সমাপ্তির পূর্ণতা পর্ব-০২

0
1090

#সমাপ্তির_পূর্ণতা
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-২
ডাক্তারের সাথে এপোয়েনমেন্টের জন্য ওয়েটিং রুমে বসে আছে অদ্রি। অদ্রির সারা শরীর মৃদু কম্পনে কম্পিত হচ্ছে বারংবার। ডাক্তারের কাছে চেকআপ করাতে এসেছে বাড়ির সবাইকে এ বিষয়ে অজ্ঞাত রেখে। অদ্রি নিজের স্বামী বিভানকেও এই ব্যাপারে কিছু জানায়নি কারণ সে কখনো চায় না বিভানের থেকে দূরে যেতে। অদ্রি মনে মনে ভালো কিছু আশা করছে আর এখন বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।

অদ্রি বাড়ির কাজের মহিলা রহিমার থেকে জানতে পেরেছিলো যে, বড় ভাবীর ছোট বোন শিমু প্রায় এই বাড়িতে আসে আর বিভানের মায়ের সাথে অনেক্ষণ গল্প করে। শিমুর এই বাড়িতে আসা নিয়ে অদ্রির কোনো সমস্যা নেই কারণ শিমু তার বোনের শশুর বাড়ি এসেছে যেমনটা তার (অদ্রির) বোন মাঝেমাঝে আসে বেড়াতে। শিমুর এখানে আসা যাওয়া আছে এই খবরটা অদ্রি প্রথম কয়েক দিন যাওয়ার পর জেনেছিলো।
অদ্রি কখনো পাত্তা দেয়নি এই ব্যাপারে কারণ দিনশেষে তার শাশুড়ি তার সাথে অমায়িক আচরণ করতো, একদম নিজের মেয়ের মতো। অদ্রির শাশুড়ি নিজের মেয়ে ও অদ্রিকে অন্য চোখে দেখেনি তবে ইদানিং উনি খুব অন্যরকম ব্যাবহার করছেন অদ্রির সাথে। তিনি অদ্রির সাথে আগের মতো কথা বলেন না। শাশুড়ির এরকম বদলে যাওয়া দেখে অদ্রির মনে ক্ষীণ ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে।

এসব কল্পনা ঝল্পনার মাঝে পাশের সিটে বসে থাকা মেয়েটার দিকে নজর যায় অদ্রির। তার পাশের সিটে বসে আছে এক সাত মাসের প্রেগনেন্ট মেয়ে। মেয়ে বলছি কারণ প্রেগনেন্ট মেয়েটির বয়স সতেরোর বেশি হবে না। এতো কম বয়সে প্রেগনেন্সির কারণে মেয়েটির চেহারার বেহাল দশা, মনে হচ্ছে একটা হাড্ডিসার মেয়ে বসে আছে তার পাশে শুধু মাত্র পেটটা খানিকটা উঁচু। মেয়েটার সাথে তার মা, স্বামী ও শাশুড়ি এসেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে শুধুমাত্র মেয়েটার মায়ের চোখে মেয়েটাকে নিয়ে শংকা আর বাকি দুজনের তো অনাগত সন্তান নিয়ে চিন্তা। এসব দেখে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অদ্রি।

এমন সময় রিসিপশন থেকে অদ্রির নাম ডাকলে অদ্রি দুরু দুরু মনে ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করে। ডাক্তারের সামনে বসে অদ্রি কিছুটা নার্ভাস হয়ে পরে। ডাক্তার হয়তো বিষয়টা আন্দাজ করতে পারলো তাই ডাক্তার অদ্রিকে বলল,

–মিসেস অদ্রি, আপনি আপনার সমস্যা নির্দ্বিধায় আমাকে বলুন।

ডাক্তারের কথায় অদ্রি নিজেকে ধাতস্থ করে সব সমস্যা খুলে বলে। সব শুনে ডাক্তার কিছু টেস্ট সাজেস্ট করে। এরপর ডাক্তারের ওখান থেকে বের হয়ে অদ্রি টেস্ট করতে যায়। অদ্রির মন অশনি সংকেত দিচ্ছে, বারবার মনে হচ্ছে কোন খারাপ কিছু হতে চলেছে। সবগুলো টেস্ট করিয়ে বাড়ি ফিরে অদ্রি। আজ অফিস থেকে হাফ ডে করে ছুটি নিয়েছিলো তাই বিকেলের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যায়। বাড়ির গেটের কাছে যাওয়ার পর আজকে সে শিমুকে দেখতে পায়।

শিমু প্রথমে অদ্রিকে দেখে হকচকিয়ে গেলেও অদ্রির বিমর্ষ মুখ দেখে বাঁকা হাসে। শিমুর এই বাঁকা হাসির কারণ, আজ তিনদিন পর শিমু এই বাড়িতে এসে জানতে পেরেছে অদ্রিকে তার শাশুড়ি বাচ্চার কথা বলেছে। শিমু জানে হয়তো সে বিভানকে নিজের করে পাবেনা কিন্তু সে বিভানকে আর অদ্রিকে সুখে থাকতে দিবেনা। শিমু তার বোনের কাছ থেকে শুনেছিলো অদ্রি নাকি রিমুর ছেলে রিহাবকে অনেক আদর করে। যে মেয়ে জায়ের সন্তানকে এতোটা সন্তানতুল্য ভালোবাসে সে কেনো বিয়ের প্রায় দুই বছর হতে চলল তারপরেও কনসিভ করছে না!
এই ভাবনাটা শিমু ও রিমুর মাথায় আসার পরেই তারা এই চাল টা চালে।

শিমু অদ্রির সাথে কোনোরূপ কথাবার্তা না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। অদ্রি শিমুর মুখে বাঁকা হাসি দেখে এবার ঠাওর করতে পারলো যে তার শাশুড়ির মাথায় এসব শিমুই ঢুকাচ্ছে রিমুর শলা পরামর্শে।

অদ্রি আর এসব ভাবতে চাচ্ছে না। তার এখন মানসিক প্রশান্তির প্রয়োজন। বাড়ির ভেতরে ঢোকার পরে অদ্রি দেখে তার শাশুড়ি সোফায় বসে পান বানাচ্ছে আর একটু আগে শিমু চলে যাওয়ার দরুন সদর দরজা খোলা ছিল। অদ্রি তার শ্বাশুড়ীকে সালাম দিয়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালে তার শাশুড়ি তাকে ডাকে।

–ছোট বউমা, আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে? তোমার তো ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়।

শাশুড়ির মুখ থেকে নরম কন্ঠে ডাক শুনে অদ্রির মন অনেকটাই ভালো হয়ে যায়। তবে সেটা বেশিক্ষন স্থায়ী হয় না।
–শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
–জ্বী মা।
–আলহামদুলিল্লাহ সুখবর পাবো হয়তো!

শাশুড়ির এহেনো মন্তব্যে অদ্রির মুখ কালো হয়ে যায়। অদ্রির শাশুড়ি যথেষ্ট বিচক্ষণ মহিলা তবে তার মুখ থেকে এমন বানী যেন অন্যকারো শেখানো বুলি।

” কুচিন্তা ও কুবুদ্ধি মানব মস্তিষ্ককে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয় যাতে সে নিজের বিচক্ষণতা হারায়। ”

শাশুড়িকে মুখে কোনো প্রতিউত্তর না করে ইশারায় না বুঝিয়ে মাথা নিচু করে নিজের রুমে চলে যায়। অদ্রি এটাই বুঝতে পারছে না শিমু কেনো এরকমটা করছে? কি স্বার্থ এতে তার? শিমু অবিবাহিত! তাহলে কেন তার (অদ্রি) ও বিভানের সংসার ভাঙ্গার জন্য উঠে পরে লেগেছে? শিমু তো কোনো অবিবাহিত ছেলেকে বিয়ে করতে পারে! তাহলে কি এসব রিমু ভাবির কারসাজি? রিমু ভাবি কাস্মিনকালেও তাকে সহ্য করতে পারত না।
নাহ! সে আর এসব নিতে পারছে না। কালকে রিপোর্ট দেখে সে সিদ্ধান্ত নিবে কি করবে।

অদ্রি মাইন্ড ফ্রেশ করতে শাওয়ার নিয়ে আসরের নামাজটা আদায় করে অনেকক্ষণ ব্যালকনিতে বসে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বিস্তর রক্তিম অম্বরে সূর্যের বিলীন হওয়া দেখতে লাগে।
মাগরিবের নামাজ পড়ার পরে অদ্রি ঘুম দেয়। তার শাশুড়ি নামাজের পরে অদ্রিকে নিয়ে চা খাবে বলে ডাকতে আসে কিন্তু এসে অদ্রিকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে আর ডাকে না।

রাত নয়টা নাগাদ বিভান বাড়ি ফেরে। মায়ের সাথে ড্রয়িং রুমেই দেখা হয়ে যায় তবে প্রতিদিনকার মতো অদ্রিকে দেখতে পায় না। নিজেদের রুমে যেয়ে অদ্রিকে এলোমেলো হয়ে ঘুমুতে দেখে ঠোঁটে ফুটে উঠে সূক্ষ্ণ হাসি। মেয়েটাকে এলোমেলো অবস্থায় তার কাছে বেশ লাগে। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে অদ্রিকে আলতো করে ডাক দেয়।

বিভানের আদর মিশ্রিত ডাকে চোখ পিটপিট করে খুলে।এরপর উঠে বসে বলে,
–কখন এলে? সরি, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম।

অদ্রির কথায় বিভান আলতো হাসে। মেয়েটা খুব সরল। তার সরলতার কারণেই মা ও বউয়ের মাঝে সে সম্প্রিতি বজায় রাখতে পারে। বিভান আস্বস্ত ভঙ্গিতে বলে,

–তুমি সেই সকালে রান্নাবান্না করে অফিসে যাও। এরপর অফিসে সারাক্ষন প্রোডাকশন, ম্যানুফ্যাকচারের কাজ গুলো সূক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষন করো যাতে বিন্দু পরিমানেও ভুল না হয়। একটু ভুল হাজার হাজার মানুষের প্রান সংশয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তারপর বাড়ি ফিরে রাতের জন্য হালকা কিছু রান্না করো। আর আজ একদিন একটু ঘুমানোতে তোমাকে সরি ফিল করতে হবে না “অদ্রিপাখি”।

অদ্রির মনে যেনো শিতল হাওয়া বয়ে যায়। বিভান সবসময় কেয়ারিং। সেদিন রাতে ওরা তিনজন প্রতিদিনকার মতো একসাথে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরেরদিন সকালে আবার সেই প্রতিদিনকার মতো ব্যাস্ত রুটিন। অদ্রির কম্পানি কিছু নিউ ড্রাগ নিয়ে কাজ করছে। নিউ ড্রাগটা জার্মানিতে ইনভেন্ট হয়েছে। অনেক এক্সপেনসিভ এই ড্রাগের ফরমুলা। এই ড্রাগটা নিয়ে কাজ করার জন্য কিছু রিসার্চার ও প্রোডাকশনের অফিসার লাগবে। ড্রাগটা যেহেতু এক্সপেনসিভ তাই প্রোডাকশন অফিসাররা এগিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছেন।

বেলা এগারোটায় অদ্রির অফিসের ঠিকানায় হসপিটাল থেকে পার্সেল আসে। পিয়ন এসে যখন পার্সেলটা দিয়ে যায় তখন অদ্রির হৃদপিন্ডের গতি যেন কয়েক গুন বেড়ে গিয়েছে। কাঁপা কাঁপা হাতে পার্সেলটার ভিতর থেকে কালকের টেস্টের রিপোর্ট খুলার পর অদ্রির পুরো দুনিয়া যেন টলে উঠল। চোখে সব কিছু যেনো ডুবন্ত প্রায় লাগছে।
রিপোর্টে লিখা আছে, ” অদ্রির জরায়ুতে বাম ফ্যালোপিয়ান টিউবে সিস্ট আছে তাই বেবি কনসিভ হচ্ছে না। তবে সঠিক চিকিৎসা নিলে সুস্থ হওয়া সম্ভব। ”

এতোটুকুন পড়ার পর রিপোর্টটা অদ্রির হাত থেকে নিচে পড়ে যায়। নিজেকে ভারসাম্যহীন লাগছে অদ্রির। অদ্রি ভাবছে এই কথাটা যদি তার শাশুড়ি জানতে পারে তাহলে কি হবে? তাকে তো শিমু অনেকটা পরিবর্তন করে ফেলেছে কান ভাঙ্গানি দিয়ে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে