সমাপ্তির পূর্ণতা পর্ব-০৯

0
1015

#সমাপ্তির_পূর্ণতা
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৯ (ধামাকা 2 )
শিমু ও রিমু ভয় পেয়ে যায়। এই ভয় পাওয়া থেকে তারা এমন কিছু করে বসে যা তাদেরকে সারাজীবন বইতে হবে।
রিমু ও শিমু বিভানের মাকে আটকাতে দুজনে মিলে ধস্তাধস্তি শুরু করে। শিমুর কিছুটা অনিচ্ছাবশত বা ইচ্ছাবশত ধাক্কায় বিভানের মা খাটের সাইডে চোখা কানির সাথে মাথার পেছনে আঘাত পায় আর যখন উনি আর্তনাদ করবে তখন শিমু তার মুখ ধরে রাখে যাতে আর্তনাদ বাহিরে না যায়।
আর রিমু! সে প্রথমে বেশ ভয় পেয়ে গেছিলো। শাশুড়িকে ডিঙিয়ে অপর পাশে যাওয়ার সময় সে ভুলবসত শাশুড়ির পায়ের সাথে এক পা বেজে ও অপর পা কার্পেটের সাথে লেগে সে ফ্লোরে পরে যায় একদম পেট নিচে দিয়ে। প্রেগনেন্সির সময় শেষের তিন মাস ও প্রথম তিনমাস দেখে শুনে চলতে হয়। প্রেগনেন্ট মা যদি একটুও ভয় পায় বা তার যদি একটা হার্টবিটটাও মিস হয়ে তাহলে বাচ্চাকে নিয়ে শংকা থাকে।

রিমু ফ্লোরে পড়ে যাবার পর পেটে তীব্র ব্যথা অনুভব করে চিৎকার করে ওঠে। শিমুর রুমটা যেহেতু বিভানের রুমের পরে স্টোর রুমের পাশে তাই শব্দটা আগে বিভানের কানে গেল। অতটা জোরালো ভাবে শোনা যাওয়ার কথা না তবে রাতের বেলা নিস্তব্ধতার কারণে তীক্ষ্ণ ভাবে কানে আসে বিভানের। বিভান শব্দের উৎস খুঁজতে জলদি করে নিজের রুমের দরজা খুলে। বিভান রুমের লাইট অফ করে খাটের উপর শুয়ে রুমের ছাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।

নিজের রুম থেকে বের হয়ে বিভান দেখল শিমুর রুমের দরজা খোলা আর সেখান থেকে অস্ফুট স্বরে গোঙ্গানির আওয়াজ আসছে। তড়িঘড়ি করে কিছু না ভেবে সেই রুমের ভেতরে যেয়ে দেখে, তার মা ও ভাবি ফ্লোরে পড়ে আছে। ফ্লোরে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ওদের দুইজনের পাশেই শিমু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর নিজের বোনের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। দুইজনের এই অবস্থায় দেখে বিভান জলদি করে দুজনের কাছে গিয়ে দেখে তার মায়ের মাথার পিছন থেকে ও তার ভাবীর পায়ের নিচ দিয়ে রক্তের স্রোত বইছে। এ অবস্থায় বিভান কি করবে বুঝতে পারছে না! সে কার দিকে দেখবে মায়ের দিকে না ভাবীর দিকে!

বিভান জলদি করে তার ভাইয়ের রুমে গিয়ে ভাইকে ডেকে তুলে নিয়ে আসে। ইভান তার মা ও স্ত্রীর এই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায়। ইভান বিভানকে মাকে নিতে বলে ও সে তার স্ত্রীকে নিয়ে এখনই হাসপাতালে উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রাত তখন প্রায় একটার বেশি।

হাসপাতালে পৌছাতে পৌছাতে রাত দুইটা বেঁজে যায়। ইমার্জেন্সিতে শুধু একজন ডাক্তার আছে। ওই ডাক্তার বিভানের মাকে নিয়ে যায় সাথে একজন নার্সকে বলে, গাইনি বিভাগের কোন ডাক্তারকে ফোন দিয়ে ইমারজেন্সিতে এখনই হাসপাতালে আসতে বলতে।

শিমুর ভয়ে হাত-পা কাঁপাকাঁপি অবস্থা। হাসপাতালে এসে সে পায়চারি করছে কি করবে। তখনি ইভান শিমুকে জিঙ্গাসা করে,

–শিমু, এগুলা কিভাবে হলো?

ইভানের প্রশ্নে শিমু ধরা পরে যাবার ভয়ে এবং নিজেকে বাঁচাতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলে,
–আমি কি বলবো ভাইয়া! আমি আর আপু কথা বলছিলাম তখনি আন্টি আর আপনার ভাই এসে আমার বোনের সাথে খারাপ কিছু করতে চায়। আমি আপনার ভাইকে বাধা দিতে গেলে এগুলা হয়ে যায়।

ইভান হতভম্বের মতো নিজের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে আর বিভান তো শকড! সে ভাবতেও পারছে না তার নামে এসব মিথ্যা কথা রটানো হচ্ছে। শিমু এগুলা বলেছে এই ভেবে যে কোনো প্রমান নেই তাই।

–আমার আপুর কিছু হলে আমি কিন্তু তাদের ছেড়ে কথা বলবো না, দরকার হলে তাদেরকে আমি পুলিশে দিব। আপনার মা ও ভাই আমার বোনের সাথে অন্যায় করবে সেটাকে মেনে নেওয়া যায় না।

ইভান সত্য মিথ্যা যাচাই করতে পারছে না। ইভানের বিশ্বাস হচ্ছে না তার ভাই ও মা এরকম করতে পারে! আর তাছাড়া তার মা নিজেও তো অনেকটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। গাইনি বিভাগের ডাক্তার ভোর তিনটা নাগাদ এসে হসপিটালে পৌঁছায়। এরপর রিমুকে সার্জারি করার জন্য নিয়ে যায়। রিমুর অবস্থা অনেকটাই খারাপ।

সার্জারি করতে করতে ভোর পাঁচটা হয়ে যায়। ডাক্তার বেরিয়ে এসে বলে,
–মিস্টাক ইভান, আমরা আপনার মেয়েকে বাঁচাতে পারিনি। তারপর আপনার স্ত্রীর জরায়ু অনেক খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই আমাদেরকে এরপরের অপারেশনে আপনার স্ত্রীর জরায়ু কেটে ফেলতে হবে। জরায়ু না কাটলে এখান থেকে বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়বে শরীরে। আপনাকে বন্ডে সই করতে হবে।

ইভান ভেঙে পরে ডাক্তারের কথায়। বিভান তার ভাইকে শান্ত করার জন্য তার পাশে এসে বসে। পরক্ষণেই শিমু বলে,

–ভাইয়া, এবার আমি পুলিশ ডাকবো। আপনার ভাই ও মায়ের কারণে আজ আমার আপুর এই অবস্থা।

বিভান ভাবতেও পারছেনা এই সময়ে, এই মেয়েটা এভাবে মিথ্যা কথা বলতে পারে। ইভানের কথার তোয়াক্কা না করে শিমু পুলিশ আনবেই। এদিকে বিভানের মায়ের মাথার সার্জারি মাত্র শেষ হলো। ডাক্তার বেরিয়ে এসে বলে,

–মিস্টার ইভান ও মিস্টার বিভান। আপনাদের মায়ের ‘ট্রোম্যাটিক ব্রেইন ইনজুরি ‘ হয়েছে। ‘ট্রোম্যাটিক ব্রেইন ইনজুরি’ অনেকক্ষেত্রে তেমন কোনো ক্ষতির কারণ নাও হতে পারে৷ আবার তা মৃত্যুর কারণও হতে পারে৷ প্রথম কিংবা হালকা পর্যায়কে বলা হয় ‘কনকাশন৷’ এর অর্থ হচ্ছে, প্রচণ্ড আলোড়ন, আঘাত বা উত্তেজনার ফলে মস্তিষ্কের ক্ষতি৷ এই পর্যায়ে সাধারণত আঘাত লাগার কয়েকদিনের মধ্যেই মস্তিষ্ক আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে৷ রোগী যখন মাথায় আঘাত লাগার পর ১৫ মিনিট বা তার বেশি সময় অচেতন থাকেন, তখন সেই আঘাতের মাত্রাকে দ্বিতীয় পর্যায়ের বিবেচনা করা হয়৷
রোগী যদি মাথায় আঘাত লাগার পর এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে অচেতন থাকেন, তাহলে তাঁর ‘টিবিআই’ এর মাত্রা তৃতীয় পর্যায়ের বিবেচনা করা হয়৷ আর রোগীর উপর এধরনের আঘাতের পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে৷ বিশেষ করে তাঁর শারীরিক এবং মানসিক, উভয় ক্ষতি হতে পারে৷ এক্ষেত্রে রোগীর হৃদযন্ত্রের কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটতে পারে, তিনি পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন, এমনকি তাঁর ব্যক্তিত্বে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে পারে৷ তৃতীয় পর্যায়ের ক্ষতি সাধারণত অপূরণীয় হয়৷

ডাক্তার এগুলো বলে থামে। দুই ভাই ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে আছে ডাক্তারের দিকে। ডাক্তার একটা শ্বাস নিয়ে আবার বলে,
–এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আপনার মায়ের কি অবস্থা? বাকিটা যা হয় তা মেনে নিতে হবে।

এই বলে ডাক্তার চলে যায়। আর শিমুকে দেখে ভীত মনে হচ্ছে। ইভানের অবস্থা অনেক খারাপ। তার মা, বউ ও বাচ্চা সবাইকে সে একসাথে হারাতে বসেছে। বিভান মায়ের এই অবস্থা মানতে পারছেনা।

সকাল আটটায় শিমু নিজ দায়িত্বে পুলিশ নিয়ে এসে পুলিশকে নিজের মনগড়া কথা শোনায়। বিভানের কাছে যেহেতু নিজের পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই সে কিছু বলেও লাভ হচ্ছে না। শিমু পুলিশকে এটাও বলে বিভানের তার ভাবির উপর রাগের কারন বিভানের স্ত্রী চলে যাবার ক্ষেত্রে ভাবির হাত আছে বলে বিভান মনে করে। এসব বলার দরুন পুলিশ বিভানকে হাসপাতাল থেকে বাহিরে যেতে দিচ্ছে না।

সকালে সাড়ে আটটার দিকে অদ্রি হাসপাতালে আসে। অদ্রি হাসপাতালের ঠিকানা বিভানের থেকে জোগাড় করেছে। অদ্রি অনেক দিন পর বিভানের সাথে যোগাযোগ করে, সকালে ঘুম থেকে ওঠে ক্যামেরাতে ধরা পড়া চিত্র গুলো দেখে।

অদ্রী এসে পুলিশকে বলে,
–আপনারা কারো মুখের কথার উপর ভিত্তি করে আমার হাজব্যান্ডকে আটকে রাখতে পারেন না। আপনাদের কাছে শিমু কি প্রমাণ দিয়েছে জানিনা তবে শিমুর বিপক্ষে আমার কাছে স্ট্রং প্রমাণ আছে।

অদ্রির কথায় শিমু ভয় পেয়ে যায় তবে পরক্ষণেই তার মুখে ফুটে ওঠে ক্রুর হাসি, হয়তো এটা ভেবে যে, অদ্রি কি আর সেখানে ছিল যে জানতে পারবে!
শিমুর মুখ ভঙ্গি দেখে অদ্রি বাঁকা হাসে তারপর পুলিশের হাতে রেকর্ড করা ভিডিও দেয়।

পুলিশ সবটা দেখার পর শিমুকে আটক করে এবং ইভান ও বিভানকেও সবটা দেখায়। সব দেখে ইভান শিমুকে জোরে একটা থাপ্পড় মেরে বলে,
–তোমার জন্য আজ আমার মায়ের এই অবস্থা। আর তোমার বোন! সে তো নিজের অন্যায়ের মাশুল নিজেই করেছে সাথে আমার সন্তানকেও।

ইভান পুলিশকে ডেকে বলে,
–অফিসার নিয়ে যান এই মেয়েটাকে। আমার স্ত্রী সুস্থ হলে আপনি তাকেও আপনার কাস্টাডিতে নিতে পারেন।

পুলিশকে অদ্রি এই এতো বছরের সব ঘটনা বলে আর প্রমান হিসেবে চাইলে ভিডিও দেখাতে পারে সেটাও বলে।
পুলিশ কয়েকদিনের ভিডিও দেখে শিমুকে গ্রেফতার করে। পুরোটা সময় শিমু যেনো অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। তার মুখের বুলি যেন হারিয়ে গেছে।

শিমুর এরূপ অবস্থায় অদ্রী তার কানের কাছে এসে বলে,
–কি ভাবছ শিমু! আমাকে সরিয়ে বিভানকে সম্পত্তির জন্য বিয়ে করবে! এতো সহজ! তোমরা তোমাদের কাজ নির্বিঘ্নে করতে পেরেছ শুধু মাত্র আমি চেয়েছি বলে।
কথায় আছে না,
” অতি লোভে তাঁতি নষ্ট। ”

শিমুকে নিয়ে পুলিশ চলে যায়। শিমুর পরিবারও কিছুক্ষণ আগে এখানে এসেছিল। তারা এসে তাদের মেয়ের এই অবস্থা দেখে লজ্জা পায়। অবশ্য তারা কিছুটা জানতো এই ব্যাপারে তবে প্রমাণের কাছে এখন তারা কিছু বলতে পারবে না।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে