সবিতা
পর্ব: ০৯
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ
সবিতা, যেটি ছিল তার জীবনের একক সংগ্রাম, এখন সেটি হয়ে উঠেছে একটি বৃহৎ উদ্যোগ—সমাজে পরিবর্তন আনা। তার বই, সেমিনার এবং লেখালেখি জীবনে সবার সাথে একযোগভাবে প্রভাব ফেলছিল। এবার সে একটি নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করল, যার নাম ছিল “শক্তি সচেতনতা”। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সবিতা অনেক তরুণ-তরুণীকে জীবনে তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন করতে চেয়েছিল। সে বিশ্বাস করেছিল, যখন একজন মানুষ নিজের আত্মবিশ্বাস খুঁজে পায়, তখন সে পৃথিবীটাকে আরও সুন্দর করতে পারে।
সবিতা তাঁর এই উদ্যোগের মাধ্যমে আরও অনেক মানুষকে নিজেদের ভেতরের শক্তি এবং সম্ভাবনার প্রতি বিশ্বাসী করতে চাইছিল। তার এই প্রজেক্টে এমন হাজারো তরুণ-তরুণী একত্রিত হয়েছিল যারা নিজেদের জীবনের নতুন পথ খুঁজছিল।
____
সবিতার জীবন এখন এক নতুন মোড় নিতে চলেছে। তার শুরু করা উদ্যোগ “শক্তি সচেতনতা” এখন এক বৃহৎ আন্দোলনে পরিণত হতে চলেছে। মানুষ আরও বেশি করে তার গল্পের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে এবং জীবনের উদ্দেশ্য খোঁজার জন্য একত্রিত হচ্ছে।সবিতা জানতো, এটি এক রাতের ব্যাপার নয়, তবে সে শুরু করেছে, এবং তার মনোবল সবার মাঝে আশার আলো জ্বালিয়েছে।
—
সবিতা তার উদ্যোগের মাধ্যমে তরুণদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে শুরু করেছিল। সে জানতো, সঠিক পথ চলতে পারলে একজন মানুষ কীভাবে তার জীবনে বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে। সেমিনার, বই আলোচনা, এবং প্রাকটিক্যাল ক্লাসের মাধ্যমে সবিতা তরুণদের জীবন সম্পর্কে ধারণা দিতে চাইছিল। তার প্রতিটি বক্তৃতা যেন একটি অনুপ্রেরণার ঝরনা হয়ে পড়েছিল।
সেখানে, একদিন এক তরুণী সবিতার কাছে এসে বলল—
– “আপনার বই এবং সেমিনারের পর আমার জীবন পুরোপুরি বদলে গেছে। আমি এখন জানি, আমি কী চাই। আমি জানি, আমি শুধু স্বপ্ন দেখতে চাই না, স্বপ্ন বাস্তব করার জন্য কাজ করতে হবে।”
সবিতা তার চোখে এক উজ্জ্বল হাসি দিয়ে বলল—
– “আমরা কেউ কখনো একা নই। আমাদের মধ্যে যে শক্তি রয়েছে, সেটিই আমাদের একে অপরের দিকে টেনে আনে। তোমরা যদি বিশ্বাস রাখো, তুমি তোমার পথ খুঁজে পাবে।”
এভাবেই সবিতা তার কাজকে আরও গভীর করে চলছিল। তার প্রতিটি উদ্যোগ নতুন আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু এখন, সবিতার সামনে নতুন এক চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়িয়েছে।
________
একদিন সবিতা একটি বড় সভার আয়োজন করেছিল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন পেশার মানুষ—কর্মী, উদ্যোক্তা, শিক্ষিকা, চাকরিজীবী, এমনকি ছাত্রছাত্রীরাও।সবিতা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো—
– “আমরা সবাই জানি, জীবনে চ্যালেঞ্জ আসে, সমস্যা আসে, তবে যদি আমরা একে অপরকে সহায়তা করি, একে অপরের জন্য দাঁড়িয়ে থাকি, তবে কোনো বাধাই আমাদের অতিক্রম করা অসম্ভব নয়। আমি চাই এই মঞ্চ থেকে আমরা সবাই মিলে একটি সংকল্প নি—নিজেকে বিশ্বাস করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।”
তার কথা শুনে উপস্থিত সবাই হর্ষধ্বনিতে মাতিয়ে তোলে। তাদের মধ্যে অনেকেই উঠে দাঁড়িয়ে সবিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল। সবিতা জানতো, তার কাজটা সঠিক পথে যাচ্ছে।
___
একদিন, সবিতা তার এক বন্ধু রিয়া’র সাথে বসে কথা বলছিল। রিয়া বলল—
– “তুমি জানো, সবিতা, তুমি একাই অনেক কিছু করতে পারো। কিন্তু এখন তুমি একে অপরকে সাহায্য করার মাধ্যমে সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে পারছো। তোমার কাজের জন্য আমি গর্বিত।”
সবিতা হাসিমুখে বলল—
– “ধন্যবাদ, রিয়া। তবে আমি জানি, এই পথ কখনো শেষ হবে না। প্রতিটি নতুন দিন একটি নতুন সুযোগ এনে দেয়।”
এভাবেই সবিতা তার জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এখন তার পথের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ ছিল, তবে সে জানতো, তার মাঝে যে শক্তি আছে, তা দিয়ে কোনো কিছুই অতিক্রম করা অসম্ভব নয়।
………
সন্ধ্যা নামে ঢাকার আকাশে। ক্লান্ত শহরের গা ঘেঁষে এক নিঃশব্দ বাসার জানালায় বসে সবিতা চুপচাপ চা খাচ্ছে। তাওহীদ আসেনি আজ। হঠাৎই একটা ফোন আসে—আমেনা আপার।
– “আন্নি মা খুব অসুস্থ। অনেকদিন ধরে তোকে দেখতে চাইছে। তুই যদি একটু…”
চুপ করে থাকে সবিতা। কিছু বলার মতো শব্দ পায় না। অনেক অভিমান, তবু মা তো মা-ই। পরদিনই সে ছুটে যায় মায়ের কাছে।
—
মায়ের চোখে জল
মা বিছানায় শুয়ে আছেন। শরীর শুকিয়ে গেছে, কণ্ঠ ক্ষীণ।
– “তুই ভালো আছিস তো মা?”
সবিতা চোখের জল আটকে রাখে। অনেকদিন পর এই মমতা-মাখানো কণ্ঠ শুনে বুকের ভেতরটা গলে যায়।
– “ভালো থাকার লড়াই করছি মা…”
– “তোর মতো মেয়ে… একদিন অনেক উঁচুতে যাবে। সাইফ বোঝে নাই, তাতে কী হয়েছে? তুই নিজের মতো করে আলো হবি…”
সবিতা মায়ের হাত ধরে রাখে। কাঁদে না, শুধু খুব নীরবে হাসে।
—
সবিতা আবার কাজ শুরু করে। “উত্তরণ”-এর ক্যাম্পেইন এবার গ্রামে, যেখানে নারীদের শিক্ষার অভাব এখনো প্রকট।
সে প্রতিদিন সকালে বের হয়, ছুটে বেড়ায় একেকটা ইউনিয়নে। তার চোখে নতুন স্বপ্ন—একটা প্রজন্ম বদলে দেওয়ার।
তাওহীদ প্রতিদিন পাশে থাকে, কখনো কিছু বলে না, শুধু বোঝে। আর সবিতা, ধীরে ধীরে তাওহীদ কে বিশ্বাস করতে শেখে।
—
এক সন্ধ্যায়, ক্যাম্প থেকে ফিরে চায়ের কাপ হাতে, তাওহীদ বলে,
– “সবিতা, আমি জানি তুমি ভেঙে পড়েছো,গড়েছো আবার ভেঙেছো… কিন্তু যদি তুমি চাও, তবে আমি তোমার পাশে থেকে এই যাত্রাটা ভাগ করে নিতে চাই।”
সবিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
– “তুমি জানো তাওহীদ , আমি প্রেমে না, জীবনে বিশ্বাস করতে চাই। যদি তুমি আমার জীবনকে সম্মান করতে পারো,তাহলে বন্ধু হিসেবে তোমাকে ভাবা যেতে পারে…”তবে সারাজীবন এর সঙ্গী হিসেবে আমি দ্বিতীয় কাউকে আর গ্রহণ করতে চাই না।
তাওহীদ মৃদু হাসে। সম্মান, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব—সব আছে তোমার প্রতি,জীবন তোমার সিদ্ধান্ত ও তোমার,যদি কখনো মনে হয় আমি তোমার পার্টনার হওয়ার যোগ্য তাহলে ভেবে দেখতে পারো, আমি অপেক্ষায় থাকবো আজীবন।
সবিতা চুপ হয়ে রইলো।
—
সবিতার গল্প এখানেই শেষ নয়। এই তো শুরু।
একজন নারীর একা পথ চলা, আত্মপরিচয় খোঁজা, সম্মান কুড়িয়ে পাওয়া আর নতুন করে বিশ্বাস করতে শেখার গল্প এটা।
একটা সম্পর্ক ভেঙে গেলে জীবন থেমে যায় না—নতুন কোনো গল্প সেখানে গাঁথা হতে থাকে…
“উত্তরণ”-এর কাজ এখন শহর পেরিয়ে বিভিন্ন জেলার নারীদের জীবনে আলো দিচ্ছে।
আন্নি একটি ছোট্ট স্কুল চালু করে, যেখানে নির্যাতিত, বঞ্চিত মেয়েরা শিক্ষা পায়, সেলাই শেখে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখে।
তাকে এখন সকলে “আপা” বলে ডাকে, কেউ কেউ “ম্যাডাম”।
তাওহীদ পাশে থাকে, কিন্তু কোনো চাপ দেয় না। শুধু সবিতার সঙ্গে হেঁটে চলে, নিজের জায়গা থেকে।
এই বন্ধুতা একরকম নির্ভরতার মতো।তবে সে সবিতার হ্যাঁ উত্তর শোনার অপেক্ষায় আছে।
—
এক সন্ধ্যায়, সবিতার বড়বোন আমেনা তাকে খুঁজে বের করে। কান্নাভেজা চোখে বলে—
– “আমরা সবাই ভুল করেছিলাম, আন্নি। তুই সাহস দেখিয়েছিস, যা আমরা পারিনি। তুই আমাদের গর্ব।”
সেই দিন, বহুদিন পরে, সবিতা প্রথমবার কোনো আপনজনের বাহুডোরে নিজেকে সঁপে দিয়ে কান্না করতে পারে।
একদিন সবিতা যখন তার স্কুলে কাজ করছিল,
আমেনা আপা নিজে এসে জানালেন—মা আসছেন।
আজকাল আমেনা মাঝেমধ্যেই সবিতার সাথে দেখা করতে আসে।আগে সবাই ঘৃণা করলেও এখন সবিতাকে নিয়ে সবার গর্ব হয়।
মা এলেন। চোখ ভরা জল, মুখে একটাই কথা—
– “আমার মেয়ে শুধু এই সমাজে টিকে নেই, নিজেই একটা পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
বাবাও এসেছেন। মুখে আর বকুনি নেই। আজ তিনি শুধু বললেন—
– “তুই আমাদের গর্ব, মা।”
সবিতার চোখে জল আসে, কিন্তু এবার সেটা কান্না নয়—অভিমান গলে গিয়ে শান্তির জল।
—
সবিতা এখন নিজেকে অনেক বেশি শক্তিশালী ও স্বাধীন একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে। কিন্তু শক্তির এই উত্থানের পেছনে যে গভীর একাকিত্ব ও মানসিক যুদ্ধ চলেছে, তা খুব কম মানুষ জানে। রাতের পর রাত সে নিঃশব্দে কেঁদেছে, নিজের সিদ্ধান্তগুলোর বিশ্লেষণ করেছে, ভুল স্বীকার করেছে, আবার উঠে দাঁড়িয়েছে।
একদিন, একটি সেমিনার শেষ করে ফেরার পথে সবিতা হঠাৎ রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে। স্থানীয় এক তরুণী ও তার মা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তার জানায়, সবিতা দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্রামহীন কাজ করে গেছে, খাওয়া-দাওয়ার ঠিক ছিল না, যার ফলে সে শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েছে।
জ্ঞান ফিরে পেয়ে সবিতা প্রথমে কিছুটা ভয় পায়, কারণ তার পাশে কেউ পরিচিত ছিল না। কিন্তু সে চমকে যায় যখন দেখে যে অচেনা সেই মা-মেয়ে খুব যত্ন করে তার সেবা করছে।
তারা জানায়—
– “আপনার নাম আমরা জানি না, কিন্তু আপনার মুখে আত্মবিশ্বাস ছিল, আর আপনার ব্যাগে পাওয়া ফাইলগুলোতে লেখা কিছু কথায় আমরা খুব অনুপ্রাণিত হয়েছি।”
সবিতার চোখে পানি চলে আসে। এই প্রথমবার সে বুঝতে পারে, তার কাজ কতদূর ছড়িয়ে পড়েছে।
—
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সবিতার মনে পড়ে তার ছোটবেলার কথা। বাবার কড়া শাসন, মায়ের গলা টিপে রাখা দুঃখ, বড় বোন আমেনার ঝাড়ি, আর সেই নিঃসঙ্গ আঙ্গিনায় বসে থাকাটা। সে বুঝতে পারে, শৈশব থেকে এখন পর্যন্ত সে শুধু ভালবাসার জন্য ছুটেছে। অথচ জীবন তাকে বারবার আত্মনির্ভরশীলতা শেখাতে চেয়েছে।
—
সবিতা এবার সিদ্ধান্ত নেয়, সে কেবল অন্যকে পরিবর্তনের কথা বলবে না, নিজের যত্নও নেবে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে সে কয়েক দিনের জন্য নিজেকে সময় দেয়।
সে এক নির্জন কফি শপে গিয়ে ডায়েরিতে লিখে—
– “আমি সবিতা, আমি একা হলেও অসম্পূর্ণ নই। আমার জীবন, আমার যুদ্ধ, আমার ভালোবাসা—সবটাই আমি নিজে গড়ে নিচ্ছি। যারা পাশে থাকবে তারা সম্মান নিয়ে থাকবে, আর যারা নয়—তাদের জায়গা জীবনে নেই।”
সবিতা এখন শুধু একটি নাম নয়, একটি আন্দোলন। নারীদের সম্মান, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠেছে সে।
চলবে_______