সম্পৃক্ততা পর্ব ১৭

0
647

সম্পৃক্ততা – ১৭তম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

ফাতেমা অনুজ্জ্বল স্বরে জিজ্ঞেস করল, ” আপনি এত চুপসে গেলেন কেন?”
” তুমি কি আমাকে নিয়ে উপহাস করতে চাচ্ছ ফাতেমা? নিশ্চয়ই এতক্ষণে জেনে গেছ কেন আমি চুপ করে আছি।”
তুহিন বিছানা থেকে নেমে যেতে চাইলে ফাতেমা সাহসা তাকে আটকে দিয়ে বলল, ” চলে যাচ্ছেন কেন? আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।”

তুহিন মাথা নাড়িয়ে বসে পড়ল। ফাতেমা মৃদু হেসে বিছানা থেকে নিজের মাথাটা সরিয়ে, তুহিনের পায়ের উপর মাথা রেখে শুলো। তুহিন বিস্মিত হলো; তবে কিছু বলল না।
ফাতেমা, মুখটা বৃথা উদ্ভাসিত করে বলল, ” আপনার কি মনে হয়, আমি আপনার থেকে দূরে চলে যাবো?”
তুহিনের একটা হাত টেনে এনে, হাতের উপর পাতায় চুমু দিলো। এরপর হাতটা বুকে ঠেকিয়ে রাখল। ম্লান হেসে আবার জিজ্ঞেস করল, ” আমার বুকের ভেতরটায় যে ধুকপুক শব্দ হচ্ছে, তা কি আপনি অনুভব করতে পারছেন? ভয় তো আমি পাচ্ছি। আপনি যদি আমার থেকে দূরে সরে যান; তাহলে আমার কী হবে? আমার এই সংসারটার কী হবে?”

তুহিনের চোখের পাতা নড়াতেই টপ করে দু’ফোঁটা জল পড়ল ফাতেমার মুখের উপর। ফাতেমা হতভম্ব হয়ে ওঠে বসল। নিজের হাতে তুহিনের চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, ” আপনি কাঁদছেন কেন? আমার উপর কি কোনো ভরসা নেই আপনার? আমি এমন কিছু করব না, যার কারণে এই সংসা শেষ হয়ে যাবে। ফাটল আপনি ধরিয়েছেন, সেটা জোড়া লাগানোর দায়িত্ব আপনার। আপনিই যদি হাল ছেড়ে দেন, তাহলে সংসার টিকবে কীভাবে।”
” যে নিজের উপরই ভরসা করতে পারে না, সে অন্যের উপর কীভাবে ভরসা করবে?”
” নিজের উপর ভরসা করতে না পারলে কি অন্যের উপর ভরসা করা যায় না? আপনি আমার উপর একটু ভরসা রাখুন।”
তুহিন কিছু না বলে আবারও চোখের পলক ফেলল। ফাতেমা দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ” উনার সাথে আরও একজন এসেছিল। উনার স্বামী।”
কপাল কুঁচকে তুহিন বলল, “কী বলো!”
” হ্যাঁ। উনারা দু’জনেই এসেছিল আমাদের সাথে কথা বলতে। দেখুন, যখন পুরো ব্যাপারটা আমি জেনেছি, তখন খুব রাগ হয়েছিল। আপনাকে সামনে পেলে আমি কুচিকুচি করে কাঁটতাম! কিন্তু পরে আমি ভাবলাম, সত্যি এটাই যে, প্রথম ভালোবাসা সহজে ভুলে যাওয়া যায় না৷ কখনো কখনো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রথম ভালোবাসা স্মরণে থাকে। এর মাঝে কত ঘটনা যে ঘটে যায়, তাঁর হিসেব নেই। আপনি আমাকে কতটা ভালোবাসেন, তা আমি জানি না। কিন্তু আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি। আপনি আমার প্রথম ভালোবাসা। তাই এর মর্ম আমি বুঝি। এই কঠিন সত্যির মুখোমুখি আরও কিছুদিন আগে হলে হয়তো আমি সহ্য করতে পারতাম না। উল্টো পাল্টা কিছু করে বসতাম। কিন্তু গত কয়েকদিনে আপনি আমায় যে ভালোবাসা দিয়েছেন, সেখান থেকে বঞ্চিত হতে চাই না আমি। সেজন্যই আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা একবারও কল্পনা করিনি আমি। আপনিই তো আমার সব। তবে, আপনার উচিত ছিল নিজে থেকে আমাকে এই সত্যিগুলো বলা। যে নিজেকে শুধরে নিয়েছে, আমি তাকে আরও আঘাত করতাম কীভাবে?”
তুহিন কাতর গলায় বলল, ” আমি বলতে চেয়েছিলাম ফাতেমা। কিন্তু এই কয়দিন তোমার সাথে এত সুন্দর সব মুহূর্ত কাটিয়েছি যে, আমি আর সাহস করে কিছু বলতে পারিনি। ভয় হচ্ছিল খুব। আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ।”
মুখে অস্বস্তিকর ভাব এনে বলল, ” ধুর! আপনি এইবার আমায় অপ্রস্তুত করে দিচ্ছেন।” তুহিনের হাতের মুঠোয় নিজের ছোট্ট হাত দু’টো ঢুকিয়ে দিলো ফাতেমা।
তুহিন হেসে বলল, ” সরি সরি।”
” হোয়াট সরি? শুনুন, মেয়েটি যদি হাজার অন্যায় করার পরও, তাঁর স্বামীর মেয়েটিকে সহজেই মেনে নিতে পারে, তাহলে আমি কেন পারব না? মেয়েটা আমার কাছে এসে সরি বলেছে। আমি এতে আপ্লুত হয়েছি। মেয়েটা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। এবার আপনি বলুন, আপনি কি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন?”
” পেরেছি।”
” থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।” তুহিনের গাল টেনে হেসে বলল ফাতেমা।
তুহিন বলল, ” আমার কাছে এই মুহূর্তটা স্বপ্নের মতো লাগছে ফাতেমা। সবকিছু এত সহজভাবে মিটে যাবে, তা আমার কল্পনার বাইরে ছিল।”
” ভালোবাসার জন্য মানুষ কতকিছু করে। আর আমি আপনাকে ক্ষমা করতে পারব না? তবে খবরদার, পরবর্তীতে এইরকম কিছু হলে আপনাকে পুলিশে দেবো।” শাসিয়ে বলল ফাতেমা।
তুহিন একগাল হেসে ফাতেমাকে নিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। ফাতেমার কপালে, গালে, ঠোঁটে, ঘাড়ে, অজস্র চুমু এঁকে দিয়ে বলল, ” বুকের উপর থেকে যেন পাথর সরে গেল। এতদিন নিঃশ্বাস আটকিয়ে কোনোরকমে বেঁচে থেকেছি। আর অপেক্ষার প্রহর গুনেছি।”
তুহিনের মাথার চুলে হাতের আঙ্গুল গুজে দিয়ে ফাতেমা বলল, ” আরও একটা সত্যি গোপন করেছেন আপনি। আপনার যে চাকরিটা নেই, সেটা আমায় বলেননি। আমি এটাও জেনেছি।”

তুহিন চোখ নিচে নামিয়ে নিলো। আর কিছু বলল না। ফাতেমা চট করে উল্লাসী গলায় বলল, ” আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
” কী?
“এখন বলব না। সময় মতো বলব।”
তুহিন কিছুক্ষণ স্থির চোখে ফাতেমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আর হেসে বলল, ” আমাদের যদি একটা ছোট্ট বেবি হয়, তাহলে কেমন হবে ফাতেমা? আমাদের দূরত্ব পুরোপুরি কমে যাবে।”

ফাতেমা সাহসা লজ্জা পেয়ে তুহিনের বুকে মুখ লুকালো। তুহিনের শার্ট খামচে ধরে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলল তুহিনের বুকের ভিতরে। তুহিন হেসে শক্ত করে ফাতেমাকে জাপটে ধরল। আর মনে মনে বলতে লাগল, “কী থেকে কী হয়ে গেল হঠাৎ! কিছুক্ষণ আগেও যেই আমি ভয়ে কাঁপছিলাম, সেই আমিই এখন স্ত্রীকে স্বাচ্ছন্দ্যে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছি। যেন কিছুই হয়নি। সব স্বাভাবিক। ফাতেমার মনের জোর যে এতটা প্রখর, তা এই জগতের কেউই জানতো না। আজ নিজের চোখে দেখলাম আমি।”
তুহিন মুচকি হেসে ফাতেমাকে আবারও চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

সকালে তুহিন যে চমকটা পেলো, তা হজম করে স্বাভাবিক হতে বেশ কিছুটা সময় লাগল। তাহমিদ যে তাকে এতবড় একটা চমক দিবে, তা কখনো কল্পনা করতে পারেনি। যে তাহমিদকে সে সবসময় উদ্ভট ভেবে অগ্রাহ্য করেছে, সেই তাহমিদই তাঁর স্বপ্ন পূরণ করে দিলো।

সকাল হতেই তাহমিদ বাড়ির সবাইকে রেডি হতে বলল। তুহিন প্রশ্ন করল, “কোথায় যাবো?”
তাহমিদ উত্তর দিলো না। ঘরের ভেতর ফাতেমা এসে বলল, ” এত প্রশ্ন করছেন কেন? বলেছিলাম না একটা সারপ্রাইজ আছে আপনার জন্য। চুপচাপ রেডি হয়ে নিন।”
তুহিন চিন্তিত ভাবে ঘরের ভিতরে গেল আবার। ফাতেমাও ওর পিছনে গেল। তাহমিদ, তৃষ্ণা, সবাই রেডি হয়ে নিলো চটপট।

আধঘণ্টার মধ্যেই ওরা একটা স্থানে পৌঁছে গেল। ওখানে গিয়ে তুহিনের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। এই জায়গাটা তুহিনের খুব পরিচিত। একসময় এখানেই তাঁর লাইব্রেরি ছিল। আজও এখানেই একটা লাইব্রেরি আছে। সেই একই নামের; তিন মুখী লাইব্রেরি। তুহিন বাকরুদ্ধ হয়ে শুধু সবকিছু দেখতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর নিঃশ্বাস আটকিয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ” এইসব কী হচ্ছে তাহমিদ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
তাহমিদ হেসে বলল, ” লাইব্রেরিটা পছন্দ হয়েছে ভাইয়া?”
” হ্যাঁ। কিন্তু এটা কার?” মুখটা বিস্মিত করে জিজ্ঞেস করল তুহিন।

পাশে থেকে ফাতেমা বলল, ” কার আবার? আপনার এটা। দেখছেন না নামটা।”
” ফাতেমা, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এই লাইব্রেরি আমার মানে কী?
ফাতেমা হেসে বলল, “আগের লাইব্রেরিটা পুড়ে যাওয়াতে আপনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন না, সেটাই এতদিন আপনার ভাই বুকে আকড়ে ধরেছিল। সবসময় বলতেন না, ও চাকরি করে বেতনের টাকা দিয়ে কী করছে? শুনুন তাহলে, তাহমিদকে আপনি যতটা বেখেয়ালি ভাবেন, ও ততটা বেখেয়ালি না। চাকরির শুরু থেকেই ও মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল, একদিন আপনাকে একটা লাইব্রেরি করে দিবে। আপনার স্বপ্ন ও পূরণ করে দিবে। আপনি ওর জন্য এতকিছু করেছেন, আর ও আপনার জন্য এইটুকু করবে না! ও নিজের বেতনের সব টাকা জমিয়ে রাখতো। আমিও আপনার থেকে কিছু কিছু টাকা নিয়ে জমাতে শুরু করেছিলাম। সে সব এক করে, ঠিক এই জায়গাটাতে আমরা এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছি।”

তুহিন অবাক চোখে তাহমিদের দিকে তাকালো। সে হাসছে। মিটমিটিয়ে হাসছে। এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাহমিদকে। তুহিনের উজ্জ্বল মুখটা দেখে যেন ফাতেমার প্রাণ ফিরে এলো।

সেদিন লঞ্চে তাহমিদ, তুহিনকে জিজ্ঞেস করেছিল, ” ভাবীর কাছে কী লুকিয়েছ তুমি?”
তুহিন অনেক ইতস্তত করার পর বলেছিল, ওর চাকরি চলে গেছে; সেটাই ফাতেমাকে জানায়নি। তাহমিদ তখনই সিদ্ধান্ত নেয়, এবার বড় ভাইকে লাইব্রেরির দায়িত্ব দিবে। তাহমিদ নিজেই তুহিনের চাকরি চলে যাওয়ার ব্যাপারটা জানায় ফাতেমাকে। ফাতেমা নির্বাক হয়ে গেছিল। তাহমিদের অনুরোধেই সে তখনকার মতো চুপ করে যায়। ভেবেছিল, তুহিন নিজেই বলবে। অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে ফাতেমা। অপেক্ষা শেষ হয় বাড়িতে অপরিচিত দু’জন মানুষের আগমনে। ফাতেমা যখন জানতে পারল, মেয়েটা তাঁর স্বামীর প্রাক্তন প্রেমিকা; তখনই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। মেয়েটা নিজেই ফাতেমাকে আশ্বস্ত করে। নিজের দোষ স্বীকার করে। বিয়ের পর ও যদি তুহিনকে উৎসাহ না দেখিয়ে বরং দূরত্ব বজায় রাখতো, তাহলে সম্পর্কটা এতদূর চলে আসতো না। মেয়েটা আরও বলে, সে নিজের স্বার্থের জন্যই তুহিনকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু তুহিন রাজি হয়নি। তুহিনের বন্ধু রাশেদ, মেয়েটাকে অনুরোধ করে বলে, এই নিয়ে যেন আর সামনে না আগায়। এদিকে মেয়েটার স্বামীও জেনে যায় ব্যাপারটা। তাঁদের সংসারটা ভেঙে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। মেয়েটা আস্তে আস্তে নিজের ভুল বুঝতে পারে। স্বামী-সংসার দূরে সরিয়ে পুরোনো সম্পর্কে ফিরে গিয়ে যে অন্যায় করেছে, সেখান থেকে বের হতে চায়। সেজন্য নিজের স্বামীর কাছে ক্ষমা চায়। তাঁদের কথা শুনে ফাতেমার মনেও তুহিনের জন্য মায়া তৈরি হয়। ঠাণ্ডা মাথা ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করে। অযথা হট্টগোল করে নিজের সংসারে আঘাত করার প্রশ্নই আসে না। মেয়েটা যেহেতু স্বাভাবিক, সেহেতু তুহিনকে আঘাত করা ঠিক হবে না। ব্যাপারটা যেখানে স্থগিত করে ফাতেমা। তাহমিদকে এইসব বলেনি। ভেবে রেখেছিল, রাতে শুধুমাত্র তুহিনকে এইসব বলবে। সংসার টিকিয়ে রাখতে হলে দু’জনের সাহায্য প্রয়োজন। একার পক্ষে এটা সম্ভব না। তুহিন, মনে যে কষ্ট নিয়ে ভারী মুখে দিন কাটাচ্ছে, সেখান থেকে তাকে মুক্ত করতে হবে।

তাহমিদ লাইব্রেরি খুলে দেয়। তুহিন আশ্চর্য চোখ করে ভিতরে ঢুকে চারিদিকে চোখ বুলাতে থাকে। প্রতিটি কোণায় তাকায়, আর মনে হয়, এটা যেন সেই কয়েক বছর আগের লাইব্রেরিটাই। এত অন্যায় করার পরও তাঁর স্ত্রী আর তাঁর ভাই এত যত্ন করে এটাকে তৈরি করেছে। তুহিনের চোখ ভিজে আসে। স্ত্রী, ভাই, বোন, সবাইকে বুকে আগলে চারিদিক দেখতে থাকে। সময় বদল হয়, কিন্তু মুহূর্তটা একই থাকে। তুহিনের বুকের ভিতর চিনচিন শিহরণ হতে থাকে। সে তাকায় ফাতেমার দিকে; তাহমিদের দিকে; আর তৃষ্ণার দিকে। এটা তাঁর পরিবার। এই পরিবার নিয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চায় সে।

৩৮.
তাহমিদ আর তানিশার বিয়ে সম্পন্ন হলো। বিয়ের অনুষ্ঠান খুব যে অলসভাবে হয়েছে, তা না। তুহিন নিজের সঞ্চয়ের সবটুকু দিয়ে বেশ চাঞ্চল্যকর ভাবে তাহমিদের বিয়েটা দিচ্ছে। কোনোদিকে কমতি রাখেনি। তাহমিদের পুরো বিল্ডিংটাই আলোর গজগজ করছে করছে। অনেকক্ষণ আগেই নিজের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে আসে তাহমিদ।

সাধারণত বাসররাতে বর ঘরে এসে দেখে, বউ বিছানার বসে আছে। ঠোঁটের কার্নিশে লজ্জাময়ী হাসি! কিন্তু তাহমিদ দেখল, তানিশা পুরো ঘর তন্নতন্ন করে কী যেন খুঁজছে।
সে শব্দহীন পায়ে হেঁটে ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। তানিশা পিছনে ঘুরতেই মুখোমুখি হলো তাহমিদের সাথে। বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, ” ধুর বাল! পুরো ঘর খুঁজে এমন জায়গা পেলাম না, যেখানে নিজের ব্যক্তিগত কিছু জিনিস লুকিয়ে রাখব।”
বাসর রাতে স্বামীর সামনে ‘বাল’ বলাটা বেমানান লাগল তাহমিদের কাছে। কিন্তু কিছু বলল না। এ প্রসঙ্গে কথা বলা মানেই অযথা সময় অপচয় করা! তাহমিদ ভিন্ন প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করল, “আসলে আমার এইসব আসবাব প্রয়োজন হয় না। সেজন্য ঘরের বিছানা আর টেবিল আর একটা ছোটখাটো ওয়ারড্রব ছাড়া তেমন আসবাব নেই। আয়নাটা আগে ছিল না। বিয়ের কিছুদিন আগেই ভাবী কিনেছে। দম্পতির ঘরে নাকি আয়না থাকা বাধ্যতামূলক! তাছাড়া ওয়ারড্রব তো আছেই; তোর ব্যক্তিগত জিনিস সেখানেই রাখ।”
” রাখা যায় বটে। তবে কতটা নিরাপদ, আমি জানি না। আমি এমন জায়গা খুঁজছিলাম, যেখানটায় কারোর নজর যাবে না। এমনকি তোরও না।”
“কী সেটা?”
তানিশা ঠোঁট কামড়ে পেটের কাছ থেকে শাড়ির অংশটা সরালো। তাহমিদ ফ্যালফ্যাল চোখে দেখল তানিশার সাদা পেট। সেখানে আরো একটা জিনিস দেখা গেল, তা হলো একটা সিগারেটের প্যাকেট। কাপড়ের আড়ালে গুজে রাখা সিগারেটের প্যাকেটটা বের করল তানিশা। ওটা হাতে নিয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে বলল, ” কী দেখছিস?”
” তুই কি এটা দেখিয়ে আমাকে লোভ দেখাচ্ছিস?” আগের মতোই ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থেকে বলল তাহমিদ।
” লোভ দেখানোর কী আছে? তুই-ই তো বলেছিলি, প্রতি সপ্তাহে একটা করে সিগারেট যেন তোকে দেই। দেখ, আমি এই বাড়ির বউ এখন। প্রতি সপ্তাহে তো আর দোকানে গিয়ে সিগারেট কিনে আনতে পারব না। মান-ইজ্জত সব যাবে তোর। তাই ওই বাড়ি থাকতেই এক ছোট ভাইকে দিয়ে আনিয়ে নিয়েছিলাম।”
তাহমিদ মুচকি হেসে তানিশার খুব কাছাকাছি এসে বলল, ” আমি সিগারেটের কথা বলিনি। তুই যে এত সুন্দর পেটটা উন্মুক্ত করে দিয়েছিস, আমি তো নিজের উপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছি। এভাবে লোভ দেখানো উচিত না।”
তানিশা হেসে লুটোপুটি খেতে লাগল। বিছানায় বসে গড়াগড়ি খেয়ে শব্দ করে হেসে বলল, ” আরে মামা, তুই তো সেই জিনিস একখান।”
” তুই এখনো আমাকে মামা বলছিস। সম্পর্কের ১২টা বাজিয়ে ছাড়বি দেখছি। বরকে কেউ মামা ডাকে?” তাহমিদ ফ্যাচফ্যাচে গলায় বলল কথাটা।
” আরে, যাকে তাকে মামা ডাকাটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই এখনো হুটহাট করে মুখ দিয়ে বেড়িয়ে যায়।” প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে আবার প্রশ্ন করল, ” আচ্ছা, মানহার সাথে উল্টো পাল্টা কূ-কাম করিসনি তো।”
তাহমিদ সোজাসাপটা বলল, ” আরে না।”
” সত্যি করে বল।” তানিশার কণ্ঠে দরাজ ভাব প্রকাশ পেলো।
তাহমিদ বিব্রত মুখ করে বলল, ” জাস্ট একটা চুমু খেয়েছিলাম।”
তানিশা বিছানায় নড়েচড়ে বসল। গম্ভীরমুখে কিছুক্ষণ নড়াচড়া করে আবার স্থির হয়ে বসে বলল, ” ঠিক আছে। প্রেম করার সময় আমাকেও তো চুমু দিয়েছিস। তাই মাফ করে দিলাম।”
” তোরটার থেকে ওরটার গভীরতা বেশি ছিল। তোকে দিয়েছি কপালে, আর ওকে দিয়েছিলাম ঠোঁটে। তবে ও ঘুমে ছিল। সেভাবে টের পায়নি।” আচমকা সাহস পেয়ে গোপন কথাটা বলে দিলো তাহমিদ।
তানিশা দাঁত খিটিরমিটির করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারও শান্ত গলায় বলল, ” তবুও মাফ করে দিলাম। ও তো আর বেঁচে নেই। এখন এই নিয়ে রাগারাগি করা ঠিক হবে না।”
তাহমিদ কিছু না বলে তানিশার সামনে হাটু গেড়ে বসল। নির্বিকার চাহনিতে তাকিয়ে তানিশার একটা হাত ধরে বলল, ” তোর জন্য একটা গিফট আনতে চেয়েছিলাম। ভাবী বলেছিল, তোর পছন্দের কিছু একটা কিনতে। আংটি বা ভিন্ন কিছু। আমি না আসলে ভুলে গেছি৷ কাল খুব সকালে দু’জনে একসাথে গিয়ে কিনে নেবো৷ আপাতত তোকে দেওয়ার মতো একটা জিনিসই আছে আমার কাছে।”
তানিশা হাসল। হেসে তাহমিদের মাথায় চুলগুলো আউলিয়ে দিলো এক হাতে। বলল, ” কী আছে শুনি?”
তাহমিদ ফিক করে হেসে বলল, ” একটা প্রসংশা আছে। চলবে?”
” চলবে।” তানিশাও হাসল খুব।
তানিশার হাত কচলিয়ে তাহমিদ বলল, ” তোর হাতে এই গাছের মেহেদী দারুণ লাগছে। আমি কাল একটা মেহেদী চারাগাছও কিনবো। টবে করে ছাদে লাগিয়ে দেবো। ভালো পাতা বের হতে একটু সময় লাগবে বটে; কিন্তু একসময় ঠিক গাছটা আরো বড় আর শক্তপোক্ত হবে। তখন তুই নিয়মিত হাতে মেহেদী লাগাবি। প্রয়োজনে আরও দুই তিনটে গাছ এক্সট্রা লাগিয়ে দেবো। তুই মেহেদী লাগাবি তো?”
” লাগাবো।” মুচকি হাসল তানিশা।

তাহমিদ কিছুক্ষণ পর আমতাআমতা করে বলল, ” আজ একটা সিগারেট খাবো।”
” এখন না। সিগারেট খাওয়ার জন্য গোটা একটা রাত পড়ে আছে। নে, এই সিগারেটের প্যাকেটটা কোথাও লুকিয়ে রাখ। কেউ যাতে দেখতে না পায়।”

তাহমিদ সিগারেটের প্যাকেটটা ওয়ারড্রবে লুকিয়ে রেখে আবার বিছানায় বসল। তানিশা বলল, ” এখন আমায় একটু মানহার সাথে কথা বলিয়ে দে। ফোন কোথায় তোর?”
তাহমিদ চোখ-মুখ শক্ত করে কর্কশ গলায় বলল, ” তামাশা করছিস?”
” তামাশা করব কেন? তুই না বলতি, ও রাতে ফোন দিতো।”
“ও দিতো; আমি তো দিতাম না।”
“এখন দেয় না?”
“না।”
“শেষ কবে দিয়েছিল?”
“মনে নেই।”
“বল বলছি।” ধমক দিলো তানিশা।
“বললাম তো মনে নেই।”
“বলবি না তো।” আগের থেকেও কঠিন করে বলল তানিশা।
তাহমিদ ফুস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “যেদিন থেকে তোকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি; সেদিন থেকেই ও আর ফোন দেয় না। ও বলতে, ‘009’ আরকি।”

তানিশা বিছানা থেকে নেমে সাহসা অনুজ্জ্বল মুখ করে জিজ্ঞেস করল, “একটা কথা বলব।”
” কী?”
” আমার না কেন জানি মানহার উপর খুব রাগ হচ্ছে। সাধারণত একটা বিষয়। তবুও খুব রাগ হচ্ছে আমার। তুই যদি ওকে চুমুটা না দিতি, তাহলে খুব ভালো হতো। তোর উপরও খুব রাগ হচ্ছে।”

তাহমিদ নিশ্চুপ দৃষ্টিতে তানিশার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিছানা থেকে নেমে ঘরের লাইটটা অফ করে দিলো। মুহূর্তের মধ্যেই পুরো ঘরটা ঘুটঘুটে আঁধারে ছেয়ে গেল। শুকনো গলায় ঢোক গিলল তানিশা। কোনো শব্দ নেই। ঘরের সবকিছু একদম চুপচাপ। বাইরে থেকে ছেলে-মেয়ের হাসির শব্দ তানিশার কানে ভেসে এলো ; উচ্চ হাসির শব্দ। আবার থেমে গেল। অনেকটা সময় আলোর মধ্যে থাকার পর হঠাৎ অন্ধকারে কিচ্ছুটি দেখতে পেলো না তানিশা। জিব দিয়ে ঠোঁট দু’টো ভিজিয়ে নিলো। এক হাতে শক্ত করে শাড়ির আঁচল মুঠি করে ধরল। নিম্নস্বরে শুধু একবার বলল, ” তাহমিদ।”
কোনো শব্দ এলো না। ঘরের জানালা আটকানো; পর্দা টানা, বাতি বন্ধ। তানিশার চোখে পুরো জগৎটাই যেন অন্ধকারছন্ন হয়ে গেছে। হঠাৎ তাহমিদের শরীরের উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে শিউরে উঠল তানিশা। শরীর জুরে কাঁটার মতো করে শিহরণ বয়ে গেল। তাহমিদের দুই হাত তাঁর কোমর জড়িয়ে আছে। ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে তাঁর চোখে-মুখে। অন্ধকারের মধ্যেও তানিশা চোখ দু’টো বন্ধ করে ফেলল। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আবারও ‘ তাহমিদ’ বলে ডাকার আগেই তাহমিদ কঠোর উত্তপ্ততায় তাঁকে শব্দহীন করে দিলো!

৩৯.
সজল দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে বলল, ” দেখেছ আসমা, আমি বলেছিলাম না খুব শীঘ্রই তোমাকে আমার কাছে আসতে হবে।”
আসমা দুই হাত বুকের নিচে জড়ো করে নড়েচড়ে দাঁড়ালো। হেসে বলল, ” হুম, বলেছিলেন তো।”
” আমি কিন্তু আগেই জানতাম তুমি নিজেই আমার কাছে আসবে। আসতে বাধ্য হবে। বাধ্য হয়েছ না?”
” হয়েছি।” মিটমিট করে হাসল আসমা।
দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে তাকালো মাথার উপরে থাকা চাঁদের দিকে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে