সম্পৃক্ততা – ১৫তম পর্ব।
রিফাত হোসেন।
তাহমিদ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, ” ভিতরে আয়। আজ তোর ক্লাস নেই?”
” আছে ভাইয়া।” ভিতরে আসতে আসতে মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিলো তৃষ্ণা।
মেঝেতে বসে পড়ল তৃষ্ণা। শেষ কবে যে বিছানায় বসেছিল, তা মনে পড়ছে না। তাহমিদও এখন মেঝেতে বসবে; তৃষ্ণার সামনে। অনেকটা ধ্যানে বসার মতো করে; গম্ভীরমুখে। হাতদুটো রাখবে দুই পায়ের উপর। এরপর অভিজ্ঞ গলায় জিজ্ঞেস করবে, ‘বল কী সমস্যা?’
তাহমিদ বিছানায় বসল। ভারী আশ্চর্য হলো তৃষ্ণা! সে ঘরে এসেছে, অথচ তাহমিদ বিছানাতে বসেছে; এইরকম কিছু দেখা আর রাজার মাটি কাটার দৃশ্য দেখা একই ব্যাপার! আরও একটা জিনিস উপলব্ধি করা গেল; তাহমিদ প্রতিদিনের মতো আজ গম্ভীরমুখে কিছু জিজ্ঞেস করল না। আজ সে বিছানার উপর বসে একগাল হেসে বলল, ” কী ব্যাপার তুলি? এত সকালে আমার ঘরে যে। কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?”
তাহমিদকে রহস্যময় দেখাচ্ছে আজ। তৃষ্ণাও কিছুটা রহস্যময় ভাব নিয়ে বলল, ” তোমার কী মনে হচ্ছে?”
” তোকে আজ মুমূর্ষু জাতির মতো লাগছে। মুখটা ভীষণ মলিন। শরীরে যেন প্রাণ নেই।” মৃদু হেসে জবাব দিলো তাহমিদ।
কথাটা একদম মিথ্যা। তৃষ্ণাকে আজ ভীষণ উল্লাসী দেখাচ্ছে। এত উজ্জীবিত মুখে তৃষ্ণাকে সচরাচর দেখা যায় না। যখন তাঁর পরিক্ষার রেজাল্ট খুব ভালো হয়, তখনও এতটা খুশি হয় না সে। আজ যেন শুধু হাসিখুশি না, আরও বিশেষ কিছু ফুটে উঠেছে তৃষ্ণার মধ্যে। তৃষ্ণার নাক লাল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। গাল দু’টোর রংও পরিবর্তন হচ্ছে আস্তে আস্তে। এর কারণ তাহমিদ জানে। মানহাকে যেদিন প্রথম সে প্রপোজ করেছিল, সেদিন মানহার অবস্থা ঠিক এমন হয়েছিল। মিটমিটিয়ে হাসি, ঠোঁটের কোণের হাসির সাথে যেন গাল দু’টোও হাসছে। খুব ছটফট করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। তানিশাকে প্রপোজ করার সময় এতকিছু দেখার সুযোগ হয়নি। তখন অন্ধকার ছিল চারিকটা। আজ তৃষ্ণাকে ঠিক সেরকম লাগছে। তাছাড়া, এ বাড়িতে রূপবতী বলতে তৃষ্ণা একাই আছে। সে ভীষণ সুন্দরী। সারাক্ষণ সাজুগুজু করে নিজেকে উজ্জীবিত করে রাখে। চিঠিটা নিশ্চয়ই তৃষ্ণাকে কেউ পাঠিয়েছে। ভুল করে এই ঘরের বারান্দায় দিয়ে গেছে। তাহমিদ ভাবল, ছেলেটা খুব বোকা। তবে খুব ভদ্র। আগে থেকে কোনোরকম খোঁজখবর নিয়ে আসেনি; এটা করে বোকার পরিচয় দিয়েছে ছেলেটা। আর বাড়িঘর সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য বখাটেদের মতো বাড়ির নিচে ঘুরঘুর করেনি; এতে ভদ্রতার পরিচয় দিয়েছে।
তাহমিদ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ” তুলি, তোর কি বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে?”
তৃষ্ণা উত্তর দিলো না। তাহমিদ এইরকম অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা তাঁর সাথে বলে না। বিশেষ করে এই ঘরে। সে চুপচাপ মানুষ। প্রয়োজনীয় কথাগুলো শুধু যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেবে। এছাড়া সে অন্যদের ব্যাপারে নাক গলায় না খুব একটা। তৃষ্ণা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ” ভাইয়া, আজকের সকালটা কি তোমার কাছে অন্যরকম লাগছে?”
তাহমিদ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, ” হ্যাঁ, কারণ আজ বৃষ্টি নেমেছে। অনেকদিন পর আজ বৃষ্টি নামল।”
” আমি এই ভিন্নতার কথা বলিনি। মানে, অন্যরকম একটা ফিলিংস আরকি।”
বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলল, ” তোকেও আজ অন্যরকম লাগছে।”
” তাই নাকি? কেমন লাগছে আমায়?” তৃষ্ণাকে খুব আগ্রহী দেখালো।
তাহমিদ অসহায় গলায় বলল, ” খুব বিষণ্ণ লাগছে। মনে হচ্ছে খুব কষ্টে আছিস।”
তৃষ্ণা কপাল কুঁচকে রাগী কণ্ঠে বলল, ” এটা তোমার ভুল ধারণা। আমি আজকেই সবচেয়ে বেশি খুশি। এইরকম আনন্দ আমার আগে কখনোই হয়নি।”
” কখনোই না?”
” না।” তৃষ্ণার কণ্ঠে উত্তেজনার আভাস পাওয়া গেল।
তাহমিদ আর কিছু বলল না। সত্যিই আজ তৃষ্ণাকে খুব আনন্দিত দেখাচ্ছে। অনেকদিন অনাহারে থাকার পর যখন একটি প্রাণী তৃষ্ণা মেটানোর সুযোগ পায়, তখন তাঁর খুব আনন্দ হয়। ক্ষণিকের জন্য হলেও পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ভাবে নিজেকে। তৃষ্ণাকে এই মুহূর্তে ঠিক ওই প্রাণীটার মতো লাগছে। আচমকাই যেন ও প্রেমের স্পর্শ পেয়েছে, এই ভেবে হাসল তাহমিদ।
তৃষ্ণা বলল, ” ভাইয়া, একটা প্রশ্ন করব?
” কর।” আগ্রহী হয়ে জানতে চাইল তাহমিদ।
“উত্তর কিন্তু এখনি দিতে হবে।”
” এখনি?”
” হ্যাঁ, এখুনি মানে এক্ষুনি।”
“উত্তরটা যদি তোর পছন্দ না হয়?”
” না হলে নাই। তবুও আমি এক্ষুনি উত্তর চাই।”
” ওকে। প্রশ্ন কর।”
একটু নড়েচড়ে বসে, এদিক-ওদিক উঁকি মারল তৃষ্ণা। এরপর তাহমিদের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলতে লাগল, ” কেউ যদি হঠাৎ করে তোমায় রূপবতী বলে সম্মোধন করে, তাহলে তোমার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে?”
” এইরকম হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।” সোজাসাপটা উত্তর দিলো তাহমিদ।
” কেন নেই?” আবারও নড়েচড়ে বসল তৃষ্ণা।
” কারণ আমি রূপবতী নই। রূপবতী হয় সুন্দরী মেয়েরা। আর সুন্দর ছেলেরা হয় রূপবান।”
” ওহ্। আচ্ছা, তাহলে বলো; কেউ যদি আমায় হঠাৎ করে রূপবতী বলে বসে, তাহলে আমি কী ভেবে নিবো সে আমায় পছন্দ করে?”
তাহমিদ মনেমনে কী যেন ভাবল। এরপর জিজ্ঞেস করল, ” সে কি বড়লোক?”
” না।”
” তাহলে ভেবে নে, ছেলেটা তোকে পছন্দ করে; এবং ভালোবাসে। মধ্যবিত্তরা অকারণে কাউকে রূপবতী বলে না। অকারণে মেয়েদের রূপবতী বলা বড়লোকদের কাজ। এরা মেয়েদের শুধুমাত্র ইমপ্রেস করার জন্যই রূপবতী বলে। আরও অনেক কিছু বলে মেয়েদের প্রসংশা করে। কিন্তু মধ্যবিত্তরা এতকিছু করতে পারে না। এরা যাকে চট করে ভালোবেসে ফেলে, শুধুমাত্রই তাকেই খুশি করার জন্য এই ধরনের কথাবার্তা বলে।”
তৃষ্ণা কিছু না বলে মুচকি হাসি দিলো। এই হাসির অর্থ তাহমিদের জানা। সে অভিজ্ঞ লোক। দু’টো মেয়ের সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক হয়ে গেছে৷ প্রেমে পড়লে মেয়েদের হাবভাব কেমন হয়, তা তাহমিদ জানে। তাহমিদ আবারও বলল, ” আরও একটা ব্যাপার আছে। বড়লোকরা কারোর প্রেমে পড়লে কখনো চিঠি দেয় না। তাঁদের আরও অনেক পদ্ধতি জানা আছে। মধ্যবিত্তরা চিঠির উপর খুব ভরসা করে।”
তাহমিদের কথা শুনে তৃষ্ণার গলা শুকিয়ে গেল। সে আবারও ঢোক গিলে তাহমিদের হাতের দিকে তাকালো। নিজের হাতের দিকেও তাকালো একবার। জামার দিকে তাকালো৷ চোখে-মুখেও হাত দিলো। ভুল করে যদি কোথাও চিঠিটা শরীরের সাথে এঁটে যায়, তাহলে ভ্যাজাল আছে!
তৃষ্ণা ওঠে চলে যেতে তাচ্ছিল; তাহমিদ নিচে নেমে খপ করে ওর হাতটা ধরে ফেলল। তৃষ্ণা ভয়ে ভয়ে বলল, ” ও ভাইয়া, প্লিজ ছেড়ে দাও।”
তাহমিদ হেসে বলল, ” ছাড়ব, আগে বল কাহিনীটা কী?”
” কোনো কাহিনি নেই। আমার এক বান্ধবী এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছিল। ও তো জানে তুমি অনেক জ্ঞানী মানুষ। পৃথিবীতে এমন কোনো প্রশ্নের উত্তর নেই, যা তোমার অজানা।”
” তারপর..।”
” তারপর আরকি? ওর প্রশ্নগুলোর উত্তর-ই আমি জেনে নিলাম তোমার থেকে। আর কিছু না।”
” এটা সত্যি না।”
” সত্যি এটা।” কাঁদোকাঁদো ভাবে বলল তৃষ্ণা। এই বুঝি ভাইয়া সব ধরে ফেলল, এই ভেবে ওর চোখ ভিজে আসছে। তাহমিদ কিছু বলার আগে ও আবার বলল, ” আমাকে ইউনিভার্সিটি যেতে হবে। ছাড়ো প্লিজ।”
” আজ তো বৃষ্টি হচ্ছে, আজ ইউনিভার্সিটি যাবি?” অবাক হয়ে জানতে চাইল তাহমিদ।
” হ্যাঁ যাবো। যেতে আমাকে হবেই। খুব গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে আজ।” ঢিপঢিপ চোখ করে বলল তৃষ্ণা।
তাহমিদ বলল, ” শুধু কী ক্লাসই আছে?”
” হ্যাঁ। আর কী থাকবে? তাছাড়া ওকে তো উত্তরটা জানাতে হবে।”
” ও কি আসবে আজ?”
” হয়তো আসবে।” মুখটা ভাবান্তর করে জবাব দিলো তৃষ্ণা।
তাহমিদ হাতটা ছেড়ে দিতেই দৌড়ে ঘর থেকে চলে গেল সে। তাহমিদ পকেট থেকে ভেজা চিঠিটা বের করে সেই ‘প্রিয় রূপবতী’ লেখাটার দিকে তাকালো। হেসে বলল, ” আমার অভিজ্ঞতা বলছে, প্রেমে পড়লে মানুষ ঘূর্ণিঝড়কে অগ্রাহ্য করে; আর এ তো সাধারণ বৃষ্টি।” কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে আবার বলল, ” আমার অভিজ্ঞতা আরও বলছে, প্রেমে পড়লে মানুষ সহজেই অনেক মিথ্যে কথা বলতে পারে। আবার সহজেই ধরা খেয়ে যায়।”
কাগজটা এখন আর খুলল না তাহমিদ। শার্টের পকেটে রেখে তোয়ালে হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে গেল।
৩৩.
ফাতেমার শরীর ভেজা। বৃষ্টিতে ভেজার লোভ সামলাতে পারেনি সে। তাই একদফা আকামটা করেই এসেছে। সাথে আরও একটা জিনিস নিয়ে এসেছে; বুকভরা ভয়! কী সুন্দর করেই না বৃষ্টিতে ভিজছিল! ছাদে জমে ছিল পানি। সেই পানির উপর আবারও বৃষ্টির টুপটাপ ফোঁটা পড়ছিল। অদ্ভুত এক শব্দ তৈরি হচ্ছিল। যে জায়গাটায় ফোঁটা পড়ছিল, ক্ষণিকের জন্য সেই জায়গাটায় অন্যরকম একটা দৃশ্য তৈরি হচ্ছিল। যেন কেউ হাত ডুবিয়ে জায়গাটুকু নিচু করে দিচ্ছে। ফাতেমা মুগ্ধ হয়ে দেখছিল, শুনছিল, আর উল্লাসে লাফিয়ে উঠছিল। অদ্ভুত ভাবে তাঁর লাফানো থেকেও একটা শব্দ তৈরি হচ্ছিল। সেটা শুনতে যেন আরও অদ্ভুত ছিল! ফাতেমা মনোযোগ দিয়ে নিজেকে আনন্দিত করছিল। ছাদের নিচের ঘরে যারা ছিল, তাঁরা নিশ্চয়ই খুব গালাগাল করেছে নিজেদের মনেমনে। ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতে পারেনি। এর মধ্যে একটা অপ্রত্যাশিত কাণ্ড ঘটে যায়! আচমকা বজ্রপাত হয়। বজ্রপাত যে সবসময় হঠাৎ করে হয়, তা না। মাঝে মাঝে জানান দেয় আগে; ঘুম ঘুম আওয়াজ করে। আজকে এই আওয়াজ করেনি মেঘ। ফলে সর্বনাশ হয়ে গেছে! বজ্রপাতের শব্দ শুধু ফাতেমার কানকেই আঘাত করেনি; তাঁর ঝলকানিতে ফাতেমার হৃদপিণ্ড সোজা হয়ে গেছিল। মনে হচ্ছিল, চোখের সামনে সবকিছুতে আগুন ধরে যাচ্ছে; শরীরেও। ফাতেমা ভয়ে দুই কান চেপে ধরেছিল। চিৎকার করে কেঁদে দিয়েছিল। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়েছিল। লাভ হয়নি; বৃষ্টির জলে সেই চোখের জল কারোর নজরে আসেনি। অবশ্য সেসময় কেউ ছিল না সেখানে। ফাতেমার মনে হচ্ছিল, ও জ্ঞান হারাবে। হাঁত-পা কাঁপছিল। দৌড়ে নিচে আসতে পারছিল না। সিড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নিজের ঘরে এসেছে।
ভেজা শরীর নিয়ে ঘুরে ঢুকতেই ফাতেমা লক্ষ্য করল, তুহিন ঘুমোচ্ছে; হাত-পা ছড়িয়ে একেবারে মূর্তির মতো করে। ফাতেমা, তাকে একপলক দেখেই ওয়াশরুমে গেল।
তুহিন ঘুমিয়ে ছিল না। উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল শুধু। এখন সোজা হয়ে শুলো। তাঁর চোখে নিদ্রা নেই। চাকরিটা চলে গেছে। সেই অফিসের বন্ধু সব জেনে গেছে। সেদিন অফিসে হঠাৎ করেই সে বলে উঠেছিল, ‘আমার সংসারটা না ভাঙলেও পারতে।’ কথাটা শুনে তুহিনের বুকটা দ্রিম করে উঠেছিল। হতভম্ব তুহিন শুধু বেশ কিছুটা সময় তাকিয়েই ছিল বন্ধুর বিমর্ষ মুখখানার দিকে। কী অসহায়, কী শান্ত দেখাচ্ছিল তাকে! শুধু চোখের কোণে ছলছলে জল ছিল ; উঁহু, জল নয়, ওটা ছিল ঘৃণার উপস্থিতি!
ওখানে আর থাকতে পারেনি তুহিন। কাউকে কিছু না বলেই অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নেয়। পরেরদিনও অফিসে যায় না সে। অফিস থেকে তাকে মেইল করা হয়। সে জবাব দেয় না। ফোন করলে রিসিভ করে না। বরিশাল থেকে ফিরে যখন ঢাকার বাড়িতে এসেছে, তখনই দরজার বাইরে চিঠি দেখতে পায়। খামের উপর অফিসের লোগো দেখেই সে স্পষ্ট হয়ে যায়, কী লেখা থাকতে পারে এখানে। কায়দা করে চিঠিটা লুকিয়ে ফেলে সে। এরপর দরজা খুলে ভিতরে চলে যায়। সবাই ছিল খুব ক্লান্ত; তাই কিছু দেখেনি। তুহিন সেদিনই উপলব্ধি করতে পারে, তাঁর চাকরিটা আর নেই। ভালোই হয়েছে; সারাক্ষণ অপরাধীর মতো থেকে কাজ করা যায় না। কিন্তু ফাতেমা; সে বাড়িতে ফাতেমা আছে। তাকে কীভাবে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব? তুহিন তো অনেক চেষ্টা করেও ফাতেমাকে সবকিছু বলতে পারছে না। বারবার মনে হচ্ছে, সংসারটা ভেঙে যাবে। তাঁর ছোট বোন তাকে যে সম্মান করতো, তা আর করবে না। ঘৃণার নজরে তাকাবে। ছোট ভাইয়ের কাছেই বা মুখ দেখাবে কীভাবে?
ফাতেমা ওয়াশরুম থেকে বের হলো। পরণে শুকনো কাপড়। ছাদে যাওয়ার আগেই কাপড়টা ওয়াশরুমে রেখে গিয়েছিল। তাঁর পুরো শরীর কাঁপছে এখন। খুব ভয় পেয়ে গেছে। সে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো। আস্তে আস্তে বিছানার উপর বসে ভারী কণ্ঠে বলল, “আপনি আজ এত দেরি করে উঠেছেন কেন? আগে তো নিজে থেকেই আমার রান্না শেষ হওয়ার আগে উঠে যেতেন।”
” আজ অফিস যাবো না, ফাতেমা।” দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়ল তুহিন।
ফাতেমা অবাক কণ্ঠে বলল, ” কেন যাবেন না?”
” পরে বলব। আগে বলো, তুমি এত কাঁপছ কেন? শীত করছে নাকি?”
ফাতেমা ইতস্ততভাবে নিজের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা বলল তুহিনকে। যা শুনে হাসির রোল পড়ে গেল তুহিনের মধ্যে; যেন এর থেকে হাস্যকর ঘটনা সে জীবনেও শুনেনি। তাঁর জীবনে হাস্যকর সব ঘটনার মধ্যে ফাতেমার এই অভিজ্ঞতার ঘটনাটা অন্যতম।
ফাতেমা অভিমানী চোখ করে তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ” আপনি জানেন, কেন একজন স্ত্রী তাঁর স্বামীর সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে চায় না?”
” স্ত্রী, স্বামীর সাথে ভিজতে চায় না, এ-কথা তোমায় কে বলেছে?” তুহিন হাসি থামিয়ে দিলো।
” আমি বলছি। এবং এটাই সত্যি। আপনি, আপনার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করে দেখবেন, তাঁদের স্ত্রী, তাঁদের কখনো বলেছে কি-না, চলো আজ দু’জনে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজি।”
” অবশ্যই ভিজেছে। সবাই কী আমাকে বলে বেড়াবে? এইসব তাঁদের খুব একান্ত এবং স্পেশাল মুহূর্ত।”
” না, ভিজেনি। আমি নিশ্চিত ভিজেনি। কারণ এই দিক দিয়ে কোনো মেয়েই তাঁর স্বামীর উপর ভরসা করতে পারে না। আমি অন্তত একেবারেই পারি না।” ফাতেমা গাঢ় জোর দিয়ে কথাটা বলল।
তুহিন তো অবাক! একটা মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে; বৃষ্টির জলে তাঁর শরীরের প্রতিটি অঙ্গ স্পষ্ট ফুটে উঠবে; সেটা তাঁরই স্বামী দেখবে; এখানে ভরসা না করার কী আছে? বরং পরপুরুষ কিংবা মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড হলে আরও সমস্যা; উল্টো পাল্টা কিছু করে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। এই জায়গায় স্বামী থাকলে সমস্যা নেই। সে দেখুক, যা করার করুক, অসুবিধের তো কিছু নেই। কিন্তু বয়ফ্রেন্ড; ইন্না-লিল্লাহ!
তুহিন চোখ মুখ কুঁচকে বলল, ” তাহলে কার উপর ভরসা করা যায়?”
” বয়ফ্রেন্ড এর উপর!”
চোখ পাকিয়ে তাকালো তুহিন। কিছু বলল না। ফাতেমা আবার নিজেই বলল, ” আপনার জায়গায় আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড থাকলে কী করতো জানেন, আমার ভয় কাটানোর চেষ্টা করতো। যদিও আমি এইরকম ঘটনার সম্মুখীন আগে কখনো হইনি। এতটা কাছ থেকে কখনো বজ্রপাত হতে দেখিনি। তবুও বলছি, কোনো মেয়ে তাঁর স্বামীর সামনে, বৃষ্টিতে ভিজতে চায় না। কারণ সে জানে, তাকে ভয় পেতে দেখলে তাঁর স্বামী মজা নিবে। আরও ভয় পাইয়ে দেওয়ার মতো কাণ্ড নিজেও করবে। বয়ফ্রেন্ড থাকলে কিন্তু এই কাজটা করবে না; সে নিজের গালফ্রেন্ডকে আরও আগলে রাখলে। আহ্লাদী করবে, যাতে মেয়েটা ভয় না পায়, সেজন্য হাত ধরে থাকবে। আরও অনেক কিছু করবে। এবার আপনিই ভেবে দেখুন, স্বামী আর বয়ফ্রেন্ড এর মধ্যে কত পার্থক্য। বয়ফ্রেন্ড চাইবে, তাঁর ভালোবাসার মানুষটা যাতে ভয় না পায়; আর স্বামী চাইবে, তাঁর স্ত্রী যেন আরও ভয় পায়! যাতে সে মন খুলে হাসতে পারে। আমার ভয় পাওয়া দেখে আপনি আজ যে কাণ্ডটা করলেন, আপনি নিশ্চিত থাকুন, আগামী ১০০ বছর যদি বেঁচে থাকি আমরা, তাহলেও আমি আপনাকে বলব না, চলুন বৃষ্টিতে ভিজি।”
তুহিন কাচুমাচু মুখ করে জিজ্ঞেস করল, “বয়ফ্রেন্ড আর স্বামীর পার্থক্য নিয়ে তুমি কি পড়াশোনা করেছ? তোমার কাছে কি এই বিষয়ের ডিগ্রি আছে? মানে, এতকিছু কীভাবে জানো তুমি?”
” না নেই। আপনি তো এতদূর পড়তে দিলেন না আমায়। নিজের টাকায় অনার্স করিয়েছেন বলে দিনরাত হুমকি দিয়েছেন; বলেছেন, এত টাকা খরচ করে পড়াচ্ছি, ভালো রেজাল্ট না হলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবো। সব টাকা উশুল করব। বলেননি? অবশ্যই বলেছেন। স্কুলে পড়ার সময় আমার বাবা-ও আমায় এইরকম ভাবে বলেননি। আপনি যদি আমায় পিএইচডি পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ দিতেন, তাহলে আমি এই বিষয়েই পড়তাম।”
তুহিনের ফোনটা বেজে উঠল। তুহিন ফোন ধরার আগেই ফাতেমা ফোন নিয়ে নিলো। স্ক্রিনে রাশেদ নাম দেখে রিসিভ করে বলল, ” আসসালামু আলাইকুম রাশেদ ভাইয়া। কেমন আছেন?”
রাশেদ হেসে বলল, ” আমি ভালো আছি ভাবী৷ আপনি কেমন আছেন?”
” আমি ভালো আছি। আপনার স্ত্রী কী পাশে আছে?”
” হ্যাঁ আছে। কথা বলবে?”
” দিন।”
রাশেদের স্ত্রীর পাশেই ছিল। ফোনটা হাতে নিয়ে কানে ধরে বলল, “কী খবর ফাতেমা?”
” ভালো। ভাবী, একটা কথা বলুন; আপনি কী আজ ভাইয়ার সাথে বৃষ্টিতে ভিজেছেন?”
” না।”
” কেন ভিজেননি? আপনি না বলেছিলেন, বৃষ্টি আপনার খুব পছন্দ।” কথাটা বলে কলটা লাউড স্পিকার দিলো ফাতেমা।
” বলেছিলাম বটে। কিন্তু এখন আর সেই শখ নেই। আগে ছিল; যখন ক্যাম্পাসে পড়তাম। তোমার ভাইয়ার সাথে তো আমার বিয়ের আগেও সম্পর্ক ছিল। সে ছিল অন্য ইউনিভার্সিটির সিনিয়র। আমি তাকে ফোন দিয়ে আমার ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে আসতাম। সে বৃষ্টিতে ভিজে আসতো৷ আমরা হাত ধরে পুরো ইউনিভার্সিটি চক্কর দিতাম। বজ্রপাতের শব্দ হলে আমাকে জড়িয়ে ধরতো। ভয় পেলে আগলে রাখতো। জানো, বিয়ের আগের দিনই ও আমায় বলেছিল, ‘বিয়ের পর আমরা রাতভর জ্যোৎস্না দেখব। বৃষ্টিতে ভিজবো।’ অদ্ভুতভাবে বাসর রাতেই বৃষ্টি হলো। আমি ওকে বললাম, চলো ছাদে যাই। ও গেল না, বলে, লজ্জা করে। বেশ, আমি আর সেদিন কিছু বললাম না। এর কয়েকদিন পর আবার বৃষ্টি হলো; বিকেলবেলা। সেদিন ও বাড়িতেই ছিল। আমি আবার ওকে বললাম, চলো যাই। ও গেল বটে, তবে ছাদ পর্যন্ত না। সিড়িতে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি দুই হাত উড়িয়ে দিয়ে একাই ভিজছিলাম। আমি হঠাৎ পিচ্ছিল খেয়ে পড়ে গেলাম ছাদে। ভাবলাম, ও এদিকে এসে আমায় ধরবে। ওমা! দেখছি ও হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে আমার ছবি তুলল, ভিডিও করল। আমি যে পড়ে আছি, সেদিকে ওর খেয়াল নেই। এরপর তো ওই ছবি, ভিডিও দিয়ে আমাকে খুব ক্ষেপিয়েছে। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, বিয়ে না করলেই ভালো হতো। আর মাঝরাতে খোলা স্থানে বসে গল্প করার কথ বললে ও বলে, ঘুম পাচ্ছে।।”
ফাতেমা দ্রুত গলায় বলল, ” ভাবী, আমি একটু পরই আবার ফোন দিচ্ছি। এখন রাখছি।”
ফোন পাশে রেখে ফাতেমা, তুহিনের দিকে তাকিয়ে গৌরবের গলায় বলল, ” আমার কথা মিলল তো। এই দেশের প্রতিটি নারীর কাছে এই বাস্তব গল্পটা শুনতে পাবেন। দুই একজন ব্যতিক্রমী স্বামী পায়, তবে ক্ষণস্থায়ী ভাবে। বিয়ের রেশ যতদিন শরীরে থাকে আরকি। তারপর বলবে, বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসবে। ঠাণ্ডা লাগবে। স্বামী জিনিসটা যে কী, তা আমার জানা হয়ে গেছে।”
তুহিন এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ফাতেমার কথা শুনছিল, ওর কাণ্ড দেখছিল। এবার বড় করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ” তুমি কী চাচ্ছ, এখন আমি তোমায় নিয়ে ছাদে যাই। তারপর তোমাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজি।”
” একেবারেই তা চাচ্ছি না।” খানিক লজ্জা পেলো ফাতেমা।
” তাহলে কী চাচ্ছ, আমি এখন তোমায় জড়িয়ে ধরি। তোমার এই কাঁপুনি থামিয়ে দেই।”
আবার লজ্জা পেলো ফাতেমা। কিছু বলার আগেই তুহিন তাঁর হাত ধরে টান দিয়ে। তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে, কাঁথাটা মাথায় উপর দিয়ে টেনে দিলো। কাঁথার ভেতরটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। দু’টো মুখ, মুখোমুখি হয়ে আবছায়া অন্ধকারে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল।
তুহিন, ফাতেমাকে জাপটে ধরে বলল, ” এবার ঠিক আছে তো। আমাকে নিয়ে তোমার কত অভিযোগ। এবার সব অভিযোগ, সব অপূর্ণতা পূরণ করব।”
ফাতেমা অবিশ্বাসের গলায় বলল, ” আপনাকে খুব অদ্ভুত লাগছে কিছুদিন ধরে। আপনি বরিশাল যাওয়ার পর থেকেই অদ্ভুত আচরণ করছেন। আগে আপনি কথা খুব কম বলতেন। আমাকে তো সময়ই দিতেন না। অথচ এখন সারাক্ষণ আমার সাথে কথা বলছেন। আপনার কাছে আসাতে আমার মধ্যে যত সংকোচ ছিল, এখন তা নেই। বিশ্বাস করুন, ইচ্ছে করছে সারাক্ষণ আপনার বুকের উপর শুয়ে থাকতে।”
তুহিন কোনো উত্তর দিতে পারল না। শুধু ফাতেমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সে নিজেও বুঝতে পারছে না, ফাতেমাকে ভালোবাসে এতটা কাছে টেনে নিচ্ছে, না নিজের দোষটাকে হালকা করার জন্য।
ফাতেমাও দীর্ঘক্ষণ পর বলল, ” অফিস যাবেন না?”
” না।” নিম্নস্বরে বলল তুহিন।
ফাতেমা জিজ্ঞেস করল, ” কেন?”
” কারণ, আমার চাকরিটা আর নেই।”
কথাটা শুনে ফাতেমার শরীর কেঁপে উঠল। বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করে উঠল। তুহিন কিছু বলল না। খানিকক্ষণ পর ফাতেমা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল” আবোলতাবোল কী বলছেন এইসব? উঠুন বলছি। ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি খারাব দিচ্ছি। তাহমিদ আর তৃষ্ণাকে ডাকতে হবে৷”
তুহিন ছেড়ে দিলো ফাতেমাকে। ফাতেমা বিছানা থেকে নেমে মৃদু হেসে বলল, ” এভাবে কেউ মজা করে। আমি তো হার্ট অ্যাটাক করব এটা সত্যি হলে। আমাদের এই সংসারটা চলে আপনার চাকরির বেতনে। হায় আল্লাহ! এইরকম কিছু যেন কখনোই না হয়।”
তুহিন তবুও কিছু বলল না। ফাতেমা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেও ওঠে দাঁড়াল।
৩৪.
সকাল ১০ টা। বৃষ্টি ভাব কেটে গিয়ে এখন খটখটে রোদে ঝলমল করছে চারিদিক। তৃষ্ণা আর অনিক পাশাপাশি হাঁটছে। অনেক খোঁজ করার পর অনিকের দেখা পেলো তৃষ্ণা। অনিকের সামনে গিয়ে বলল, ” তোমার দুঃসাহস দেখে তো আমি অবাক!”
অনিক মাথা নিচু করে হাঁটছিল। তৃষ্ণার কথা শুনে মাথা কিছুটা তুলে হেসে বলল, ” পছন্দ হয়েছে আমার দুঃসাহস? যাক, আমার একটা কিছু অন্তত তোমার পছন্দ হয়েছে। তুমি তো আমার সব কিছুকেই অপছন্দ করো।”
তৃষ্ণা রাগী গলায় বলল, ” এটাও অপছন্দ করি। এইরকম দুঃসাহস দেখাতে নেই।
” আমার গান শুনে সবাই প্রসংশা করে, আর তুমি বলো, ‘এইরকম প্যানপ্যানানি গায়ক আমাদের বাড়ির নিচে সারাক্ষণ দুই একটা পড়ে থাকে। তাই ভাবলাম, ওই দুই একটাকে সঙ্গ দিয়ে আসি। এখানে দুঃসাহস-এর কিছুই নেই।”
তৃষ্ণা হেসে উঠল খিলখিল করে। অনিক, তৃষ্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ” তোমার হাসিটা খুব সুন্দর। আমার মনের তৃষ্ণা মিটিয়ে দেয়।” কথাটা বলে হাসল অনিক।
তৃষ্ণা কপট উগ্র গলায় বলল, “আর তোমার হাসিটা খুব বিচ্ছিরি।”
অনিকের মুখটা মলিন হলো না। এইরকম কথা তাকে প্রায়ই শুনতে হয়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে অনিক জিজ্ঞেস করল, ” এতদিন আসোনি কেন?”
” ভাবীর বাবা-মায়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ভাবীর বোনের বিয়ে ছিল।”
” ওহ্। আমি তোমায় খুঁজছিলাম।”
” কেন খুঁজছিলে?”
” এমনি।” বিমর্ষ মুখ করে তাকালো অনিক।
” চিঠিতে ‘প্রিয় রূপবতী’ লিখেছিলে কেন?” অনেকক্ষণ পরে আসল কথাটা ইতস্ততভাবে জিজ্ঞেস করল তৃষ্ণা। আড়চোখে একবার অনিকের প্রতিক্রিয়া দেখে মাথা নিচু করে ফেলল।
অনিক লাজুক ভঙ্গিতে বলল, ” যা সত্যি, তাই লিখেছি।”
“আমি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, একটা ছেলে কেন একটা মেয়েকে রূপবতী বলে? ভাইয়া বলেছে, ছেলেটা যদি মধ্যবিত্ত হয়, তাহলে বিশেষ কারণে, অর্থাৎ মেয়েটাকে পছন্দ করে এবং ভালোবেসে রূপবতী বলে। আর বড়লোকেরা কোনো কারণ ছাড়াই মেয়েদের রূপবতী বলে। কথাটা কি ঠিক?”
” হ্যাঁ।” লাজুক ভঙ্গিতে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল অনিক।
তৃষ্ণার রাগ হলো। ‘ হ্যাঁ’ মানে কী? সরাসরি বললেই তো হয়। মচকানো পা নিয়ে রাত-বিরেতে একতলা টপকিয়ে দু’তলায় গিয়ে চিঠি দিয়ে আসতে পারে, অথচ সরাসরি কিছু বলতে পারে না। এইরকম ছেলের সাথে প্রেম করা খুব রিস্ক। দেখা গেল, বিয়ের সময় বাড়িতে বলতেও পারবে না।
তৃষ্ণা মুখটা কঠিন করে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল, ” ভেবেছিলাম তুমি আজ আসবে না ক্যাম্পাসে।”
” তোমার জন্যই এলাম। নাহলে আসতাম না।”
” তুমি কি খুব লজ্জা পাচ্ছ?”
” খুব বেশি না; একটু একটু।”
” তাহলে মাথা নিচু করে হাঁটছ কেন? যারা খুব বেশি লজ্জা পায়, তাঁরাই লজ্জায় মেয়েদের দিকে তাকাতে পারে না।”
অনিক একবার পিছনে তাকালো। আবার সামনে তাকিয়ে হেসে বলল, ” আমার খুব বেশি লজ্জা নেই। আমি সাহসী ছেলে। তোমার দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকার মতো সাহস আমার আছে।”
তৃষ্ণা মুখ চেপে হাসি আটকিয়ে বলল, ” যারা সারাক্ষণ মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে, তাঁদের বেয়াহা বলা হয়।”
অনিক চুপসে গেল। কাতর কণ্ঠে বলল, ” আমি কি বেহায়া?”
” এটা তোমার আগামী মুহূর্তের কর্মকাণ্ডের উপর ডিপেন্ড করবে। তুমি যদি বেহায়ার মতো আমার দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকো, তাহলে তো আমাকে প্রতিক্রিয়া দেখাতেই হবে।”
” তুমি কি জানো আমি নিচের দিকে তাকিয়ে আছি কেন?” প্রসঙ্গ পাল্টাল অনিক।
“না। তুমি যেহেতু খুব একটা লজ্জা পাচ্ছ না। তাহলে নিশ্চয়ই অন্য কোনো কারণ আছে।” দুই হাত কচলিয়ে হেসে জবাব দিলো তৃষ্ণা।
অনিক বলল, ” পায়ে এখনো ব্যথ আছে। তাই নিচের দিকে তাকিয়ে সাবধানে হাঁটছি। তুমি, আমার প্রতি এতটাই অমনোযোগী যে, আমার হাঁটার গতির দিকে লক্ষ্য করছ না। আমি যে খুব সাবধানে পা ফেলছি, সেটাও দেখছ না।”
তৃষ্ণা লজ্জা পেলো। লজ্জায় নিজেও মাথা নিচু করে কাঁচুমাচু মুখ করে হাঁটতে লাগল। অনিক, তৃষ্ণার লজ্জামাখা মুখটা দেখে সহজভাবে বলল, ” ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। ডাক্তার কী বলেছে শুনবে?”
” কী?” তৃষ্ণার কণ্ঠে জড়তা প্রকাশ পেলো। কিছুটা বিষণ্ণ মুখ করে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল।
অনিক বলল, ” ডাক্তার বলেছে, ক্যাম্পাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটার সাথে কিছুক্ষণ হাঁটলেই পা ঠিক হয়ে যাবে। তোমার চেয়ে সুন্দরী কেউ আমার নজরে আসেনি এখনো।”
নিজের প্রসংশা শুনে আপ্লুত হলো তৃষ্ণা। হেসে বলল, “তুমি কি আমায় পটানোর চেষ্টা করছ?”
মাথা তুলে অনিক বলল, ” তুমি কি একটুও পটেছ?”
“না।”
” তাহলে ভেবে নাও, আমি তোমায় পটানোর চেষ্টা করছি না। সেই চেষ্টা করলে এতক্ষণে তুমি পটে যেতে।”
খিলখিল করে হেসে উঠল তৃষ্ণা। অনিক আবারও মুগ্ধ চোখে তৃষ্ণার হাসির দিকে তাকিয়ে রইল।
হাঁটতে হাঁটতে ক্লাসের কাছাকাছি চলে এলো দু’জনে।
একটা ক্লাস করে আবার বেরিয়ে এলো দু’জনে। হাঁটতে হাঁটতে স্ট্যাণ্ডের দিকে যেতে লাগল। হঠাৎ অনিক বলল, ” তৃষ্ণা, চিঠি দু’টোই পেয়েছ তো?”
তৃষ্ণা কপাল কুঁচকে বলল, ” দু’টো মানে? আমি তো একটাই পেয়েছি; যেটা আমার ঘরের বারান্দায় ছিল।”
” আমি দুই ঘরে দু’টো দিয়েছি। বারান্দায় রেখে চলে এসেছি।”
তৃষ্ণার বুকটা ধুক্ করে উঠল। ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ” কোন দু’টো ঘরে রেখে এসেছে?”
” আমি যতটুকু জেনেছি, দু’তায় তোমাদের তিনটে ঘর।”
” মাঝেরটাতে রেখেছ নাকি? ওটা কিন্তু বড় ভাইয়ার ঘর।”
অনিক একগাল হেসে বলল, ” আমি জানতাম ওটা তোমার বড় ভাইয়ের ঘর। অভিভাবকরা সবসময় মাঝে থাকে। তোমার বড় ভাই তো তোমাদের অভিভাবক। তাই সহজেই বুঝে গেছি। তোমার আরেক ভাই একটু অন্যরকম। আমি কয়েকবার দেখেছি তাকে। তাঁর বন্ধুরা সবাই খুব হাসাহাসি করে। কিন্তু তিনি চুপচাপ শুনে। প্রয়োজন হলে কথা বলে। বারান্দায় যায় হলো সৌখিন মানুষরা। তোমার ভাই হলো রোবটের মতো। ঘুম থেকে ওঠে অফিস যায়; অফিস শেষ একটু বন্ধুদের সাথে দেখা করে, এরপর বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে৷ দূর থেকে দেখে আমার অন্তত এইরকমই হয়েছে। তাই নিশ্চিন্তে দু’টো বারান্দায় চিঠি রেখেছি।
তৃষ্ণা মাথায় হাত দিয়ে বলল, ” হায় আল্লাহ! এতকিছু জেনেছ, অথচ এটা জানোনি আমি কোন ঘরে থাকি?”
” জানার প্রয়োজন হয়নি। অন্যের সাহায্যে শুধু জেনেছি, ওই বিল্ডিংয়ের দু’তলায় তোমরা থাকো। গতকাল তো কোনোরকম প্ল্যান ছাড়াই চলে গেছিলাম। তাই কারোর কাছে জিজ্ঞেসও করতে পারিনি।”
” তাহমিদ ভাই যদি চিঠিটা দেখে ফেলে, তাহলে কী হবে ভেবে দেখেছ একবার?”
অনিক অগ্রাহ্যের স্বরে বলল, ” আরে কিছুই হবে না। এইসব উনি বুঝবেনই না।”
অনিকের হাতে একটা থাপ্পড় মারল তৃষ্ণা। দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ” তুমি ভাইয়ার সম্পর্কে কিছুই জানো না। ও যে কী জিনিস, তা শুধু আমিই জানি। তুমি থাকো, আমি গেলাম। গিয়ে দেখি চিঠিটা আছে কি-না।” কথাটা বলে হাঁটা দিল তৃষ্ণা।
অনিক বলল, ” আরে থামো। এত তাড়াহুড়োর কী আছে? সে তো এখন অফিসে; সেই সন্ধ্যায় আসবে। এখনো দুপুরই হলো না ঠিকমতো। তোমার ভাবী কি ওই ঘরে যায়?”
” ভাইয়া থাকার সময় কিছু বলতে, বা কোনো কাজে যায়। এছাড়া অপ্রোয়জনে যায় না।”
” তাহলে রিল্যাক্সে বাড়িতে যাও।”
তৃষ্ণা রিল্যাক্স হতে পারল না। তবে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল। তাঁর মধ্যে ভয়ঙ্কর চিন্তার ছাপ ফুটে এসেছে। সকালে তাহমিদ খুব রহস্য করে কথা বলছিল। তাকে দেখে মনে হয়েছিল, অনেককিছু জানে। চিঠি প্রসঙ্গে কিছু একটা বলেছিল আবার।
তৃষ্ণার বুক কাঁপছে; মন কাঁপছে; হাত-পা, পুরো শরীরই কাঁপছে। মাথা যেন বনবন করে ঘুরছে।