সম্পৃক্ততা – দশম পর্ব।
রিফাত হোসেন।
তাহমিদ গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করল, – ‘ আপনি মানহাকে চেনেন?’
প্রশ্নটা শুনে ইতস্ততবোধ করতে লাগল আসমা। কী বলবে, ঠিক বুঝতে পারছে না। মানহাকে ও চেনে, এই কথাটা তাহমিদকে জানানো ঠিক হবে কি-না, সেটাও বুঝতে পারছে না। মাথা ব্যথা করছে তাঁর। চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
তাহমিদ আবার জিজ্ঞেস করল, – ‘ কী হলো, বলুন আপনি মানহাকে চেনেন কি-না?’ তাহমিদের কণ্ঠে কিছুটা কড়া ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠল।
থতমত খেয়ে গেল আসমা; সাথে রাইশা। কিছুটা আড়ষ্টভাবে বলল,
– ‘ যদি বলি চিনি না, তাহলে আপনার জবাব কী হবে?’
তাহমিদ উগ্র কণ্ঠে বলল, – ‘ এটা বললে তো আপনি সক্কাল সক্কাল একটা মিথ্যা কথা বলবেন। আমি তো স্পষ্ট শুনেছি রাইশা বলল, ‘মানহা, মানে পেয়ারা আপা।’ দেখুন, এই পেয়ারা আপা কে তা আমি জানি না। কিন্তু মানহার নামটা যখন উচ্চারিত হয়েছে, তাহলে অবশ্যই আপনারা মানহাকে চেনেন। বলছিলাম কী, আপনাদের পরিচিত এই মানহার বাড়ি কি নদীর ওপাড়ের গ্রামে?’
আসমার শরীরটা ঝেঁকে উঠল তাহমিদের কথা শুনে। তাঁর কাছে সব পরিষ্কার। ফাতেমা বলেছিল, তাহমিদের সাথে একটা মেয়ের সম্পর্ক ছিল। মেয়েটাকে ফাতেমা স্ব-চোখে না দেখলেও পরিচয়টুকু জানে। তাহমিদ নিজেই বলেছিল। সমবয়সী বন্ধুসুলভ ভাবীর কাছে অনেক কিছুই শেয়ার করেছিল তাহমিদ। মেয়েটার নাম মানহা। বাড়ি এই বরিশাল। ঢাকায় গিয়েছিল পড়াশোনা করতে। ইউনিভার্সিটির হলে থাকতো। দেখতে সুন্দরী। অল্পতেই শরীরে আধুনিকতার ছাপ ফুটে উঠেছিল। এছাড়া আর কোনো তথ্য তাহমিদের কাছ থেকে জানা যায়নি। আসমার খটকা লেগেছিল শুরু থেকেই। প্রায় সবদিক থেকেই তাঁর কলেজ লাইফের বন্ধুর সাথে মিলে যাচ্ছিল। তবুও বিভ্রান্তি ছিল মনের মধ্যেখানে। চারিদিকে ভিন্ন ভিন্ন গ্রাম আছে; তাহমিদ অন্যসব গ্রামের কথা না বলে; এমনকি এই গ্রামের কথা না বলে সরাসরি নদীর ওপাড়ের গ্রামের কথা বলেছে। অর্থাৎ তাঁর সেই প্রেমিকা পাশের গ্রামে থাকে; এবং আসমার বান্ধবী মানহাও পাশের গ্রামে থাকে। পুরো ব্যাপারটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে আসমার কাছে। কিন্তু মানহার কী হয়েছিল, সেটা কী তাহমিদ জানে? সে তো সবাইকে বলেছিল, মানহা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সবাই ভেবেছে মানহা প্রতারণা করেছে তাহমিদের সাথে। কিন্তু আসলেই কী সেরকম কিছু ঘটেছিল?
তাহমিদের যেন ধৈর্যের বাধ ভেঙে যাচ্ছে ক্রমশ। তাঁর ইচ্ছে করছে আসমার দুই গালে ঠাসস করে দু’টো থাপ্পড় দিয়ে দিতে। তাহমিদ শেষবারের মতো দাঁত খিঁচিয়ে মুখে প্রশ্ন করল, – ‘ আপনাকে আমি একটা প্রশ্ন করেছি আসমা। আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।’
– ‘ আপনি যা অনুমান করেছেন, সেটা ঠিক। আপনার পরিচিত মানহা, আর আমার পরিচিত মানহা একজনই। আমার বান্ধবী মানহা ঢাকা গিয়েছিল পড়াশোনা করতে। ইন্টার পাস করে খুব সহজেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল। আমি ওখানে চেষ্টাই করিনি। আমার শহরের ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলাম। কারণ ঢাকায় পড়াশোনা করা আমার দ্বারা সম্ভব ছিল না।’
তাহমিদ ভাঙা গলায় বলল, – ‘ আর আমি প্রতি সপ্তাহে দু’বার করে সেই গাজীপুর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম মানহার সাথে দেখা করতে। গাজীপুর-এ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তাম আমি তখন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বন্ধুরা ছিল। ওদের মাধ্যমেই মানহার সাথে পরিচয়। এরপর আমাদের মাঝে সম্পর্ক তৈরি হলো; প্রেমের সম্পর্ক।’
– ‘ আর সেটার পরিনতি যেন কী হয়েছিল? মানহার মৃত্যু!’ ক্ষিপ্ত গলায় কথাটা বলেই রাইশার হাত চেপে ধরল আসমা। তাঁর মুখ দিয়ে আর কোনো শব্দ বের হলো না।
তাহমিদ থমকে গেল কিছু মুহূর্তের জন্য। বুকটা ভারী হয়ে এলো; যেন কেউ বিশাল একটা পাথর বুকে চাপা দিয়েছে। হাত-পা ঝিম ধরে গেল। নিজের অনিচ্ছাতেই চোখ থেকে বেয়ে পড়ল অশ্রু। অশ্রুসিক্ত চোখ দু’টো নিয়ে আর সামনের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। ঝাপসা চোখে ভেসে এলো একটা প্রতিচ্ছবি! একটা দৃশ্য! টিএসসির পাশে কোনো এক ফাঁকা স্থানে সাদা আর লাল রঙে মিশ্রিত শাড়ি পরে নাচছিল একটি মেয়ে। হাতে লাল রঙের চুড়ি। কপালে ছোট্ট টিপ; আর চোখে কাজল। ঘন ভুরুতে কাজল বেশ মানিয়েছিল। কমলার মতো ঠোঁট দু’টোয় ছিল লিপস্টিক। পায়ে ছিল ঘন আলতা। হাতে গাছের মেয়েদী। মেয়েটি নাচছিল। দিনটি ছিল পহেলা বৈশাখ। গোল হয়ে ১০-১২ জন্য ছেলে-মেয়ে বসেছিল। মেয়েদের পরণে শাড়ি, আর ছেলেদের পরণে পাঞ্জাবি। শুধু একজনের মধ্যে ভিন্নতা ছিল। সে হলো তাহমিদ। গাজীপুর থেকে যাতায়াত করে যেতে হয়েছিল বলে সে পাঞ্জাবি পরেনি। সাদামাটা শার্ট আর প্যান্ট পরেছিল। অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের মাঝেই বসেছিল সে। ওখানকার চার-পাঁচজনকে সে চিনলেও বাকিদের চিনতো না। সেদিনই প্রথম দেখেছিল। তবুও কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে সবার মাঝে আবদ্ধ থাকা মেয়েটিকে দেখছিল সে। সে অনেক আগে থেকেই মেয়েটা তাঁর পরিচিতি! ছোট্ট স্পিকারে চলছিল বাংলা গান। মেয়েটি গানের তালে তালে নাচছিল। একটু পরপর নিজের পরণের শাড়ি সামলাচ্ছিল। বন্ধুদের সাথে কথা বলে তাহমিদ জানতে পারল, মেয়েটি সেদিনই প্রথম শাড়ি পরিধান করেছিল। পহেলা বৈশাখের মতো অত আকর্ষণীয় একটা উৎসবে বাংলা গানের সাথে সেলোয়ার-কামিজ কিংবা জিন্স শার্ট বেমানান ছিল বলেই বাধ্য হয়েছিল শাড়ি পরতে। বন্ধুদের আবদারে নাচ করছিল। যতক্ষণ সে নাচ করছিল, তাহমিদ মুগ্ধ চোখে শুধু দেখছিল। নাচ শেষ করে হঠাৎ তাহমিদের সামনে ধপাস করে বসে পড়ল মেয়েটি। তাহমিদের বুকটা ধুক করে উঠেছিল সেসময়। হার্টবিট এলোপাথাড়ি ভাবে বেয়াদবি করছিল। তাহমিদ বুঝতে পারছিল না, সেসময় কী করবে। মেয়েটা তাঁর একদম মুখোমুখি বসেছিল। বাকিরা সবাই উঠে দাঁড়ালেও তাহমিদ আর মেয়েটা খানিকক্ষণ নীরবে বসেছিল। এরপর অন্য একটা মেয়ের তাগাদায় মেয়েটাও ওঠে দাঁড়ায়। কোমরে গুজে রাখা লাল-সাদা রঙের শাড়ির আঁচলটা হাতে তুলে নেয়। তাহমিদ বসে থেকেই মেয়েটার কোমরের দিকে তাকিয়েছিল। শুধুমাত্র এক মুহূর্তের জন্য দেখেছিল মেয়েটার মেদহীন মসৃণ কোমর। প্রেমে পড়ে গিয়েছিল সাথে সাথেই। কোমর দেখে প্রেমে পড়েছিল; এ কথা কেউ জানতে পারলে তাকে লুচ্চা বলে সম্মোধন করতো নিশ্চয়ই। এটা ভেবে নিজের মনেমনে বেশ লজ্জাও পেয়েছিল তাহমিদ। সেও সবার সাথে উঠে দাঁড়ায়। তখন আবার মেয়েটার মুখোমুখি হয়।
মেয়েটা সামনে এসে রাগী কণ্ঠে বলে, – ‘ আপনার কী কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই? এইরকম একটা দিনে আপনি শার্ট-প্যান্ট পরে এসেছেন কেন? এখন যদি আমরা গ্রুপ ফটো তুলে ফেসবুক আপলোড দেই, তাহলে লোকে কমেন্ট এ বলবে, একঝাঁক বাঙালি মানুষের সাথে একটা হিন্দি মাল! আপনিই বলুন, এইরকম মন্তব্য দেখলে কি আমাদের ভালো লাগবে?’
তাহমিদ কোনো কথাই বলতে পারছিল না সেসময়। নির্বাক হয়ে শুধু তাকিয়েছিল মেয়েটার দিকে। মেয়েটা নিজের নরম ঠোঁট দু’টো নাড়িয়ে মুচকি হাসি দিয়েছিল। বলেছিল, – ‘ বাই দ্যা ওয়ে, আপনার ঠোঁট দু’টো কিন্তু খুব সুন্দর।’
তাহমিদের খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘আপনার ঠোঁট দু’টোও খুব সুন্দর। কমলার মতো। দেখতেই কামড়ে দিতে ইচ্ছে করে!’ কথাটা ইচ্ছে পর্যন্তই থেমেছিল। মুখ দিয়ে আর বলার সাহস পায়নি। মেয়েরা চট করে ছেলেদের অনেক কিছু বলে ফেলে ফেলতে পারে। মাল, শালা, এইসব বলে গালাগালও দিতে পারে। কিন্তু ছেলেরা তা পারে না। মেয়েদের সাথে কথা বলার সময় ছেলেদের অনেক ভাবনাচিন্তা করতে হয়। শালী বললে আবার সম্পর্কের দিকে চলে যায় ব্যাপারটা। আর মাল বললে তো কাম সারছে! মাইর একটাও মাটিতে পড়বে না।
মেয়েটা আবার বলেছিল, – ‘ আচ্ছা, আপনি কি সিগারেট খান?’
তাহমিদ মাথা ঝাঁকিয়ে ‘না’ বলেছিল। মেয়েটা আবার বলেছিল, – ‘ কেন খান না?’
– ‘ আপনি বললে এখন থেকে খাওয়া শুরু করব।’ অনেকক্ষণ পর নিঃশ্বাস আটকিয়ে কথা বলেছিল তাহমিদ। এটা বলার পর আবার চুপ হয়ে গিয়েছিল।
কথাটা শুনে মেয়েটা কিছুক্ষণ ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে ছিল। এরপর হুকুম করে বলেছিল, – ‘ খবরদার খাবেন না। সিগারেট খেলে এত সুন্দর ঠোঁট জোড়া কালো হয়ে যাবে। আপনার ফরসা মুখে কালো ঠোঁট বিচ্ছিড়ি দেখাবে। শ্যামলা চেয়ারার সাথে কালো ঠোঁট মানায়; ফরসা চেহারার সাথে লাল ঠোঁট মানায়। সিগারেট খেতে ইচ্ছে করলে খাবেন; তবে এমনভাবে খাবেন যেন ঠোঁট জোড়া কালো না হয়।’
তাহমিদ মাথা নেড়েছিল। মেয়েটা আবার বলেছিল, – ‘ আর শুনুন, ঠোঁট জোড়া সাবধানে রাখবেন। এত আকর্ষণীয় ঠোঁট জোড়া দেখে কোনো কোনো মেয়ে আবার লোভ সামলাতে না পেরে চুমু দিয়ে বসবে। তখন হবে আরেক ঝামেলা। সবার চুমুতে তো একরকম ভিটামিন থাকে না। এই যেমন আমার চুমুতে মিষ্টি একটা ভিটামিন আছে। অন্যদেরটায় হয়তো অন্যকিছু আছে। সব ভিটামিন আবার আপনি সহ্য করতে পারবেন না। তাই সাবধান; নিজেও না বুঝে কাউকে চুমু দিয়েন না, আর কাউকে দিতেও দিয়েন না।’
তাহমিদ মাথা নেড়েছিল শুধু। প্রথম কেউ তাঁর ঠোঁটের প্রসংশা করছে। তাঁর ঠোঁট নিয়ে এত চিন্তা করছে। স্কুল, কলেজ, কত মেয়ের সাথেই তো দেখা হয়েছিল, কথা হয়েছিল, কিন্তু কেউ তাঁর ঠোঁট নিতে এতটা চিন্তা করেনি, যতটা চিন্তা ওই মেয়েটা করেছিল। অত প্রসংশাও করেনি। তাহমিদ সেদিনই ঠিক করেছিল, যাই হয়ে যাক, ঠোঁটের অযত্ন সে করবে না।
তাহমিদ ভেবেছিল, মেয়েটা চলে যাবে সেসময়। কিন্তু যায়নি; সে উচ্চস্বরে হেসে উঠে বলেছিল, – ‘ আপনাকে এবারের মতো মাফ করলাম। পরেরবার সবার সাথে মিলিয়ে জামা পরে আসতে হবে। আসুন, ওরা ছবি তোলার জন্য অপেক্ষা করছে।’
তাহমিদ ছবি তুলেছিল। মেয়েটা তাঁর পাশেই দাঁড়িয়েছিল। সে ক্যামেরার দিকে না তাকিয়ে আড়চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছিল। ক্যামেরাম্যান আড়চোখা তাহমিদকে না দেখে সেভাবেই ছবি তুলেছিল। পরে তাহমিদ সে-সব ছবি দেখে লজ্জায় লাল হয়ে গেছিল।
ছবি তোলা পর্ব শেষ হওয়ার পর মেয়েটা একগাল হেসে বসেছিল, – ‘দুঃখিত। আমি অনেক কিছু বলে ফেললাম। যা বলেছি, বন্ধু হিসেবে বলেছি। আপনাকে আমি চিনি। আপনি রনির বন্ধু। সপ্তাহে একদিন এখানে আসেন ওদের সাথে আড্ডা দিতে। আমি প্রায়ই দেখি আপনাকে। তাই জড়তা ছাড়াই অনেক কথা বলেছি। ভুল হলে মাফ করবেন।’
মেয়েটার ব্যবহারে তাহমিদের প্রেম আঠালো হয় আরও। সে মনেমনে ঠিক করেই নিয়েছিল, যেভাবেই হোক, মেয়েটার সাথে প্রেম করতেই হবে। ভিটামিন-এ,বি,সি,ডি, অনেক নামই শুনেছে তাহমিদ। কিন্তু মিষ্টি ভিটামিনের নাম সে জীবনেও শুনেনি। তাকে এই নতুন সৃষ্টি ভিটামিন গ্রহণ করতেই হবে। সেজন্য সে সপ্তাহে একদিনের জায়গায় দু’দিন করে ঢাকায় আসতে থাকে। পড়াশোনার গোল্লায় যাক! সবার জীবনেই প্রেম একবার অন্তত আসে। তাঁর জীবনেও এসেছিল। এত সহজে হাতছাড়া করা যায় নাকি? মেয়েটার সাথে আলাপ-পরিচয় বেশ জমে উঠে তাহমিদের। ওদিক থেকেও কিছুটা ইচ্ছুক ছিল বোধহয়। তাই ব্যাপারটা সহজ হয়েছিল আরও। সেই প্রথম দেখার দিন শুধুমাত্র মেয়েটার ‘মানহা’ নামটুকু জেনেছিল। এরপর আস্তে আস্তে আরও অনেক কিছুই জানতে পারে।
এরপর পেরিয়ে গেল মাঝের দীর্ঘ একটা সময়। এতগুলো দিন পর আজকের তাহমিদ সম্পূর্ণ অন্যরকম। জীবনটাই অগোছালো। তবে সে এখনো ঠোঁটের যত্ন নেয়৷ আঘাত পেয়ে যখন একাকীত্ব তাকে টানতো, তখন সে একজনের কথা ভেবেই নিজেকে এক জায়গায় স্থির রাখতো। কোনোরকম নেশাদ্রব্য স্পর্শ করেনি কখনো। মাঝে মাঝে শুধু শখের বসে সিগারেট খায়; পান করে।
২৫.
হঠাৎ কারোর ডুকরে কেঁদে উঠার শব্দে শোয়া থেকে বসে গেল আসমা। ঘরে বিদ্যুৎ নেই। গরম লাগছিল বলেই ঘুম আসছিল না আসমার। সামনের জানালা খোলা। ওখান দিয়ে বাতাস আসছে বটে, তবে শরীরকে ঠাণ্ডা করতে পারছে না। অনেকক্ষণ পায়চারি করেও চোখে ঘুম আনতে পারেনি আসমা। সেজন্য চোখ মেলে শুয়েছিল।
কান্নার আওয়াজটা পাশের ঘর থেকেই আসছে। পাশের ঘরে তাহমিদ আছে। সে একাই আছে পাশের ঘরে। আসমার ডানপাশে আছে ফাতেমা। তাঁর পাশে তৃষ্ণা। রাইশা বাবা-মায়ের ঘরে আছে। আর তাহমিদ একাই আছে পাশের ঘরে। ঘরটাতে তাহমিদ ছাড়া দ্বিতীয় কেউ থাকলে আসমা খুব একটা পাত্তা দিতো না। তাহমিদ নিশ্চয়ই কাঁদবে না এত রাতে! আসমা চুপচাপ শুয়ে রইল। কিন্তু মনকে স্বস্তি দিতে পারল না। মন যে পাশের ঘরে যাওয়ার জন্য উসখুস করছে।
মোবাইলে চার্জ নেই। ভেবেছিল সকালে ওঠে চার্জ দিবে। ক’টা বাজে, তাও অনুমান করা যাচ্ছে না। আসমা আবার উঠে বসল। বিছানা থেকে নেমে অন্ধকার হাতড়ে টেবিলের কাছে গেল। বিছানায় শোয়ার আগে এখানেই মোমবাতি রেখেছিল সে৷ মোমবাতি খুঁজে বের করল। দেশলাই দিয়ে আগুন জ্বালালো আস্তে আস্তে। ঘর থেকে বেরিয়ে উঠনো এলো। সে উঠোনে দাঁড়িয়েই দেখল, তাহমিদের ঘরের জানালা খোলা। সে-ও নিশ্চয়ই একটু ঠাণ্ডা হাওয়া চাচ্ছে। আসমা একবার ভাবল দরজা ধাক্কিয়ে তাকে হাত পাখা দিয়ে আসবে৷ ‘ এমনও হতে পারে তাহমিদ ঘুমোচ্ছে’ এটা ভেবে দরজা ধাক্কানোর সিদ্ধান্ত মাথা থেকে ত্যাগ করল। ঢিপঢিপ পায়ে এগিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালো। হাতের মোমবাতিটা একটু উঁচু করতেই দেখল তাহমিদকে। মেঝেতে হাটু মুড়িয়ে বসে আছে। দুই পায়ের মাঝে মাথা নিচু করে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। তাহমিদকে এইরকম অবস্থায় দেখে আতঙ্কে উঠল আসমা। জানালার কাছেই দাঁড়িয়ে রইল। তাহমিদের কোনো ভ্রু-ক্ষে নেই কোনোদিকে। দুই হাটুর মাঝে মাথা ডুবিয়ে দিয়ে বসে আছে নিশ্চিন্তে।
মাঝে মাঝে শুধু কেঁপে উঠছে, আর ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আসমা চোখ দু’টো বড় করে তাকিয়ে আছে ঘরের ভিতরে। মোমবাতির আলো আরও একটু উপরে তুলতেই তাহমিদ নড়েচড়ে উঠল। মুখ তুলে তাকালো জ্বানালার দিকে। আসমা খানিকটা চমকালেও চলে গেল না। আকাশের অবস্থা দেখে মনে হলো, এখন যেন ভোর! অথচ চাঁদ মাথার উপর মাত্র। নিশ্চিত এখন মাঝরাত।
আসমা সটান দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
– ‘ তাহমিদ, কী হয়েছে আপনার?’
তাহমিদ কোনো উত্তর দিলো না। অবাক চোখে শুধু তাকিয়ে রইল আসমার দিকে। যেন আসমাকে সে এই প্রথম দেখছে। আসমা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দরজার কাছে গেল। দরজায় কড়া নাড়ার আগে একবার ধাক্কা দিলো শুধু। অদ্ভুতভাবে দরজাটাই খুলে গেল। বিস্মিত চাহনিতে সামনের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেল। মোমবাতিটা পাশে রেখে তাহমিদের পাশে বসল নিজেও। কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, – ‘ আপনার কী হয়েছে? এইরকম করছেন কেন?’
– ‘ আপনি এখানে এসেছেন কেন?’ আগুন গরম চোখে তাকিয়ে আসমাকে ধমক দিলো তাহমিদ।
আসমা থতমত খেয়ে গেল। মনে পড়ল ফাতেমার কথাগুলো। তাহমিদ মাঝরাতে কারোর সাথে কথা বলে। ‘হ্যালুসিনেশন’ রোগে আক্রান্ত সে। এই সময় তাকে ডিস্টার্ব করা ঠিক হলো না। মনে মনে নিজেকে কয়েকবার গালাগাল দিলো আসমা। – ‘কিন্তু তাহমিদ কাঁদছে কেন? উনার চোখমুখ এখনো ভিজে আছে।’ এই প্রশ্নগুলো নিয়ে নিজের মনে ভাবতে লাগল আসতা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সাবধান গলায় বলল, – ‘ একটা বিশেষ কারণে এসেছি।’
ভ্রু জোড়া কুঁচকালো তাহমিদ। আসমার পরের কথার অপেক্ষায় রইল। এই মুহূর্তে কথা বলার কোনো ইচ্ছে নেই তাঁর। তবে শোনার ইচ্ছে আছে। মাঝরাতে আসমা কী বিশেষ কারণে এসেছে, তা জানা প্রয়োজন। তাহমিদ একটু নড়েচড়ে বসল। হাত দিয়ে মুখটা মুছল। কপালের ঘাম মুছল। সে শোনার জন্য প্রস্তুত ; নড়েচড়ে এটাই আসমাকে বুঝালো।
আসমা একটু নীরব থাকার পর বলল, – ‘আমার বাবা-মা আমাকে জোর করে অন্য একটা ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এখন আমার কী করা উচিত?’
– ‘ পালিয়ে যাওয়া উচিত। এইরকম বাবা-মায়ের থেকে যত দূরে থাকবেন, ততই ভালো।’ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে জবাব দিলো তাহমিদ।
ওর কথা শুনে আসমার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল। স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর নিজেকে সামলে নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল,
– ‘একটু ভাবুন। ভেবে বলুন। আমার দিকে তাকান।’
তাহমিদ তাকালো আসমার দিকে। চোখের গভীরে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ নীরবতার দু’জনের মধ্যে। হঠাৎ নীরবতা কাটিয়ে তাহমিদ বলে উঠল, – ‘ কখনো দেখেছেন নিজের পায়ে নির্ভরশীল কোনো মেয়েকে তাঁর বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিচ্ছে?’
– ‘ না।’ অবাক হয়ে উত্তর দিলো আসমা।
তাহমিদ আসমার দিকে তাকিয়ে থেকেই মৃদু হেসে আবার বলল, – ‘ কারণ তাঁরা জানেন, তাঁদের মেয়ে যে খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে আছে, সেট বেশ শক্ত। অর্থাৎ মেয়েটা চাইলেই তাঁদের ছাড়াও নিজের মতো থাকতে পারে। তাই বাবা-মা এই বোকামিটা করে না। তাঁরা জোর করে তাকেই বিয়ে দেয়, যে দূর্বল। যে অন্যের খুঁটির উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিজস্ব কোনো খুঁটি নেই। শুধু আপনার ক্ষেত্রে না, যে মেয়ে নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে শিখেছে, কোনো বাবা-মা-ই তাঁদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারে না। এরজন্য প্রতিটি মেয়েরই উচিত সারাজীবন অন্যের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজে কিছু করা। যে খুটিটার উপর দাঁড়িয়ে আছে, সেটা নিজের এবং মজবুত করা। তাহলেই কোনো বাবা-মা তার সাথে জোরজবরদস্তি করতে পারবে না। তাকে গুরুত্ব দিবে। যা-ই করবে, আগে মেয়েটার সাথে আলোচনা করে নিবে। কারণ বাবা-মা তখন বিশ্বাস করেন, তাঁদের মেয়ে বড় হয়েছে। জোড়াজুড়ি করলে মেয়েকে হারাতে হবে। ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না। আপনি শিক্ষিকা মানুষ। বাবা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেও ঢাকা গিয়ে কিছু একটা করতে পারবেন। সুতরাং আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনাকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টার মতো বোকামি তাঁরা করবে না।।’
আসমা অবাক হলো খুব। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তাহমিদের দিকে। এইরকম কিছু তাঁর ভাবনাতেও আসেনি। তাহমিদ আবার বলল, – ‘ উত্তর পেয়ে গেছেন নিশ্চয়ই। এবার যান প্লিজ।’
আসমা গেল না। চুপচাপ বসে রইল সেখানেই। তাহমিদও আর তাকে পাত্তা দিলো না। দু’জনে মধ্যে আবার নীরবতা নেমে এলো। ঘরে ঘড়ি নেই। থাকলে হয়তো এই নিস্তব্ধতায় ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ শোনা জেতো।
দীর্ঘক্ষণ পর আসমা আবার বলল, – ‘ আপনি মানহাকে খুব ভালোবাসতেন, তাই না?’
তাহমিদ মাথা নাড়ালো শুধু। এমন ভাব ধরল, যেন সে ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। আসমা আবার জিজ্ঞেস করতো, – ‘ আপনি এটাও জানতেন মানহা সেদিনই মারা গেছিল, তাই না?’
আগের মতো নিশ্চুপ থেকে মাথা নাড়ালো তাহমিদ৷
আসমা আবার বলল, – ‘ মানহাদের পারিবারিক কবরস্থানেই মানহাকে কবর দেওয়া হয়েছিল। পরিচয়ের জায়গায় সিরিয়াল নম্বর লেখা ছিল। সেই সিরিয়াল নম্বরটি ছিল ‘009’। আমি কী ঠিক বলছি?’
আগের মনোভাব বজায় রেখে মাথা ঝাঁকালো তাহমিদ।
আসমা একটু ভেবে আবার বলল,
– ‘মানহার একটা অসুখ ছিল ছোট থেকেই। ও সেটার জন্য সারাক্ষণ মৃত্যুর ভয়ে থাকতো। ভাবতো, এই বুঝি ও মরে গেল। ওদের পারিবারিক কবরস্থানে আগেই ৮টা কবর ছিল। ওদের বংশের ৮জন মারা গিয়েছিল আগেই। ও ধরেই নিয়েছিল, ৯ নম্বর সিরিয়ালে ওর কবর থাকবে। সবার সিরিয়ালে ’01 বা 02’ থাকলেও মানহা সবসময় বলতো, ওর সিরিয়াল নম্বর হবে ‘009’। ওর ক্ষেত্রে একটা শূন্য বেশি কেন, সেটা কী আপনি জানেন?’
মাথা ঝাঁকিয়ে না বলল তাহমিদ।
আসমা বলল, – ‘ আমিও জানি না। কলেজে পড়ার সময়ে ও আমাকে সব বললেও এটা বলেনি। ও সবসময় আমাকে বলতো, খুব শীঘ্রই ও মারা যাবে। কবরস্থানে ওর সিরিয়াল নম্বর হবে ‘009’। আমার বিশ্বাস, এই একই কথা ও আপনাকে হাজারবার বলেছে। শেষবার ও আপনার সাথে ঝগড়া করে গ্রামে আসছিল। সেদিনই মারা যায় ও। কিন্তু ও তো অসুখের জন্য মারা যায়নি। ওর মৃত্যুর কারণ ছিল অন্যটা।’
তাহমিদের পুরো শরীরটা ঝাঁকি দিয়ে উঠল হঠাৎ। কাঁপতে কাঁপতে গাড়িয়ে পড়ল মেঝেতে।
আসমা উৎকণ্ঠায় চেঁচিয়ে উঠল। বাড়ির সবাই জেগে গেল আসমার একটা চিৎকারের আওয়াজে। সবাই দৌড়ে তাহমিদের ঘরে এলো। তাহমিদকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। তৃষ্ণা ‘ভাইয়া’ বলে দৌড়ে তাহমিদের কাছে। ফাতেমাও দৌড়ে এসে বসে পড়ল তাহমিদের পাশে।