সম্পৃক্ততা – চতুর্দশ পর্ব।
রিফাত হোসেন।
৩২.
দেখা হবে মুগ্ধকর এক সকালে —
দেখা হবে তপ্ত দুপুরের সোনালী রোদ্দুরে।
দেখা হবে পশ্চিমে ডুব দেওয়া সূর্যের ক্লান্ত বিকেলে —
দেখা হবে গোধূলির আলোমাখা আকাশপটের নিচে।
দেখা হবে কাকভেজা জ্যোৎস্নার রাতে —
দেখা হবে নক্ষত্রভরা আকাশের ছায়াতলে; মধ্যরাতের উঠোনে।
“কবে আপনার সাথে আমার দেখা হবে মাস্টার সাহেব?” আসমা কাতর কণ্ঠে সজলকে বলল কথাটা।
সজল ঘুমোচ্ছিল। এখন ভীষণ ভোর! স্বভাবত এত ভোরে সজলের ঘুম ভাঙে না। আজ ভেঙেছে। সেটাও অপরিচিত একটা মানুষের জন্য। মানুষটা যে একটা মেয়ে, তা কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পেরেছে সজল। স্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর! সুরেলা গলায় কিছু একটা বলেছে। আধঘুমো সজল কথাটা শুনতে পায়নি। বিচ্ছিরি কণ্ঠের কেউ হলে, এতক্ষণে ফোন কেটে দিতো। কিন্তু এই মেয়ের কণ্ঠে সুন্দর। গান গাইলে অল্পতেই বেশ নাম করতে পারবে। এর সাথে কথা বলাই যায়।
ঘুমন্ত কণ্ঠে সজল আস্তে করে মেয়েটির কণ্ঠের প্রসংশা করল, ” বাহ্! আপনার কণ্ঠস্বর খুব সুন্দর। এই ভোরবেলা মনকে শান্ত করে দিলো।”
অবাক হলো আসমা। সজল এভাবে কখনো তাঁর কণ্ঠের প্রসংশা করেনি। করেছে মুচকি হাসির প্রসংশা ; লজ্জামাখা মুখের প্রসংশা; বুকের ভিতরের অদৃশ্য কম্পনের প্রসংশা! এই প্রথম যেন সজল তাঁর কণ্ঠের প্রসংশা করল। সজল মাস্টার নিজের মধ্যে আছে তো, এটা ভেবেই আসমা আবার বলল, ” আপনি শুধুই আমার কণ্ঠ শুনেছেন, কথাটা শুনেননি নিশ্চয়ই?”
” না, শুনিনি। আগের কথাটা আর শোনার প্রয়োজনবোধ করছি না। যে মেয়ের কণ্ঠ এত সুন্দর, সে নিশ্চয়ই খারাপ কিছু বলবে না।”
আসমা হাসল। সাথে এটাও বুঝল, সজল মাস্টারের ঘুম এখনো কাটেনি। এমনটা আগেও বেশ কয়েকবার হয়েছে। তবে প্রতিবারই ছিল আসমার পরিচিত নম্বরের ফোনকল। কিন্তু আজ সে অপরিচিত নম্বর দিয়ে সজলকে ফোন দিয়েছে। তাই সজল একেবারেই উল্টো পাল্টা বলছে। আসমা নিঃশব্দে ফিক করে হেসে বলল, ” শুধুই কি কণ্ঠ সুন্দর? না আরও কিছু সুন্দর আছে।”
” আপনিও খুব সুন্দর।”
” আমায় দেখেছেন আপনি?”
” না। অনুমান করলাম। আমার অনুমানশক্তি খুব প্রখর। যে মানুষটার সুর এত মধুর, সে দেখতেও নিশ্চয়ই মধুর হবে।”
” দেখবেন আমায়?” মুচকি হেসে জানতে চাইল আসমা।
সজল দ্রুত কণ্ঠে বলল, “অবশ্যই। আপনার মতো সুন্দরী একজন মানুষকে যে দেখতেই হবে। আপনার মধ্যে এমন কিছু আছে, যা অন্য কারোর মধ্যেই নেই।” কথাটা বলে ‘হাই’ তুলল সজল।
আসমা একটু কৌতূহলী কণ্ঠে বলল, ” তা কী আছে আমার মধ্যে?”
” স্পেশাল কিছু আছে। যা আমাকে প্রেমে পড়তে উৎসাহিত করছে।”
” কার প্রেমে? আমার!” কপালে সুক্ষ্ম ভাজ করল আসমা।
সজল চোখ মেলল না ভালো করে। উত্তরও দিলো না। আসমা আবার বলল, ” কণ্ঠস্বরের সাথে কি প্রেমের কোনো যোগসূত্র আছে?”
” আছে। একজন মানুষ এমনি এমনি কারোর প্রেমে পড়ে না। অন্তত একটা বিশেষ কারণ থাকে। এই যেমন আপনার কণ্ঠ শুনে আমি, আপনার প্রেমে পড়ে গেছি। এটাও কিন্তু বিশেষ একটা কারণ; আমার কাছে।”
” মাস্টার সাহেব, আমি আসমা।” কিছুটা দরাজ কণ্ঠে বলল আসমা। অপরিচিত একজনকে লোকটা এইরকম কথা বলতে পারলো? এত খারাপ! কান্না পেয়ে গেল আসমার। সজল কিছু বলার আগেই আবার বলল, ” আমি এখন কথা বলতে পারছি না। রাখছি।” ফোনটা কেটে দিলো আসমা।
সজল লাফ দিয়ে উঠল বিছানা থেকে। এক মুহূর্তের জন্য ফোন স্ক্রিনে তাকিয়ে ওয়াশরুমে দৌড় দিলো।
কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলো। হাতে তুলে নিলো একটা তোয়ালে। মন এখন কিছুটা ফ্রেশ লাগছে। খুব বড় ভুল হয়ে গেছে। নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনা হলো। আসমা নিশ্চয়ই খুব অভিমান করেছে। সজল জানালার পর্দা সরালো। জানালা খোলাই আছে। তাই পর্দাটা সরানোর সাথে সাথে চোখ দু’টো কেমন যেন ঝলমল করে উঠল। পূর্বদিকের সূর্য কুসুম রঙের হতে শুরু করেছে মাত্র। এখনো কিছুটা আড়ালে আছে। চারিদিকটা থমথমে; নিস্তব্ধ। সজল জানালার কাছ থেকে বিছানায় এসে ফোনটা হাতে তুলে নিলো। আসমা অপরিচিত একটা নম্বর থেকে ফোন দিয়েছে৷ কারণটা জানা নেই সজলের। কিন্তু এটা জানে, সে নিজের অজান্তেই ভুল করে ফেলেছে। ঘুমের ঘোরে কাকে ভেবে কী বলেছে, তাও স্পষ্ট মনে নেই এখন। তবে আসমার হঠাৎ ফোন কেটে দেওয়া থেকেই স্পষ্ট বুঝা যায়, সে খুব অভিমান করেছে।
সজল আসমার নম্বরে ফোন দিলো। রিং হতে থাকলো; কিন্তু রিসিভ করল না।
আসমা গাল ফুলিয়ে বসে রইল। চোখ দু’টো ছলছল করছে তাঁর। ফোনের রিংটোন বেজে যাচ্ছে ক্রমাগত। প্রেমে পড়লে মানুষের বয়সের বোধগম্য হারিয়ে যায়; তখন সে শুধু প্রেমটাই বুঝে। মান-অভিমান, রাগ, এইসব তো প্রেমের একেকটা অঙ্গ। তাই মানুষ প্রেমে পড়লে, বাচ্চাদের মতো রাগ করে, অবুঝের মতো অভিমান করে। আসমার ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে।
১৫ বারের মতো ফোনকল এলো সজলের নম্বর থেকে। আসমা গননা করেনি; অনুমান করে এটাই মনে হলো। প্রেমিক-প্রেমিকাদের অনুমান আবার মিলে যায় মাঝে মাঝে। আর থাকতে না পেরে ফোন রিসিভ করল আসমা। ফোন কানে ঠেসে ধরে, নিশ্চুপে বসে রইল।
সজল হঠাৎ হেসে বলল, ” আসমা একটা মজার গল্প শুনবে?”
আসমা কোনো উত্তর দিলো না। দাঁতে দাঁত চেপে আগের মতোই চুপচাপ বসে রইল। সজল কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেই বলতে শুরু করল, ” গতকাল বিকেলে আমি যখন অফিস থেকে ফিরেছি, তখন দেখি নুপুর আমার ঘরে এসে ছবি আঁকছে। তোমাকে তো বলেছিলাম ও সারাক্ষণ শুধু ছবিই আঁকে।”
” শুধুমাত্র আপনার ছবি।” হঠাৎ মুখ খুলে কথাটা বলল আসমা। এরপর আবার চুপ হয়ে গেল।
সজল আবার সহজ ভাবে বলতে লাগল, ” এখন অন্যান্য দৃশ্যের ছবিও আঁকে; আমার অনুরোধে। যাই হোক, আসল কাহিনিটা শোনো; আমি এসে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ভবিষ্যতে কী হতে চাও? আর্টিস্ট, না অন্যকিছু। ও ফট করে বলল, ‘আমি ভবিষ্যতে একজন প্রেমিকা হতে চাই। সবাই আমায় প্রেমিকা নামেই চিনবে। গোটা পৃথিবী। বেশ রোমাঞ্চকর হবে ব্যাপারটা। অপরিচিত নম্বর থেকে আমার কাছে ফোন আসবে। আমি প্রথমে তাঁদের কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করব। যদি খুব ভালোলেগে যায়, তাহলে কিছু রোমান্টিক কথাবার্তা বলে পটিয়ে ফেলব। এরপর প্রেম, দেখাসাক্ষাৎ যা হওয়ার হবে।”
গল্পের আগামাথা বুঝতে পারল না আসমা। সে রাগে গজগজ করে বলল, ” এটা কোনো গল্প হলো? এটা বলে আমায় কী বুঝাতে চাইলেন আপনি?”
” দেখো, ব্যাপারটা কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং। মানে, শুধুমাত্র কণ্ঠের উপর নির্ভর করবে, তাকে আমি পটাবো কি-না। আমি গতকাল থেকে এইগুলো ভেবে যাচ্ছি। বিশ্বাস করো, ভোরবেলা আমি এইরকমই একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। ভাবলাম, স্বপ্নে অপরিচিত কোনো নম্বর থেকে মেয়ে ফোন দিয়েছে। আমি ঠিক করলাম, তাঁর কণ্ঠস্বর ভালো হলে পটানো শুরু করব। ওই যে সারারাত যা ভেবেছি, তারই প্রভাব। আমি আধঘুমন্ত অবস্থায় হাত হাতড়িতে ফোন রিসিভ করলাম। ঠিক তাই হলো। একটা মেয়ে কণ্ঠ শোনা গেল। কণ্ঠটা এতই মধুর শুনতে যে, আমি প্রেমে পড়ে গেলাম। সেজন্যই তো স্বপ্ন ভেবে ফোন করা মেয়েটিকে পটানোর জন্য ওই কথাগুলো বলেছি। কে জানতো বলো, ওটা স্বপ্ন না, সত্যি। তুমি আমায় ফোন দিয়েছ। তাছাড়া আগেই তুমি পরিচয় দিলে আমি সতর্ক হয়ে যেতাম।”
“তবুও আমার কণ্ঠ শুনে আপনার চিনে ফেলা উচিত ছিল।”
” বললাম না স্বপ্ন দেখছিলাম। স্বপ্নে তো আমার মধ্যে অপরিচিত নম্বরটাই খেলা করছিল। তাই অতকিছু বুঝতে পারিনি। দোষটা আসলে আমার না।”
” তাহলে কার?”
” স্বপ্নের। নুপুরকেও দোষারোপ করা যায়।”
আসমা ফিক করে হেসে দিলো এবার। সজল শুনল আসমার হাসি৷ অনুভব করল। অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে একপলক দেখেও নিলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেও মুচকি হাসল। কিছুক্ষণ নীরব থাকলো দু’জনেই।
১ মিনিট পর হঠাৎ সজল নিজেই বলে উঠল, ” আরও একটা স্বপ্ন দেখেছি। তবে সেটা মাঝরাতে।”
আসমা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে বলল, ” হি হি হি, এটাও সত্যি হবে না। শুনেছি ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে তা হয়নি। অপরিচিত নম্বর থেকে আপনি আমার ফোন পেয়েছেন। যেখানে ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়নি, সেখানে মাঝরাতের স্বপ্ন সত্যি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।”
” হতেও পারে।”
” হবে না।” দৃঢ় কণ্ঠস্বর আসমার।
” আগে তো শোনো মাঝরাতের স্বপ্নটা কী? আমি দেখেছি, তুমি ঢাকায় এসেছ। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছো। হাসছ; খিলখিল করে। আমি বললাম, ‘আসমা তোমার হাসিটা খুব সুন্দর।’ তুমি সাথে সাথে লজ্জায় আমার বুকে মুখ লুকালে।”
আসমার পিলে চমকে উঠল। থতমত চেহারা করে বলল, ” অসম্ভব। বাবা-মাকে ছেড়ে আমি ঢাকায় যাবো না। তাছাড়া ফাতেমা আপুরা চলে গেছে কাল রাতেই। এতক্ষণে ঢাকা পৌঁছে গেছে। বাবা আমাকে একা যেতেই দেবে না।”
” তবুও তুমি আসবে। খুব শীঘ্রই। আমার এই স্বপ্ন সত্যি হবেই।”
” আচ্ছা ঠিক আছে। সে পরে দেখা যাবে। এখন বলুন, আপনি কেমন আছেন?”
” আছি ভালোই। নিজেকে কেমন যেন খাটি প্রবাসী মনে হচ্ছে।
” খাটি প্রবাসী!” অবাক হলো আসমা।
” হ্যাঁ। যদিও এখানে আমার মামা-মামী আছে, মামাতো বোন আছে। এদের সাথে আমি অনেকটা সময় থেকেছি। তবুও নিজেকে প্রবাসী মনে হচ্ছে।
হেসে উঠল আসমা। কিছুক্ষণ আগেও এই মানুষটার উপর খুব রাগ ছিল, অভিমান ছিল। এখন তা ভালোবাসায় পরিনত হয়েছে। সম্পর্কগুলো এমনই। সবকিছুর মিশ্রণেই তো একটা পরিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আসমা জানতে চাইল, ” আপনার তো অফিস আছে। নিশ্চয়ই এত ভোরে জাগিয়ে দিয়ে ঠিক কাজ করিনি। আরও একটু পরে উঠতেন আপনি।”
” অবশ্যই ঠিক কাজ করেছ। খুব সকালে বিছানা ত্যাগ করার মধ্যে একটা আলাদা ব্যাপার আছে। আচ্ছা, আমায় এটা বলো, আজ হঠাৎ অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন দিলে কেন?”
” এমনি। মাঝে মাঝে অপরিচিত হয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে। একটা নতুনত্বের ব্যাপার থাকে।” কথাটা বলে বিছানা থেকে নেমে গেল আসমা।
সজল বলল, ” বাহ্, আজ মনে হচ্ছে একটু বেশিই খুশি।”
” তা অবশ্য ঠিক। সেজন্যই সক্কাল সক্কাল ফোন দিলাম। যদিও মাঝে একটু ব্যাঘাত ঘটেছিল। তবে এখন সব ঠিক। ইচ্ছে করছে পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে। পুরো আকাশ নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসতে।” কথাটা বলে দরজা খুলে দুয়ারে এসে দাঁড়ালো আসমা। বসন্তের প্রকৃতির সুবাস মনকে ভরিয়ে দিয়ে গেল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘঃশ্বাস নিলো।
উৎফুল্লতায় শব্দ করে হাসতে লাগল সজল। আবারও জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো। বলল, ” ঠিক আছে। তুমি পাখির মতো উড়ে বেড়াও। আমি জানালা দিয়ে উঁকি মেরে তোমায় দেখি।”
” উড়ছি তো।” এক হাতে মোবাইলটা কানে ঠেসে ধরে, অন্যহাত মেলে দিলো পাখির ডানার মতো। আবার বলল, ” আপনি আমায় দেখছেন না? আমি তো আপনাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ওই যে আপনি দু’তলায় জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। উৎসুক চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। আপনার পরণে একটা ইয়োলো কালারের টি-শার্ট।”
সজল চমকে ওঠে নিজের দিকে তাকালো। আসমার কথা একদম সত্যি। সে এখন ইয়োলো কালারের টি-শার্ট পরে আছে। এবং জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরের দিকে উঁকি দিচ্ছে। সজল জিজ্ঞেস করল, ” এই দাঁড়াও, দাঁড়াও।”
সজলকে থামিয়ে দিয়ে আসমা বলল, ” দাঁড়াতে পারব না। আকাশ পথে দাঁড়ানো যায় না। আমি এখন শুধুই উড়বো। আর গান শুনবো। আপনিও গান শোনেন।”
..এমন যদি হতো,
আমি পাখির মতো;
উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ’…
সজল ধমকের সুরে বলল, ” চুপ। আগে আমার কথা শোনো। তুমি জানলে কীভাবে আমার শরীরে ইয়োলো কালারের টি-শার্ট? কাকতালীয় ভাবে মিলে গেল নাকি? আচ্ছা বলো তো, আমি কি প্যান্ট পরে আছি?”
” ট্রাউজার পরে আছেন। ইয়োলো কালার টি-শার্ট এর সাথে সাথে ছাই রঙের একটা ট্রাউজার। ঠিক কি না?” মুচকি হেসে উত্তর দিলো আসমা।
সজল তাজ্জব গলায় ‘ঠিক’ বলল।।কিছুক্ষণ ভেবে আবার বলল, ” তুমি জানলে কীভাবে?”
” পাখিরা সব জানে। আকাশে উড়ে বেরিয়ে সব দেখে নেয়। এখন রাখছি মাস্টার সাহেব।” দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে আবার বলল, “আমাকে স্কুলে যেতে হবে আজ। ছুটি শেষ।” কথাটা শেষ করেই টুট করে ফোন কেটে দিলো আসমা। মিটমিট করে হেসে, গতকাল সজলের দেওয়া ছবি দু’টো বের করল মোবাইলে। বলল, ” বোকা মাস্টার। গতকাল ঘুমোনোর আগেই তো আমায় ছবি তুলে দিলেন। এর মধ্যেই ভুলে গেছেন। অপরিচিত মেয়ের ফোনের আশায় এতই বিভোর ছিলেন যে, সব ভুলে গেছেন। হা হা হা।”
ফোনটা বুকে জড়িয়ে পিছনে ঘুরে তাকালো আসমা। দেখল, তাঁর বাবা উঠোনে দাঁড়িয়ে আছেন। দাঁতের সাথে দাঁত খিঁচিয়ে তাকিয়ে আছেন শুধু। আসমা জিবে কামড় দিয়ে এক ছুটে নিজের ঘরে গিয়ে দরজায় খিল দিলো।
৩৩.
ঝুম বৃষ্টি নেমেছে তোমার শহরে —
অথচ আমি অনুভব করছি চোখের কার্ণিশে।
সকাল থেকেই ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। চিন্তিত আর উৎফুল্ল ফাতেমা রান্নাঘর আর বারান্দা ছুটে বেড়াচ্ছে। গতকাল সকালে তাঁরা ঢাকা এসেছে। কালকে দিনের প্রায় অর্ধেক সময়টাই ঘুমিয়েছে বাড়ির সবাই। ঢাকায় আসার পর আজ দ্বিতীয় দিন। বাড়ির দু’জন মানুষ অফিসে যাবে; একজন ইউনিভার্সিটি যাবে। তাঁদের জন্য রান্না করতে হবে। এদিকে আজ অনেকদিন পর বৃষ্টি নেমেছে। হঠাৎ করেই এমন কাণ্ড! মন চাচ্ছে এক ছুটে বাড়িটার ছাদে চলে যেতে। কোমরে আঁচল গুজে মেঘলা আকাশের দিকে চোখের পাতা ডুবিয়ে তাকাতে। টুপটুপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়বে; টসটসে গালে, আদুরে ঠোঁটে, আর চকচকে ললাটে! ক্লান্ত হলেই হাত দু’টো কপালের উপর ছাউনির মতো রাখতে। শীতল আবেশে নিজেকে জড়িয়ে নিতে। চিলেকোঠার ঘরে থাকবে স্পিকার। সেখানে গান বাজবে, আর সে বৃষ্টিতে ভিজে নাচবে —..
” অসময়ি বৃষ্টিতে আমি;
অসময়ি বৃষ্টিতে তুমি!
কিছু না বলা কথা দিলাম ভাসিয়ে—
ধুয়ে যাক না এই মন অভিমানী..”
রান্নাটা আজ খুব ঝামেলার মনে হচ্ছে ফাতেমার কাছে। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর জন্যই বারবার যাচ্ছে বারান্দায়। তুহিন এখনো ঘুমোচ্ছে। তাই অসুবিধে হচ্ছে না। বারান্দা থেকে আবার ছুটে আসছে রান্নার কাছে। বৃষ্টির বেগ বেড়ে যাচ্ছে। রান্না এখনো মাঝের দিকে। ফাতেমা আবারও বারান্দায় গেল। এক হাতে গ্রীল ধরে অন্য হাতটা বাড়িয়ে দিলো বাইরের দিলে। বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিলো হাত। কিন্তু মন ভেজাতো পারল না। অভিমানী ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারও রান্নাঘরে চলে এলো।
আধভেজা চিঠির পাতা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তৃষ্ণা। হঠাৎ করেই ঘরের বারান্দায় চিঠিটার আবির্ভাব ঘটেছে। গতকাল সকালে তাঁরা বাড়িতে এসেছে। দিনটা প্রায় ঘুমিয়েই কাটিয়েছে। তারপর রাত পেরিয়ে আবার সকাল হলো। মেঘের ঘুম ঘুম ডাকে তাঁর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। দ্রুত বিছানা নেমে গেল বারান্দায় গেছে। তখনই দেখল, একটা ভাজ করা কাগজ পড়ে আছে। বৃষ্টি শুরু হলো হঠাৎ করেই। বাতাসের সাথে বৃষ্টি এসে ক্ষণিকের মধ্যেই কাগজটার কিছু অংশ ভিজিয়ে দিয়ে গেল। তৃষ্ণা ঝড়েরবেগে কাগজটা হাতে তুলে ঘরে চলে এলো। ভিতর থেকে উঁকি দিলো বাইরের দিকে। না, সামনের বাড়ির বারান্দায় কেউ নেই। রাস্তাটায় কেউ নেই। রাস্তায় পাশের দোকানটাও বন্ধ।
বিছানায় বসে কাগজটা পড়তে লাগল তৃষ্ণা..
প্রিয় রূপবতী,
তুমি হয়তো জানো আমার ক্ষিধে মাত্রাতিরিক্ত বেশি। যাকে বলে মারাত্মক। আমার অনেক কিছুর ক্ষিধে আছে; যার মধ্যে অন্যতম হলো জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্না খেতে খুব ভালোবাসি আমি। মাঝরাতে ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাই। মনে হয় যেন এক টুকরো জ্যোৎস্না আমার মুখের সামনে চলে এসেছে। আমি খপ করে গিলে ফেলি। ক্ষিধে মিটে যায় আমার। প্রতিদিনের মতো আজকেও আমার ক্ষিধে পেয়েছিল। সেজন্য এক ছুটে বাড়িটার ছাদে গিয়েছিলাম। কত আশা যে ছিল মনে! ছাদে ওঠে দেখি, জ্যোৎস্না নেই। আকাশে চাঁদ-নক্ষত্র, কিছুই নেই। প্রথমে ভাবলাম কুয়াশায় জ্যোৎস্না ঢেকে গেছে। তৎক্ষনাৎ আবার ভাবলাম, শীতের সময় শেষ। এখন আর কুয়াশা আকাশকে ঘিরে ধরে না; মেঘ ধরে। এটা নিশ্চয়ই মেঘের কাজ! ভীষণ রাগ হলো আমার। চুপচাপ অন্ধকার আকাশের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। আচমকা যেন তোমার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল; বিদ্যুতের ঝলকানির মতো করে। মনে হলো, ওই আকাশ আমার সাথে স্বার্থপরতা করলেও তুমি করবে না। তোমার কাছে একটুকরো জ্যোৎস্না চাইলে তুমি অবশ্যই দিবে আমায়। তোমার চাঁদের মতো মুখ যেন স্বচ্ছ কাঁচের মতো ঝকঝকে। চাঁদে কালো দাগ আছে; তোমার মুখে নেই। তোমার হরিণী চোখের চাহনি, চিকোন ঠোঁট জোড়ার আড়ালে থাকা নিষ্পাপ হাসি; সবকিছুই বিদ্যুতের মতো চমকে ওঠে আমার চোখের সামনে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, তোমার কাছে গেলে একটুকরো জ্যোৎস্না পাবোই, পাবো। তোমার দেওয়া জ্যোৎস্না দিয়ে আমি ক্ষিধে মেটাবো। সেজন্য ছুটে আসতে চাচ্ছিলাম তোমার কাছে। সিড়ি দিয়ে নামার সময় হঠাৎ স্লিপ কেটে পড়ে গেলাম নিচে। ভয় পেয়ো না; গুরুতর কিছু হয়নি। সিড়ি থেকে পড়লে আজকাল খুব বেশি কিছু হয় না। বড়জোর হাত-পা ভাঙতো। ভাগ্যের জোরে তবুও বেঁচে গেলাম৷ শুধু পায়ে কিছুটা ব্যথা পেয়েছি। চমকে গেছে বোধহয়। আমি ব্যথায় কাতরে উঠলাম। কেউ শুনতে পায়নি। এদিকে ক্ষিধেতে আমার পেটও কাতরাচ্ছিল। আমি কষ্ট চেপে উঠে দাঁড়ালাম। এরপর পা ল্যাংড়িয়ে তোমার কাছে গেলাম। সরাসরি তোমার কাছে যাওয়ার ক্ষমতা বা সাহস, আমার মধ্যে নেই। ভেবেছিলাম মেঘলা আকাশ দেখার জন্য তুমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি দূর থেকে তোমার দেখবো। তোমার মুখ, তোমার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসি, তোমার চাহনি, আমার কাছে এইসব কিছুই তো একেকটা জ্যোৎস্না। আমি দূর থেকে তোমার দেখতাম। তোমার অজান্তেই জ্যোৎস্না খেয়ে ফেলতাম। সবকিছুর জন্য অনুমতি নিতে নেই। কিন্তু তুমি নেই। আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আজ বোধহয় অনাহারেই থাকতে হবে! কী করি, কী করি ভেবে পকেটে হাত দিলাম। সন্ধ্যায় টিউশনিতে গিয়েছিলাম। পকেটে তখনও কলমটা ছিল। রাস্তাতেই সাদা ঠোংগা পেয়ে গেলাম। হাঁটুর উপর ঠোঙাটা রেখে লিখতে শুরু করলাম। লিখা যেন শেষই হচ্ছে না। কাগজে জায়গা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। তাই আপাতত এখানেই থেমে যেতে হলো। আর শোনো, বড় ভাইকে বলবা, একতলায় বাড়ি ভাড়া নিতে। দু’তলায় ওঠে চিঠি দেওয়া বেশ মুশকিল। হয়তো পড়ে গিয়ে আবার পায়ে ব্যথা পাবো। ক্ষিধের কষ্ট যখন সহ্য করতে পারছি, তখন তোমার জন্য এইটুকু কষ্ট সহ্য করতে পারব। তাই এভাবেই উঠব। ভালো থেকো।
ইতি,
ক্যাম্পাসের নবীন বরণে তোমার সঙ্গীতের সঙ্গী হওয়া ছেলেটি।
শ্বাস আটকিয়ে পুরো চিঠিটা পড়া শেষ করল তৃষ্ণা। কাগজের কোণায় কিছুটা ধুলো লেগে আছে। তৃষ্ণা ফু দিয়ে ধুলো উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু উড়ল না ধুলো। ” চিঠির সাথে সাথে নাহয় ধুলোটুকুও যত্ন করে রেখে দেবো।” এই বলে দ্রুত চিঠিটা বইয়ের ভাজে লুকিয়ে ফেলল। তাঁরপর বিছানা থেকে নেমে তাহমিদের ঘরের দিকে যেতে লাগল।
বৃষ্টির সকাল যে তাহমিদ এতটা ভড়কে যাবে, তা বারান্দায় যাওয়ার আগে বুঝতে পারেনি। নতুন করে প্রেমে পড়েছে সে। এ-সময় একটু-আধটু বৃষ্টি স্পর্শ করতে ইচ্ছে করে। হৃদয়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে প্রেম তরতাজা হয়। কিন্তু বারান্দায় যেতেই হতভম্ব হওয়ার মতো কিছু একটা পেয়ে গেল। একটা সুন্দর ভাজ করা কাগজ। উত্তরমুখী ঘর হওয়ায় বাতাসের সাথে বৃষ্টি ৯০ ডিগ্রি এঙ্গেলে এসে বারান্দা ভিজিয়ে দিচ্ছে। বারান্দার সাথে সাথে কাগজটা ভিজে যাচ্ছে। কাগজটা কীসের, তা দেখার জন্য সে হাতে তুলে নিলো। ভাজ খুলতে গিয়ে কিছুটা ছিড়েও গেল। তবে পুরোটা খোলার আগেই প্রথম লাইনটা স্পষ্ট দেখতে পেলো। প্রথম লাইনে লেখা, ‘প্রিয় রূপবতী’। পুরো ভাজ খোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল তাহমিদ। তাকে যে, কেউ রূপবতী বলবে না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত। এখানে বেশ বড়সড় একটা রহস্য আছে। এ বাড়িতে আহামরি সুন্দরী একজনই আছে।
হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। কাগজের বাকি অংশটুকু না খুলে আবারও ভাজ করে পকেটে রেখে দিলো। এরপর দরজা খুলে দিলো। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তৃষ্ণা। তাহমিদ চোখ বড় করে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলল ‘ প্রিয় রূপবতী’।
হকচকিয়ে উঠল তৃষ্ণা। ঢোক গিলে তাহমিদের হাতের দিকে তাকালো। ‘না, কিছু নেই, এই ভেবে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারল না।