– ১৬তম পর্ব।
রিফাত হোসেন।
৩৫.
তোমার প্রেমে আসক্ত হয়ে আমি আজ খোদার তৈরি রিহ্যাবে ভর্তি!
ডেস্কে বসে আকাশ-কুমুস ভাবছিল তাহমিদ। অনেকদিক পর আজ অফিসে এসেছে; নিজের ডেস্কে বসেছে। মনে হচ্ছে কয়ক যুগ অফিস থেকে দূরে ছিল! অফিস আর সে, আলাদা দু’টো প্রান্তে ছিল।
” স্যার, ম্যাডাম আপনাকে ডাকছেন।” সিনিয়র রিপোর্টার তাহমিদের সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ এইরকম একটা বাক্য বলে উঠল।
ভড়কে গেল তাহমিদ! সিনিয়র রিপোর্টার তাকে ‘স্যার’ বলছেন, ব্যাপারটা যে মোটেও সুবিধাজনক না, তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারল তাহমিদ। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। অবাম হওয়ার রেশটা কেটে গেলেও সে অবাক কণ্ঠে বলল, “স্যার, আপনি ভুল করে আমায় স্যার ডেকে ফেলেছেন। আমি আপনার জুনিয়র।”
” হ্যাঁ হ্যাঁ জানি।” সাংঘাতিক বিরক্তি প্রকাশ করল লোকটা। আবার বলল, ” সাথে এটাও জানি, খুব শীঘ্রই আপনি আমার সিনিয়র হতে যাচ্ছেন। তাছাড়া বসের খুব কাছের মানুষদের সাধারণত আমরা স্যার বলেই ডাকি।”
লোকটার কথা শুনে তাহমিদের মনে হলো, কথাগুলো উনি একেবারেই বলতে চাচ্ছেন না। কেউ যেন জোর করে বলাচ্ছে; কোমরে পিস্তল ঠেকিয়ে। তাহমিদ কিছুটা গম্ভীর গলায় বলল, ” স্যার, আপনি উল্টো পাল্টা বলছেন৷ জরুরি কিছু বলার হলে বলুন। আমার কাজ আছে।”
” বললাম না ম্যাডাম আপনাকে ডাকছে। সহকারী সম্পাদক ম্যাডাম। চিনতে পেরেছেন নিশ্চয়ই।” এবারও বিরক্তির স্বরে বলল কথাটা।
তাহমিদ আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ডেস্ক ছেড়ে ওঠে দাঁড়াল। লোকটার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে সামনে থেকে চলে গেল।
তানিশার রুমে যেতেই তাহমিদ প্রথমে বলল, ” তুই কি ওই লোকটাকে কিছু বলেছিস? আমার সিনিয়র রিপোর্টারকে।”
” কেন, স্যার বলেছে নাকি?”
” হ্যাঁ। আচ্ছা তুই বল, উনি আমায় স্যার বলল কেন? আমি কোন এঙ্গেলে উনার স্যার?”
” আর বলিস না; আমি উনাকে বললাম তাহমিদকে ডাকতে। উনি বলল, ‘ওই ব্যাটা খুব ফাঁকিবাজ। এখন একটু কাঁজ করছে, করতে দিন ম্যাডাম।’ উনার কথা শুনেই আমার মাথা গরম হয়ে গেল৷ তাই বলেছি, তোকে যেন আজ থেকে স্যার বলে ডাকে। এটাও বলেছি, খুব শীঘ্রই আমাদের বিয়ে হতে চলেছে।”
” এত সহজে বলে দিলি তুই?”
” হ্যাঁ। এবার থেকে তোর সাথে ভালো ব্যবহার করবে সারাক্ষণ।”
” তাই বলে সরাসরি বিয়ে।”
” হ্যাঁ। যা সত্যি, তাই বলেছি।”
” আচ্ছা ঠিক আছে। আগে আমার একটা কথা শোন।” প্রসঙ্গ পাল্টাল তাহমিদ। বলল, ” শুনবি তো?”
” শুনবো। বল তুই।” অতি আগ্রহী হয়ে তাহমিদের দিকে তাকালো তানিশা।
তাহমিদ বলল, সবটা। তৃষ্ণার হাবভাব, আর ওই চিঠি প্রসংশে। । সবটা শোনার পর তানিশা আরও আগ্রহী হয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আরে বাহ্। কই, চিঠিটা দেখি তো আমি।”
তাহমিদ শার্টের পকেটে হাত দিলো। কিন্তু পেলো না সকালে রাখা সেই আধভেজা কাগজটা। মন খারাপ হলো৷ বিমর্ষ মুখ করে তাকালো তানিশার দিকে। তানিশা জিজ্ঞেস করল, ” চিঠিটা কি নেই?”
” না। বোধহয় গোসল করার সময় যে শার্টটা ধুয়ে দিছি, সেটার ভেতরে আছে।”
” একেই ভেজা ছিল। তাঁর উপর শার্টের পকেটে রেখে, শার্টের সাথে ওটাও ধুয়েছিস। বুঝতে পারছিদ, চিঠির অবস্থাটা কেমন হয়েছে?” হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ল তানিশা।
তাহমিদও আহত কণ্ঠে বলল, ” হুম। বুঝছে পারছি। আমিও পড়তে পারিনি ওটা।”
” একটুও পড়িসনি?”
” শুধু ‘ প্রিয় রূপবতী’ কথাটা পড়েছিলাম। যা পড়েই বুঝেছি, ওই চিঠিটা তৃষ্ণাকে পাঠিয়েছে কেউ। ভেবেছিলাম কিছুদিন পর ওকে দিয়ে ও দেবো। কিন্তু সেটা আর হলো না।”
তানিশা হঠাৎ মুহূর্তটা স্বাভাবিক কররে ভারী ভাব কাটিয়ে বলল, “এই কথা এখন বাদ দে। আমার কথা শোন। কাল বিকেলে আমাদের বাড়িতে তোদের সবাইকে দাওয়াত।”
” হঠাৎ দাওয়াত দিচ্ছিস যে? বিয়েশাদি করছিস নাকি? ছেলে কি কাল দেখতে আসছে?”
” জানি না। তুই সবাইকে নিয়ে আসবি কি-না বল। ভাবীকে আমি আগেই বলেছি। তোকেও বললাম। তোরা চারজনই আসবি। কাল শুক্রবার। সুতরাং কোনো অসুবিধে নেই।”
” আসতে পারি, যদি একটা সিগারেট খাওয়াস। তোর বেডরুমে গিয়ে খাবো। যাতে কেউ টের না পায়।” কিছুক্ষণ ভেবে এই শর্ত দিলো তাহমিদ।
তানিশার ভ্রু জোড়া উঁচু হয়ে গেল। হবু জামাই নাকি শ্বশুর বাড়ি গিয়ে সিগারট খাবে! যে হবু বউকে দেখতে যাবে, তাকেই বলছে, একটা সিগারেট খাওয়াতে হবে। এইরকম আবদার কেউ করে? এইরকম আবদার মেনে নেওয়া সম্ভব না।
কিছুক্ষণ ভাবার পর এই অসম্ভব টাকেই সম্ভব করল তানিশা। তাহমিদকে ভড়কে দেওয়ার জন্য এইরকম শর্তে রাজি হওয়াই যাই। কাল হঠাৎ চমকে দেবে তাহমিদকে। তাহমিদ অবাক হয়ে দেখবে তানিশাকে! এইরকম মুহূর্তটার জন্য সব করা যায়। আর এ তো সামান্য একটা সিগারেট। তানিশা হেসে বলল, ” বেশ। তুই আমার বেডরুমে বসেই সিগারেট খাস। আমি ব্যবস্থা করে দেবো।”
” বসে না। দাঁড়িয়ে খাবো। জানালা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ব। যে দেখবে, তাঁর সৌভাগ্য ভালো।”
তানিশা কিছু বলল না। এখন কথা না বাড়ানোই ভালো। শেষে দেখা গেল, আরও দুই একটা শর্ত হাজির করেছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ” যা নিজের ডেস্কে যা। কাজ কর।”
তানিশার ওখান থেকে বেরিয়ে নিজের ডেস্কে গেল তাহমিদ। সিনিয়র রিপোর্টারের সাথে একবার চোখাচোখি হলেও কথা হলো না।
৩৬.
তাহমিদের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছে। সেদিন সবাইকে নিয়ে তাহমিদ গিয়েছিল তানিশাদের বাড়ি। বেশ স্বাভাবিক সে। আগে থেকে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি, আজ তাঁর বিয়ের তারিখ ঠিক করা হবে। খাওয়াদাওয়া শেষে যখন তুহিন আর ফাতেমা, তানিশার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলছিল, তখন তানিশা, তাহমিদের সাথে কথা বলতে বলতে নিজের ঘরের দিকে চলে গিয়েছিল। দরজা আটকিয়ে তাহমিদকে অবাক করে দিয়ে তানিশা একটা প্যাকেট থেকে, একটা সিগারেট বের করে তাহমিদের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাহমিদ ভীষণ অবাক! ওই প্রস্তাবটা যে তানিশা সিরিয়াস ভাবে নিবে, তা ভাবতে পারেনি সে। তানিশার হাত থেকে সিগারেট নিয়ে মুখে দিয়েছিল। এরপর দেশলাই দিয়ে সিগারেটে আগুন দিয়েছিল। বেশ আরাম করেই জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সিগারেট টেনে যাচ্ছিল। হঠাৎ তানিশা তাঁর একটা হাত ধরে। তাহমিদ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকায় তানিশার দিকে। তানিশা মৃদু হেসে বলে, ” আজকে আমাদের জীবনের স্মরণীয় একটি দিন?”
” কেন?” বেশ অবাক হয়ে জানতে চাইলো তাহমিদ।
তানিশা মুচকি হেসে বলল, ” কারণ আজ আমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হচ্ছে।”
তাহমিদ ভ্রু জোড়া উঁচু করে জানতে চাইলো, ” আমাকে আগে বলিসনি কেন?”
” তোকে চমকে দিবো বলে।”
” তোর কী ধারণা, আমি এই কথা শুনে খুব চমকে গেছি?” মিটমিট করে হেসে কথাটা বলল তাহমিদ। আবারও আস্তে করে সিগারেটের ধোঁয়া নিজের মধ্যে নিয়ে নিলো।
তানিশা বোকাসোকা ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ” চমকে যাসনি তুই?”
” না।” মাথা ঝাঁকালো তাহমিদ। আবার বলল, ” আমি তো আগেই অনুমান করেছিলাম। এরপর তোর বাবাকে ফোন করেছিলাম। সে তো গড়গড় করে বলে দিলো আসল কাহিনী।”
বাবার কথা মনে করে দাঁত কিড়মিড় করল তানিশা। কিছুক্ষণ সেভাবে থেকে তাহমিদের বুকে মাথা রেখে ওকে জড়িয়ে ধরল। তাহমিদ, তানিশাকে জড়িয়ে ধরে আলতো করে কপালে চুমু দিয়ে বলল, ” কখনো ভাবিনি আমি এভাবে তোর সাথে জড়িয়ে যাবো। মানহাকে হারানোর পর তো আমার জীবনের সব স্বপ্ন, ইচ্ছা, আকাঙ্খা, সবকিছু ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আচমকা তোকে ভালোবেসে ফেললাম। নিজেকে এবং প্রিয়জনদের গুরুত্ব দিতে থাকলাম। যে ভালোবাসা নামক অনুভূতিটা হারিয়ে ফেলেছিলাম, সেটা আবার ফিরে পেলাম। তুই দেখিস, আমাদের সংসারটা খুব সুন্দর হবে। আমি, তুই, বড় ভাই, ভাবী, আর তুলি, আমরা সবাই একসাথে খুব ভালো থাকবো।”
তাহমিদের বুক থেকে মাথা তুলে, হাতটা শক্ত করে চেপে ওকে আশ্বস্ত করল তানিশা।
আরও কিছুটা সময় ওখানে কাটিয়ে নিচে চলে এলো।
খুব তাড়াতাড়িই দু’জনের বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। সব কথাবার্তা শেষ হওয়ার পর সবাই চলে সে।
৩৭.
তাহমিদের বিয়ের খুব বেশি দেরি নেই। ফাতেমাকে এখনো সত্যিটা জানাতে পারল না তুহিন। চাকরির কথাটাও জানাতে পারেনি। সকালে বের হয়, এরপর এদিক-ওদিক ঘুরে, দুপুরে রাশেদের সাথে দেখা করে। আবার বিকেলেও ওরা দেখা করে। এরপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঠিক সময়ে বাড়িতে চলে আসে।
প্রতিদিনের মতো আজও বাড়িতে এলো তুহিন। রাতের খাবার শেষ করে ঘরে গেল। কিছুক্ষণ পর ফাতেমাও ঘরে এলো। দরজা আটকিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ল তুহিনের পাশে৷ তুহিন চুপচাপ থাকল কিছুক্ষণ। হঠাৎ সে অনুভব করল, ফাতেমা কাঁদছে। কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তুহিন চমকে ওঠে ফাতেমার দিকে তাকালো। ফাতেমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে ফাতেমা? কাঁদছ কেন তুমি?”
ফাতেমা কান্না থামালো না। নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল সে। চোখ থেকে অনবরত অশ্রু ঝড়তে লাগল। তুহিন হাত দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিলো। কিন্তু আটকে রাখতে পারল না। বাধছাড়া হয়ে আবার ফাতেমার চোখ থেকে জল পড়তে লাগল। তুহিনের দৃষ্টিতে নির্বাকতা, ভয়, শঙ্কা। ফাতেমার মুখের উপর তুহিনের কৌতূহলী মুখটা। ফাতেমা ডুকরে কেঁদে উঠল। বলল, ” কেন করলেন এমনটা?”
হতভম্ব চোখে শুধু তাকিয়েই রইল তুহিন। বুঝতে পারল না, ফাতেমা কী বলতে চাচ্ছে। তবে ভীষণ ভয় পাচ্ছে তুহিন। আগের মতোই কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইল ফাতেমার দিকে।
তুহিনকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে ফাতেমা আবার বলল, ” একটা কথা বলব?”
তুহিন মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলো।।গলা শুকিয়ে আসছে তাঁর। শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। কেউ যেন গলা টিপে ধরেছে। বুক ঢিপঢিপ করছে। শিরদাঁড়া সোজা করতে পারছে না।
ফাতেমা বলল, ” আজ বাড়িতে একটা মেয়ে এসেছিল; আপনার গালফ্রেন্ড। দেখতে খুব সুন্দর; আমার থেকে অনেক বেশি। অবশ্য আমি একটুও সুন্দরী নই। আমার সাথে উনার তুলনা হয় না।” ম্লান হাসল ফাতেমা।
তুহিনের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। যে শঙ্কা অনুমান করছিল, সেটাই হলো। শেষমেশ আর নিজে থেকে কিছু বলা হলো না। ফাতেমাকে অন্যরকম লাগছে আজ। খুব রহস্যমতী