#সম্পর্কের_বন্ধন
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৪
ব্যস্ত নগরী।অন্তরিক্ষে ছুটে চলা সাদা মেঘের ভেলা।মধ্যাহ্নের কারণে সূর্য একেবারে খাড়াভাবে মাথার উপর কিরণ দিচ্ছে।তবুও মানুষ থেমে নেই।ছুটে চলেছে জীবিকার তাগিদে।
ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে রাস্তার ফুটপাত ধরে কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে হেঁটে চলেছে তুহা।রৌদ্র তাপে ঘর্মাক্ত হলদে ফর্সা মুখ লালছে বর্ণ ধারণ করেছে।চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ।ওড়নার ফাঁক দিয়ে কয়েক গাছি ছোট চুল এসে আছড়ে পড়ছে কপাল বেয়ে।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে দু’আঙ্গুলের সাহায্যে চোখের উপর উপছে পড়া চুল কানের পাশে গুঁজে নিলো তুহা।রাস্তার অপর পাশে গেলেই রিকশা নিতে পারবে।ভার্সিটির গেইট থেকে সামনে কিছুটা হাঁটলেই রিকশা পাওয়া যায়।
ক্লাস শেষ হয়েছে ঘন্টা খানেক পূর্বেই।এতসময় ধরে বান্ধবীদের সাথেই আড্ডা দিচ্ছিলো।এখন যে যার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছে।রাস্তার অপর পাশে এসে একটা রিকশায় উঠে পড়লো তুহা।রিকশা চালক পেছনে ঘিরে তুহাকে কপাল কুঁচকে বললেন,’আফা আমিতো যাবোনা।
তুহা আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো।দৃষ্টি সীমার ভেতর কোনো খালি রিকশা চোখে পড়লোনা।লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,’দাঁড়িয়েই তো আছেন।যাবেননা কেনো?ভাড়া বেশি দিতে হবে?
রিকশাচালক পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হেসে দিলো।সরল,প্রানবন্ত হাসি।বলল,’ভাড়ার কথা না আফা।আমি এহন বাড়িতে যামু।দুপুরের খাওন বউ,বাচ্চার লগেই খাই।অনেক বেলা হইছে বাড়ি থেইকা বউ ফোন করছিলো বাড়িত যাওনের লাগি।
তুহা মুচকি হেসে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।আমি হেঁটেই যেতে পারবো।
রিকশাচালক মাথা নাড়তেই তুহা রিকশা থেকে নেমে আবারও রাস্তার পাশ ঘেষে কদম ফেললো।
আচ্ছা!ইভান ও কি বিয়ের পর এমন করবে?দুপুরে একসাথে খাওয়ার জন্য কি সেও বাসায় ছুটে আসবে?নিজের ভাবনা দেখে তুহা নিজেই অবাক হলো।ও কি ভাবছে?ইভান থাকবে ঢাকায় আর সে নিশ্চয়ই শশুর বাড়িতে থাকবে।তবে ইভান কিভাবে আসবে?
আপন ভাবনা ভাবতে ভাবতেই দীর্ঘ ত্রিশ মিনিটের পথ শেষ করে বাড়ির গেইটে পা রাখলো তুহা।
দরজা খুলে দিয়ে তুহার মা শাহিনুর জিজ্ঞেস করলেন,’আজ এতো দেরি হলো যে?সবাই তোকে রেখেই খেয়ে নিয়েছে।
তুহা ব্যাগটা মায়ের হাতে দিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে বলল,’আজ ক্লাস শেষে একটু আড্ডা দিয়েছি।একেবারে খাবার সময় হয়ে যাওয়াতে রিকশাওয়ালারা ও সবাই খেতে চলে গেছে।তাই হেঁটেই এসেছি।
শাহিনুর চিন্তিত সুরে বললেন,’সেকি!এই রোদের মধ্যে এতটা পথ হেঁটে এসেছিস?যা তাড়াতাড়ি গোসল সেরে আয়।আমি তোর খাবার দিচ্ছি টেবিলে।
তুহা মায়ের কথায় সায় জানিয়ে রুমে ঢুকলো।তৃষা বেশ আয়েশ করেই খাটে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে ফোন টিপছে।চুলগুলো ঘাড় অব্দি করে ফেলেছে।নিশ্চিত সকালে নাস্তার পরই পার্লারে গিয়েছে।সকালে চুলের যেই অবস্থা ছিলো বাসার কেউ দেখলে নানারকম প্রশ্ন করতো।
তুহা নিজের চুলগুলো বাসায় বসেই যতটা পেরেছে সাইজ করে কেটে নিয়েছে।ওয়াশরুম থেকে গোসল সেরে চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় গেলো তুহা।হাতের তোয়ালে গ্রিলের সাথে মেলে দিয়ে খেতে চলে গেলো।এরমাঝে তৃষা একবারও চোখ তুলে তাকালোনা।
খাবার শেষ করে তুহা ছাদে চলে গেলো।দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামলো কিন্তু তুহা ছাদ থেকে নামেনি।
এরমাঝে ছোট চাচা ছাদে আসলেন।তুহাকে একা একা ছাদে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,’এখানে একা একা বসে আছিস কেনো?
ছোট চাচার কথায় তুহার সম্বিত ফিরলো।চাচাকে দেখে একগাল হেসে বলল,’এমনিতেই এখানে ভালো লাগছে বলে বসে আছি।তুমি হঠাৎ ছাদে কি করছো?
আমিও ঘরে বসে বোর হচ্ছিলাম।তাই ছাদে আসলাম একটু খোলা হাওয়ায় মনটা যদি ফুরফুরে হয় সেই আশায়।যাক এখন তবে দুজনে মিলে গল্প করা যাবে।
তুহা মাথা নেড়ে হাসলো।
কথার মাঝেই তুহা খেয়াল করলো তার ছোট চাচা রাদিফ একদৃষ্টিতে তার দিকে কিছু একটা তাকিয়ে পরোখ করছে।রাদিফের কপালের সূক্ষ্ম ভাঁজ দেখেই তুহার মস্তিস্ক সেকথায় জানান দিলো।রাদিফ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে তুহার চুলে হাত দিলো।চুলের আগা টেনে হাতে নিয়ে কৌতুহল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,’তোর চুলের এই অবস্থা কেনো?লম্বা চুলগুলোর একি অবস্থা?
রাদিফের প্রশ্নে তুহা ভড়কে গেলো।চাচাকে কি জবাব দেবে ভেবেও সহসা কোনো উত্তর তার মস্তিষ্ক সাজাতে পারলোনা।
উত্তর না পেয়ে রাদিফের কপালের ভাঁজ আরেকটু দৃঢ় হলো।পূনরায় প্রশ্ন করলো,’চুলের এরকম অবস্থা কেনো?’
তুহা মেকি হেসে বলল,’আব!আসলে খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো চুল ছোট করার।আগে কখনো করা হয়নি বলে আজ হুট করেই নিজে নিজে ছোট করে ফেলেছি।
রাদিফের বিশ্বাস হলোনা তুহার কথা।বাজপাখির মতো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তিরিক্ষি মেজাজে বলল,’তুই কবে থেকে আমার সাথে মিথ্যে বলা শুরু করেছিস?লম্বা চুল যে তোর অনেক পছন্দের সেটা সবাই জানে।মেজো ভাবি দুবছর আগে তোর চুল সমান করতে গিয়ে এক ইঞ্চি বাড়তি কেটেছিলো বলে তুই ভাত খাসনি।আর এখন প্রায় ছয় সাত ইঞ্চি চুল কেটে ফেলেছিস?
দুপুরে তৃষার চুলও দেখলাম ঘাড় পর্যন্ত।জিজ্ঞেস করাতে বলল,’পার্লার থেকে কেটে এসেছে।তারটা মান যায় কারণ,তৃষা কিছুদিন পর চুল বড় হলেই নতুন নতুন কাট দিয়ে আসে।
কি হয়েছে বলবি আমাকে?
তুহার দৃষ্টি শীতল হলো।রেলিং এ হাত রেখে অদূরে দৃষ্টি রাখলো।নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো কিছু একটা বলার জন্য।
রাদিফ উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলো তুহার পানে।মনে একবুক আকাঙ্খা তার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর পাওয়ার।
————————————————————★
মাঝখানে কেটে গেলো কয়েকটা দিন।দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসলো।মেহেদী রাঙা হাত উল্টেপাল্টে দেখছে তুহা।আজই ইভানের ঘরের ঘরনি হবে সে।ব্যাপারটা ভাবতে যতটা ভালোলাগা কাজ করছে তারচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে এই পরিচিত বাড়ি,মা-বাবা,পরিচিত মানুষ গুলোকে ছেড়ে যেতে হবে বলে।
মুহূর্তেই চোখ দুটো জলে সিক্ত হয়ে উঠলো।কারো চিৎকারের আওয়াজ শুনে চোখ মুছে তুহা দৌড়ে গেলো রুমের বাহিরে।বিয়ে বাড়ির আমেজে মেহমানে ভরপুর।সবাই একজায়গায় বসে ভিড় জমিয়েছে।তুহা সেদিকে গিয়ে ভিড় ঠেলে দেখলো তৃষা ফ্লোরে বসে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে রেখেছে।কেউ নাকি কলার চামড়া ফেলেছিলো।তৃষা না দেখে পা দেওয়াতে অসাবধানতা বশত পড়ে কোমরে ব্যথা পেয়েছে।
তুহা নিজের রুমে ফেরত আসার সময় দেখলো তৃণা এককোনায় দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে।তুহার সন্দেহ হলো তাই তৃণার কান মলা দিয়ে বলল,’তুই করেছিস এসব তাইনা?
তৃণা কান ছাড়িয়ে বলল,’বেশ করেছি।আমাকে সব সময় বান্দীর মতো খাটায়।
তুহা রাগ দেখিয়ে বলল,’যদি এখানে তৃষা আপু না এসে অন্যকেউ আসতো?
তৃণা হাত ঝেড়ে বলল,’আমি তৃষা আপুকে দেখেই কলার চামড়া ফেলেছি।এতটা বোকাও ভেবো না আমায়।
তুহা ফিক করে হেসে দিলো।দুবোন হাসতে হাসতে রুমে ফেরত গেলো।
এই কয়েকদিন তৃষাকে বেশ শান্ত,শিষ্ট থাকতে দেখা গেছে।সেদিনের পর থেকে আর তুহার সাথে কথা বলেনি।সবার সামনে স্বাভাবিক থেকেছে।স্বাভাবিক থাকার কারণটাও তুহার অজানা নয়।সে বেশ ভালো করেই সবটা জানে।
পার্লারের মেয়েরা তুহাকে সাজিয়ে দিয়ে চলে গেলো।একা একা রুমে বসে আছে তুহা।সাজার আগে মা আর বড় চাচি মিলে অনেকবার খেয়ে নিতে বলেছে।কিন্তু তুহা ক্ষিধে নেই বলে না করে দিয়েছে।কিছুক্ষণ পরই তুহার একটা কাজিন এসে তুহার হাতে শরবতের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বলল,’তুহা আপু এই শরবত টুকু খেয়ে নাও।মেজো মামি পাঠিয়েছে।তুমি নাকি কিছুই খাওনি।
তুহা শরবতের গ্লাস হাতে নিলো।হঠাৎ দরজায় চোখ পড়তেই দেখলো কেউ একজন দরজা থেকে সরে গেলো।তুহা পাত্তা দিলোনা।গ্লাসের শরবতটুকু পান করে পাশের টেবিলে গ্লাস রাখলো।মিনিট কয়েক যেতেই তুহার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসলো।চোখের উপর যেনো ওজন কিছু বসানো হয়েছে।তুহা চোখ খুলে রাখতে পারছেনা।দুচোখ ভেঙে ঘুম নামলো।খাটের সাথে হেলান দিয়েই সেখানে তুহা ঘুমিয়ে পড়লো।
তুহা ঘুমিয়ে পড়তেই রুমে তৃষার প্রবেশ ঘটলো।মুখে ক্রুর হাসি।যেনো সে পুরো বিশ্ব বিজয় করে নিয়েছে।দরজা বন্ধ করো আস্তে আস্তে তুহার দিকে এগিয়ে গেলো।তুহার গালে আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করে আফসোসের সুরে বলল,’আহারে!বোনটা আমার।আজ বুঝি তোর হবু বরটা আমার হয়ে যাবে?তোর জায়গায় আমি নববধূ হয়ে ইভানের ঘরে উঠবো।আজ হবে আমার আর ইভানের ভালোবাসার রাত।আমার পৌষ মাস আর তোর সর্বনাশ।’বলেই তৃষা হাসতে লাগলো।
পরক্ষণে তুহাকে টেনে বাথরুমে রেখে বাইরে থেকে সিটকিনি দিয়ে দিলো।সেদিন তুহার শাড়ির মতো সেইম ডিজাইনের একটা শাড়ি কিনে নিয়ে এসেছে তৃষা।সেটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলল,’আমার ইভানের পছন্দের শাড়ি।আজ আমি মনের মতো করে সাজবো।তুমি আমার থেকে চোখ ফেরাতে পারবেনা ইভান।আমার মোহে মুগ্ধ হয়ে ভুলে যাবে ওই দস্যি কাল নাগিনকে।
সাজ সম্পুর্ন করে তৃষা একটা গাঢ় ওড়না মাথার উপর দিলো।মুখ ঢেকে গেছে।কেউ দেখলে বোঝার উপায় নেই ঘোমটার আড়ালে কে আছে?
তৃষা লম্বা ঘোমটা টেনে বসে রইলো বিয়ের অপেক্ষায়।কখন সবাই এসে তাকে নিয়ে যাবে আর সে তিন কবুল বলে ইভানকে নিজের করবে।
বিবাহ সম্পন্ন করে নতুন বউকে ঘরে তোলার পালা।ইভানের বাবা বেশ তাড়া দিলেন বউ নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য।বেশ ভালোভাবেই সবটা মিটে গেলো।বিয়ের সময়টাতে তৃষাকে আশেপাশে কোথাও দেখা গেলোনা।অবশ্য কারো তাতে খেয়ালও নেই।
বিদায়ের সময় রাদিফ লম্বা ঘোমটায় আবৃত তুহার মাথায় হাত রেখে বলল,’আমি সবসময় তোর পাশে আছি।তোর এই ছোট চাচাকে যেকোনো মুহূর্তে স্মরণ করবি সে তোর জন্য সব করতে প্রস্তুত।মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে রাদিফ তুহাকে গাড়িতে তুলে দিলো।
সবার চোখে অশ্রু।তুহার বাবা মেয়েকে বিদায় দিয়েই দরজা আটকে রুমে ঢুকে গেলেন।এতক্ষণ নিজেকে ধরে রাখতে পারলেও এখন আর পারছেননা।বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রনা হচ্ছে।
সমস্ত নিয়মকানুন শেষে নতুন বউকে ফুলে সজ্জিত খাটে বসিয়ে সবাই চলে গেলো।সবাই যাওয়ার পরই ইভান প্রবেশ করলো।ফ্রেশ হয়ে এসে এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে তার বিয়ে করা অর্ধাঙ্গিনীর মুখশ্রী দর্শন করবে বলে।দুহাতে ঘোমটা তুলেই ইভানের কপাল কুঁচকে গেলো।
#চলবে……..