সম্পৃক্ততা – ত্রয়োদশ পর্ব।
রিফাত হোসেন।
আসমা মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে দৌড় দিলো। দরজাটা শুধু ভেজানো ছিল। আসমা দরজা ধাক্কা দিয়ে চট করে ভিতরে ঢুকে গেল। আচমকা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সে। ভীমড়ি খেয়ে চোখ পাকিয়ে তাকালো।
ফাতেমা হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে ওঠে বসল। বাঁকা চোখে একবার বিছানায় শুয়ে থাকা তুহিনের উপর চোখ রাখল, আবার সামনে তাজ্জব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা আসমার দিকে চোখ রাখল। তুহিন এখনো ঘুমোচ্ছে। বাচ্চাদের মতো গুটিশুটি মেরে নয়; একদম হাত-পা ছড়িয়ে। এটা তাঁর পুরোনো অভ্যাস। এর জন্য প্রায়ই ফাতেমাকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। বিশেষ করে তুহিন ঘুমানোর পর যখন ফাতেমা একবার বিছানা ত্যাগ করে, তারপর ততক্ষণ পর্যন্ত বিছানায় ফাতেমার জায়গা হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত তুহিনের হুশ না ফিরে। এমনভাবে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে যে, তাকে সরিয়ে আবার নিজের জন্য একটু জায়গা করে নেওয়া মহা মুশকিল।
বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় ফাতেমার। অন্ধকারে সে অনুভব করে, নিজের অজান্তেই তুহিনের বুকের গভীরে চলে গেছে। যেখান থেকে চাইলেই তাঁর মতো ছোট্ট একটা মানুষ বের হতে পারবে না। বলতে গেলে সে তুহিনের বুকের নিচে চাপা পড়ে গেছে। সুঠাম দেহের অধিকারী তুহিন; চওড়া বুকের নিচ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারছে না ফাতেমা। তাঁর চোখ বেয়ে
অশ্রু ঝড়ছিল তখন। মানুষটা তাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছে যে, হাত-পা নাড়াবার উপায় পর্যন্ত নেই। নিঃশ্বাস যেন আটকে আসছে। অন্ধকারে তুহিনের মুখের দিকে তাকায় ফাতেমা। জানালার পর্দা ভেদ করে জ্যোৎস্নার আলো ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে। ফাতেমায় চোখ জ্যোৎস্নার আলোর সাথে মিলিয়ে যায়। সে আধো আলোয় তাকায় তুহিনের মুখের দিকে। কী সুন্দর দেখাচ্ছিল তুহিনকে! মুগ্ধ হয়ে জ্যোৎস্নার আবছায়া আলোয় তুহিনকে দেখছিল ফাতেমা। কত সুন্দরই-না দেখতে তুহিন! ফাতেমা ভাবে, ‘কে জানতো, ভবিষ্যতে এইরকম সুন্দর একটা মানুষ আমার স্বামী হবে; তাঁর জীবনসঙ্গী হবে!’ শেষ কবে যে এত মনোযোগ দিয়ে তুহিনকে দেখার সুযোগ ফাতেমা পেয়েছিল, তা মনে নেই। স্বামীর কাছে সে লজ্জা রাঙা একজন মেয়ে মানুষ। এখন হঠাৎ করে যদি তুহিন জেগে যায়, তাহলে অপ্রস্তুত হয়ে তাকে মুখ লুকোতে হবে ফাতেমাকে।
ফাতেমার দম বন্ধ হয়ে আসে। সে যখন নড়াচড়া করে নিজেকে ছাড়াতে পারল না, তখন মুচকি হেসেই তুহিনের গালে একটা কামড় বসিয়ে দিলো। তুহিন নড়েচড়ে উঠল। সেই সুযোগে তুহিনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় ফাতেমা। বিছানা থেকেই ওঠে আসে। আস্তে আস্তে সুইচের কাছে গিয়ে বাতি জ্বালায়। স্পষ্ট দেখতে পায় তুহিনকে। মানুষটা একাই পুরো বিছানা দখল করে ফেলেছে। যেন এটা তাঁর একার সম্পত্তি! ফাতেমার জায়গা আর হয় না বিছানায়। সে মুখে ভেংচি কেটে মেঝেতে কাঁথা বিছিয়ে শুয়ে পড়ে। মাথায় দেওয়ার জন্য একটা বালিশও নেয়। সেদিনের কামড়টা ছিল মাপছাড়া কামড়! অর্থাৎ ফাতেমা না বুঝে একটু জোরেই তুহিনের গালে কামড় বসিয়ে দেয়। ফলে দাঁতের ছাপ বসে যায় তুহিনের গালে। ফাতেমা এই ঘটনার সম্মুখীন হয় সকালে। সকালে তুহিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের গালে হাত বুলিয়ে দেখে, কারোর দাঁতের ছাপ বসে গেছে৷ ঘরে ফাতেমাকে বসে থাকতে দেখে তুহিন জিজ্ঞেস করে, ‘ ফাতেমা, তুমি কি ঘুমের ঘোরে আমাকে কামড়িয়েছ?’ ফাতেমা আতঙ্কে ওঠে আয়নায় থাকা তুহিনের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকায়। আসলেই কামড়টা একটু জোরেই মেরেছিল ফাতেমা। প্রথমবার তো; সেজন্য বুঝতে পারেনি। এরপর যতবার এইরকম ঘটনা ঘটেছে, ফাতেমা আস্তে করে তুহিনের গালে কামড় বসিয়ে দিয়েছে। কখনো তুহিন নড়েচড়ে উঠেছে, কখনো আবার তাঁর মধ্যে কোনোরকম প্রতিক্রিয়া-ই দেখা যায়নি। ফাতেমা একবারই কামড় দিতো৷ তুহিন তাকে ছাড়লে সে ওঠে যেতো; না ছাড়লে সেভাবেই শুয়ে থাকতো। নিঃশ্বাস আটকে যাক; স্বামীর বুকে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা সৌভাগ্যের ব্যাপার। সবাই এইরকম সৌভাগ্য নিয়ে জন্মায় না। ফাতেমা হয়তো জন্মেছিল। সেজন্য তুহিনের ওইরকম একটা ‘ভালো’ অভ্যাস তৈরি হয়েছিল। জেগে থাকতে না জোক, অন্তত ঘুমোনোর পর স্ত্রীকে বুকে টেনে নেয়।
ফাতেমা আজও আতঙ্কে উঠল। তবে তুহিনের গালে হালকা দাঁতের ছাপ দেখে নয়; আচমকা ঘরে আসমাকে দেখে। অবশ্য তুহিনের গালে এখন কোনো দাগ নেই৷ ওত আস্তে করে কামড়ে দিয়েছিল। দাগ বসার সুযোগই পায়নি।
আসমা জিজ্ঞেস করল, ” বড় আপু, তুমি নিচে কেন?”
” না মানে, উপরে জায়গা হচ্ছিল না।” ইতস্ততভাবে কথাটা বলে ‘হাই’ তুলল ফাতেমা। আবার বলল, “তুই হঠাৎ এ-ঘরে?”
আসমা চিন্তিত আর ভাবান্তর চাহনিতে তাকিয়ে বলল, ” না মানে, আমি ভুলে এ ঘরে এসে গেছি। আগে তো আমিই থাকতাম ; তাই হুটহাট করে ঢুকে যেতাম। তোমরা যে এখানে আছো, আমার মনে ছিল না।”
” ওহ্। ” ছোট করে বলল ফাতেমা।
আসমা আবার প্রশ্ন করল বোনকে, ” উপরে জায়গা হচ্ছিল না মানে? এতবড় একটা বিছানা; তবুও জায়গা হচ্ছে না? অথচ কালকেও আমরা তিনজন এই বিছানায় ঘুমিয়েছি।”
” দেখছিস না উনি কেমন নিজেকে ছড়িয়ে শুয়ে আছেন।”
” সে তো দেখতেই পাচ্ছি। সারারাত কী তুমি নিচেই শুয়েছিলে? ঠাণ্ডা মেঝেতে একটা কাঁথাতে কী হয়? আমাকে বললে একটা মাদুর বিছিয়ে দিতাম।”
” সারারাত বিছানাতেই ছিলাম। ভোরে নামাজের জন্য উঠেছি। সেজন্যই তো আর দরজায় খিল দেয়নি। নামাজ পড়ে দেখি, উনি হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছেন। তাই আর ধাক্কাধাক্কি করে ঘুম ভাঙাইনি। শরীর অসুস্থ; বিরক্ত করা ঠিক হবে না।”
মৃদু হেসে আসমা বলল, ” ওহ্ আচ্ছা। ঘুমোও তোমরা। আমি বাইরে দিয়ে একটু ঘুরে আসি। প্যান্ডেলে গিয়ে দেখে আসি, কাজ কতটা কী হলো।”
” আচ্ছা যা। কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে ডাক দিস।” মাথা ঝাঁকিয়ে বলল ফাতেমা।
আসমাও মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, ” আচ্ছা।” কথাটা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ফাতেমা আবার শুয়ে পড়ল না। কাঁথাট গুছিয়ে রেখে, একটা টুল নিয়ে আয়নার সামনে বসে গেল। মেয়েদের সবচেয়ে পছন্দের স্থান যে শুধু স্বামীর বুকে, তা না। আয়নার সামনের স্থানটি-ও তাঁদের অতি পছন্দের একটি স্থান। এবং সেখানে বসা তাঁদের খুব পছন্দের একটি কাজ।
৩০.
প্রথম দিকের সিটের টিকিট কেটেছিল বলে, বাস ড্রাইভার এর কাছাকাছি বসেছিল তাহমিদ। সঠিক সময়ে বাস ছেড়েছিল। ঢাকা পাড় হতেই বাস চলছিল দ্রুত গতিতে। বাসের হেল্পারও ড্রাইভার এর পাশে বসেছিল। তাহমিদ চিন্তিত মুখ করে বসেছিল এক জায়গায়। বৃষ্টি পড়ছিল সেসময়। হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। মেঘ নেই, মেঘের গর্জন নেই, অথচ অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। অনেকটা বাধহীন চোখ দিয়ে অনবরত জল গাড়িয়ে পড়ার মতো! তাহমিদের বুক কাঁপছিল- মন কাঁপছিল; কাঁপছিল সারা শরীর। জানালা আটকানো ছিল। বাইরে থেকে কোনো বৃষ্টির ফোঁটা বা বাতাস ভিতরে প্রবেশ করছিল না। ছিল ভ্যাপসা গরম। তবুও কাঁপছিল তাহমিদ। ভয়ে; অজানা শঙ্কায়! মেয়েটাকে ওভাবে যেতে না দিলেই বোধহয় ভালো হতো। ফোন বন্ধ তাঁর। না জানি এখন কোথায়, কী অবস্থায় আছে! নিশ্চয়ই কাঁদতে কাঁদতে পুরো বাসের লোকজনকে হয়রান করে দিয়েছে এতক্ষনে। খুব আবেগপ্রবণ মেয়ে তো; অল্পতেই কেঁদে দেওয়াটা স্বভাব ওর।
তাহমিদ হেসে উঠল। নিষ্প্রাণ হাসি! কোনো অনুভূতি নেই এই হাসিতে।
হঠাৎ বাসের হেল্পারের ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। বাজছে ‘পরাণ যায় জুড়িয়ে-রে’ গানটা। এখনো যে মানুষ এ ধরণের গানের মায়া ত্যাগ করতে পারেনি, তা এই হেল্পারের ফোন রিংটোন শুনেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। সে ক্লান্ত চোখে ফোন স্ক্রিনে তাকালো। কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকার পর রিসিভ করে কানে ধরল। কিছু বলল না। চুপচাপ শুনে গেল ওপাশের মানুষটার কথা। আদৌও ওপাশের মানুষটা কিছু বলছে কি-না, তা নিয়েও সন্দিহান আছে তাহমিদ। তাই চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে হেল্পারের দিকে। একজন হেল্পার ফোনে কাকে কী বলল, তা জানার জন্য তাহমিদের মনে কখনো কৌতূহলী তৈরি হয়নি। আজ হঠাৎ করেই মনে হচ্ছে, তাকে জানতে হবে হেল্পারকে কে ফোন করেছে। হয়তো সন্ধ্যার আগের বরিশালের উদ্দেশ্যে যাওয়া সেই বাসটার ড্রাইভার, বা হেল্পার। এইরকম তো হয়-ই। একই মালিকের গাড়ি চালায় এরা। একে অপরের সাথে যোগাযোগ থাকাটা খুব স্বাভাবিক। হয়তো ফোন করে বলছে, ‘আমি অনেকটা পথ চলে এসেছি।’ বা সরাসরি বলছে, ‘আমরা প্রায় বরিশালে ঢুকে পড়েছি।’ যদিও তাহমিদ জানে না এতটুকু সময়ে বরিশাল বিভাগে চলে যাওয়া যায় কি-না। সে বহুদিন আগে একবার গিয়েছিল। তাঁর বড় ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি সেখানে। এখন মনে নেই কিছুই।
হেল্পারের কথায় তাহমিদের ভাবনায় ছেদ পড়ল। হেল্পার ফোনটা কান থেকে নামিয়ে কিছুটা আতঙ্কিত গলায় বলল, ” উস্তাদ, সর্বনাশ হয়ে গেছে!”
সর্বনাশের কথা শুনে তাহমিদের বুকটা ধুক্ করে উঠল। সেই অজানা শঙ্কাটা যেন হঠাৎ গাঢ় হয়ে তাকে ভয় পাইয়ে দিলো। কিছু না বলে তাকালো ড্রাইভার এর দিকে।।
ড্রাইভার কপাল কুঁচকে বলল, ” কী হইছে?”
” বাবলু ভাইয়ের গাড়িটা এক্সিডেন্ট করছে। বাস আর ট্রাকের মধ্যে সামনাসামনি সংঘর্ষ। বাবলু ভাইয়ের হেল্পার লাফ দিয়ে নেমে গেছে আগেই। ও ফোন করছিল।” হেল্পার হাঁপাতে হাঁপাতে একনাগাড়ে কথাগুলো বলল।
ড্রাইভার কথাগুলোর শুনেই গাড়ি একপাশ করে ব্রেক করে বসল। উৎকণ্ঠায় বলল, ” কসকি! বাবলু ভাই কই?”
” ও জানে না। ও নাকি ভয়ে পালায়া গেছে।”
তাহমিদের শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেল। টানটান হয়ে বসে রইল। নিজের মনকে শক্ত করল। আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে নিজেকে বুঝালো, ” ধুর, বাবলু হয়তো অন্য কোনো ড্রাইভারের নাম। মানহা যে গাড়িতে গেছে, ওই গাড়ির ড্রাইভারের নাম হয়তো অন্যটা। হাবলু, ডাবলু, এই টাইপ কিছু।”
মনকে স্থির রাখতে পারছে না তাহমিদ। সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করছে৷ হেল্পারকে জিজ্ঞেস করতেই হবে, ‘ বাবলু কোন গাড়ির ড্রাইভারের নাম?’ ও যদি বলে, ‘ আগে যে গাড়িটা বরিশালের দিকে গেছে, ওই গাড়িটার ড্রাইভারের নাম।’
নাহ্, তাহমিদ আর ভাবতে পারছে না। শরীর ঘামছে তাঁর। গরম থেকেই বোধহয় শরীরটাও কাঁপছে; আগের থেকেও বেশি। মানহার কিছু হয়ে গেলে খুব বাজে হবে ব্যাপারটা। তাহমিদ যদি কড়া করে মানহাকে আটকানোর চেষ্টা করতো, তাহলে সফল হতো। সেই অধিকার তাকে মানহা নিজেই দিয়েছে। আজ না গিয়ে কাল যেতো; অথবা আরও কিছুদিন পর। কিংবা ও যে গাড়িতে যাচ্ছে, সেটায় করে যেতে পারতো, একসাথে। তাহমিদের আরও মনে হচ্ছে, সে-ও যদি মানহার সাথে ওই গাড়িতে চলে যেতো, তাহলে খুব ভালো হতো। উল্টো পাল্টা কিছু হয়ে গেলে একসাথে হতো। অন্তত এই অস্থিরতা তৈরি হতো না। অস্থিরতা সাধারণ দুই কারণে হয়। প্রথমত উত্তেজনা থেকে। দ্বিতীয়ত যন্ত্রণা থেকে। তাহমিদের যন্ত্রণা হচ্ছে খুব; বুকে, মনে। মাথাটা কেমন যেম ঝিম মেরে আছে। নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে। প্রকৃত পাগলরা নিজেকে পাগল ভাবতে পারে না। কিন্তু তাহমিদ পারছে; অর্থাৎ, সে প্রকৃত পাগল হয়নি এখনো। কিন্তু হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। মাথায় খুব আঘাত করছে একটা ভাবনা। দুশ্চিন্তার ভাবনা!
যাত্রীদের হৈচৈ-এ নড়েচড়ে বসল তাহমিদ। খুক করে একটু কেঁশে পিছনে তাকালো। সবাই কিছুটা হুংকার ছেড়ে জানতে চাইছে, ‘বাস কেন থামানো হলো?’
ড্রাইভার তাকালো পিছনে। হাত উঁচিয়ে ধমকের সুরে বলল, ” আরে থামেন। চিল্লাচিল্লি কম করেন। আগের বাসের এক্সিডেন্ট হইছে। অবস্থা খারাপ। বাসের কেউ বাঁইচা নাই।”
ড্রাইভার মিথ্যে বলছে। ‘বাসের কেউ বাঁইচা নাই’ এই কথাটা হেল্পার মুখ দিয়েও উচ্চারণ করেনি। তাছাড়া সবাই যদি মারা যেতো, তাহলে হেল্পার ফোনে দিলো কীভাবে? কেউ কেউ নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে মানহা একজন, এই বলে নিজেকে আশ্বস্ত করল তাহমিদ।
বাসের যাত্রীরা চুপসে যাওয়ার মতো করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ড্রাইভারের দিকে। এরপর শুরু করল নিজেদের মধ্যে কোলাহল। তাহমিদ দুই কান চেপে মাথাটা জানালার সাথে ঠেসে ধরেছে। রাস্তাটা সফট। ঝাঁকি লেগে মাথা ফাঁটার সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া লোকদের মুখে ‘ কেউ বেঁচে নেই’ কথাটা শোনার চেয়ে ঝাঁকিতে মাথা ফাঁটানো অনেকটা সুখের। অচেতন হয়ে গেলে আরও ভালো হবে। অন্তত কিছুক্ষণের জন্য জাগতিক চিন্তাভাবনা, মানহা, এক্সিডেন্ট, কেউ বেঁচে নেই, মানসিক যন্ত্রণা, এইসব থেকে দূরে থাকা যাবে। সারাজীবনের মতো অচেতন হলে তো আরও ভালো। এইরকম মর্মান্তিক যন্ত্রণার থেকে চিরনিদ্রায় থাকা ঢেড় ভালো।
ড্রাইভার বসেই কয়েকজনকে ফোন করলেন। এরপর আবার বাস স্টার্ট দিলেন৷
তাহমিদ দেখল, দু’টো ভাঙা গাড়ি মুখোমুখি হয়ে আছে। দু’টো গাড়িরই অর্ধেকটা একটার সাথে আরেকটার মিশে গেছে। মানহা যে কোন দিকটাতে বসে ছিল, তা মনে করতে পারল না তাহমিদ। মনে পড়ার সম্ভবনাও নেই। মানহা বাসে উঠার পর সে আর সামনে তাকায়নি। বেশ কয়েকটা এম্বুলেন্সও দেখা গেল। তাঁর থেকেও বেশি লোকজনের উপচে পড়া ভীড়। হুড়োহুড়ি করে সবাই যে আহত, নিহত, ব্যক্তিদের এম্বুলেন্সে তুলছে, তা না। অধিকাংশ লোকজনই ‘হা’ করে তাকিয়ে আছে, আর কপাল চাপড়াচ্ছে। তাহমিদ এগিয়ে গেল। পরপর থেতলে যাওয়া রক্তাক্ত কয়েকজনকে দেখে তাঁর মনে হলো, এদের মধ্যেই মানহা আছে। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। আস্তে আস্তে এম্বুলেন্স সব উধাও হয়ে গেল। হৈচৈ কিছুটা কমল। পিছনে তাকিয়ে দেখল, অসংখ্য গাড়ি আটকে আছে। সামনেও আছে। তাহমিদ যে গাড়িটাতে আসছিল, সেটাও কোনো একদিকে আটকে আছে বোধহয়। খুঁজতে হবে। কিন্তু এ ঝামেলায় আর গেল না তাহমিদ। গাড়ি খোঁজাখুঁজি আপাতত অফ। তাকে হাসপাতালে যেতে হবে। একজনকে জিজ্ঞেস করে নিলো, হাসপাতালে ঠিকানা।
উনার থেকে ঠিকানা নিয়ে রাস্তায় ইউ টার্ন নিলো তাহমিদ। হেঁটে অন্য রাস্তায় এসে গাড়িতে উঠল।
হাসপাতালে গিয়ে অনেক খোঁজখবর নিয়ে অবশেষে দেখা পেলো মানহার। রক্তাক্ত শরীর। তবে মুখটা খুব বেশি ক্ষত হয়নি। স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে তাকে। ঠোঁটের কোণে অভিমানী একটা ভাব ফুটে উঠেছে। ঠিক যেমনটা ঢাকার বাসস্ট্যান্ডে থাকাকালীন সময়ে ছিল। অভিমানী মানহা চলে গেল সামনে থেকে। মানহার চোখমুখ ফুলে একাকার। নিশ্চয়ই এক্সিডেন্ট হওয়ার আগে পুরো রাস্তাটাই কেঁদেছে৷ মানহা মারা গেছে, ডাক্তার নিষ্ঠুরের মতো এই কথাটা বলে গেল। মানুষ নিজের মৃত্যুর খবর আগে থেকে জানলে একটা দিক দিয়ে বেশ সুবিধা হতো। মৃত্যুর আগে অন্তত একটু আনন্দ করতে পারতো। প্রিয়জনদের সাথে কিছু সময় কাটাতে পারতো। মানহা সেই সুযোগ পেলো না। উল্টো বুকভরা কষ্ট নিয়ে তাকে জীবন ত্যাগ করতে হলো। তাঁর শেষ নিঃশ্বাসের সময় তাহমিদ পাশে থাকতে পারলো না৷ অথচ প্রেমের শুরুতে এটাই মানহার খুব গভীর একটা স্বপ্ন ছিল। একটা আকাঙ্খা ছিল। ফিল্মি স্টাইলে তাহমিদ তাকে জড়িয়ে ধরবে। আর সে, তাহমিদের বুকে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাসটা তাহমিদের বুকে ফেলবে। মানহার কোনো আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নই পূরণ হলো না। তাঁর আগেই চলে যেতে হলো তাকে।
মানহার ভাইকে তাহমিদ চিনতো। অনেকদিন আগে এক শুক্রবারে মানহা তাঁর ভাইয়ের সাথে তাহমিদকে বন্ধু হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। লোকটা মোটামুটি ভালোই। সৎ ভাইদের অতটা ভালো হতে নেই, এটাই আগে মানহাকে বলতো তাহমিদ। কিন্তু মানহার ভাইকে দেখে মনে হয়েছিল, ভাই তো ভাই-ই হয়; আপন-পরের কথা তো পরের প্যারাতে আসবে।
তাহমিদের সাথে মানহার ভাইয়ের সাক্ষাৎকার বেশ জমে উঠেছিল। সেই সুবাধে তাহমিদ তাঁর নম্বরটাও নিয়ে নিয়েছিল। এতদিন সেটা কাজে লাগেনি। এবার লাগবে। সে পকেট থেকে মোবাইল বের করে সেই নম্বরে ফোন দিলো। কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে মানহার মৃত্যু সংবাদটা জানালো।
সকালের আগেই ছুটে এলো মানহার ভাই, বাবা-মা। মানহা বলেছিল, তাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে তাঁর ভাই ক্লান্ত। কিন্তু তাহমিদের সেরকম মনে হয়নি সেসময়। ক্লান্ত মানুষ অত কাঁদতে পারে না! এখনো ভাবছে সৎ বোনের জন্য। মানহা বেঁচে থাকলে হয়তো সারাজীবন ভাবতো। মানহাকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল নিশ্চয়ই জোর করে বিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। মাহনার শরীরে একটা অসুখ ছিল। যা কিছুতেই ঠিক হচ্ছিল না। ডাক্তাররা বলেছিল, যেকোনো সময় এর মৃত্যু হতে পারে। ট্রিটমেন্ট করে হয়তো কিছুদিন বেশি বাঁচিয়ে রাখা যাবে। হায়াত যদি না থাকে, তাহলে সেটাও সম্ভব হবে না। মানহা নিজের ইচ্ছেতেই ঢাকা এসেছিল পড়াশোনা করতে। তাঁর ভাই তাকে সাপোর্ট করেছিল। আপাতত এক্সাম শেষ। এবার তো সে চাইবেই নিজের বোনকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে। সেজন্যই তাড়া দিয়ে মানহাকে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিল।
হাসপাতালে মানহার ভাইকে সামলানো যাচ্ছিল না। তাই দ্রুত এম্বুলেন্স নিয়ে তাঁরা মানহার লাশ নিয়ে যায় গ্রামের বাড়িতে। সাথে যায় তাহমিদ। সেখানেই মানহার দাফনকাজ সম্পন্ন হয়।
সেই সেমিস্টারটা গ্যাপ যায় তাহমিদের। বড় ভাই রাগ করে, ভাবী রাগ করে, বন্ধুরা রাগ করে, কিন্তু কোনোকিছুতেই যায় আসে না তাহমিদের। তাঁর জীবনটা এলোমেলো হয়ে যায় একটা ঘটনার প্রভাবে। বন্ধুরা মানহার খোঁজখবর নেয় না রাগে। মানহার ক্লোজ যারা ছিল, তাঁদের সাথে আবার তাহমিদ বা ওর বন্ধুদের সম্পর্ক অতটা গাঢ় ছিল না। ফাইনাল এক্সামের পর আর সেভাবে যোগাযোগ হয়নি। মানহার বন্ধুরা হয়তো মানহার মৃত্যুর খবর পেয়েছিল; কিন্তু সেভাবে কাউকে জানায়নি। তাহমিদ নিজেও জানায়নি। অনেকেই ভেবেছে, মানহা তাহমিদের সাথে প্রতারণা করেছে। তাহমিদ কারোর ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায় না। শুধু কেউ যখন মানহাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের খারাপ কথা বলতো, তখন তাহমিদ রেগে গিয়ে বলতো, ‘যা হয়েছে আমার সাথে হয়েছে, তোরা একদম চুপ থাকবি।’ সবাই চুপ করে যেতো। ব্যাপারটা আস্তে আস্তে ধামাচাপা পড়ে যায়। তাহমিদ পরেরবার আবার এক্সাম দেয়। কিন্তু একটা লাল দাগ পড়ে যায়। সেজন্য ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে আর কিছু ভাবেনি। এর মধ্যে আবার আবির্ভাব হয় ‘009’ এর মতো অদ্ভুত কিছুর। ব্যাপারটা বেশ ইনজয় করতো তাহমিদ। তাঁর মনের সব প্রশ্ন বলার আগেই একজন জেনে যাচ্ছে, আবার উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। এতে মন্দ কিছু তো নেই। ব্যাপারটা আরও ভালো! ফ্রি তে একটা অপরিচিত মেয়ের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। মেয়েটা যেই হোক, কিছু প্রশ্নের দারুণ দারুণ উত্তর দিচ্ছে, ফ্রিতে অত সুন্দর কণ্ঠ শোনাচ্ছে, বেশ ভালোই। ফ্রিতে এইরকম সার্ভিস ক’জন দেয়! সে যে শুধুই একটা ভ্রান্তি, তা কখনো অনুভব করার চেষ্টাই করেনি তাহমিদ। চেষ্টা করলে হয়তো বুঝতে পারতো। অন্যের কাছে এটা পাগলামি হলেও তাঁর কাছে ছিল এটা প্রশ্নোত্তরের দারুণ একটা মাধ্যম। তাহমিদের পরামর্শ শুনে অনেকেই উপকৃত হয়েছে। কেউ কেউ তো তাকে নিজের আইডল ভেবে বসেছিল। এমনকি তাঁর বোন, তাঁর বন্ধুরা। এর জন্য তাহমিদ আরও বেশি করে ‘009’ এর মেয়েটির প্রতি দূর্বল ছিল। ব্যাস, আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছিল দিন।
৩১.
রাত প্রায় ১টা। তাহমিদ সহ সবাই আজ ঢাকায় ফিরে যাচ্ছে। গাড়িতে নয়, লঞ্চে করে। তিনটে কেবিন বুক করা হয়েছে। একটাতে আছে তানিশা আর তুলি। আর একটাতে আছে তুহিন আর ফাতেমা। অন্যটা তাহমিদের জন্য।
দু’তলায় কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তাহমিদ। রেলিং-এ ঝুঁকে রাতের ধোঁয়াশা আকাশ দেখছে; আর অন্ধকারে আধচোখে তাকিয়ে নদীর কালো কুঁচকুচে জল দেখছে। মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসছে লঞ্চ আর ট্রলারের হুইসেলের শব্দ। কিছুক্ষণ আগেও পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল লোকজন। কেউ বলছিল, ‘ঝাঁলমুড়ি, ‘কেউ আবার বলছিল ‘এই চানাচুর’। এইরকম নানান আওয়াজ আসছিল। এখনো হয়তো আছে। তবে চেচাচ্ছে না। কেবিনের দিকটা পুরোপুরি ফাঁকা। সবাই নিজ কেবিনে ঘুমোচ্ছে। তাহমিদ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দেখছে, হুইসেলের শব্দ শুনছে, আর উপভোগ করছে। এ যেন অন্যরকম এক জগৎ! এতোএতো মানুষ জড়োসড়ো হয়ে আছে একটা জায়গায়। লঞ্চের এই দিকটা বেশ ভালো লাগে তাহমিদের। এখানে সবাই নিজের মতো আছে। সবাই যেন নিজের একটা জগৎ তৈরি করে নিয়েছে এখানে। কেউ একটা চাদর বিছিয়ে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে, কেউ আবার চেয়ারে বসে আছে; এদিক-ওদিক হাঁটছে। কেউ কেউ ঠিক বেডরুমের মতোই জায়গা নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। তাহমিদ দুই হাত রেলিঙের উপর রেখে দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসল। বাতাসের তীব্রতায় চুলগুলো উড়ে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে কপালে।
” তাহমিদ, ঘুমোবি না?” তানিশা নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে তাহমিদকে দেখে কথাটা বলল।
হঠাৎ মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনে পাশে তাকালো তাহমিদ। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে তানিশা। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে তাহমিদ বলল, ” ওহ্ তুই। দূরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এদিকে আয়।”
তানিশা ইতস্ততভাবে এগিয়ে গেল তাহমিদের দিকে। বাঁ হাতের তালু ঠেকালো কপালে। ঘামটুকু মুছে তাহমিদের পাশে এসে দাঁড়ালো। তাহমিদ জিজ্ঞেস করল, ” ব্যাপারটা কী? তুই ইদানীং আমার থেকে লুকিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন?”
” কই?” চমকানো কণ্ঠে বলল তানিশা।
” আমার মনে হলো, তুই আমার থেকে দূরে দূরে থাকছিস।”
” আসলে, আমি নিজের মধ্যে অন্যরকম কিছু অনুভব করছি। কেমন যেন লজ্জা লাগছিল তোর সামনে আসতে।” কথাটা বলার পরই লজ্জায় তানিশার মুখের রং পাল্টে যেতে লাগল।
তাহমিদ শব্দ করে হেসে উঠল কথাটা শুনে। রাগে ফুঁসে উঠল তানিশা। তাহমিদকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ” হাসছিস কেন? হাসার মতো কী বললাম আমি?”
তাহমিদ হাসতে হাসতে বলল, ” কী বলিসনি সেটা আগে বল? ওহ্ মাই গড! তানিশা কি-না আমার সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছে। এটাও কী আমায় বিশ্বাস করতে হবে?”
” বিশ্বাস না করার কী আছে? আমি কি নির্লজ্জ?” মুখ বাঁকিয়ে বলল তানিশা।
তাহমিদ আগের মতো হাসতে হাসতে বলল, ” অন্তত আমার সামনে আসলে তুই নির্লজ্জ হয়ে যাস। এটা তোরই কথা। ঠিক কি না বল?”
” আগে ঠিক ছিল। এটা এখন ঠিক নয়। কারণ, আগে আমি শুধুই তোর বন্ধু ছিলাম। এখন আমাদের মাঝে ভিন্ন একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। বললাম না, আমি নিজের মধ্যে অন্যরকম কিছু অনুভব করছি।”
” তাতে কী হয়েছে?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো তাহমিদ।
তানিশা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তরে বলল, ” অনেক কিছুই হয়েছে। আগে আমি যেমনতেমন ভাবে তোর সামনে চলে আসতাম। কিন্তু এখন পারছি না। কেমন যেন বিব্রত হয়ে যাচ্ছি বারবার। এই যে তোকে তুই করে বলছি, এখানেও কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে, তুমি করে বলা উচিত।” কথা বলতে বলতে উত্তেজনায় তাহমিদের হাত চেপে ধরল তানিশা।
তাহমিদ মৃদুস্বরে বলল, “এবার তুই ভেবে দেখ, প্রেম- ভালোবাসা বন্ধুত্বের মধ্যে কতটা ফাটল তৈরি করে দেয়।”
“সেই ফাটল জোরা লাগানোর মতো মনের জোর আমার মধ্যে আছে।” তানিশার কণ্ঠস্বর অত্যন্ত দৃঢ়।
তাহমিদ চুপ করে মুচকি হাসল শুধু। তানিশা ঘুরে রেলিং-এ হেলান দিয়ে বলল, ” তোকে একটা কথা বলব।”
কথা বলার আগে এভাবে কখনো অনুমতি নেয়নি তানিশা। আজ নিচ্ছে। তাহমিদ কপাল কুঁচকে তাকালো। তানিশা ঢিপঢিপ চোখে তাকিয়ে বলল, ” চল না এক্ষুনি আমরা বিয়ে করে ফেলি।”
আতঙ্কে উঠল তাহমিদ। এক্ষুনি বিয়ে; তানিশা পাগল হলো নাকি! তাহমিদ ‘হা’ করে তাকিয়ে রইল তানিশার দিকে। দমকা হাওয়া এসে তানিশা চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে গেল। চুলগুলো উড়ে এসে তানিশার মুখটা ঢেকে দিলো। নিজের লজ্জামাখা লাল মুখটা আড়াল করার জন্য এটার প্রয়োজন ছিল বোধহয়। প্রকৃতি নিজের অজান্তেই ওকে সাহায্য করল। তাহমিদের ইচ্ছে হলো, নিজের ডান হাতটা তানিশার মুখের দিকে বাড়িয়ে দিতে! ভালো কাজের জন্য ডান হাত ব্যবহার করতে হয়। তাই সে ডান হাত দিয়ে তানিশার মুখের সামনে থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিবে। তাঁর হাত স্পর্শ করবে তানিশার কপাল, গাল, নাক, আর ঠোঁট। শিউরে উঠবে তানিশা। স্পর্শটা প্রথম নয়। তবুও অনুভূতিটা একেবারেই ভিন্ন অনুভব করবে সে।
কাজটা করল না তাহমিদ। বিয়ের আগেই এতকিছু করা ঠিক না। একবার মানহাকে চুমু দিয়েছিল। পরে আর তাকে বিয়ে করতে পারেনি। এই নিয়ে এখনো মনে একটা অনুশোচনা কাজ করে। সেজন্য এই সত্যিটা এখন পর্যন্ত কাউকে বলতে পারেনি।
মানহা নিজেই, নিজের মুখের সামনে থাকা চুলগুলো সরালো। কিন্তু বাতাসে চুলগুলো আবার তাঁর মুখটা ঢেকে দিলো। আবারও বৃথা চেষ্টা করতে লাগল তানিশা। তাহমিদ বাধা দিলো না। মেয়েটা খুব সুন্দর করে এলোমেলো চুলগুলো কানের পিছন গিয়ে গুজে দিচ্ছে। প্রতিবারই বাতাসে আবার সেগুলো মুখের সামনে এসে ঝাপটা মারছে। সে আবার সরাচ্ছে, আবার আসছে। এই অবস্থায় তাকে বেশ সুন্দর দেখতে লাগছে।
আশেপাশে লোকজনের ভীড় নেই। রাত গভীর হচ্ছে। এবার কেবিনে যাওয়া উচিত মনে করে তাহমিদ বলল, ” কেবিনে যা তানিশা। রাত অনেক হয়েছে।”
তাহমিদের কথায় পাত্তা দিলো না তানিশা। এক হাতে চুলগুলো কানের কাছে নিয়ে ধরে রাখল। অন্যহাত তাহমিদের হাতের উপর রাখল। চোখ দু’টো বন্ধ করে মুখে অদ্ভুত একটা শব্দ করে বলল, ” জানিস, আগেও আমি বহুবার তোর হাত ধরেছি; কিন্তু এমন অনুভূতি কখনো হয়নি। সেদিন সন্ধ্যায় অনেককিছু হয়ে গেছিল। তুই যখন আমায় জড়িয়ে ধরেছিলি, আমি একদম জমে গেছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমার মধ্যে বজ্রপাত হচ্ছে। আর বজ্রপাতের আঘাতে আমি একদম স্ট্যাচু হয়ে গেছি। তুই তাকিয়ে দেখ, এখনো আমার হাত কাঁপছে। তোর হাত স্পর্শ করতেই আমার শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরা কেঁপে উঠেছে। শরীরে যেন কাঁটা বিধে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তুই নিজের হাত দিয়ে আমার শরীরের প্রতিটি অঙ্গে কাঁটা বিধিয়ে দিচ্ছিস। আমি নিশ্চিন্ত, এটাই ভালোবাসার অনুভূতি। তোর মনে হতে পারে, আমি একটু বেশিই আহ্লাদী হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তোর মনে হওয়াতে সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবে না। বিশ্বাস কর, সত্যিই আমার হাত কাঁপছে। তাকিয়ে দেখ।”
তাহমিদ অবাক চোখে তানিশার হাতের দিকে তাকালো। নাহ্, হাত একটুও কাঁপছে না। এটা শুধুমাত্র তানিশার অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। শুধুমাত্র ও নিজেই অনুভব করছে, ওর সারা শরীর কাঁপছে। বাইরে থেকে এই কম্পন দেখা যাবে না। তাহমিদ বলল, ” হুম। হাতটা খুব কাঁপছে।” মিথ্যে বলল তাহমিদ। এতে যদি তানিশা একটু বেশিই খুশি হয়, তাহলে অন্যায় কোথায়?
তানিশা উত্তেজনায় তাহমিদের হাতটা আরও চেপে ধরল। চেঁচিয়ে বলল, ” তোরও নিশ্চয়ই এইরকম হচ্ছে। ইয়েস।” উল্লাসে লাফ দিতে গিয়েও থেমে গেল তানিশা। নির্লজ্জের মতো বলল, ” ইচ্ছে করছে তোর সাথে চুটিয়ে প্রেম করতে।” একটু থেমে আগের কথাটা আবার বলল, “আমাদের উচিত, এক্ষুনি বিয়ে করা৷”
তাহমিদ নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে তানিশার গাল টেনে আদুরে গলায় বলল, ” পাগলামি বাদ দিয়ে নিজের কেবিনে যা। আমাকে আর লজ্জা দিস না। সবাইকে খুব বড় মুখ করে বলেছিলাম, এ জীবনে আমি আর প্রেম করব না। সেদিন রাতে তুই কেমন করে সবাইকে বলে দিলি। বিশ্বাস কর, লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম আমি। ভাবী মিটমিট করে হাসছিল আমায় দেখে। আর তুলি ক্ষেপাচ্ছিল। বড় ভাই-ও জেনে গেছে সবটা। মাফ চাই বোন। আমায় ছেড়ে দে।”
” বোন।” মলিন মুখে বলল তানিশা।
তাহমিদ বলল, ” তুই আমায় মামা বলতে পারলে আমি তোকে বোন বলতে পারব না?”
” আচ্ছা বল।” একটু চুপ থেকে তানিশা আবার বলল, ” কিন্তু আমায় আজকেই বিয়ে করতে হবে।”
” তুই কি ছোট থেকেই ভেবে রেখেছিলি লঞ্চে বিয়ে করবি?”
” না। ভাবনাটা হঠাৎ মাথায় এলো।”
” কিন্তু এটা সম্ভব না৷ এখানে কাজী নেই।”
” অবশ্যই আছে। এই লঞ্চে সব আছে। ঝাঁলমুড়িওয়ালা আছে, ফুচকাওয়ালা আছে, দোকানদার আছে, রুটি-বিস্কুটওয়ালা আছে, বিড়িওয়ালা আছে, সবাই আছে। কাজীও আছে নিশ্চয়ই।”
” নেই। এতসব-ওয়ালার সাথে কাজীর কোনো সম্পর্ক নেই৷ মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্যই মানুষ ওইসব নিয়ে এখানে ঘুরে বেড়ায়৷ কিন্তু কাজীর এখানে কোনো প্রয়োজন নেই।”
তানিশা ফুস করে হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “হয়তো সত্যি সত্যিই কাজী এখানে নেই। বাট থাকা উচিত ছিল। কখন কাদের প্রয়োজন হয়, তা কী আগে থেকে বলা যায়।”
রাশেদের ফোন পেয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো তুহিন। তাহমিদ আর তানিশাকে দেখেনি সে। ওদের পাশ দিয়ে ফোন কানে রেখে হেঁটে কোথায় যেন চলে গেল। তাহমিদ আর তানিশা তাকে দেখেছে। তানিশা বলল, ” জানিস তাহমিদ, তুহিন ভাইয়ার কিছু একটা হয়েছে। আমি শুনেছি, তিনি ফোনে কাকে যেন বলছে, ‘আমি এখনো নিজের অপরাধটা স্বীকার করতে পারিনি। আদৌ পারব কি-না, জানি না। রাশেদ, আমার খুব অনুশোচনা হচ্ছে। ফাতেমাকে আমি ক্রমাগত ঠকিয়ে যাচ্ছি।’
তাহমিদ কপাল ভাজ করে জানতে চাইলো, “কখন শুনেছিস এ-কথা?’
” গতকাল বিকেলে। আমি ঘরের সামনে দিয়েই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ তুহিন ভাইয়ের কণ্ঠ শুনতে পাই। ঘরে সেসময় উনি একাই ছিল। এই কথাটা শোনার পরই আমি ওখান থেকে চলে যাই।’
তাহমিদ কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ” ঠিক আছে। তুই কেবিনে যা। ঘুমিয়ে পড়।’
” তুই ঘুমাবি না?”
” হ্যাঁ। তুই আগে যা।”
তানিশা মৃদু হেসে ‘গুড নাইট’ বলে চলে গেল। তাহমিদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে তাকালো উল্টো দিকে। নিজের মধ্যে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে হাঁটা দিলো তুহিন যেদিকে গেছে।