#সম্পর্কের_বন্ধন
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৬
ঝলমলে রোদ্দুরে মাঝারি আকারের বাড়িটিতে জাঁকজমক পূর্ণ মরিচ বাতির আস্তরণ।উঠান সদৃশ অংশে প্যান্ডেল করে মেহমানদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।বাড়ির কর্তারা ছোটাছুটি করছে খাবারের তদারকি করতে।
কনের বাড়ি থেকে একে একে মেহমানরা সব এসে পড়েছে।
ইভান ব্যস্ত ভঙ্গিতে সবার সাথে কাজে হাত লাগিয়ে যাচ্ছে।মেরুন রঙের পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে উপরে ঠেলে রেখেছে।রৌদ্রতাপে ঘেমে নেয়ে একাকার।গায়ের পাঞ্জাবিটা ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে।কিছুটা গরম লাঘব করতে গলার দিকের দুটো বোতাম খুলে রেখেছে।উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গালে লালছে আভা।হাসলে না গালে টোল পড়ে!আর না গেজ দাঁত দৃশ্যমান হয়।কেবল সরু চোখদুটো ক্রমশ আরো সরু হয়ে আসে।এতেই তার সৌন্দর্য বেরিয়ে আসে।লোমশ হাতে বড় ডায়ালের ঘড়িটাও ঘামে ভিজে আছে।
তুহা বাড়ির লোকের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত।তার চোখ দুটো তৃষাকে খুঁজে চলেছে।একটিবারের জন্যেও তৃষাকে দেখেনি।
তৃণা তুহার পেছনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,’তৃষা আপু আসে নি।বাড়িতে অনেক কিছু ঘটে গেছে।’
তুহার কৌতুহলী চোখ উৎসুক হয়ে চাইলো তৃণার পানে।তৃণা সংক্ষেপে গতকালের ঘটনা খুলে বলতেই তুহা অবাক হয়ে বলল,’তৃষা আপুকে কেউ আটকায় নি?’
তৃণা মুখ কুঁচকে নিয়ে বলল,’আম্মু আটকাতে গিয়েছে।কিন্তু ওই বে/য়া/দ/ব মেয়ে আম্মুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।
আফসান এগিয়ে আসলেন তুহার কাছে।তুহার মাথায় হাত রেখে ক্ষীণ হেসে বললেন,’কেমন আছিস মা?
তুহা মিষ্টি হেসে উত্তর দিলো,’আলহামদুলিল্লাহ!আমি অনেক ভালো আছি।তোমরা সবাই কেমন আছো?
আফসান আগের মতোই হেসে মাথা নাড়লেন।
দুহাত জড়ো করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললেন,’আমাকে ক্ষমা করে দিস।তৃষার কারণে তোর জীবনে এতবড় দুর্ঘটনা ঘটতে গেছে।আমি বাবা হয়ে মেয়েকে শিক্ষা দিতে পারিনি।এটা আমার বড় ব্যর্থতা।
তুহা আশেপাশে তাকিয়ে বড়চাচার হাত চেপে ধরলো।অস্বস্তি নিয়ে বলল,’তুমি কিন্তু আমাকে অস্বস্তিতে ফেলছো বড়চাচ্চু।এখানে তোমার কোনো দোষ নেই।এ ভাবে হাত জোর করে আমাকে লজ্জায় ফেলোনা।
আফসান তুহার মাথায় হাত রেখে দোয়া করে দিলেন।’সুখী হ।’
কাজের ফাঁকে ইভান আসলো শশুর বাড়ীর লোকেদের সাথে দেখা করতে।ঘর্মাক্ত,ক্লান্ত মুখে মৃদু হাসি খেলছে।তুহা বারকয়েক আড়চোখে তাকিয়ে দেখেছে ইভানকে।সকালের পর থেকে আর দেখা মেলেনি এই ব্যস্ত পুরুষের।সে তার কাজ নিয়েই দিন পার করেছে।তুহা এতবার তাকিয়েছে কিন্তু ইভান একটিবারের জন্যেও চাইলোনা তার দিকে।
ইভানের সাথে কথা বলে তুহার বাবা চাচারা বেশ সন্তুষ্ট।বেশ ঠান্ডা স্বভাবের নম্র,ভদ্র প্রকৃতির ছেলেই মনে হচ্ছে।
তুহাকে ইভানের দিকে তাকাতে দেখে তুহার বান্ধবীরা তুহাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,’বরকে দেখছি একেবারে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিস।
রুশা দাঁত কেলিয়ে বলল,’ওপস!কি জোস মাইরি।তোর আগে আমি পেলে ভাগিয়ে নিয়ে যেতাম।
তুহা চোখ পাকিয়ে তাকাতেই সবগুলো হো হো করে হেসে উঠলো।
সবার সাথে কথা বলে যাওয়ার সময় ইভান মাথা ঘুরিয়ে একঝলক তুহাকে দেখে নিলো।ঠোঁটের কোনো স্থান পেলো সূক্ষ্ম হাসি।কেউ দেখলেও ঠাওর করে উঠতে পারবেনা ওটা আদৌও হাসি ছিলো কিনা?
দেরি না করে অন্যকাজে চলে গেলো ইভান।
তুহার বাবা যাওয়ার সময় ইভানের বাবা মায়ের সাথে কথা বলে তুহাকে সাথে নিয়ে গেছে।তুহার সাথে মান্নতা ও গিয়েছে।রীতি অনুযায়ী ইভানেরও যাওয়ার কথা।সে সন্ধ্যার পর যাবে বলে জানিয়েছে।
বাড়িতে পৌঁছে তুহা পরনের শাড়ি পাল্টে পুরো বাড়ি একবার চক্কর দিয়ে ফেলেছে।ইভানের উপর ভীষণ রাগ লাগছে।এত সুন্দর করে সেজে গরমের মধ্যে পুরোদিন কাটিয়ে দিয়েছে অথচ লোকটা একটিবার তাকালো ও না।কমপ্লিমেন্ট তো দূরে থাক।
মান্নতা তৃষ্ণার্ত চোখে এদিক ওদিক দৃষ্টি বুলিয়ে তুহাকে প্রশ্ন করলো,’ভাবি!তোমার বোন কোথায়?’
তুহা মুচকি হেসে তৃণাকে ডেকে দিলো।মান্নতা হালকা হেসে বলল,’তৃণা নয়।তোমার আরেকটা বোন আছেনা?তৃষা আপু সে কোথায়?’
তুহা কিছু বলার আগেই তৃণা জোর করে হেসে মান্নতাকে টেনে নিয়ে বলল,’তৃষা আপুর অফিস আছে।তাই সে ঢাকায় চলে গেছে।তুমি আমার সাথে আসো,আমাদের বাড়ির পেছন দিকে একটা বিল আছে।খোলা হাওয়ায় বসে থাকতে অনেক ভালোলাগে।চলো তোমাকে সেখানে নিয়ে যাই।
মান্নতা আর কথা বাড়ালোনা।তৃণার সাথে সাথে চললো।
সব কাজ সেরে সন্ধ্যায় ইভান রওনা দিয়েছে শশুর বাড়ীর উদ্দেশ্যে।গাড়িতে উঠে সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো।ফোনে টুংটাং মেসেজ আসতেই কপালে ভাঁজ পড়লো।দুই ভ্রু খানিকটা নিচে নেমে কুঞ্চিত হলো।এখন চোখ মেলতে ইচ্ছে হচ্ছে না বিধায় আর ফোন চেইক করা হলোনা।
তুহার বাসার সামনে গাড়ি থামতেই সিএনজির ড্রাইভার বলল,’এসে পড়েছি স্যার।
ইভান চোখ খুলে তাকালো।ড্রাইভারের সাথে হাতে হাতে ব্যাগ নিয়ে ভেতরে ঢুকলো।
তুহা বসার রুমে সোফার উপর দুই পা তুলে আচার খাচ্ছে।কোলে ছোট্ট বাটি নিয়ে চুল ছেড়ে বসে আছে।বাবার বাড়িতে এসে আরেকবার গোসল করে নিয়েছে।চুল শুকাতেই ছেড়ে বসে আছে।
দরজার বেল বাজতেই তৃণা গিয়ে দরজা খুলে দিলো।ইভান চমৎকার হাসি দিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।ইভানের হাসির প্রত্যুত্তরে হাসলো তৃণাও।দরজা থেকে সরে গিয়ে তৃণা বলল,’ভেতরে আসুন ভাইয়া।
ড্রাইভার লোকটি ব্যাগ গুলো রেখেই চলে গেলো তার ভাড়া নিয়ে।তৃণা গেলো মাকে ডাকতে।বাবা চাচারা কেউই বাসায় নেই।আয়নার ঘাড়টা ব্যথা করছে।প্রমি শাশুড়ীর ঘাড় টিপে দিচ্ছে বসে বসে।
বাসায় যে কেউ এসেছে সে খেয়াল তুহার নেই।সে আচার খাচ্ছে আর টিভি দেখছে।আচার তার প্রিয় খাবারের মধ্যে একটি।বছরে আম,বরইয়ের সিজনে যে আচারগুলো বানানো হয় সেগুলো শেষ করে আবার বাবার হাতে বাজার থেকে কিনে আনে।
বসার রুমে চোখ বুলিয়ে ইভান তুহাকে ছাড়া আর কাউকে দেখলোনা।
তুহার ভেশ ভুষা দেখে ইভানের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো।তুহাকে দেখলে বোঝাই যাবেনা সে একজন বিবাহিত নারী।কেমন বয়ঃসন্ধিকালে পা দেওয়া কিশোরীদের ন্যায় হাবভাব।
তুহার মনযোগের বিঘ্ন ঘটাতে ইভান হালকা কেশে উঠলো।গমগমে স্বরে বলে উঠলো,’এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও।’
তুহা টিভির দিকে তাকিয়ে বলল,’হ্যাঁ?তৃণাকে বলো।আমি শশুর বাড়ী থেকে এসেছি।কোথায় তোমরা আমার খাতির যত্ন করবে।তা না করে আমাকে কাজে পাঠাচ্ছো?
ইভান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।সে আর কথা বললোনা।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুহার আচার খাওয়া পরোখ করতে লাগলো।
এর মাঝে শাহিনুর এসে পড়েছেন।
ইভানকে দেখে তিনি তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।মায়ের বকাতে তুহার সম্বিত ফেরে।টিভি থেকে চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে ইভানকে দেখলো।নিজের দিকে একবার তাকিয়ে জিহ্বায় কামড় দিলো।তার কি অবস্থা?আর উনিই বা কখন এলেন?
শাহিনুর ধমকে বললেন,’ছেলেটা কখন এসেছে আর তুই এখানে বসে আছিস?
তুহা হড়বড়িয়ে উঠে রুমে ফেরত গেলো।যাওয়ার সময় আচারের বাটি নিতে ভুললোনা।বাটি টেবিলের উপর রেখে হাত ধুয়ে চুল বেঁধে নিলো।ওড়না নিয়ে মাথায় কাপড় দিয়ে বের হলো রুম থেকে।
মান্নতাকে ডেকে দিয়ে মায়ের সাথে রান্নাঘরে গেলো।ইভানের জন্য নাস্তা নিয়ে একেবারে সামনে গেলো।
শরবতের গ্লাস তুলে ইভানের সামনে ধরলো।ইভান গ্লাস হাতে নিয়ে চুমুক দিতেই তুহার বাবা চাচারা সবাই একসাথেই বাসায় ফিরেছে।তিনভাই সামনের একটা মোড়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলেন।এখন মেয়ে জামাইয়ের সাথে আড্ডায় বসলেন।
রাতের খাবারের পর ঘুমাতে গিয়ে ইভান ফোন হাতে নিলো।তুহা ওয়াশরুমে ছিলো।সন্ধ্যার সেই মেসেজ ওপেন করে স্থির নেত্রে চেয়ে রইলো কিয়দংশ সময়।পলক ফেললোনা।
পরপর কয়েকটি মেসেজ ভেসে উঠলো ফোনের স্ক্রিনে।
“আপনি যে মেয়েটিকে বিয়ে করেছেন মেয়েটা ভালো নয়।
কয়েকটা বয়ফ্রেন্ড ছিলো মেয়েটির।তাদের সাথে প্রায় প্রতিদিনই ডেটে যেতো।আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী।তাই সত্যটা আপনাকে জানালাম।
ইভান ফোনের আলো নিভিয়ে চোখ বন্ধ করলো।
তুহা ফ্রেশ হয়ে এসে ইভানের পাশে বালিশ ঠিক করে শুয়ে পড়লো।কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠস্বর কর্ণধারে পৌঁছায়।ইভান নিষ্প্রভ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,’আচ্ছা তুহা!সম্পর্কের মূল ভিত্তি কি?’
তুহা চোখ বুজে ছিলো।ইভানের প্রশ্নে চোখ খুলে তাকায়।দেখে ইভান তার দিকেই তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায়।
তুহা নির্বিকার কন্ঠে উত্তর দিলো,” বিশ্বাস।”
ইভান মুচকি হেসে তুহার দিকে ফোন বাড়িয়ে দিলো।তুহা কিছু বুঝতে না পেরে ইভানের ফোন হাত নিলো।ইভান ইশারা করতেই মেসেজ গুলোতে চোখ বুলিয়ে নিলো।তুহার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।ইভানকে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই ইভান মুখ খুললো।
তোমাকে কিছু বলতে হবেনা।আমি এগুলো বিশ্বাস করিনি।তোমাকে বিয়ে করার আগে সম্পুর্ন খোঁজ নিয়ে তবেই বিয়ে করেছি।আর নিজের ব্যাপারেও তোমাকে অবগত করেছি।এগুলো সত্যি হলেও সমস্যা নেই।অতীত কেবল অতীতই।
এটা তোমাকে দেখানোর কারণ হয়তো তুমি তোমার শত্রুকে চিহ্নিত করতে পারবে।
তুহার মনে শুধু তৃষার নামটাই ঘুরপাক খাচ্ছে।ভবিষ্যতে যে সিনক্রিয়েট হবেনা তার কি নিশ্চয়তা আছে?তাই তুহা তৃষার ব্যাপারে ইভানকে সবটা জানাবে বলে মনস্থির করলো।
লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,’আমি শতভাগ নিশ্চিত এটা তৃষা আপুর কাজ।সে আপনাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো।ফ্যামিলির সবাই জানাজানির পর বাসায়ও ঝামেলা হয়।আর বড়চাচ্চু তৃষা আপুকে নিজের মেয়ে বলে অস্বীকার করে।যার কারণে তার সমস্ত রাগ আমার উপর গিয়ে পড়েছে।
ইভানের চোখমুখের রং পাল্টে গিয়ে একটা ভাব নিলো সে।চুলের ভাঁজে একবার হাত গলিয়ে ভাব নিয়ে বলল,’অবশ্য হ্যান্ডসাম ছেলেদের জন্য মেয়েরা পাগল থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
তুহা চোখ সরু করে তাকালো।মুখ বেঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,’আসছে!দেশে মনে হয় হ্যান্ডসাম ছেলের অভাব পড়েছে।উনি এক পিস।
তুহা আস্তে আস্তে বললেও ইভান ঠিকই শুনলো।
কিছু না বলে মিটিমিটি হেসে চোখ বন্ধ করে নিলো।
সকালের বাসেই তৃষা ঢাকায় এসে পড়েছে।ঢাকার একটা ফ্রেন্ডের বাসায় উঠে নিজের জন্য বাসা খুঁজতে বিকেলে বেরিয়েছে।রাত দশটায় বাসা ঠিক করে বান্ধবীর বাসায় আসলো।কালই নিজের বাসায় উঠবে।
রাতের বেলা ফোন দেখতে দেখতে ঘুমাতে যাওয়া তৃষার স্বভাব।তাই স্বভাব অনুযায়ী আজও ফোন দেখতে দেখতে শুয়ে পড়েছে।হঠাৎ মেসেন্জারে একটা মেসেজ আসতেই সেটা ওপেন করে দেখে একটা ভিডিও ক্লিপ।তৃষা কৌতুহল বশত ভিডিও অন করে কয়েক সেকেন্ড যাওয়ার পরই গগনবিদারী চিৎকার করে ওঠে।ফোন হাত থেকে পড়ে থরথর করে তার শরীর কেঁপে ওঠে।তৃষার বান্ধবী ধড়ফড়িয়ে উঠে তৃষাকে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করছে।তৃষা কিছু বলতে পারছেনা পুরো শরীরে কাঁপুনি ধরে গেছে তার।
ভিডিওটিতে একজন মানুষের দেহ থেকে এক কোঁ/পে মাথা আলাদা করে দেওয়া হয়েছে।
তৃষা ভেবে পায়না এমন ভিডিও তাকে কে পাঠাবে।
তুহা?
তুহার কথা মাথায় আসার মুহূর্তেই আবারও মেসেন্জারে শব্দ হয়।তৃষা ভয়ে সেঁটে বসে তার ফ্রেন্ডকে ধরে রাখে।
#চলবে………