#সম্পর্ক
#Tasfiya Nur
#পর্বঃ১
তুমি পচা বর তোমাকে এত করে চকলেট আনতে বললাম তুমি আনলে না আমার আইসক্রিম টাও আনোনি কিচ্ছু না তুমি খুব পচা যাও কথা বলবোনা তোমার সাথে।
উফ পিচ্চি বউ রাগ করে না তো বাবা কাজে বিজি ছিলাম কেন বোঝো না,কাল আনবো পাক্কা প্রমিস।
সত্যি তো নয়তো দেখো বাবাকে বলবো আমায় নিয়ে যেতে এখান থেকে।
আচ্ছা বাবা ঠিক আছে এখন চলো ডিনার করে ঘুমাবে।সকালে কাজে যেতে হবে আমার তোমাকে স্কুলেও যেতে হবে সামনে ফাইনাল এক্সাম মনে আছে ভালো রেজাল্ট করতে হবে তো।সকালে গানের রিহার্সালও আছে ভুলে কেন যাও মহুপাখি।
মাম্মাম ও মাম্মাম তোমার ফোন বাজে শুনতে পাওনা কি?
মেয়ের ডাকে অতীতের বিচরণ থেকে ফিরে আসে মহুয়া,সময় কোথা থেকে কি না করে তখন ছিলো ষোলো বছরের ষোড়শী আজ সাতাশ বছরের যুবতী একটা মেয়ের মা।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কোলে নিয়ে নেয় তারপর ফোনটা নিয়ে দেখে রাহাত কল করেছে, রিসিভ করলোনা কেটে দিয়ে টাইম দেখলো কিছুক্ষণ পর গানের রেকর্ড আছে স্টুডিওতে যেতে হবে। রাহাতকে একটা টেক্সট করে দিলো যে আসছি আমি।
মাম্মাম সোনা আমার তো কাজে যেতে হবে তুমি গ্রানীর কাছে গুড গার্ল হয়ে থাকবে ওকে মাম্মাম কাজ সেরে চলে আসবে রাতের ভিতর।তুমি গ্রানীকে একদম জালাবেনা ওকে।
মহুয়া কথাটা মেয়েকে বলে চুমু খায় কপালে।
মেয়েটাও মায়ের বাধ্য বাচ্চা মায়ের কথায় মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।
আসার সময় চকলেট আনবে মাম্মাম আমার জন্য।
ওকে মাম্মাম সোনা তুমি গ্রানীর কাছে যাও আমি রেডি হয়ে নিই।
ওকে মাম্মাম।কথাটা বলে মহুয়ার ছোট্ট মেয়ে তিথিয়া দৌড়ে চলে যায় রুম থেকে। আজও কেন তাকে মনে পরে আল্লাহ ভুলিয়ে কেন দাওনা তুমি সে তো দিব্বি ভালো আছে আমি কেন তারজন্য জ্বলে পুড়ে ছাই হচ্ছি।কথা গুলো আনমনে ভেবে নিজেই নিজেকে ধিক্কার দেয় মহুয়া।
না আমায় স্ট্রং হতে হবে আমার মেয়ের জন্য আমায় স্ট্রং হতে হবে যার কাছে আমার ভালোবাসার দাম ছিলোনা তার জন্য আমি বিরহে দিন কেন পার করবো কথাগুলো বিরবির করে বলতে বলতে ওয়াশরুমে যায় মহুয়া। শাওয়ার নিয়ে বের হয় ওয়াশরুম থেকে তারপর রেডি হয়ে নেয় লেডিস জিন্স ফুলহাতা টপস গলায় স্কার্ফ পড়ে মুখে হালকা ফেস পাউডার আর ঠোটে লিপবাম লাগিয়ে ড্রয়িং রুমে আসে।
আন্টি আজ আসতে হয়তো লেট হবে তুমি তিথিয়ার খেয়াল রেখো খায়িয়ে ঘুম পারিয়ে দিও। কথাগুলো মিসেস শিরিনকে বলে মহুয়া।আচ্ছা মা তুই যা৷ সাবধানে থাকিস। আচ্ছা ফুফু আমি আসি তাহলে আর তিথিয়া কোথায় দেখছিনা যে?ও বারান্দায় খেলছে।আচ্ছা আমি তাহলে আসি ফুফু।কথা শেষ করে বেরিয়ে পরে মহুয়া তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আফসোসের নিঃশ্বাস ছাড়েন তিনি।এত ভালো একটা মেয়েকে কিভাবে পারলো ওরা ভুল বুঝতে আদৌ কি ওরা মানুষ ছিলো,কথা গুলো ভেবে তিথিয়ার দিকে পা বাড়ান মিসেস শিরিন। পার্কিং লটে এসে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরে।উদ্দেশ্য গান রের্কডের স্টুডিও তে যাওয়া।নিজেই ড্রাইভ করতে পারে তাই ড্রাইভার লাগেনা।
মিসেস শিরিন মহুয়ার দূরসম্পর্কের ফুফু হয় তার খারাপ সময়ে আশ্রয় হয়েছিলো সে।মহুয়ার ফুফা বিদেশ থাকেন কাজের সূত্রে।নিঃসন্তান দম্পতির কাছে মহুয়া সন্তানের জায়গা পূরণ করেছে।খারাপ সময়ে নিজের বাবা মাও বিশ্বাস করেনি নিজের শহর ছেড়ে ঢাকায় এসেছিলো যখন এই ফুফুই তার শেষ সম্বল ছিলো।আল্লাহ সব রাস্তা বন্ধ করলেও কিছু না কিছু রেখে দেন বান্দার জন্য। সময় বদলায় খারাপ সময়ও একসময় কেটে যায়,আজ সে শহরের মোটামুটি পরিচিত নাম সবার কাছে। পেশায় একজন প্রথম ঢাকায় এসে ফ্যাশন ডিজাইনার হলেও এখন গায়িকা বিভিন্ন কনসার্ট আর গানের এলবামে সুর দেয়।নিজস্ব একটা ফ্যাশন হাউজ ও আছে এখন।গানের কাজ না থাকলে ফ্যাশন হাউজে সময় দেয় এখন ওখানে কর্মচারি লাগিয়ে কাজ করায় নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আজ সে এই পর্যায়ে।ফুফা ফুফু আর তার ৬বছরের ছোট্ট মেয়ে তিথিয়াকে নিয়ে তার দুনিয়া ভালোয় তো আছে সে শুধু কিছু বিষাক্ত স্মৃতি ভেঙেচুরে গুড়ো করে দেয় কিন্তু একটা উপকার সে করেছে গানের গলা ভালো ছিলো বলে গানটা আয়ত্ত করতে সাহায্য করেছে। ড্রাইভিং করছিলো আর আনমনে এসব ভাবছিলো মহুয়া।
ফোনটা বেজে উঠে আবার, রাহাত আবার কল দিয়েছে কলটা রিসিভ করে মহুয়া।রিসিভ করে রাহাতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলে
আসছি রাহাত ওন দ্যা ওয়ে।
সময় কম মহুয়া সবাই এসে গেছে প্রায় শুধু তুমি আসতে পারলে না এখোনো।
পনেরো মিনিটেই আসছি।
কথাটা বলে কল কেটে দেয় মহুয়া।
রাহাত মহুয়ার অপজিট সিংগার,মহুয়া যে এই নিজের পায়ে দাড়িয়েছে তার পিছনে সবথেকে বড় অবদান এই রাহাত নামক মানুষটার।সত্যিই কখনো কখনো আপন মানুষের থেকে পরই বেশি আপন হয়ে যায় কিন্তু দিনশেষে তো আপন মানুষই আগলে ধরে আফসোস আমার বেলায় তা হয়নি।মনে মনে কথাগুলো ভেবে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দেয় মহুয়া।কিছুক্ষনের মাঝেই স্টুডিওতে পৌছে যায়।গানের ডিরেক্টর মিঃ শাহেদের সাথে কথা বলে সব বুঝে নিয়ে রেকর্ড রুমে যায় রাহাতের সাথে।
বিকেল থেকে পুরো রাত দশটা অব্দি সময় লেগে যায় গানের রেকর্ড করতে তবুও যেন কিছু বাকি রয়ে যায় গানের।স্টুডিও থেকে বিদায় নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রাহাতের সাথে বেরুতে নেয় তখন পিছন থেকে মিঃ শাহেদ ডেকে উঠে তাকে,
মহুয়া!শাহেদ সাহেবের ডাকে রাহাত মহুয়া দুজনই দাড়িয়ে যায়। মহুয়া জবাব দেয়,
জ্বী বলুন মিঃ শাহেদ।
পরশু একটা কনসার্ট হবে একটা কলেজে বর্ষপূর্তি উপলক্ষে দায়িত্ব আমরা পেয়েছি তোমাকে আর রাহাতকে গান করতে হবে কিন্তু। এখন তবে বাসায় যাও পরশু টাইম জানিয়ে দিবো।
ওকে।কথা বলা হয়ে গেলে গাড়ির কাছে মহুয়া সাথে রাহাত।
তিথিয়া কেমন আছে মহুয়া?
রাহাত মহুয়ার সাথে কথা বলতে জিগাডা করে।
জ্বী আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে রাহাত।
আর কতদিন এভাবে থাকবে মহুয়া তিথিয়ারও একজন বাবা দরকার বিয়েটা কেন করছোনা?
রাহাতের প্রশ্নে চমকে যায় মহুয়া।তারপর নিজেকে শান্ত করে তাকায় উনত্রিশ বছর বয়সী ফরমাল ড্রেসআপে সামনে দাড়িয়ে থাকা উজ্জল শ্যামলা বরণের রাহাতের দিকে।উত্তর দেয়,
তুমিও তো বিয়ে করছোনা রাহাত নাম যশ তো কম নয় তোমার,তোমার সাথে জুটি বেধে গান গেয়েছি বলে হয়তো মাথা তুলে দাড়াতে পেরেছি সবার সামনে তাহলে তুমি কোন আশায় বিয়ে করছোনা কিসের কমতি তোমার।
মহুয়ার কথায় আহত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাশ রাহাত।এই মেয়েটা এমন কেন একটুও কি তাকে বুঝে না সব বুঝে শুধু তাকেই বুঝেনা।মনে মনে কথাগুলো ভাবে রাহাত।
রাহাতের দৃষ্টি বুঝে মহুয়া তাই কথা বাড়ালো না,বললো বাসায় যাও রাহাত।রাহাতও এই হৃদয়হীনার মন সে পাবেনা তাই গাড়িতে উঠে চলে যায় সে।মহুয়া রাহাতের যাওয়ার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে ভাবে সে যে নিরুপায় একজন ডিভোর্সি বাঙালি মেয়ে সে সমাজ তাকে কি রুপে দেখে তা শুধু সেই বুঝে যে এসবের সামনাসামনি হয়।তার উপর তার ছয় বছরের মেয়েও আছে।একটা কালচারাল পরিবার যে রাহাতের মতো এত ভালো একজন ছেলের বউ হিসেবে তার মতো মেয়ে কখনোই চাইবেনা।আর সেও পারবেনা নিজের ভালোবাসা ভুলতে তার জীবনে তার সাথে গড়া সেই সম্পর্ক টাই যে সব।গাড়ির দিকে পা বাড়ায় মহুয়া, ঢাকা ধানমন্ডির একটা আবাসিক এলাকায় তার বাসা,একটা এপার্টমেন্টের চার তলায় থাকে ওরা।ড্রাইভিং করে বাসায় চলে আসে মহুয়া, লিফটের চার নম্ব বাটনটা প্রেস করে ওয়েট করে বাসার সামনে এসে লিফট থামলে নেমে কলিং বেল টিপ দেয়।ফুফু দরজা খুলে দিলে মহুয়া প্রশ্ন করে,
তিথিয়া ঘুমিয়েছে কি ফুফু?খেয়েছিলো তো তোমাকে বেশি বিরক্ত করেনি তো?
ক্লান্ত মহুয়ার দিকে তাকান মিসেস শিরিন বাসায় এসেই মেয়ের খোজ এত লক্ষী মেয়েকে কি করে পারছে ওরা গর্ভবতী অবস্থায় বাসা থেকে বের করে দিতে তার আফসোস হয় বড্ড আফসোস হয় ছেলে থাকলে আজ ছেলের বউ করতেন তিনি।
ফুস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে জবাব দেন মিসেস শিরিন,
আগে ঘরে তো আয় তারপর বলছি।আর তোর মেয়ে তোর মতোয় শান্ত একটুও বিরক্ত করেনি তোর রুমে ঘুম পাড়িয়ে রেখে আসছি।
মুচকি হেসে ঘরে ঢুকে মহুয়া তারপর বলে আচ্ছা আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।
আচ্ছা যা আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি তোর জন্য বসে ছিলাম একসাথে খাবো।
মিসেস শিরিনের দিকে চকিতে তাকায় মহুয়া এই মানুষটা এত ভালো কেন তারজন্য এখনও না খেয়ে অপেক্ষা করছে কিন্তু হায় নিজের মাও বাকিদের মতো অবহেলা করলো তাকে।
আচ্ছা ফুফু আমি আসছি তুমি যাও খাবার দাও টেবিলে।
তিনটা বেডরুম একটা ড্রয়িং রুম একটা কিচেন রুম আর একপাশে গেস্ট রুম এই মহুয়ার ছোট্ট বাড়ি নিজের উপার্জনে কেনা ফুফুর বাসা ঢাকার সাভারে ওখান থেকে কাজের সুবিধার জন্য চলে আসে এখানে।ক্লান্ত শরীরটা টেনে রুমে এসে ফ্রেশ হয় মহুয়া খাবার খেয়ে মেয়ের পাশে শুয়ে কপালে চুমু খায় মেয়েটা হয়েছে একদম তার বাবার মতো গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে তার বাবা যেমন আমায় নিয়ে শুয়ে থাকতো তেমন কথা গুলো মনে আসতেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে মহুয়ার।কানের কাছে আজও বাজে তার ঘোরলাগা কন্ঠের মহুপাখি ডাকটি। চোখ দুটো বুজে আসে ঘুমে।
বিছানায় শুয়ে আছে রাহাত।বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে না খেয়েই শুয়ে পরেছে।মাথার উপর সিলিং ফ্যানটা অনবরত ঘুরছে দৃষ্টি তার ফ্যানের উপর নিক্ষিপ্ত। রাহাতের মা কয়েকবার এসে ডেকে চলে গেছেন।
কেন মহুয়া কিসের কমতি আমার একটু কি ভালোবাসা যায়না আমায় চারটা বছর ধরে তোমায় ভালোবেসে যাচ্ছি তবুও কি আমার উপর মায়া হয়না।কথাগুলো ভাবতেই চোখের কোণ বেয়ে দুফোটা পানি বেয়ে গড়িয়ে পড়ে রাহাতের আরও একটি নির্ঘুম রাত কাটবে তার।
রাহাত মির্জা ঢাকা শহরের এই বর্তমান সময়ের নামকরা প্লেব্যাক সিংগার বাবা মায়ের বড় ছেলে ছোটো একটা বোন আছে চারজনের ছোটো পরিবার উত্তরার একটি আবাসিক এলাকায় নিজেদের বাসা বাবার নিজস্ব বিজনেস কোনো কিছুর কমতি নেই তবুও নিজের পায়ে দাড়াতে নিজের ভালো গানের গলাকেই কাজে লাগায় সে।কিন্তু এতকিছুর পরেও মহুয়া নামক মেয়েটির মন সে গলাতে পারেনা।
সময়টা রাত দুটো ঘরের ভিতর সিগারেটের ধোয়া আর হাতে একটা মেয়ের ছবি অন্যহাতে সিগারেট ব্যালকনিতে দাড়িয়ে ছবিটা দেখছে আর সিগারেট টানছে অনবরত সাগর চৌধুরী।
কোথায় তুমি মহুপাখি তোমাকে খুজতে খুজতে আজ ব্যর্থ আমি একটিবার কি ফিরে আসা যায়না।মানছি ভুল করেছি তার শাস্তি এভাবে দিবে।ছবিটির দিকে তাকিয়ে বিরবির করে কথা বলে যাচ্ছে সাগর চোধুরি মহুয়ার প্রাক্তন স্বামি।তিন প্যাকেট সিগারেট শেষ করেছে সে হাতেরটা শেষ হতে আরও একটা সিগারেট আবার জ্বালাতে প্যাকেট নেয় কিন্তু দেখে শেষ সিগারেট তাই ছবিটা বুকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে চোখের সামনে ভেসে উঠে মহুয়ার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরে অশ্রুর ধারা।
চারদিকে ফজরের আজান পড়েছে ঘুম থেকে জাগনা পায় মহুয়া,শুরু হয় নতুন দিনের সুচনা।
চলবে?
(আসসালামু আলাইকুম,ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন)