#সম্পর্কের_বন্ধন
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৮
নিস্তব্ধতার চাদরে ঢাকা রাত পেরিয়ে সকাল নামলো ধরনীর বুক ছিঁড়ে। তৃষা অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নাস্তা করেই বেরিয়ে পড়লো।
বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়ির জন্য দাঁড়ালো। আশেপাশে নজর বুলিয়েও কোনো খালি গাড়ির হদিস পেলোনা।সময় দেখে নিয়ে সামনের দিকে কয়েক কদম পা বাড়ালো। কিছুদূর যেতেই তৃষার মনে হলো ওর পেছন পেছন কেউ আসছে। তৃষা পা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। পেছন ফিরতেই সন্দেহজনক কাউকে নজরে এলোনা। রাস্তা একেবারে ফাঁকা নয়। কয়েকজন আছে যারা নিজেদের চলাফেরায় ব্যস্ত। আবার হাঁটা ধরলো। এখনও মনে হচ্ছে পেছনে কেউ আছে যে তাকে ফলো করছে। পরপর তিনবার দাঁড়িয়ে পড়েছে তৃষা। মাঝরাস্তায় এসে একটা খালি রিকশা পেয়ে উঠে পড়লো।
পেছনে আসা ব্যক্তি আড়াল থেকে বেরিয়ে ফিচেল হাসি দিলো। মোটা পুরুষালি কন্ঠে বলে উঠলো,’তোমার ডানা ছাঁটার সময় হয়ে এসেছে মিস তৃষা।’
অফিসে এসে বসের বকাঝকা শেষে তৃষা নিজের ডেস্কে বসলো। চিন্তারা এসে মাথায় ভীড় জমালো। কে ওকে ফলো করেছে আজ?
ইভান আজই ঢাকায় ফিরবে। অফিস থেকে বেশিদিনের ছুটি নেয়নি। ইভানের বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন ছেলের সাথে ছেলের বউকেও পাঠিয়ে দেবেন। ইভান মাঝখানে বাঁধা দিয়ে বলল,’তুহা আমার সাথে ঢাকায় গেলে ওর পড়ালেখার ক্ষতি হবে।’
ইভানের বাবা বিচক্ষণ প্রকৃতির মানুষ। তিনি খানিক হেসে বললেন,’এমনিতেও বউমা প্রতিদিন ভার্সিটিতে যাবেনা। ঢাকায় গেলে বই নিয়ে যাবে আর পরীক্ষার সময়টাতে কুমিল্লায় থাকবে।
এবছর পড়াটা শেষ হলে পরের বছর ঢাকায় ভর্তি করিয়ে দিস। ইভান মাথা নেড়ে বাবার কথায় সায় জানালো।
পরক্ষণেই মাথা তুলে শান্তস্বরে বলল,’কিন্তু তুহার মতামত ও তো নিতে হবে। সে এখানে থাকতে চায় নাকি ঢাকায় যেতে চায়।
ইভানের বাবা নাকের ডগা থেকে চশমা আরেকটু ঠেলে দিয়ে বললেন,’বউমা নিশ্চয়ই আমার কথায় দ্বিমত করবেনা। কি বলো বউমা?
তুহা এতক্ষণ চুপচাপ খাবার খাচ্ছিলো আর স্বামী,শশুরের কথা শুনছিলো। এবার শশুরের প্রশ্নে মাথা তুললো।মৃদুস্বরে বলল,’আপনারা যা বলবেন তাই হবে। আমার কোনো ভিন্ন মতামত নেই।
ইভানের বাবা হেসে উঠে বললেন,’দেখেছিস ইভান বউমা কি বললো? আমাদের কথার উপর তার কোনো কথা বলার নেই।
খাবার শেষে ইভান রুমে চলে গেলো।গায়ের পোশাক চেঞ্জ করে নিলো। একটু বের হওয়ার দরকার আছে। আবার কবে আসা হবে কুমিল্লা তার ঠিক নেই। তাই বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা করে আসাটা উচিত মনে করলো।
ইভান বেরিয়ে যাওয়ার আগে তুহা রুমে ফেরত আসলো।
ইভান তুহার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তুহা ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইভানের দিকে। কফি কালার শার্ট কালো প্যান্টে সুদর্শন দেখাচ্ছে মানুষটাকে।
ইভান এক ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল,’তুমি আসলেই যেতে চাও আমার সাথে?’
কারো ইচ্ছে নিজের মধ্যে চাপিয়ে নিওনা। তোমার মন কি চায় সেটাই বলো। যদি যেতে মন না চায় তবে আমাকে বলতে পারো। বাবাকে বোঝানোর দায়িত্ব আমার। বাবা এটা নিয়ে তোমাকে কিছু বলবেনা শিওর থাকো।
তুহার স্থির দৃষ্টি ইভানের শার্টের দিকে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলল,’আমার কোনো প্রবলেম নেই বাবার সিদ্ধান্তে। এখন আপনার যদি প্রবলেম থাকে আামকে নিয়ে তাহলে বলতে পারেন।
ইভান গমগমে স্বরে বলল,’কথাগুলো কি আমার শার্টকে বলছো? তোমার দৃষ্টি কিন্তু সেটাই বলছে।
তুহা দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে ফিরলো। কন্ঠে দৃঢ়তা বজায় রেখেই বলল,’আমি কেনো আপনার শার্টকে বলতে যাবো?’ শার্ট কি কথা শুনতে পারে নাকি?
ইভান ঈষৎ চোখে হাসলো। পরপরই ঠোঁট প্রসারিত করে রগড় করে বলল,’এবার মনে হচ্ছে পাশের দেয়ালকেই বলছো।’
তুহা এবার সরাসরি ইভানের দিকে তাকালো। তেজি গলায় বলল,’আপনার সমস্যা কি?’ আমি দেয়ালে তাকাবো নাকি অন্য কোথাও তাকাবো সেটা আমার ব্যাপার। আমার চোখ আমার ইচ্ছে।
ইভান হাসিয়ে থামিয়ে বলল,’আচ্ছা মানলাম তোমার ইচ্ছা।এখন আমি বের হচ্ছি। প্রয়োজনীয় কি কি লাগে ঘুছিয়ে নাও। আর তোমার কি কি বই খাতা লাগবে সেগুলো তৃণাকে গুছিয়ে রাখতে বলো। আমি গিয়ে এক ফাঁকে নিয়ে আসবো।
ইভান বেরিয়ে যেতেই তুহা শাশুড়ীর ফোন থেকে মাকে ফোন করলো। কিছুক্ষণ কথা বলে তার ঢাকায় যাওয়ার ব্যাপারটা জানালো। সাথে তার প্রয়োজনীয় বই গুছিয়ে রাখতে বলল।
শাহিনুর মেয়েকে নানা উপদেশ দিয়ে ফোন রাখলেন।
তুহা শাশুড়ীর দিকে ফোন বাড়িয়ে দিয়ে চলে আসতে যেতেই ইভানের মা থামিয়ে দিলেন তুহাকে। হাত টেনে বসিয়ে দিয়ে তুহার মাথায় হাত রেখে কোমল কন্ঠে বললেন,’ঢাকায় যাচ্ছো আমার ছেলেটার সমস্ত দায়িত্ব এখন তোমার। সব দিক খেয়াল রাখবে। ইভান শান্ত স্বভাবের ছেলে। হুটহাট রেগে যায়না। তবে একবার রেগে গেলে তার রাগ ভাঙানো দুষ্কর হয়ে পড়ে। তাই সব সময় তার মন যুগিয়ে চলার চেষ্টা করবে। তাই বলে আমি বলছিনা তুমি তোমার স্বাদ আল্লাদ বিসর্জন দিবে। তোমার ইচ্ছে অনিচ্ছের ব্যাপারেও ইভানকে জানাবে। যদি তোমার ইচ্ছে গুলো সৎ হয় তবে আমার বিশ্বাস আমার ছেলে কখনো তোমার ইচ্ছে পূরণে পিছুপা হবেনা।
ইভান নারীদেরকে সম্মান দিতে জানে। যার একমাত্র উদাহরণ আমি।
তুহার ভ্রু কুঁচকে গেলো। কপাল কিঞ্চিৎ বটে গেলো।
তুহার মুখভঙ্গি দেখে ইভানের মা হাসলেন। কোনো শব্দ হলেনা। নিঃশব্দে হাসি যাকে বলে।
হাসির রেখা টেনে রেখেই বললেন,’আমি ইভানের বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। আর ইভান প্রথম পক্ষের সন্তান।
তুহা অবাক হলো ইভানের মায়ের কথায়।
তিনি আবারও অমায়িক হাসলেন। মৃদুশব্দে বললেন,’আমাদের দেখলে বোঝা যায় না তাইনা?’
আসলে আমাদের মধ্যে সম্পর্কটাই এমন,যে কেউ দেখলেই বলবে আমরা আপন মা ছেলে।
তবে আমার নিজেরও ইভানকে পর মনে হয়না। ছোটবেলা থেকেই ইভান আমাকে সম্মান দিয়ে এসেছে। আমিও নিজের সন্তানের মতো আঁচল পেতে দিয়েছি তার জন্য।
মানুষ বলে সৎ মা খারাপ হয়। কিংবা সৎ মায়ের মুখে শোনা যায় তার স্বামীর প্রথম পক্ষের ছেলে মেয়ে খারাপ। কিন্তু আমাদের পরিবারের দিকে কেউ কোনোদিন আঙ্গুল তুলতে পারেনি। একটা সম্পর্কে একে অপরের প্রতি সম্মান আর শ্রদ্ধাবোধ থাকলে সেই সম্পর্কের বন্ধন মজবুত হয়। সেটা হোক যেকোনো সম্পর্ক।
তুহা প্রশান্ত হাসলো। তাদের মা ছেলেকে দেখলে কেউই বলবেনা এরা পর। এক দেখাতেই যেকেউ বলবে আপন মা ছেলে। তুহা নিজেও বুঝতে পারতোনা যদিনা এখন ইভানের মা তাকে না বলতেন। ইভান কত সুন্দর করে মা বলে ডাকে উনাকে। তিনিও নিজ জায়গা থেকে মায়ের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তিন সন্তানকেই সমান চোখে দেখেন। ইভান আর মান্নতা,রাফিকে কখনো আলাদা করেননি।
তুহা শাশুড়ীর হাতে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করে বলল,’আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো উনার খেয়াল রাখার। শুধু আপনি আর বাবা আমাদেরকে প্রাণ ভরে দোয়া করবেন মা।
ইভানের মা প্রশান্ত হেসে তুহার মাথায় হাত রেখে বলল,’মা-বাবার দোয়া সবসময় সন্তানের সাথে থাকে।
সোনালী রোদ্দুরের উষ্ণ তাপে গতর ছুইয়ে ঘর্মগ্রন্থি দিয়ে ঘাম ঝরছে ইভানের। ঈষৎ লম্বাটে চোয়ালে লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে রৌদ্রতাপে। কপালের ফুলে ওঠা রগ বেয়ে একফোঁটা ঘাম ছুইয়ে পড়ছে। কফি কালার শার্ট আঁটসাঁট হয়ে শরীরে আটকে আছে। সুঠাম দেহের অধিকারী সুপুরুষটি যখন একগাদা বইয়ের স্তূপ হাতে নিয়ে সদর দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে তখনই তুহার হৃদপিণ্ড তড়িৎ লাফিয়ে ওঠে। স্থির নেত্রে চেয়ে রইলো ইভানের দিকে। ইভান বইগুলো সোফার সামনের সেন্টার টেবিলে রেখে তুহার উদ্দেশ্যে বলল,’এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও তুহা।’
ইভানের কন্ঠস্বর অবসন্ন,ক্লান্ত শোনালো। সোফায় গা এলিয়ে চোখ বুজে রইলো। শার্টের কয়েকটা বোতাম খুলে মুখ গোল করে শ্বাস ছাড়লো।
আড়চোখে আরেকবার ইভানকে দেখে নিয়ে রান্নাঘরে ছুটলো তুহা।
তুহার আসতে দেরি দেখে ইভানের কপাল কুঁচকে গেলো। কুঁচকানো কপালে বিরক্তি ঢেলে গলার স্বর দৃঢ় করলো।
‘কি হলো তুহা?’একগ্লাস পানি আনতে এতক্ষণ লাগে?’
তুহা দ্রুত হাত চালিয়ে গ্লাস হাতে সোফার রুমে আসলো। ইভানের দিকে গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে মৃদু স্বরে বলল,’এই নিন।’
ইভান গ্লাস হাতে নিয়ে চুমুক দিলো। লেবুর শরবত বানিয়ে আনায় এতক্ষণ লেগেছিলো তুহার সেটা বুঝতে পারলো ইভান।
শরবতটুকু শেষ করে শান্ত চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,’সব গুছিয়ে নিয়েছো?
তুহা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই ইভান বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে। বই এখানেই থাক। এখন একবার টেনে রুমে নিয়ে যাবে আবার যাওয়ার সময় বের করা লাগবে। তুমি দেখে নাও সব বই ঠিকঠাক আছে কিনা?
তুহা দেখে নিলো সব ঠিকঠাক।
ইভান গোসল সেরে নিচে নেমে আসলো। সবাই একসাথেই দুপুরের খাবার শেষ করলো।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামলো। ব্যাগপত্র গুছিয়ে তুহা আর ইভান সবার থেকে বিদায় নিলো।
সিএনজি করে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এসে বাসের জন্য অপেক্ষা করলো প্রায় পনেরো মিনিট। বাসের টিকিট নিয়ে একহাতে ব্যাগ অন্যহাতে তুহার হাত ধরে বাসের দিকে এগিয়ে গেলো ইভান। মাঝের দিকেই তাদের সিট পড়েছে।
লোকজন এখনও উঠছে। ইভান তুহাকে জিজ্ঞেস করলো বাসে উঠলে সমস্যা হয় কিনা? বমি হলে এখনই নেমে ঔষধ নিয়ে উঠবে।
তুহা জানালো বাসে চড়লে তার সমস্যা হয়না। ইভান ঠিক আছে বলে তুহার পাশে বসে পড়লো।
ইভান ফোন খুলে বসেছে। তুহা কিছুক্ষণ জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলো। ইভানকে ফোন ঘাটতে দেখে বিরক্ত হলো। কোথায় ওকে সঙ্গ দেবে তা না করে ফোন নিয়ে ব্যস্ত। তুহা মুখ ঘুরিয়ে আবারও বাইরে তাকালো।
কখন যে তুহা ঘুমিয়ে পড়েছে ইভানের খবর নেই। ফোন পকেটে ঢুকিয়ে পাশে তাকাতেই দেখলো তুহা ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথা থেকে আঁচল পড়ে গেছে।
হলদে ফর্সা শরীরে কালো রঙের জামদানী জড়ানো। চোখের উপর-নিচে মোটা করে কাজল টানা,ঠোঁটে ম্যাট লিপস্টিক। চুলে খোঁপা করা। ইভান বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করলো তুহাকে। ঠোঁট বাঁকিয়ে বিড়বিড়ালো,’মাশাআল্লাহ।’
পরক্ষণে নজর গেলো তুহা ঘাড় বাকিয়ে হেলে যাচ্ছে। তাই সিটটা পেছনের দিকে হেলিয়ে দিলো। পেছনে একজন অসুস্থ বয়স্ক মহিলা ছিলেন। তিনি জানালেন সামনের সিট হেলিয়ে দেওয়ায় উনার বসতে অসুবিধা হচ্ছে। ইভান সিট ঠিক করে তুহার মাথা খুব সন্তর্পণে তার ঘাড়ে রাখলো। মাথায় কাপড় ঠিক করে দিয়ে সামনে তাকালো ইভান।
মিনিট দশেক যেতেই ইভান বিপরীত পাশের এক সিট সামনে তাকিয়ে বেশ শান্ত স্বরে বলল,’কি ভাই?বারবার উঁকি দিয়ে এদিকে কি দেখেন?
কাঁটাচামচ চিনেন? আমি কিন্তু ভালো রান্না জানি। চোখ দুটো তুলে ফ্রাইপ্যান রেখে তেলে ভেজে নেবো।
ছেলেটি থতমত খেয়ে সামনেই ফিরে গেলো।আর একটিবারের জন্যেও পেছনে তাকালোনা। ইভান আঁচল আরেকটু টেনে দিলো। যাতে করে তুহার পুরো মুখ ঢেকে গেলো।
#চলবে…….
(ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো।হ্যাপি রিডিং।)