সম্পৃক্ততা – দ্বাদশ পর্ব।
রিফাত হোসেন।
২৮.
ফাতেমা রেগে আছে। সে খুব আশা করেছিল, তাঁর স্বামী অন্তত বিয়ের তিন-চারদিন আগে আসবে। নিজের দায়িত্বে সবদিক সামলাবে। কিন্তু তা করেনি তুহিন। এসেছে তো এসেছে; একেবারে হলুদের দিন এসেছে। তাও আবার সন্ধ্যার সময়। গত কয়েকদিন ফোনেও ঠিকমতো কথা বলে তুহিন। হু, হ্যাঁ ছাড়া আর কোনো শব্দ ব্যবহার করেনি। গত দু’দিন তো আরও কঠিন অবস্থা হয়েছিল। ফাতেমা তুহিনকে ফোন করেছিল বহুবার। কিন্তু সে রিসিভ করেনি। আরও একটা অপরাধ আছে তুহিনের; সে যে এক্সিডেন্ট করে মাথা ফাটিয়েছে, এটাও গোপন করেছে ফাতেমার কাছে। তুহিনকে শুনিয়ে শুনিয়ে আসমার কাছে ঠিক এই অভিযোগগুলোই করেছে ফাতেমা। কিন্তু তুহিনের কোনোরকম ভ্রুক্ষেপ দেখেনি তাতে। এতে সে বেশ অপমানিতবোধ করেছে। রাগেরও একটা ধৈর্য আছে। সেটা অতিক্রম করলে আর নিজেকে সামলানো যায় না। ফাতেমার মনে হচ্ছে, তাঁর রাগ ধৈর্যের শেষ পর্যায়ে আছে। ভয়ঙ্কর এক ক্ষিপ্ততা গলা পর্যন্ত চলে এসেছে।
তুহিন এখন একটা ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। হলুদের ঝামেলা আজকের মতো প্রায় শেষ। বাড়িতে অতিথি বলতে তেমন কেউই নেই। তাই এখন সবকিছু নীরব। কুয়ো তলায় শুধু তাহমিদ, তৃষ্ণা, আসমা, তানিশা আর রাইশা আছে। ওরা রিল্যাক্স করে গল্প করছে সেখানে। বাড়ির বাইরে একটা প্যান্ডেল করা হয়েছে। কাল বর আসবে। রান্নাবান্নার জোগাড় সব ওখানেই হচ্ছে। তাই বাড়ির ভিতরটা অনেকটাই নীরব এখন। ফাতেমা এতক্ষণ মায়ের সাথে গোছানোর কাজ করছিল। কাজ ছিল বললে ভুল হবে; সে কাজ তেমন করছিলই না; মায়ের পাশে দাঁত কিড়মিড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হুমাইরা নিজেই কিছুক্ষণ পর মেয়েকে বলেছে, ” এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? গিয়ে দেখ জামাইয়ের কিছু লাগবে কি-না।”
বাধ্য মেয়ের মতো, মায়ের কথা মেনে সে-ঘর থেকে বেরিয়ে অন্য একটা ঘরের সামনে এলো ফাতেমা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলো ভিতরে। তুহিন পা উঁচিয়ে বিছানায় বসে আছে। তাঁর তীক্ষ্ণ নজর বাইরের দিকে। জানালা দিয়ে সে বাইরের দৃশ্য দেখছে। দরজার কাছে যে আস্ত একজন মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে, এই নিয়ে তাঁর কোনো ভাবনাই নেই। তাকাচ্ছেও না। যেন বরফের মতো জমে গেছে।
ফাতেমা পায়ে শব্দ না করে ভিতরে ঢুকল। খুব সাবধানে গেল বিছানার কাছে। তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল। কেউ কেউ বলে, ভালোবাসার মানুষ ১০০ গজ দূরে থাকলেও তা অনুভব করা যায়; অথচ সে স্বামীর এতটা কাছাকাছি থাকার পরও, স্বামী তা বুঝতে পারছে না। এমনভাবে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে, যেন বাইরে কোনো সুন্দরী নারী দাঁড়িয়ে আছে। পুরুষ মানুষ অস্বাভাবিক রমকের খারাপ। বিশেষ করে বিবাহিত পুরুষ। বিয়ের কয়েক বছর পরই স্ত্রীরা তাঁদের কাছে পুরোনো হয়ে যায়। যেন স্ত্রী একটা প্রোডাক্ট। মেয়াদ শেষ হলে তাঁর আর মূল্য নেই। এ-কথা শোনার পর কিছু কিছু স্বামী আবার ডায়লগ দেয়, স্ত্রী হলো অমূল্য রতন। এদের সাথে মেয়াদ
থাকা, না থাকার কোনো সম্পর্ক নেই। সারাজীবন এরা অমূল্য রতন হয়ে স্বামীর কাছে থাকবে।
তুহিন হঠাৎ পিছনে ঘুরে দেখল, ফাতেমা আনমনে কী যেন ভেবে যাচ্ছে। সে ফাতেমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। কোনোকিছু বুঝতে না পেরে ডাকল ‘ ফাতেমা ‘ বলে। চমকে উঠল ফাতেমা। ভড়কে গিয়ে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ল। তুহিন জিজ্ঞেস করল, ” কখন এসেছ?”
” একটু আগে। কেন আপনি দেখেননি আমায়? বাইরে কাকে দেখছিলেন?” কথাটা নিজের মনে বিড়বিড় করে বলল ফাতেমা। মুখে সে কিছু বলতে পারছে না। এখনো ‘হা’ করে তাকিয়ে আছে। অনেকদিন পর হঠাৎ করেই সে অনুভব করল, তুহিন অনেকটা রোগা হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালচে দাগ পড়ে গেছে। চুলগুলো পাগলদের মতো এলোমেলো হয়ে আছে। যেন কতকাল ধরে শ্যাম্পু করে না। অথচ আগে সে প্রতি সপ্তাহে অন্তত দু’বার চুলে শ্যাম্পু দিতো। তাঁর প্রিয় দু’টো কাজ আছে, যা করতে সে খুব ভালোবাসে। প্রথম কাজ হলো বইয়ের যত্ন নেওয়া। দ্বিতীয় কাজ হলো চুলের যত্ন নেওয়া। প্রতিটি মানুষের কিছু একটার প্রতি একটু বেশিই আকর্ষণ থাকে, বেশি যত্নশীল থাকে। এই যেমন তাহমিদ নিজের ঠোঁটের প্রতি যত্নশীল। ফাতেমা নিজের সংসারের প্রতি যত্নশীল৷ তুহিন আবার দু’টো দিকের প্রতি খুব যত্নশীল। একসময় তুহিনের একটা লাইব্রেরি ছিল। বাচ্চাদের খাতা-কলম, বই থেকে শুরু করে কলেজ ইউনিভার্সিটির বইপত্র তাঁর লাইব্রেরিতে ছিল। গল্পের বইও ছিল তাঁর লাইব্রেরীতে। বাংলা, ইংরেজি সব। কুরআন, সাহিদ সহ আরও অনেক ইসলামিক বইও ছিল। লাইব্রেরীর প্রতি তুহিনের ছোট থেকেই ঝোঁক ছিল। সে মনে করতো, এর থেকে স্বাধীন আর আরামের কাজ হয় না। রোজ কতশত মানুষের সাথে আলাপ-পরিচয়। কলেজ, ইউনিভার্সিটির কত ছেলে-মেয়েরা আসতো রোমান্টিক গল্পের বই, একাডেমিক বই, প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনতে। টুপি পড়া পুরুষ, পর্দাশীল নারী, সহ অনেক অভিভাবকও আসতো প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনতে। তিন মুখী দোকান ছিল ওটা৷ তিন দিকে তিন ধারার লোক ভিড় জমাতো। কর্মচারী ছিল দু’জন, আর তুহিন নিজে একজন। তিন জনে মিলে তিনমুখো ছোট লাইব্রেরীটা সামলাতো। বেশ পরিচিত লাইব্রেরী ছিল ওটা৷ এমন কিছু ছিল না, যা ওখানে পাওয়া যেতো না। দেখা গেল মাঝে মাঝে অন্য শহরের লোকজনও আসতো ওই দোকানে। বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে নিজেদের প্রয়োজনীয় সব পণ্য ক্রয় করতো। মালামাল শেষের দিকে চলে এলে সে একজন কর্মচারীকে দোকানে রেখে, অন্যজনকে নিয়েই চলে যেতো মালামাল কিনতে। হঠাৎ এক কর্মচারী জানায়, তাকে ইমিডিয়েট গ্রামে যেতে হবে। না গেলে হবেই না। তুহিন তাকে ছুটি দেয়। এদিকে মালামাল কেনার জন্য দু’জনকেই যেতে হবে। একরাত লাইব্রেরীতে কেউ না ঘুমালে কিছু হবে না, এই ভেবে রাতেই গাড়ি ভাড়া করে রওয়ানা দেয় তুহিন আর ছেলেটা৷ ভোরে ফিরে আসে। দেখে, তাঁর সাধের লাইব্রেরী আগুনে ধাউধাউ করে পুড়ে যাচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস আসে, কিন্তু লাভ হয় না। সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। শুধু লাইব্রেরী না, সাথে তাঁর স্বপ্নও। অনেকেই বলেছিল, আবার শুরু করতে। সে সাহস পায়নি। গ্রামের জমিজমা, ভিটে বাড়ি, সব বিক্রি করে নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছিল। সেই স্বপ্ন যখন একবার পূড়ে ছাই হয়ে গেছে, তখন আবার একই স্বপ্ন দেখা ঠিক হবে না। তাছাড়া অত টাকা কোথায়? লাইব্রেরী থেকে যা ইনকাম হতো, তা দিয়ে সে আস্তে আস্তে লাইব্রেরী উন্নত করছিল। সঞ্চয় করার কথা তখনও ভাবেনি। ভেবেছিল, লাইব্রেরী বড় হলে একদিন লাখ লাখ টাকা সঞ্চয় করা যাবে। সেদিন রাতে যে বইগুলো এনেছিল, সেগুলো ঘরে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। ওগুলো ঘরেই থাক; স্বপ্নের লাইব্রেরী তো শেষ। বইগুলো নাহয় স্মৃতি হয়ে থাক। স্মৃতি কষ্ট দিবে তো? দিক। মাঝপথে স্বপ্ন ভাঙার আঘাতে হৃদয়ে যে ক্ষত হয়েছে, এক জীবনে সে ক্ষত স্থান ঠিক হবে না। সামান্য এই স্মৃতি আর হৃদয়কে কতটুকু পোড়াবে? কতটুকু ক্ষত করবে?
সেই থেকে প্রতিদিন একবার করে স্মৃতিগুলোকে যত্ন করে তুহিন। ধুলো জমার সুযোগ দেয় না। তাঁর আগেই সব পরিষ্কার করে ফেলে নিজের হাতে। বইয়ের সাথে সাথে চুলেরও খুব যত্ন নেয় তুহিন। পড়াশোনা জানা ছিল বলে চাকরি পেয়ে যায়। কিন্তু সুখ পায় না। তবুও চাকরি করেছে। তাঁর সাথে অনেকগুলো জীবন জড়িয়ে আছে। ভেবেছে, বাড়িঘর, জমিজমা সব নিজের হাতে খেয়েছে। ছোট দু’জন ভাই-বোন আছে, স্ত্রী আছে ঘরে। বাবা-মা নেই। ভাই-বোনদের তাকেই দেখতে হবে। হোক কষ্ট! স্বপ্ন ভাঙার কষ্টের কাছে এইসব কষ্ট অতি তুচ্ছ। দিনরাত পরিশ্রম করেছে। এমনও দিন গেছে, এক সকালে খাওয়ার পর আবার পরের সকালে খাওয়া হয়েছে। স্ত্রী ফাতেমা তাকে দেখতো, কাঁদতো। বলত, বাপের বাড়ি থেকে টাকা এনে দেবে। তুহিন ধমক দিতো ফাতেমাকে। বাপের বাড়ির সম্পদ বাপের বাড়ির। স্বামীর বাড়িতে ওইসব আনার দরকার নেই। যে আল্লাহ এমন অবস্থায় ফেলেছেন, সে-ই উদ্ধার করবেন। উদ্ধার করেছেন আল্লাহ। স্বপ্ন উদ্ধার না হোক, অন্তত ভাই-বোনের থেকে যেটুকু কেড়ে নিয়েছিল, সেটুকু পূরণ করার সামর্থ করে দিয়েছেন। একার খরচেই ভাইকে ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছে। বোনকে ভালো স্কুলে পড়িয়েছে; কলেজে পড়িয়েছে৷ এখন যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এর একজন ছাত্রী। মেধাবী ছাত্রী বলে তাঁর বেশ নামডাক আছে।
তুহিন, ফাতেমার কাধে হাত রাখল আলতো করে। আবারও চমকে উঠল ফাতেমা। বিষণ্ণ গলায় বলল, ” আপনার এই অবস্থা কেন?”
” কোন অবস্থা? বেশ ভালোই তো আছি আমি।” একটু হেসে জবাব দিলো তুহিন।
ফাতেমা সন্তুষ্ট হলো না। স্বামীর এই হাল সে বেশ কয়েকবছর পর দেখছে আজ। বিষণ্ণ মুখ করে আবার বলল, ” আপনার কি বড় ধরনের কোনো রোগ হয়েছে? হলে আমাকে বলুন।”
” আমার কিছু হয়নি ফাতেমা। হলে তোমাকে বলতাম না?” দ্রুত কণ্ঠে বলে দিলো তুহিন। এইরকম প্রশ্নের উত্তর দিতে দেরি করা উচিত নয়।
ফাতেমা অভিমানী কণ্ঠে বলল, “আপনি কী আর সব আমায় বলেন? আমরা একসাথে থাকি। একই বিছানায় ঘুমাই। আমাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে সব স্বাভাবিক। তবুও যেন একটা অজানা দূরত্ব আমি অনুভব করি। দূরত্বটা ঠিক কোথায়, আমি বুঝতে পারি না। পারলে আমি সব লজ্জাসংকোচ ভুলে তা পূরণ করে দিতাম। এই যেমন গত কয়েকদিন আপনি আমার সাথে ঠিকভাবে কথা বলেননি। আমার খুব অভিমান হচ্ছিল। কিন্তু আপনার কাছে তা প্রকাশ করতে পারছিলাম না। কেন পারছিলাম না, সেটাই বুঝতে পারি না। অথচ আপনার উপর অভিমান করা আমার অধিকার।”
” কখনো জিজ্ঞেস করোনি বলেই বলতাম না সবকিছু। এই যেমন এখন জিজ্ঞেস করলে, আমার কী হয়েছে; তাই আমি উত্তর দিলাম। আমার কিচ্ছু হয়নি।” কথাটা হেসে বলল তুহিন। হাসিতে কোনো ভালোলাগা নেই। আছে মলিনতা। রাশেদ বলে দিয়েছে, আগে ফাতেমাকে শান্ত করতে হবে। হুটহাট করে কিছু বলে দেওয়া যাবে না। আর সব শোনার পর ফাতেমা যতই রিয়্যাক্ট করুক, তাকে আগলে রাখার দায়িত্ব তুহিনের। কারণ ভুলটা তুহিনের। নারীরা সবকিছুর ভাগ অন্যকে দিতে পারে, কিন্তু স্বামী আর সংসারের ভাগ কাউকে দিতে পারে না। স্বামী তাঁদের অক্সিজেন, আর সংসার তাঁদের নিঃশ্বাস। সুতরাং স্বামীর মতো অক্সিজেন হারিয়ে তাঁরা নিজের নিঃশ্বাস বন্ধ করতে চায় না। দেরিতে হলেও সবকিছুই বলতে হবে ফাতেমাকে। হটকারিতা নয়, বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করতে হবে। আর আল্লাহর কাছে প্রতিজ্ঞা করতে হবে, এখন থেকে স্ত্রীকে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে ভালোবাসতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আগের সব ভুলে যেতে হবে।
ফাতেমা, তুহিনের ব্যান্ডেজ করা কপালে আস্তে করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ” আপনি কী হাঁটার সময় চোখ দু’টো পকেটে ভরে রেখেছিলেন?” ফাতেমা রসিকতা করল একটু। স্বামীর পেট থেকে কথা বের করার জন্য মুহূর্তটাকে সহজ করতে হবে। তারপর কায়দা করে সব জানতে হবে। নাহলে সে কিছুই বলবে না। কতগুলো বছর ধরে এই মানুষটাকে সে চেনে; মতিগতি সব আয়ত্তে চলে এসেছে।
তুহিন ফিক করে হেসে বলল, ” কী যে বলো না! চোখ আবার পকেটে ভরে রাখা যায় নাকি?”
” না যায় না৷ যেহেতু যায় না, সেহেতু আপনার চোখ জোড়া কপালে নিচেই ছিল। আমার প্রশ্ন হলো, সামান্য একটা সিএনজি আস্ত একটা মানুষকে কীভাবে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল?”
” ফাতেমা, তুমি শহরের রাস্তাঘাটে হাঁটো না; তাই জানো না। শহরের সিএনজিগুলো মোটেও সামান্য নয়। এরা পারে তো মানুষের দুই পায়ের মাঝখান দিয়ে চলে যায়। আর হকারদের কথা কী বলব; যাত্রীদের রাস্তার মাঝখানে এরা বসে যায়। তাই আমাদেরও নিচে আঁকাবাঁকা পথে হাঁটতে হয়। লোকজনের ভিড়ে সিএনজিগুলোও সোজা রাস্তা দিয়ে যেতে পারে না। ব্যাস, প্রতিনিয়ত যে বিপদের সম্মুখীন অন্যরা হয়, সেদিন আমিও হয়েছি।” কথাটা বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল তুহিন।
ফাতেমা ফট করে প্রতিবাদী কণ্ঠে বলে উঠল, ” এটা পুরোপুরি সত্যি না। দোষ আপনারই বেশি ছিল। তানিশা আমায় বলেছে, আপনিই উদাসীন হয়ে হাঁটছিলেন রাস্তা দিয়ে। এটা ঠিক না। আপনাকে আমি আগেও বহুবার বলেছি, রাস্তা দিয়ে সাবধানে হাঁটবেন। আর যতই ভিড় হোক, যাত্রীদের জন্য যে রাস্তাটা দেওয়া হয়েছে, সেটা দিয়ে হাঁটবেন। আমি রাস্তাঘাটে না হাঁটলেও বাসে বসে দেখেছি, পায়ে হাঁটা মানুষের জন্য দুই পাশে আলাদা দু’টো রাস্তা আছে। আপনি ওটা দিয়ে হাঁটবেন। ভিড় হোক, দেরি হোক, তবুও ওখান দিয়েই হাঁটবেন।” হুকুম করল ফাতেমা। স্বামীকে হুকুম করতে পেরে কিছুটা আনন্দিত হলো। সচরাচর এইরকম সুযোগ পায় না সে। কড়া করে কিছু বলতে গেলেই তুহিন তাড়াহুড়ো দেখাতো। যেন আগেই বুঝে যেতো, ফাতেমা তাকে কঠিন কিছু কথা বলার চেষ্টা করছে।
তুহিন পুরোপুরি ভাবে ঘুরে বসল ফাতেমার দিকে। ফাতেমার কাধ থেকে হাত সরিয়ে, ফাতেমার হাত দু’টো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মৃদুস্বরে বলল, ” আজ্ঞে ম্যাডাম। আপনার সব আদেশ আমি মেনে চলবো।”
লজ্জায় লাল হয়ে গেল ফাতেমা।। আজ একটু সাহস সঞ্চয় করে কিছু কথা বলবে ভেবেছিল। সেই সাহসটাও শেষ করে দিলো তুহিন। জড়তার কারণেই কিছু কিছু বিষয়ে এখনো তুহিনের সামনে লজ্জা পায় ফাতেমা। শুরুটা হয়েছিল বাসর রাতে। তুহিন সেদিন হঠাৎ করেই ফাতেমাকে ‘ম্যাডাম’ বলে সম্মোধন করেছিল। ফাতেমার সে-কি লজ্জা! ফাতেমার যেমন সাংঘাতিক রাগ, তেমনই মারাত্মক লজ্জা। রাগটা অন্যের জন্য প্রযোজ্য হলেও তুহিনকে রাগ দেখাতো না সে। তুহিনের জন্য শুধুমাত্র লজ্জাজনক ভাবটা বরাদ্দ করা ছিল। ফাতেমা সেদিনই বলতে চেয়েছিল, ঠিক এক বছর পর তাঁরা সন্তান নিবে। দেরি চলবে না। সন্তান ছাড়া সংসার পরিপূর্ণ হয় না। আর ফাতেমা শুধু স্বামী চায় না, একটা পরিপূর্ণ সংসারও চায়। কিন্তু তুহিন সেদিন এমন এমন কথা বলেছিল, যা শুনে লজ্জায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল ফাতেমার। বাসর রাতে যে স্বামীর কাছ থেকে ওই ধরনের কথা শুনতে হবে, আগে থেকে তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সদ্য কৈশোরে পেরোনো ফাতেমা। সেসময় বয়স কম ছিল। সেই যে লজ্জা নামক একটা জড়তা ফাতেমার মধ্যে তৈরি হয়েছিল, তাঁর রেশ এখনো কাটেনি। এ-জীবনে আর কাটবে কি-না, তাও জানে না ফাতেমা। বিয়ের প্রায় ৭-৮ বছর হতে চলল। এখনো একটা সন্তান হলো না তাঁদের। এই নিয়ে সবার অভিযোগ। শুধু অভিযোগ নেই ফাতেমার। একেবারেই যে নেই, তা না। কিন্তু মুখ ফুটে তুহিনকে বলতে পারে না, ‘অনেক তো হলো, এবার সংসারে নতুন সদস্যের আগমন হওয়া চাই। চাই মানে চাই।’ আসমা আগে দিনরাত ফোন করে বলতো, আপু, ‘তোমাদের কী এ-জীবনে বাচ্চাকাচ্চা হবে না?’ দুলাভাইকে সেভাবে সামনাসামনি পেতো না তাঁরা। তাই রসিকতার নামে এইরকম কিছু বলার সুযোগও পেতো না। বাড়িতে শ্বাশুড়িও ছিল না, যে এইসব নিয়ে আলোচনা করবে। বাড়ির নিচতলার ভাবীও কতবার তুহিনকে বলেছে, এবার সন্তান নাও তুহিন। তুহিন পাত্তা দেয়নি। আড়চোখে শুধু ফাতেমার দিকে তাকিয়েছিল কয়েকবার। তুহিনের মধ্যেও ছিল স্ত্রীর প্রতি সাংঘাতিক জড়তা। সেজন্যই রাতে আধোআলোয় জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী কণ্ঠে একটু জিজ্ঞেস করতো না, ‘ তোমারও কী মনে হচ্ছে, এবার আমাদের পরিবারে নতুন একজনের আসা উচিত?’ এই কথাটা বললেই ফাতেমা ‘হ্যাঁ’ ‘হ্যাঁ’ বলে লাফিয়ে উঠতো। অনেকবার ভেবেছিল, তুহিন যদি কোনো একদিন আচমকা এইরকম কিছু বলে, তাহলে ফাতেমা ‘হ্যাঁ’ ‘হ্যাঁ’ বলে লাফিয়ে উঠবে। কিন্তু আফসোস, তুহিন এতগুলো বছরে একবারের জন্যেও এই কথা বলেনি। রাতের আঁধারে পাশে শুয়ে ফাতেমার সাথে কতশত গল্প করতো। কিন্তু এই নতুন সদস্য প্রসঙ্গে কখনো কোনো শব্দ মুখ দিয়ে বের করেনি। পুরুষ মানুষের মধ্যে এত জড়তা থাকতে নেই, এই কথাটা যেন তুহিন বুঝতেই পারে না। ফাতেমা সরাসরি না বললেও আকারে-ইঙ্গিতে, হেয়ালি করে কিছুটা বইয়ের ভাষায় বুঝানোর চেষ্টা করেছিল তাকে। কিন্তু তুহিন বুঝতে পারেনি। মাঝে মাঝে ফাতেমা গল্পের বই পড়ার সময় হঠাৎ একটু জোরেই পড়তে শুরু করেছিল। তুহিনকে শুনিয়ে বলছিল, “বেশ কয়েকবছর আগে বিয়ে হয়েছে ফাতেমার। কয়েক বছর আগে আজকের এই দিনেই তাঁর সাথে অপরিচিত একজনের বিয়ে হয়েছিল। ফাতেমার বয়স তখন ছিল ১৮। লজ্জায় স্বামীকে কিছু বলতো পারতো না। বাসর রাতের দিন থেকেই সে মনেমনে ভেবে এসেছে, কোনো একদিন তাঁর কোল আলো করে একটা নতুন সদস্যের আবির্ভাব হবে। যে নিজের সবটুকু দিয়ে নতুন সদস্যকে আদর করবে। কিন্তু মেয়েটার এমন দুঃখী কপাল যে, বিয়ের এতগুলো বছর পরেও সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না। না পারছে নিজে থেকে স্বামীকে কিছু বলতে, আর না স্বামী তাকে কিছু বলছে। দু’জনেই যেন চাপা লজ্জার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। ফাতেমার এই কষ্ট দেখে আশেপাশের আপনজনেরা খুব আফসোস করে। তাঁদের আফসোস করতে দেখে ফাতেমার খুব কষ্ট। বেচারি ফাতেমা খুব অসহায়বোধ করে।”
এই লেখাগুলো বইয়ে নেই। নিজের বানানো কথাগুলো বই পড়ার নাম করে তাহমিদকে শোনায় সে। একেকদিন একেক গল্প বানায়। কিন্তু প্রতিটার প্রধান বিষয় একই থাকে। সেদিন হঠাৎ করেই নিজের নামটা বলতে শুরু করেছিল। যার জন্য তাকে আরও লজ্জায় পড়তে হয়েছিল। তুহিন হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে, “বইয়ে কী তোমার নামটাই লেখা আছে?” আচমকা দ্বিতীয় ব্যক্তির প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে ওঠে ফাতেমা। উৎকণ্ঠাযুক্ত গলায় বোকার মতো বলে ওঠে, ” না না; এখানে অন্য নাম আছে।” যখন বুঝতে পারে, সে খুব বড় ভুল করে ফেলেছে, তখনই বই দিয়ে মুখ আড়াল করে তৃষ্ণার ঘরের দিকে দৌড় দেয়।
তুহিন হঠাৎ ফাতেমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। নড়েচড়ে উঠল ফাতেমা। ভাবনা থেকে বেরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো, কেউ আছে কি-না। কাউকে না দেখে সে আবার তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ” করছেন কী? দরজা খোলা আছে। কেউ এসে পড়লে কী ভাববে বলুন তো।”
” কেউ দেখবে না। তোমার বাবা প্যান্ডেলের ওখানে আছে। আমি জানালা দিয়ে ওখানেই কাজ করতে দেখছিলাম। তোমার মা-ও ব্যস্ত। আর বাকিরা সবাই কুয়ো তলায় আছে। সুতরাং আমাদের এখানে উঁকি মারার মতো কেউ নেই।” আরও ভালো করে শুয়ে জবাব দিলো তুহিন।
” তবুও আপনি উঠুন। আমি বালিশ দিচ্ছি, আপনি বালিশে ঘুমান।”
” উঁহু। তুমি দরজাটা আটকে দিয়ে আসো। রাত তো অনেক হলো। আমার শরীরটা ক্লান্ত লাগছে”
” আপনি বিশ্রাম নিন। আমি ওদের কাছে যাচ্ছি। সবাইকে ঘুমোনোর জায়গা ঠিক করে না দিয়ে আমি ঘুমাবো কীভাবে?” কথাটা বলে বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করল ফাতেমা। কিন্তু পারল না।
” তোমাকে এতকিছু ভাবতে হবে না। আসমা আছে তো ওখানে। চুপচাপ বসে থাকো।” ধমকে সুরে বলল তুহিন।
ফাতেমা হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ” আচ্ছা ঠিক আছে। আমিও শুয়ে পড়ব। ওদের বলে আসছি আমি ঘুমোতে গেলাম। আর দরজাটা লাগিয়ে আসছি।”
তুহিম মাথা উঁচু করে ফাতেমাকে যেতে দিলো। আর ভাবতে লাগল, কীভাবে ফাতেমার কাছে ক্ষমা চাওয়া যায়।
কিছুক্ষণ পর ফাতেমা আবার ফিরে এলো। তুহিনের মতিগতি আজ সুবিধার লাগছে না তাঁর কাছে। অন্যদিনের তুলনায় আজ যেন একটু বেশিই আহ্লাদী করছে। এইরকম আহ্লাদী আগে করলে কবেই লজ্জাসরম ভুলে যেতো ফাতেমা। ফাতেমা দরজা লাগিয়ে আবার আগের জায়গায় ফিরে এলো। বিছানায় বসতেই তুহিন আবার তাঁর কোলে মাথা রাখল। এক হাতে তুহিনের চুলে হাত বুলাতে লাগল। তুহিন চোখ বন্ধ করে বলল, ” ফাতেমা, তোমাকে একটা কথা বলব ভাবছিলাম।”
” এখনই বলবেন?”
” না, পরে বলব।”
” আমি জানতাম আপনি এখন বলবেন না।”
” কীভাবে জানতে?” চোখ মেলে তাকালো তুহিন।
” সেটাও পরে বলব।”
হেসে উঠল তুহিন। ফাতেমা-ও হেসে উঠল। একসময় হাসি থামিয়ে দিলো তুহিন। ঘুমোনোর চেষ্টা করল। ফাতেমা চুপচাপ বসে তুহিনের মাথায় হাত বুলাতে লাগল। তুহিন ঘুমোনোর পর ফাতেমা তুহিনের মাথার নিচে একটা বালিশ দিয়ে বিছানা থেকে নামল। তুহিনের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ” এতগুলো বছর যদি এভাবে নিজে থেকে আমার কাছে আসতেন, তাহলে হয়তো আমাদের মাঝে কোনোরকম দূরত্ব থাকতো না। আমাদের সম্পর্কটা হতো মধুর। আপনাকে আমি খুব ভালোবাসি। কৈশোর পেরিয়ে যখন যৌবনে পা দিয়েছি, তখন থেকেই আমি ভালোবাসতে শিখেছি। সেসময় অন্য কোনো ছেলে আমার জীবনে আসেনি। তাই আপনিই আমার প্রথম ভালোবাসা। এবং শেষ পর্যন্ত আমি আপনাকেই ভালোবাসতে চাই।”
ঘর থেকে বেরিয়ে কুয়ো তলায় এলো ফাতেমা। সবার সাথে গল্পগুজব করতে লাগল।
২৯.
হুমাইরা অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছে, আসমা তাঁর ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। হুমাইরা তাকালেই আবার সে চলে যাচ্ছে। পরপর একই ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে।
এখন সকাল ৭ টা। মেয়েগুলো তাঁর সাথেই ঘুমিয়েছিল রাতে। হাফিজ উদ্দিন ছিল প্যান্ডেলে৷ কাজ করেছে, খবরদারি করেছে, আর গ্রামের সমবয়সীদের সাথে আজাইরা সব গল্প করেছে। যদিও হাফিজ উদ্দিনের কাছে ওগুলো আজাইর গল্প ছিল না। রাতটা সে ওভাবেই পাড় করেছে। হুমাইরা কত করে বলেছে, “তাহমিদ ওই ঘরে একাই আছে। তুমি গিয়ে ওর পাশে ঘুমিয়ে পড়। সকালে আবার খাটাখাটুনি করতে হবে।”
কিন্তু হাফিজ শোনেনি। বলেছে, ” আমি ঘুমিয়ে পড়লে এতকিছুর দেখাশোনা কে করবে? কোন কাজে কখন কী প্রয়োজন হয়, সব তো আমাকেই দেখতে হবে। জামাই অসুস্থ। তাকে তো আর এইসব কাজে হাত লাগাতে দিতে পারি না।”
হুমাইরা আর কিছু বলার সুযোগ পায়নি।
তানিশা বিছানা ছেড়েছে খুব সকালে। সারারাত তো সে ঘুমোতেই পারেনি। একেই নতুন জায়গা। তাঁর উপর গতকাল সন্ধ্যায় ওইরকম একটা ঘটনা ঘটল আচমকা। সন্ধ্যার পর আর তাহমিদের মুখোমুখি হয়নি সে। প্রথমবারের মতো তাহমিদকে দেখে লজ্জায় কথা বলতে পারছিল না। বন্ধু হোক আর যেই হোক, নারী লজ্জা পাবেই, এ কথাটা কাল সে বুঝে গেছে। আসমা, রাইশা, দু’জনেই ওঠে গেছে অনেকক্ষণ আগে। এখন বিছানায় তৃষ্ণা ঘুমোচ্ছে শুধু। আর হুমাইরা মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বসে আছে। আসমা আবারও ঘরের সামনে আসতেই হুমাইরা ইশারায় ডাকলেন মেয়েকে। দুই-একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে ভিতরে এলো আসমা। মায়ের পাশে মাদুরে বসে পড়ল। ছটফট গলায় বলল, ” কী করছ মা”
” তুই কি এটা জিজ্ঞেস করার জন্য তখন থেকে আমার আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করছিলি?” কড়া করে বললেন হুমাইরা।
আসমা মুখ কালো করে বলল, ” এভাবে বলছ কেন? আমি কী তোমার সাথে দু’টো কথাও বলতে পারব না?”
” তোর বয়সী মেয়েদের কী কথা থাকতে পারে, সে আমি জানি। বয়সটা আমিও পেরিয়ে এসেছি, বুঝেছিস?” বেশ অভিজ্ঞ গলায় বললেন হুমাইরা।
আসমা রাগ দেখি বলল, ” বলো দেখি আমি কী কথা বলতে এসেছি?”
হুমাইরা ফট করে বলে উঠল, ” সজল মাস্টারের কথা। ছোট বোনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এবার তোরও ইচ্ছে করছে বিয়ে করতে। তাই তো?”
আসমা চমকে উঠল। সে বিয়ের কথা বলতে না এলেও সজল প্রসঙ্গে বলতে এসেছিল। তাঁর মা জানলো কীভাবে এটা? মানুষের মনের কথা পড়ার অদ্ভুত ক্ষমতা কী আল্লাহ তাকে দিয়ে দিয়েছেন? দিলে দিক, কিন্তু মায়ের ধারণাকে সঠিক হতে দেওয়া যাবে না। আসমা ভাবতে লাগল, ভিন্ন প্রসঙ্গে কী বলা যায় মা’কে।
হুমাইরা মেয়ের ভাবান্তর মুখটা দেখেই আবার বলে উঠলেন, ” নিশ্চয়ই কথা ঘোরানোর চেষ্টা করছিস। আরে মা, এইসব আমি জানি। আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবি না।”
” তাই নাকি? তা কয়খানা প্রেম করেছ শুনি? এত অভিজ্ঞতা তোমার হলো কোত্থেকে? ডজনখানেক প্রেম তো নিশ্চয়ই করেছ।” রসিক সুরে কথাটা বলে জোরে জোরে হেসে উঠল আসমা।
ঘুম ভেঙে গেল তৃষ্ণার। তবে এখনি ওঠে পড়ল না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে আসমা আর হুমাইরার কথোপকথন শোনার চেষ্টা করল। আড়ি পেতে অন্যের কথা শোনার মধ্যে একটা মজা আছে। হোক সেটা অপরাধ। এইরকম মজাদার একটা মুহূর্ত মিস করা বোকামি। ব্যাপারটা এইরকম যে, কেউ নিজের সব গোপন কথা বলে দিচ্ছে, আর তা আড়াল থেকে শুনছে অন্য একজন। অথচ সে বুঝতেই পারছে না। মানুষ বলে দেয়ালের কান আছে। অথচ সত্যি এটাই যে, দেয়ালের কোনো কান নেই। কান আছে দেয়ালের সাথে আষ্টেপৃষ্টে লেগে থাকা কিছু মানুষের। যারা নিজে অন্যের কথাগুলো গিলবে, আর ধরা খেলেই দেয়ালের দোষ দিয়ে পালিয়ে যাবে।
আসমা বলল, ” বলছিলাম কী মা, আমি ঢাকায় যাবো।”
” কেন কেন?” চমকে উঠলেন হুমাইরা।
” এমনিতেই। গ্রামে আর ভালো লাগছে না।”
” শহরে গিয়ে সজল মাস্টারের সাথে হাত মেলানোর ফন্দি করছিস নাকি?” রাগে গেটে পড়লেন হুমাইরা।
আসমা শান্ত কণ্ঠে বলল, ” না না।।সেরকম কিছু না।”
” তা এই ভূত মাথায় ঢুকালো কে?”
” কেউ ঢোকায়নি। আমি কাল রাতে বড় আপুকে বলেছিলাম, ‘আমার এখানে ভালো লাগছে না।’ বড় আপু বলল, ‘ আমার ওখানে চল। তৃষ্ণার সাথে থাকবি।’ মা, প্লিজ আমায় যেতে দাও।”
হুমাইরা কিছু বলার আগেই বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠল তৃষ্ণা। বলল, ” একদম ঠিক। তুমি আমাদের সাথে চলো আপু। তাছাড়া তুমি চাইলে ওখানে এর থেকেও ভালো চাকরি করতে পারবে। ওখানে তো স্কুল-কলেজের অভাব নেই।”
” তৃষ্ণা, তুই জেগেছিলি এতক্ষণ?” অবাক হয়ে আসমা জানতে চাইল।
তৃষ্ণা ইতস্ততভাবে বলল, ” না মানে, শেষের কথাটাই শুনেছি শুধু।”
– ” ওহ্। আচ্ছা, তাহলে বাকিটাও শোন। তাছাড়া রাতে তো সব শুনেছিসই। এখন আবার শোন।”
মৃদু হেসে ওঠে বসল তৃষ্ণা। আসমা আবার মায়ের দিকে তাকিয়ে করুণ কণ্ঠে বলল, ” ও মা, যাবো তো।”
” আমি জানি না। তোর বাবা যেতে দিলে যাবি।” হুমাইরার কণ্ঠে অভিমান জড়ানো।
” বাবাকে রাজি করানোর দায়িত্ব বড় আপুর। তোমাকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। তুমি শুধু বলো, তুমি রাজি।”
হুমাইরা উত্তর দিলেন না। তাঁর বুক চিড়ে কান্না বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। চোখের কোণে অশ্রুর মেলা বসেছে। এ অশ্র রোধ করার কতো কেউ নেই। ছোট মেয়েটা কালকেই চলে যাবে। তারপর বড় মেয়েও চলে যাবে। এখন আবার মেজো মেয়েটাও চাচ্ছে, তাঁদের ছেড়ে চলে যেতে। সবাই চলে গেলে তাঁরা থাকবে কী করে?
আসমা তৃষ্ণার্ত প্রাণীর মতো চেয়ে আছে মায়ের দিকে। যেন মা রাজি হলেই তাঁর তৃষ্ণা মিটে যাবে। হুমাইরা কিছু বলছে না। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। তাঁর চাহনি নির্বাক, নিঃশ্বাস নির্বাক, সময় নির্বাক, সে নিজেও নির্বাক। সবকিছুই যেন স্তব্ধ হয়ে আছে। কারোর কোনো কথা নেই, ভাষা নেই, ইশারা-ইঙ্গিত নেই। একসময় বলতো, মেয়েগুলো যে কবে বড় হবে, বড় হয়ে আমাদের দুঃখ ঘোচাবে। আর আজ বলতে হচ্ছে, মেয়েগুলো এত তাড়াতাড়ি বড় না হলেই ভালো হতো। অন্তত আরও কয়েকটা নিঃশ্বাস একসাথে নিতে পারতো, আরও কয়েকটা মুহূর্তে একসাথে কাটাতে পারতো, কয়েক দিন, সপ্তাহ, মাস, আর সবশেষে বছর। এক নয়, একাধিক বছর মেয়েদের সাথে থাকতে পারতো, যদি মেয়েগুলো এত তাড়াতাড়ি বড় না হয়ে যেতো। আজ বড্ড আফসোস হচ্ছে; কেন যে আল্লাহর কাছে দোয়া করতো, ‘ আল্লাহ, মেয়েগুলো যেন খুব বড় হয়।’ কে জানে, আল্লাহ কোন বড়’র কথা বুঝে কোন বড় বানিয়ে দিয়েছে। শুধুমাত্র বড় মনের মানুষ বানাতে পারতো। তা না করে সাথে শারিরীক বড়, চিন্তাভাবনার বড়, নারী সত্তার বড় এর মতো আরও হাজার খানেক ধারার বড় বানিয়ে দিয়েছে আল্লাহ।
আসমা মায়ের একটা হাত ঝাঁকিয়ে বলল, ” ও মা, প্লিজ রাজি হয়ে যাও না। যেতে দেও আমায়।”
হুমাইরা জোর করে আসমার হাতটা দূরে ঠেলে দিলেন। নাক-মুখ কুঁচকিয়ে বললেন, ” যা, চলে যা। আমাকে জিজ্ঞেস করার কী আছে শুনি? যাবি তো যাবিই। আর আসবি না আমাদের কাছে। এই বুড়ো-বুড়ি দু’জন মরে গেলে শুধু একবার কবরটা দেখে যাস। সময় না থাকলে তাও আসিস না। সবাই তো বড় হয়ে গেছিস৷ বাবা-মায়ের মতো ঝামেলা এখনো কী বয়ে বেড়ানোর বয়স আছে তোদের? সবাই চলে যা। আমরা একা বাঁচতে পারলে বাঁচবো, নাহলে গলায় দড়ি দেবো।” কান্নায় ভেঙে পড়লেন হুমাইরা।
স্তম্ভিত আসমা। ভড়কে গিয়ে নিষ্পলক চোখে শুধু তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। মায়ের এই রূপ তাঁর অচেনা। আগে কখনো দেখেনি। বড় আপার বিয়ের সময় শুধু একটু চোখের জল ফেলেছিলেন। এরপর আর কখনো কাঁদেনি। আজ খুব কাঁদছেন তিনি। আসমা দুই হাত বাড়িয়ে মায়ের গলায় জড়িয়ে ধরল। মা’কে শান্ত করার জন্য মায়ের গালে, কপালে, মাথায় অজস্র চুমুর বন্যা বইয়ে দিয়ে আতঙ্কিত গলায় বলতে লাগল, ” এ কেমন কথা মা! ছি ছি! আমি তোমাদের ছেড়ে কোত্থাও যাবো না। কখনোই যাবো না আমি। তুমি কষ্ট পেও না। আই অ্যাম সরি। আর কক্ষণো এ ধরণের কথা বলব না। বুদ্ধিটা বড় আপা দিয়েছে, ওকে আমি খুব বকব।” একনাগাড়ে কথাগুলো বলল মা’কে শান্ত করার জন্য।
তৃষ্ণা অদ্ভুত ভঙ্গিতে ‘হা’ করে তাকিয়ে ছিল। আসমা ওর দিকে তাকিয়ে এবার ক্ষিপ্ত গলায় বলল, ” এই মেয়ে, কূ-বুদ্ধি ছাড়া ভালো কিছু দিতে পারিস না? যা এখান থেকে। আমি এখানেই চাকরি করব।”
তৃষ্ণা এক ছুটে বাইরে বেরিয়ে এলো। উঠোনে এসে আবার পিছনে তাকিয়ে দেখল, আসমা এখনো তাঁর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আছে। উঠোন থেকে কুয়ো তলায় চলে এলো তৃষ্ণা। হাঁসফাঁস করে নিজের মনেমনে আসমালে গালাগাল দিয়ে বলল, ” তুমি খালি একবার বাইরে আসো। তারপর দেখো নেবো। কাল রাতে নিজেই আমাকে বললা, ‘ তৃষ্ণ শোন, মা যদি আমায় জিজ্ঞেস করে, ঢাকায় গিয়ে কী করবি? তখন আমার আগেই তুই বলবি, আমাদের ওদিকে অনেক স্কুল-কলেজ আছে। খুব সহজেই যেকোনো একটাতে চাকরি হয়ে যাবে।’ অথচ এখন আবার আমাকে ধমকিয়ে বলল, আমি নাকি কূ-বুদ্ধি দেই। বজ্জাত মেয়ে কোথাকার!
আসমা মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে দৌড় দিলো। দরজাটা শুধু ভেজানো ছিল। আসমা দরজা ধাক্কা দিয়ে চট করে ভিতরে ঢুকে গেল। আচমকা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। ভীমড়ি খেয়ে চোখ পাকিয়ে তাকালো।