আগে এইরকম কিছু ভাবলে, নামটা চেঞ্জ করে ফেলতো৷
তানিশা হাতের সামনে থাকা কাগজটা মুড়িয়ে তাহমিদের দিকে ছুড়ে মারল। চেঁচিয়ে বলল,
– হোক বোন। রক্তের তো আর না। তবুও আমি তোকে বিয়ে করব। বিকেলে আমি তোর বাড়িতে যাবো। এরপর ভাবীকে অনুরোধ করে বলব, আমাদের বাড়িতে তোর আর আমার বিয়ের পস্তাব পাঠাতে।
তাহমিদ তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। মনেমনে কী যেন বিড়বিড় করে মোড়ানো কাগজটা আবার তানিশার দিকে এগিয়ে দিলো। তানিশা সেটা হাতে নিয়ে রাগে গজগজ করতে লাগল। তাহমিদ কিছু না বলে বেরিয়ে এলো।
১০.
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও নুপুরের মনে হচ্ছে, চোখ দু’টো মনমতো হচ্ছে না। সেই চার-পাঁচ বছর আগের সজলের চোখে যে মাদকতা ছিল, কাগজে আঁকা ছবিটির চোখে সেই মাদকতা নেই। কিছু একটা যেন মিসিং আছে। কী জানি, মানুষটার চোখ দু’টো এখন কেমন হয়েছে!
নুপুর ছবি আঁকছে, আর কতকিছু ভাবছে! চোখের সামনে সজলের মুখটা ভেসে উঠছে। কিন্তু চোখ দু’টো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না; ঝাঁপসা লাগছে। কিছুটা ভয় পাচ্ছে নুপুর। যে মানুষটাকে এতগুলো বছর নিজের অন্তরে গেঁথে রেখেছিল, এক মুহূর্তের জন্যও যার মুখটা আড়াল হতে দেয়নি, আজ হঠাৎ তাঁর চোখ দু’টো সে আঁকতে পারছে না। ঘরে সজলের অসংখ্য ছবি লুকিয়ে রেখেছে নুপুর। চাইলেই ওখান থেকে একটা ছবি নিয়ে আসতে পারে; তারপর সেই ছবি দেখে চোখটা এঁকে ফেলতে পারে। কিন্তু সে তা করবে না। আগেও অন্তরে গেঁথে রাখা সজলকে সে ভালোবেসে এঁকেছে; আজও আঁকবে।
নুপুর নিজের মনে বলল,
– সমস্যাটা হলো, আজ আমার মন প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন; তাই মন স্থির রেখে সজলকে আঁকতে পারছি না।
কলিংবেলটা বেজে উঠল হঠাৎ। নুপুরের সময় যেন থমকে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। সে উৎসুক হয়ে নিচতলায় উঁকি দিলো। রহিম চাচা দরজা খুলে দিতে গেল। নিচে নুপুরের বাবা আফজাল হোসেনও বসে আছেন। তিনি ওঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। রহিম চাচা দরজা খুলে দিলেন। একগাল হেসে বললেন,
– আহেন ভাইজান। বড়সাব আপনি লিগা বইয়া আছে।
সজল রহিম চাচাকে সামাল দিয়ে ভিতরে ঢুকল। রহিম চাচা সালামের উত্তর নিয়ে সজলের হাত থেকে ব্যাগটা নিজের হাতে নিলো। সজল ব্যাগটা তাঁর হাতে দিয়ে আফজাল হোসেনের সামনে এলো। বলল,
– আসসালামু আলাইকুম মামা। কেমন আছেন?
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
– আমিও ভালো আছি।
– সেই যে মাস্টার্স শেষ করে ঢাকা ছাড়লে, আর তো আসার কথা ভাবলেও না। অনেক কষ্টে তোমাকে আবার ঢাকায় আনতে পারলাম।
সজল হাসল কিছুটা। আফজাল হোসেন আবার বললেন,
– যা-ও, ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। তোমার মামি নিজের হাতে রান্না করছে তোমার জন্য। দুপুরের খাবার সবাই একসাথে খাবো; এরপর আমি বাইরে বের হবো। তা ঘরটা কোনদিকে মনে আছে তো; নাকি ভুলে গেছ?
সজল হেসে বলল,
– মনে আছে মামা। আমি অতটাও ভুলো মনের না।
– ঠিক আছে যাও। উপরে নুপুর আছে। ছবি আঁকছে।
নুপুরের কথা শুনেই সজলের আত্মা শুকিয়ে এলো। কয়েকবছর আগে যখন সজল এই বাড়ি থেকে পড়াশোনা করতো; তখনই নুপুর ওর দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। সবসময় সজলের সাথে ইউনিভার্সিটি যেতো। দু’জনের ইউনিভার্সিটি একই হওয়ায়, সজল কখনো ‘না’ করতে পারতো না। মাস্টার্স পরিক্ষা শেষ হলো। সজল বারান্দায় বসে গুনগুন গান গাইছিল। নুপুর সেসময় পাশে এসে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ আমতাআমতা করে বলে,
– সজল, আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। অনেকদিন আগে থেকেই। কিন্তু বলতে পারছিলাম না। তোমার তো পরিক্ষা শেষ। এবার বাড়িতে যাবে। আবার কবে আসবে, তাঁর ঠিক নেই। তাই একপ্রকার লাজলজ্জা ভুলে গিয়ে তোমার কাছে এলাম।
সজল চমকে উঠেছিল। বাকরুদ্ধ হয়ে শুধু কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল নুপুরের দিকে। এরপর আর এক মুহূর্তও ওই বাড়িতে দাঁড়ায়নি। ব্যাগপত্র গুছিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিল। আর ফিরে যায়নি ঢাকায়। কারণ, তাঁর মনে আগে থেকেই আসমার স্থান ছিল। আসমাকে ছাড়া সে অন্য কাউকে কল্পনা করতে পারতো না। বাড়িতে গিয়ে বাবা-মায়ের অনেক প্রশ্নের মুখে পড়ে সজল। কেন হঠাৎ চলে এলো? নুপুরের সাথে কী হয়েছে? নুপুর বাড়িতে কাঁদছে কেন?
সজল সোজাসাপটা উত্তর দিয়ে সব বলে দিয়েছিল। সেটা শুনে ওর বাবা বলেছিল, বেশ তো, যদি তোমরা রাজি থাকো, তাহলে আমি আফজালের সাথে কথা বলব বিয়ের ব্যাপারে।
সজল তখন আরও রাগ করে বাবা-মায়ের কাছ থেকে চলে গেছিল। আসমাকে ফোন করে দেখা করতে বলে। আসমার সাথে দেখা হয়। কিন্তু নুপুরের কথা, বাবার কথা সে এড়িয়ে যায়।
সজলকে দেখেই নুপুর চোখ আঁকতে শুরু করেছিল। সজল তাঁর পাশ দিয়েই নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল। সেসময় নুপুরকে দেখল। সাদা কাগজের মাঝখানে নিজের মুখটা দেখে থেমে যেতে বাধ্য হয়েছে সে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল,
– ওয়াও।
নুপুর হকচকিয়ে উঠল। সজল যে কখন তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তা বুঝতেই পারেনি। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে সজলের দিকে তাকিয়ে রইল। সজল বলল,
– তুমি বেশ সুন্দর ছবি আঁকতে পারো। আমি তো ভাবতেই পারছি না তুমি এইরকম বিশাল মাপের আর্টিস্ট হয়ে গেছ।
নুপুর আপাদমস্তক ভঙ্গিতে হাসল। বলল,
– থ্যাঙ্কিউ সো মাচ৷ তুমি কি ঘরের দিকে যাচ্ছো?
– হ্যাঁ।
– চলো আমি দেখিয়ে দেই।
– আমি একাই যেতে পারব। তুমি যে কাজটা করছিলে, সেটা করো।
নুপুরের মুখটা নিরোৎসাহিত হয়ে গেল। উল্টো দিকে ঘুরে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সজল আর দাঁড়ালো না। নিঃশব্দে নিজের ঘরের দিকে যেতে লাগল।
১১.
তাহমিদের ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। তাহমিদ পকেট থেকে ফোন বের করে দেখ, তানিশা নাম। পাশেই রনি বসে ছিল। মোবাইলের ছোট্ট স্ক্রিনে ভেসে উঠা তানিশা নামটা তাঁর চোখ এড়ালো না। তাঁরা চার বন্ধু আর এক বান্ধবী চায়ের দোকানে বসে আছে। রনি সবাইকে উদ্দেশ্য করেই রসিকতা করে বলে উঠল,
– সবাই শোন, হবু বরের মোবাইল কল এসেছে হবু বউয়ের।
রনির কথা শুনে হেসে উঠল সবাই। দোকানী চাচা-ও না হেসে পারল না। এতক্ষণ তাঁদের মধ্যে তানিশাকে নিয়েই কথা হচ্ছিল। তানিশাকে সবাই চেনে। যদিও এদের মতো তানিশা অফিস শেষ করে এখানে এসে আড্ডা মারে না। তবে ফোনে এবং শুক্রবারে যোগাযোগ হয় সবার সাথে।
তাহমিদ সবাইকে ধমক দিয়ে বলল,
– আহ্! ফাজলামি বন্ধ কর। তোদের কী মনে হয় আমি ওকে বিয়ে করব?
– করবি না কেন? রাজকন্যার সাথে রাজ্য ফ্রি পাবি। বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে। গাড়ি দিয়ে চলাফেরা করে। এছাড়া ও নিজেও ভালো চাকরি করে। তোর ভবিষ্যৎ তো আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আহ্! তুই টাকার বিছানায় শুয়ে আছিস।
রনি উচ্চবাক্যে কথাটা বলল। ওর কথা শুনে আবারও উচ্চস্বরে হেসে উঠল সবাই। তাহমিদ বলে উঠল,
– ওই শালা, তোর কী মনে হয় আমি ঘরজামাই থাকবো? তাছাড়া তোদের কে বলল, আমি ওকে বিয়ে করব. দেখ, বিয়ে একটা পবিত্র কাজ। আমি যদিও করি, তাহলে শেষ বয়সে করব। বউকে বলব, আমার যৌবন এক প্রেমিকাকে দিয়েছিলাম। সে চলে গেছিল। তাঁর বিরহে আমি এতই কাতর ছিলাম যে, উদাসীন থাকতে থাকতে যৌবন পেরিয়ে বুড়ো বয়সে চলে এসেছি। এবার যদি এই বুড়োটাকে নিতে চাও, তাহলে নাও; অন্যথায় উল্টো রাস্তা দেখো।
তাহমিদ রসিক সুরে বললেও ওর কথাগুলো সিরিয়াস শোনালো। ফোনের রিংটোন প্রথমবার কেটে গিয়ে দ্বিতীয়বার বাজতে শুরু করছে। তাহমিদ সংকোচবোধ করছে। নিজের মনে ভাবছে,
তানিশা বলেছিল ও আমার বাড়িতে যাবে। মনে হচ্ছে ও এখন আমার বাড়িতেই আছে। হায় আল্লাহ!
চতুর্থ পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।