সম্পৃক্ততা পর্ব ১১

0
651

সম্পৃক্ততা – একাদশ পর্ব।

রিফাত হোসেন।

২৬.
মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে হঠাৎ অচেতন হয়ে যায় তাহমিদ। ডাক্তার এটাই জানিয়েছে। তবে এখন সে সুস্থ। তাকে পরদিন দুপুরের আগেই বাড়িতে আনা হয়েছে। তাহমিদের মানসিক যন্ত্রণা হওয়ার কারণ আসমা কাউকে বলেনি এখন পর্যন্ত। সবার প্রশ্ন এড়াতে সহজ ভাবে শুধু বলেছিল, ‘একটা শব্দ শুনে আসমা তাহমিদের ঘরে আসে। এসে দেখে, তাহমিদ মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে আছে।’ সবাই তাহমিদকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আসমাকে আর জেরা করেনি। দুপুরে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আসার পর তাহমিদ নিজেও ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে। শুধু আসমার মুখোমুখি হওয়ার পর কিছুটা অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিল তাকে। এছাড়া সব স্বাভাবিক ছিল। রাইশার হলুদ আজ ; তাই কোনোরকম ঝামেলা চাচ্ছে না তাহমিদ।

বেলা পড়ে গেছে। ডেকোরেশনের লোকজন এসেছে বাড়িতে। দূরের আত্মীয়স্বজন সেরকম কেউ ছিল না বলে আগে থেকে বাড়িতে কেউ আসেনি। গ্রামের কিছু লোকজন এসেছে কাজে সাহায্য করতে। রাইশার হবু শ্বশুর বাড়ি পাশের গ্রামে। তাঁরা সন্ধ্যার আগেই আসবে। রাইশাকে সাজানো হচ্ছে। সেখানে সবাই আছে। তাহমিদ কুয়ো তলায় একটা চেয়ারে বসে আছে। গালে হাত দিয়ে গম্ভীরমুখে বসে আড়চোখে ডেকোরেশনের কাজ দেখছে। দু’টো প্যান্ডেল করা হয়েছে। একটা বাড়ির ভিতরে, আরেকটা বাইরে। চারিদিকে লাইটিং করা হচ্ছে। সন্ধ্যায় নিশ্চয়ই পুরো বাড়ি আলোকসজ্জায় ভরে উঠবে। চারদিকে হৈচৈ। কতশত আনন্দ!

যে স্মৃতিগুলো মনে দাগ কেঁটে ছিল, সেগুলো এখন মনে করিয়ে দিচ্ছে। মনের ভিতর তো অনেক কিছুই গোপন থাকে, কিন্তু গচ্ছিত রাখা সেই স্মৃতিগুলো আর আড়ালে থাকতে চাচ্ছে না বোধহয়। সেই আহ্লাদী ঝগড়াগুলো থেকে বড় মাপের ঝগড়া পর্যন্ত, সব যেন আজ একসাথে তাকে আক্রমণ করছে।

সেদিনও শেষ বেলা ছিল। দূর্বল সূর্য এলিয়ে পড়েছিল পশ্চিমে। বাস স্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে অসহায় চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল মানহা। তাঁর ফাইনাল এক্সাম শেষ। আজকেই তাকে বরিশাল যেতে হবে। তাহমিদকে ফোন করেছে। কিন্তু জ্যামে আটকে পড়ায় তাঁর আসতে দেরি হচ্ছে। ওদিকে বাড়ি থেকে ক্রমাগত ফোন করেই যাচ্ছে। যেভাবেই হোক, তাকে আজকে রাতের মধ্যেই বাড়ি যেতে হবে। ব্যাপারটা সুবিধার লাগছে না মানহার কাছে। তাঁর বাবা-মা, বড় ভাই, সবাই তাঁর গ্রামে ফেরা নিয়ে যেন একটু বেশিই এক্সাইটেড।
তাহমিদ তখনই এলো, যখন গাড়ি ছাড়তে আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি। টিকিট আগেই কেটেছিল সে। মানহার মেজাজ বিগড়ে আছে। সকালেই তাহমিদকে জানিয়েছিল, সে চলে যাচ্ছে। কিন্তু তাহমিদ সকালে বের না হয়ে দুপুরে বের হয়েছে। এইজন্য রেগে আছে মানহা।
তাহমিদ এসে ওর সামনে দাঁড়ালো। তাকিয়ে দেখল, মানহার হাতে দু’টো ব্যাগ। অর্থাৎ সে আবার ঢাকা কবে আসবে, তাঁর কোনো নিশ্চয়তা নেই। । সকালে কেন, এইরকম কিছু আরও আগে জানানো উচিত ছিল, মনে মনে এটাই ভাবল তাহমিদ। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, – ‘ দেখে তো মনে হচ্ছে একেবারে চলে যাচ্ছো; আর আসবে না নাকি?’
– ‘ আসার উপায় কই? ক্যাম্পাসের হল তো আর আমার নিজের সম্পত্তি না, যে এক্সাম শেষ হওয়ার পরেও আমি আরামসে সেখানে থাকতে পারব।’
– ‘ তা এই চলে যাওয়ার খবরটা আমাকে আগে জানাতে পারলে না। তুমি জানো, আজ আমার এক্সাম ছিল? আমাকে এক্সাম দিয়ে এখানে আসতে হলো। কতটা প্রেশারে ফেলেছিলে আমায়, সেটা কী বুঝতে পারছ.’
– ‘ বুঝতে পারছি। কিন্তু কী করব বলো? বাবা তো সকালেই ফোন দিয়ে জানালো, আজকে আমাকে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে। সব গোছগাছ করতে আর তোমার জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে এতটা সময় পেরিয়ে গেল। শেষ রাতে আমি বাড়ি পৌঁছাবো। আবার ভাইয়াকে ফোন করে স্ট্যাণ্ডে আনতে হবে।’ কথাটা বলার সাথে সাথেই মানহার চোখ থেকে অশ্রু গাড়িয়ে পড়ল।

আহত হলো তাহমিদ। হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
দু’মিনিট পেরিয়ে গেছে। আর ৮ মিনিট পর ড্রাইভার শেষ হর্ণ দিবে। পরের বাস আবার সেই সন্ধ্যা ৬ টায়। প্রায় দেড় ঘন্টা পর। মানহাকে যে যেতে হবে, এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। সুতরাং এই ৮ মিনিটে কিছু একটা করতে হবে। স্ট্যাণ্ডে লোকজন খুব বেশি। বাসের সংখ্যা কম।
মানহা একবার পিছনে তাকিয়ে বাস দেখে নিলো। লোকজন নিজেদের সিটে বসতে শুরু করছে। একটু পর তাকেও উঠতে হবে।

সে ঢোক গিলে অনুনয়ের স্বরে তাহমিদকে বলল,
– ‘ তুমি আমার সাথে চলো প্লিজ।’
– ‘ পাগল হয়েছ নাকি?’ ভড়কে উঠল তাহমিদ।
মানহা আগের থেকে আরও বেশি অসহায় আর অনুনয় করে বলল,
– ‘ প্লিজ চলো। দেখো, আমি জানি না বাবা-মা কেন আমায় এত তাগাদা দিয়ে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার খুব ভয় হচ্ছে। আমার এক্সাম শেষ। আবার ঢাকায় আসতে দেরি হবে। এর মধ্যে যদি কিছু হয়ে যায়।’
– ‘ মরে যাওয়ার কথা আর বলবে না।’ জোর গলায় বলল তাহমিদ।
মানহা চোখের জল ফেলে আবার বলল,
– ‘ ঠিক আছে, বলব না। কিন্তু তবুও তুমি আমার সাথে চলো। দেখো, প্রতিমাসে ভাইয়া এসে আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। তুমি তো সব জানোই। ডাক্তার যা বলার, ভাইয়াকে বলেন। সুতরাং এই এই অসুখের অজুহাতে আমি তোমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছি না। আমার মনে হচ্ছে, আমি বাড়িতে গেলে ওরা আমার বিয়ে দিয়ে দেবে।’
– ‘ এটা কীভাবে সম্ভব? তাঁরা তো জানেনই তোমার আয়ু বেশিদিন নেই। ইনফ্যাক্ট এটা সবাই জানে। তাছাড়া কোনো ছেলে জেনেশুনে তোমার সাথে বিয়ে করতে রাজি হবে না।’
– ‘ তুমি তাহলে রাজি হয়েছ কেন?’ নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা করল মানহা।
তাহমিদ জবাবে বলল,
– ‘ কারণ আমি তোমায় ভালোবাসি। আমি চাই, তোমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমার পাশে থাকতে। অন্য কোনো ছেলে তোমায় ভালোবাসে না। তাই সে সবটা জেনে তোমায় বিয়ে করবে না।’
মানহা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে এক হাত কোমরে রাখল। অন্য হাত দিয়ে ঠোঁট আর নাকের মাঝখানে থাকা ঘামটুকু মুছে ভারী কণ্ঠে বলল,
– ‘ আমার বাবা-মা হয়তো তাঁদের বিষয়টি জানাবেই না। এইরকম তো অহরহ হচ্ছে। তাছাড়া ভাইয়া তো আমার আপন ভাই না। সৎ ভাই আমার। বাবার প্রথম স্ত্রীর সন্তান। আমি বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান। বাবা যে আমাকে খুব একটা পছন্দ করে না, তা আমি জানি। কারণ আমার অসুখের জন্য তাঁর পকেটের টাকা খরচ হচ্ছে। ভাইয়াও অনেকটা শান্ত হয়ে গেছে। সৎ বোনের জন্য আর কত করবে? তাই হয়তো চাচ্ছে, আমাকে অন্যের ঘাড়ে ঝুঁলিয়ে দিতে। দেখো আমি শুধু চাই মরার আগ পর্যন্ত তোমাকে পাশে পেতে। যেন তোমার কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি।’
তাহমিদ অসহায়ের মতো তাকিয়ে বলল,
– ‘ তোমার কিচ্ছু হবে না মানহা। আমার ফাইনাল ইয়ারের প্রজেক্টের কাজ চলছে। এক্সাম চলছে। এইসব ফেলে আমি এখন তোমার সাথে চলে গেলে, আমার একটা বছর নষ্ট হবে। আমার ভাইয়া কত কষ্ট করে আমাকে পড়াচ্ছে। আমাকে নিয়ে তাঁর কত স্বপ্ন। ১টা বছর নষ্ট হলে তাঁর সামনে দাঁড়াতে পারব না আমি।’
– ‘ আর আমার কিছু হয়ে গেলে তুমি নিজের বিবেকের সামনে দাঁড়াতে পারবে তো?’ মানহার স্বরে হুমকি ভাব ফুটে উঠল।
তাহমিদ বলল,
– ‘ তুমি আমার বাড়িতে চলো। ভাবীকে আমি যা বলার বলব। আমার পরীক্ষাগুলি শেষ হোক, তারপর আমরা একসাথে তোমার বাড়িতে যাবো। তাঁরা আমাদের সম্পর্ক না মানলেও আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না।’
– ‘ সেটা সম্ভব না। যে আমাকে জন্ম দিয়েছে, যারা আমাকে খাইয়ে পড়িয়ে বড় করে তুলেছে, তাদের দেওয়া প্রতিজ্ঞা আমি ভঙ্গ করতে পারব না। আমাকে এই বাসে করেই যেতে হবে।’
– ‘ তারপর কী করবে? পরিবারের কথামতো বিয়ে করবে?’
– ‘ আমি তাঁদের বিরুদ্ধিতা করতে পারব না। সেই সাহস আমার নেই। কিন্তু তুমি পাশে থাকলে আমি অন্তত বলতে পারব, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই না।’ কোমর থেকে হাত নামিয়ে আবারও পিছনে তাকিয়ে বাস দেখে নিলো।

ড্রাইভার এখনো সিটে বসেনি। সে টিকিট কাউন্টারে কথা বলছে। হাতে আছে আর চার মিনিট। এক্ষুনি হয়তো ড্রাইভার বাসে উঠবে। এরপর বাস স্টার্ট দিবে।
তাহমিদ কিছু বলছে না দেখে মানহা আবারও বলল,
– ‘ প্লিজ আমার সাথে চলো। বাবা-মা আর ভাইয়ার কথাকে অমান্য করে আমি এখানে থাকতে পারব না। তাঁরা আমাকে আজকে এই জায়গায় আসতে সাহায্য করেছে। তাঁরা না চাইলে তো আমি ঢাকাতেই আসতে পারতাম না কখনো। তোমার সাথে পরিচয়ও হতো না। তাই তাঁদের অবাধ্যতা আমি করতে পারব না।’

তাহমিদের খুব রাগ হলো মানহার উপর। তাঁর পেট একদম ফাঁকা৷ টেনশনে গতরাতে কিছু খায়নি। আজ সকালে খাওয়ার সময়ই পায়নি। এক্সাম দিয়ে আবার এখানে আসতে হয়েছে। অর্থাৎ গতকাল রাত থেকে এখন পর্যন্ত সে ঠিকঠাকমতো পানিও খেতে পারেনি। এইসময় আবার নাকি তাকে বরিশাল যেতে হবে। এইসব এর কোনো মানে হয়? তাহমিদ ধকম দিয়ে বলল,
– ‘ তোমার কাছে তোমার পরিবারের যতটা গুরুত্ব আছে, আমার কাছে আমার পরিবারেরও ততটাই গুরুত্ব আছে। আমার বড় ভাই, আমার বইপত্রের খরচ দিতেই হিমশিম খায়। এখন যদি আমি একটা বছর নষ্ট করি, তাহলে কতটা ক্ষতি হবে বুঝতে পারছ?’
– ‘ তোমার জীবনে সবার গুরুত্ব আছে, শুধু আমার নেই, তাই তো?’ কিছুটা কড়া হলো মানহা।
তাহমিদ আগের মতো ধমকে বলল,
– ‘ আছে। অবশ্যই আছে। না থাকলে আমি ছুটে আসতাম না এখানে।’
– ‘ এসে লাভটা কী হলো শুনি? তুমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছ, আমি এখন গ্রামে গেলে তোমার থেকে হারিয়ে যাবো। বাবা-মা আমাকে এত তাড়া দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কেন, তা সঠিক ভাবে আমি না জানলেও আমার সিক্স সেন্স বলছে, হয় আমার অসুখটা গুরুতর হয়েছে, তাই তাঁরা আমায় ওখানে যেতে বলছে; আর নাহয় আমার দায় এড়াতে আমাকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করতে চাচ্ছে। যাতে আমার চিকিৎসার ভার আর তাঁদের না নিতে হয়। এই দু’টোর যেটাই হোক, আমি যে তোমায় হারিয়ে ফেলবো, সেটা নিশ্চিত।’ কথাগুলো একনাগাড়ে বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল মানহা। মুখ চেপে কোনোরকমে নিজেকে সামনে নিলো।
তাহমিদের মাথা সাংঘাতিক গরম হয়ে আছে। তাঁর শরীর দূর্বল এমনিতেই। তার উপর এইসব ঝামেলা। সহ্য করতে পারছে না। একটু চুপ থেকে বলল,
– ‘ তুমি যদি এখন বাড়িতে না যা-ও, তাহলেই সবদিক স্বাভাবিক থাকবে। দেখো, মৃত্যু আল্লাহর হাতে। তাই তুমি যেখানেই থাকো না কেন, তোমার মৃত্যু লিখা থাকলে অবশ্যই তা হবে। আর তোমার সাথে যদি আমার মিলন লিখা থাকে, তাহলে সেটাও হবে। আমার শরীরটা অসুস্থ লাগছে। ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছি না। প্লিজ, আমার সাথে এসো তুমি। আমার বাড়িতে চলো। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তোমাকে হারাতে চাই না। তোমার অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি। যারা তোমার জন্য এতকিছু করেছে, তাঁদের কষ্ট দিতে চাও না তুমি। অন্তত নিজের জীবনের শেষের দিনগুলোতে তাঁদের আঘাত করতে চাও না। কিন্তু কী করবে বলো, পরিস্থিতির স্বীকার আমরা।’

বাসের হেল্পার তাগাদা দিলো সবাইকে। বাসের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল আরও কয়েকজন। তাঁরা পরিবারের লোকদের সাথে কথা বলছিল। হেল্পারের তাগাদায় সবাই উঠে গেল বাসে। মানহা হাতে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকালো। চোখের জল মুছে বলল,
– ‘ বেশ, তুমি তাহলে নিজের মতো ভালো থেকো। আমাকে ভুলে যাও।’
– ‘ এখানে ভুলে যাওয়ার প্রসঙ্গ আসছে কেন?’ ঢিপঢিপ চোখে তাকিয়ে বলল তাহমিদ।
– ‘ আর কিছু বলতে পারব না তাহমিদ। আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তুমিও জানো, আর আমিও জানি, এটাই আমাদের শেষ দেখা৷ প্রেম মানুষের জীবনে একবার হলেও আসে। আমাদের জীবনেও এসেছিল। আমার অসুখের কথা জেনেও তুমি আমাকে ভালোবেসেছিলে। এরজন্য আমি সারাজীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো৷ আমি তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি। একটা বিয়ে মানে অনেক কিছু। সুতরাং তুমি চাইলেও এখন আমাকে নিয়ে গ্রামে যেতে পারবে না। আমার বাবা-মাকে বলে আমাকে বিয়ে করতে পারবে না। ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ হলে তুমি চাকরি করতে। তারপর হয়তো বিয়ের কথা ভাবতে। আমাকে বিয়ে করে তুমি বেশিদিন সুখে থাকতে পারবে না। অনেকটা দেরিতে হলেও এটা বুঝেছ তাহলে।’
– ‘ মানহা, আমায় ভুল বুঝছ তুমি। দেখো, আমি তোমাকে মন থেকেই ভালোবাসি।’
মানহা কঠিন করে বলল,
– ‘ প্রেম করে ভালোবাসা আর বিয়ে করে ভালোবাসা এক নয়। প্রেমিক হিসেবে তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো। কিন্তু আমাকে বিয়ে করা তোমার দ্বারা সম্ভব না। কারণ তুমি জানো, যেকোনো সময় আমি মরে যেতে পারি। এখানে আমি তোমাকে দোষারোপ করব না। দোষটা আমারই। আমারই উচিত হয়নি নিজের অনিশ্চিত জীবনে তোমাকে জড়ানো। আসলে তোমাকে দেখেই ভালো লেগে গিয়েছিল। তাই তোমাকে ভালোবাসার লোভটা সামলাতে পারিনি।’
তাহমিদ, মানহার একটা হাত চেপে ধরল। অস্থির কণ্ঠে বলল,
– ‘ আমাকে একটু সময় দাও প্লিজ। আসলে আমি মানসিক ভাবে প্রস্তুত না এইসবের জন্য। তুমি পরের বাসে যাও। ততক্ষণে আমাকে সময় নাও। আমি একটু ভাবী। তারপর সিদ্ধান্ত নেবো।’
– ‘ ভাবাভাবির কিছু নেই আর। তুমি যদি এখন আমার সাথে যা-ও, তাহলে সেখানে কোনো ভালোবাসা থাকবে না। ওটা হবে দয়া দেখানো। সহানুভূতি থেকেই আমার সাথে যেতে বাধ্য হবে তুমি। আমি সেটা চাই না। ভুলটা আমারই। ১টা বছর মানে অনেককিছু। গালফ্রেন্ড এর জন্য নিজের পড়াশোনা এতবড় ক্ষতি কেন করবে? তোমার এই ১ বছরের জন্য সারাজীবন তোমাকে পস্তাতে হবে। তোমার ভবিষ্যতে একটা লাল দাগ থেকে যাবে। এইসব আমি জানি। তবুও অন্ধ হয়ে বোকার মতো বলে ফেলেছি, আমার সাথে চলো। ক্ষমা করে দিও প্লিজ। তুমি এখন গাজীপুর যাও। ভালো করে প্রজেক্টের কাজ করবে। ভবিষ্যৎ জীবনে অনেক উন্নতি করবে।’ কথাটা বলে হ্যাচকা টানে তাহমিদের হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিলো মানহা।

আর কোনোদিকে না তাকিয়ে বাসের কাছে চলে গেল। এরপর বাসে উঠে গেল ব্যাগ নিয়ে। ওরা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। মানহা চলে আসার পর তাহমিদ কিছুটা এগিয়ে এলেও মানহার চোখে চোখ রাখতে পারল না আর। মাথা নিচু করে টিকিট কাউন্টারে থাকা ছাউনির ভিতরে একটা বেঞ্চে বসে পড়ল।
পকেটের ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ করে। তাহমিদ ফোন বের করে দেখল, রনি নাম৷ সে রিসিভ করল। রনি জিজ্ঞেস করল,
– ‘ কোথায় তুই? মানহা তো চলে গেছে হল থেকে।’

তাহমিদ এলোমেলো কণ্ঠে কী যেন বলল কিছুক্ষণ। রনি কিছুই বুঝতে পারল না। ফোনটা কেটে দিলো।
তাহমিদ চুপচাপ বসে রইল অনেকটা সময়। বাস ছেড়ে দেওয়ার পর আধঘন্টা পেরিয়ে গেল৷ কী করবে বুঝতে পারল না তাহমিদ। মানহাকে সে মন থেকেই ভালোবাসে। তাকে হারিয়ে বুকে চাপা কষ্ট অনুভব করছে তাহমিদ। নিজের মনেমনে বলল,
– ‘ নাহ্, কাজটা ঠিক হয়নি। মানহা খুব কষ্ট পেয়েছে। আমার ১ বছরের থেকেও মানহা গুরুত্বপূর্ণ বেশি।’

৬ টার বাসে তাহমিদ নিজেও বরিশালের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলো।

২৭.
সন্ধ্যার আগে যখন বরের বাড়ির লোকজন এসে রাইশার মুখে হলুদ লাগাচ্ছিল ; সেসময় তাহমিদ নিজের সামনে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। সে একাই কুয়ো তলায় বসে ছিল। আসমার কাছে শুনেছিল, মানহাও এই কুয়ো তলায় বসে থাকতো। একটু পর পর টুপ করে গাছ থেকে পেয়ারা পাড়তো। আর খাওয়া শুরু করতো। আনন্দে নেচে উঠল। গাছটাও যেন মানহার নাচ দেখার লোভ সামলাতে পারেনি। যে দুই বছর মানহা এসে পেয়ারা খেয়েছে, অন্যান্য বছরগুলোর তুলনায় সেই দুই বছরই সবচেয়ে বেশি পেয়ারা হয়েছিল গাছে।

এই পর্যন্ত অনেকেই তাহমিদকে ডাকতে এসেছে। কিন্তু তাহমিদ কুয়ো তলা থেকে উঠেনি। মানহার বিরহে কাতর হয়ে যে সে কুয়ো তলায় বসে আছে, তা না। মানহার মৃত্যুর খবর তো আগেই পেয়েছিল। ইনফ্যাক্ট সে-ই প্রথম পেয়েছিল। জানাযা নামাজ পর্যন্ত পড়েছিল। উদাসীন যা হওয়ার, আগেই হয়েছিল। এখন শুধু বুকে কিছু দীর্ঘঃশ্বাস জমে আছে। যা থমকে গিয়ে মাঝে মাঝে কষ্ট দেয়। যেমন গতকাল দিয়েছিল। হৈহুল্লা ভালো লাগছিল না বলেই সে একজায়গায় চুপচাপ বসে ছিল। কিন্তু হঠাৎ এমন একজনকে দৃষ্টির সীমানায় আবিষ্কার করল, সে নিজে থেকেই ওঠে দাঁড়াতে বাধ্য হলো।

তানিশা মুচকি হেসে একবার আশেপাশে তাকালো। সবাই কনে-কে নিয়ে ব্যস্ত। তাই সে এগিয়ে এলো তাহমিদের দিকে৷ কুয়োর উপরে বসল। কুয়োর গভীরতা না দেখেই পিছনে তাকাতেই মনে হলো পিছনে পড়ে যাচ্ছে। তাহমিদ চট করে তানিশার হাতটা ধরে ফেলল। উৎকণ্ঠাযুক্ত গলায় বলল,
– ‘ আরে এত ছটফট করছিস কেন? পড়ে গেলে তো তোকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।’

তানিশা, তাহমিদের হাতটা শক্ত করে ধরে আবারও নিচের দিকে তাকালো। চমকে ওঠে আবার বলল, – ‘ আরে বাপ্রে! ভেবেছিলাম মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। তাই লাফিয়ে বসে পড়েছি। তুই না ধরলে তো পড়েই যেতাম।’
– ‘ হুম। এবার ট্রিট দে। তোকে এত কষ্ট করে বাঁচালাম।’ রসিক সুরে বলল তাহমিদ।
– ‘তুই উল্টো আমায় ট্রিট দে। আমি এখানে এলাম বলেই না তুই আমাকে ধরার সুযোগ পেলি। মেয়েদের হাত ধরার জন্য কিন্তু অনেক সাধনা করতে হয়।’ খুব গৌরবের গলায় কথাটা বলল তানিশা।
হেসে উঠল তাহমিদ। জিজ্ঞেস করল,
– ‘ তুই যে এখানে আসবি, আমাকে জানাসনি তো? কখন এসেছিস?’
– ‘ অনেকক্ষণ আগে। এতক্ষণ বাকিদের সাথে গল্পগুজব করলাম। তোর সামনে দিয়েই গেলাম, অথচ আমাকে দেখলিও না।’
– ‘তাই নাকি?’ কপাল কুঁচকালো তাহমিদ। আবার বলল,
– ‘কালকেও তো সাথে কথা হলো। তখন অন্তত বলতে পারতি তুই এখানে আসছিস।’
তানিশা নিচে নামল। বলল,
– ‘ আরে মামা, তোর ফিট খাওয়ার কথা শুনেই তো সকালে আমি আর তুহিন ভাই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আগে জানতাম নাকি আমি আসবো? তা কাহিনিটা কী? আমাকে খুব বেশি মিস করে কী শেষমেশ অজ্ঞান হয়ে গেলি?’ কথাটা বলে নিজেই হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো করতে লাগল তানিশা।
তাহমিদ দাঁত কিড়মিড় করে মনেমনে বলল,
– ‘যত্তসব পাগলের দল।’ কেঁশে মুখে বলল, – ‘ তোকে মিস করার কী আছে? তাছাড়া অজ্ঞান-টজ্ঞান কিছু না। আমি তো একটু ভং করছিলাম।’
হাসি থামিয়ে তানিশা বলে উঠল,
– ‘ ভং ধরছিলি! এটা কী সিনেমা? যে তুই অজ্ঞান হওয়ার অভিনয় করছিলি। আর তোর প্রিয়তমা সেই ঢাকায় বসে গান গেয়ে তোকে জাগিয়ে দিবে। এইরকমই ভাবছিলি বুঝি।’ কথাটা বলে আবারও হেসে উঠল তানিশা।

তাহমিদ রেগে দিয়ে তানিশার চুলগুলো টেনে দিলো। তানিশা হাসি থামিয়ে ‘উফ’ বলে চেঁচিয়ে উঠতেই তাহমিদ ভয় পেয়ে চুল ছেড়ে দিলো। তানিশা আবার হাসতে হাসতে চেয়ারে বসল। বলল,
– ‘ তুই কি জানিস না মেয়ে জাতি চুলের প্রতি কতটা যত্নশীল? মেয়ে জাতি সব সহ্য করতে পারে, কিন্তু চুল টানা সহ্য করতে পারে না। কুয়োর ভিতরে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে তুই আমাকে বাঁচিয়েছিস। তাই এবারের মতো মাফ করে দিলাম। এবার বল তো তোর কী হইছে?’
– ‘ নতুন করে আমার আবার কী হবে? যা হওয়ার তা আগে হয়ে গেছে। তুই যে নির্লজ্জের মতো নিজের বাবা-মাকে বিয়েসাদী কথা বলেছিস, তোর কী লজ্জাসরম নেই?’
– ‘ আছে তো। বাবার সামনে তো আমি খুব লজ্জায় পড়ে গেছিলাম। মা বাবাকে বলেছে। আমি বলিনি।’ কথাটা বলেও কিছুটা লজ্জা পেলো তানিশা। খানিকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে আবার বলল, – ‘ভাবীর বোন, মানে আসমার সাথে একান্তে কিছু কথা বললাম। ও আমাকে সবটা বলেছে।’

চমকে উঠল তাহমিদ। চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল,
– ‘ সব বলেছে?’
– ‘ হ্যাঁ।’ স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিলো তানিশা। পরক্ষণেই আবার বলল, – ‘ মানহার ব্যাপারেও সব বলেছে। তোর আর মানহার মধ্যে কী হয়েছিল, সেটা তো ও জানে না। কিন্তু মানহার মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল, সেটা জানে। আমি খুব কষ্ট পেয়েছি সব শুনে। সেসময় তোর উপর দিয়ে কী ঝড়টাই না বয়ে গেছিল!’
– ‘ আরে চুপ কর তো। আমার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাবে কেন?’ বিরক্ত হলো তাহমিদ।
তানিশা বলল,
– ‘ খুব যে কষ্ট পেয়েছিলি, তা তো অস্বীকার করতে পারবি না। তাছাড়া কাল যে তুই হঠাৎ অচেতন হয়ে গেলি, সেটাও তো মানসিক আঘাত পেয়ে।’
– ‘ এইসব গাজাখুরী কথাবার্তা। আমি কী এতই দূর্বল, যে সামান্য কিছু কথা শুনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবো? আসমা মেয়েটা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেই যাচ্ছিল। ওকে এড়িয়ে যেতেই আমি অজ্ঞান হওয়ার ভান করছিলাম।’
– ‘ তাকি নাকি?’ কথাটা বলে চোখ পাকিয়ে তাকালো তানিশা। আবার বলল, – ‘ তা হাসপাতালে যাওয়াটাও কি তোর অভিনয় ছিল?’
– ‘ হ্যাঁ। ওরা সবাই বোকা। ভয় পেয়ে আমায় নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করছিল। আরে ভাই, চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিলেই তো আমি চোখ মেলে তাকাতাম।’
– ‘ ভাবী তো বলল, তোর মুখে পানি দিয়েছিল। কিন্তু তুই তাকাসনি। তাই তো একটা ভ্যান দিয়ে তোকে হাসপাতালে গিয়ে গেছিল। তুই কী এখন বলবি, ভাবী মিথ্যে বলেছে?
– ‘ না। ভাবী মিথ্যে বলবে কেন? পানি দিয়েছিল তো। তবে গরম একটু বেশি ছিল বলে ওইটুকু পানিতে কাজ হয়নি।’

তানিশা চেয়ার ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল৷ তাহমিদের বুকে ধাক্কা দিয়ে রাগী গলায় বলল,
– ‘ ধুর! ফাজলামি করিস না। তোর কথা বিশ্বাস করার কোনো মানেই হয় না। অভিনয় করে হাসপাতালে যাওয়া; ডাক্তারদের সেবা নেওয়া; এতকিছু সম্ভব না। আমি চোখ বন্ধ করে আছি; অথচ সবাই চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এখানে আমি হলে তো হেসেই লুটোপুটি খেতাম। তুইও খেতি। সুতরাং এটা অভিনয় ছিল না। তাছাড়া ডাক্তার তোকে দেখে কী বলেছে, সেটাও শুনেছি আমি।’

বিরক্তিতে আর কথা বলতে পারল না তাহমিদ। তানিশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
– ‘ চল হেঁটে আসি।’
– ‘সন্ধ্যা হয়ে আসছে।’ অনীহা দেখালো তাহমিদ।
তানিশা গম্ভীরমুখে প্রতিবাদী কণ্ঠে বলল,
– ‘ হোক, তবুও আমি যাবো।’

অগত্যা বাধ্য হলো তাহমিদ। দু’জনে পাশাপাশি হেঁটে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। হাঁটতে হাঁটতে আচমকা তানিশা প্রশ্ন করল,
– ‘ তুই আমার বাবাকে কী বলেছিস শুনি?’
তাহমিদ ভেবে বলল, – ‘ কী বলেছি?’
– ‘ তুই জানিস না কী বলেছিস?’ কিছুটা রেগে গেল তানিশা। – ‘বাবা তোর নাম্বার চাইলো; আমি ভাবলাম হয়তো জরুরি কোনো কথা বলবে; তাই নম্বর দিলাম। সে ফোন করে জিজ্ঞেস করল, ‘ তুমি কী সত্যিই আমার মেয়েকে বিয়ে করবে?’ আর তুই উত্তরে কী বললি। বাবা তো রেগেমেগে ফায়ার। আমাকে শাসিয়ে বলল, ‘ যে ছেলে বিয়ের আগেই এত হেয়ালিপনা করে, তাঁর সাথে আর যাই হোক, বিয়েসাদী নিয়ে আলোচনা করা যায় না।’
তাহমিদ ফিক করে হেসে বলল,
– ‘ আর কী বলতাম বল। প্রথমবার জিজ্ঞেস করল; আমি বললাম, ‘আঙ্কেল, আমি ঢাকায় এসে নেই। তারপর ভাবীকে নিয়ে আপনাদের বাড়িতে গিয়ে যা বলার বলব।’ তাঁর এখানেই বুঝে যাওয়া উচিত ছিল আমি কী বলতে চাচ্ছি। তখন সে আবারও একই প্রশ্ন করল। আমি বললাম, ‘ আমাকে একটু ভাববার সময় দিন।’ সে দিলো না। আবার বলল, ‘তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করবে কি-না সেটা বলো?’ আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। রাগারাগি তো আর করতে পারি না। তাই সুন্দর করে বলে দিলাম, ‘ আমি বিয়ে করব না আপনার মেয়েকে।’ সে মনেহয় এই কথাটা শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিল। বলল, ‘ বেশ, তাহলে ফোন রাখছি।’ আজব মানুষ সবাই। এই পৃথিবীতে যে কত রকমের অদ্ভুত মানুষ আছে, তা তুই ভাবতেও পারবি না। হাসপাতালের ডাক্তার আমায় বলে, ‘ তোমার শরীরটা দূর্বল। আজকের দিনটা আমাদের এখানে থেকে যাও।’ তুই বল, পেসেন্টকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য হাসপাতাল রাখা হয়, না জামাই-আদর করার জন্য? উনার কথা শুনে মনে হলো, উনি মেয়ের জামাইকে বলছে, ‘জামাইবাবাজি, আজকের দিনটা আমাদের সাথে থেকে যাও। আবার কবে আসবে না আসবে, তাঁর কী ঠিক আছে!’ আসলে এইসব ওদের টাকা কামানোর ধান্দা। আমাকে যতক্ষণ ওখানে রাখবে, বিল অটোমেটিক বাড়তে থাকবে। পারে তো ১০ দিনের জন্য আমাকে লাইফ সাপোর্টে রেখে দেয়। অথচ আমার কিছুই হয়নি। তোর বাবা-ও এইরকম আচরণ করছিল। আরে ভাই, আমাদের বিয়ে হলে আপনি হবেন আমার শ্বশুর। এইসব বিয়েসাদী নিয়ে আমি কী আপনার সাথে আলোচনা করব? আমার কী লজ্জাসংকোচ নেই?’

তাহমিদের কথা শুনে হাসতে লাগল তানিশা। হাসতে হাসতে তাহমিদের হাত জড়িয়ে ধরল । তাহমিদ হাতটা সরিয়ে দিলো না। মেয়েরা নিজের ইচ্ছায় স্পর্শ করলে সরিয়ে দিতে নেই। বরং এতে আলাদা একটা শিহরণ আছে। যা প্রকাশ করার মতো ভাষা বাংলা অভিধানে নেই।

তাহমিদ আর কিছু বলল না। তানিশা তাঁর হাত জড়িয়ে ধরে হাঁটছে। খোলা আকাশের নিচে দু’জনে। আকাশ আর তাঁদের মাঝে কোনো বাধা নেই। সন্ধ্যায় হয়ে আসছে। চারিদিকটা আস্তে আস্তে আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে। চোখের দৃষ্টি দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না তানিশার মুখটা। তবে অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে অনুভব করা যাচ্ছে। তানিশা খুব স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটছে। মনে কোনো জড়তা নেই। যেন সে খুব নিরাপদে আছে। তানিশাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে তাহমিদের ইচ্ছে করছে, ওকে একবার জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। এর আগেও একবার ভুল করে ফেলেছিল তাহমিদ। এরজন্য তাকে মহা বকাঝকা খেতে হয়েছিল। তবে এখন সেরকম কিছু হওয়ার ভয় নেই। আগের সময়টা ভিন্ন ছিল। এখনকার সময়টাই রোমান্স করার। সরু পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দু’জনে। পাশেই আছে শুকিয়ে যাওয়া নদী। চৈত্র মাসেই নদীটা কেমন শুকিয়ে গেছে! একটা ব্রিজ দেওয়া হয়েছে পাড়াপাড়ের জন্য। তানিশা আর তাহমিদ হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজের উপরে গেল। দূর থেকে পাখির ডাক ভেসে আসছে। কোথায় যেন ঝিঁঝিঁপোকারা অদ্ভুত একটা শব্দ করে ডাকছে। মুহূর্তটা দেখে ওদের মনে হলো, ‘প্রকৃতি যেন ওদের কিছুটা স্পেশাল মুহূর্ত উপহার দিয়েছে।’ তাহমিদের ইচ্ছে করছে তানিশাকে একটু ভালোবাসতে। মেয়েটা তাকে এতই ভালোবাসে যে, তাঁর সামান্য অসুখের কথা শুনে সব কাজ ফেলে ঢাকা থেকে বরিশাল চলে এসেছে। মনের গহিনে সাংঘাতিক পরিমাণ ভালোবাসা না থাকলে হয়তো এতকিছু সম্ভব না। তাহমিদও ভালোবেসে ফেলেছে তানিশাকে। কিন্তু ভালোবাসা প্রকাশ কীভাবে করবে, তা বুঝতে পারছে না। ব্রিজের মাঝে দাঁড়িয়ে চুপচাপ পশ্চিমের লালচে আকাশের দিকে তাকালো দু’জনে। মানহাকে ভালোবাসে যে কাজ তাহমিদ করেনি, তানিশাকে আচমকা ভালোবেসে সেটাই করল! তানিশার দুই কাধে হাত রেখে মুখোমুখি দাঁড়ালো। খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে হঠাৎ তানিশার কপালে যত্ন করে নিজের ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিলো। কেঁপে উঠল তানিশা। তাহমিদ এখানেই থেমে থাকলো না। তানিশাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো। শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে বলল, ‘ আই লাভ ইউ তানিশা।’
তাহমিদের কথা কতটা শুনেছে, তা তানিশা নিজেও জানে না। তাঁর নিঃশ্বাস থমকে গেছে। হৃদপিণ্ড সোজা হয়ে গেছে। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ গতিতে ঝাঁকি দিলো। প্রথম স্পর্শ! প্রথম অনুভূতি! প্রথম ভালোবাসা! সবকিছুর মিশ্রণে পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো তানিশার। দুই হাত বাড়িয়ে যে তাহমিদকেও জড়িয়ে ধরবে, সেই অবস্থাতেও সে নেই। নিজের শরীরের সমস্তটুকু এলিয়ে দিয়ে চুপচাপ তাহমিদের বুকে আবদ্ধ হয়ে রইল। তাহমিদের বুকের ভিতর ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে। তানিশার বুকেও হচ্ছে। তানিশার বুকের ঢিপঢিপ আওয়াজ শুনতে না পেলেও তাহমিদ তা অনুভব করতে পারছে। বুক ধড়ফড় করছে তানিশার। তাহমিদের বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্টে আছে সে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে