সবিতা
পর্ব: ০৮
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ
সবিতা তার লেখালেখির জগতে নিজের অবস্থান শক্ত করে রাখলো। বইটি সফলতার সাথে বিক্রি হতে থাকল, এবং তার গল্প অন্যদের জন্য এক অনুপ্রেরণা হয়ে উঠলো। তবে তার জন্য সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল নিজের অভ্যন্তরীণ শান্তি এবং আত্মবিশ্বাস। সে জানত, তার জীবনের পথে যে পথচলা শুরু হয়েছিল, তা শুধু তার জন্য নয়, আরও অনেকের জন্য একটি নতুন আলো হতে পারে।সবিতা তার লেখার মাধ্যমে সেই আলো ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল।
—
একদিন সন্ধ্যায়, সাইফ আবার সবিতার কাছে এসে দাঁড়াল। অনেক দিন পর তাদের মধ্যে আবার দেখা হয়েছিল, কিন্তু এবারের পরিবেশ অনেকটা ভিন্ন ছিল। সাইফ, যে আন্নিকে একসময় মনে করত নিজের জীবনের অংশ, আজ তাকে একেবারেই অপরিচিত মনে হচ্ছিল। সাইফ বলল—
– “আন্নি, আমি জানি আমি অনেক ভুল করেছি,তোমার কাছে এজন্য বার বার ক্ষমাও চেয়েছি।কিন্তু তুমি ক্ষমা করে দাও নি। আমি কি তোমার কাছ থেকে একেবারে হারিয়ে গেছি?”তোমার মনে আমার কি সত্যি কোনো জায়গা নেই?
আজকেই শেষ, আর কখনো বলবো না আমার ভুল হয়ে গেছে আন্নি,আমাকে ক্ষমা করে দাও,আর একটিবার তোমার জীবনের সাথে জড়িয়ে নাও।
সবিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে, গভীরভাবে সাইফের দিকে তাকাল। তার মধ্যে আর কোনো ক্ষোভ বা কষ্ট ছিল না। তার কণ্ঠে শান্তি ছিল, তবে এক অদ্ভুত শক্তি, যা সে নিজের থেকে পেয়েছিল—
– “সাইফ, আমি এখন সত্যি বলতে ভয় পাই না।আমি আগেও বলেছি আর বার বার বলছি তুমি আমার জীবনের অতীত,কিন্তু অতীত আর বর্তমান এক নয়। আমি আমার জীবনের নতুন পথ তৈরি করেছি। তুমি যদি ক্ষমা চাও, হ্যাঁ দিলাম ক্ষমা করে,কিন্তু তুমি তো এতে আন্নিকে আর ফিরে পাবে না।আন্নি হারিয়ে গেছে সাইফ,তুমি নিজের হাতে আন্নিকে মেরে ফেলেছো,এখন যাকে আন্নি ভেবে বার বার কাছে ডাকছো সে হলো সবিতা।
আর সবিতার জীবনে সাইফের কোনো জায়গা নেই।সবিতা একা নিজের পথ চালিয়ে যেতে পারে এখন, আর আমি আশা করি তুমিও তোমার পথ খুঁজে পাবে।”
সাইফ আর রিকুয়েষ্ট করে না সবিতাকে,সে অনেকক্ষণ তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শুধু একটা হাসি দিলো,আর বললো,
নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা সবিতা।
তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।তোমার থাকলে ক্ষমা করে দিও।তুমি থাকতে তোমাকে মূল্যায়ন করি নি ঠিকই এখন হারিয়ে ঠিক বুঝতে পারছি তুমি কি ছিলে আমার জীবনে?
সাইফ চলে গেলো।
সে আজ ব্যর্থ।
আর সবিতা তার জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল।এতটা কঠোর সবিতা।
সবিতা এবার তার সৃষ্টিকর্তাকে বললো আমি কয়েক মিনিটের জন্য আন্নি হতে চাই,আর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে চাই,আমি অনেক বেশি ভালোবাসি তোমাকে সাইফ,কিন্তু তোমার দুর্ব্যবহার, তোমার অবহেলা দিন দিন আমাকে এতো টাই কঠিন বানিয়েছে যে আজ আমি পুরোপুরি সবিতা তে পরিবর্তিত হয়েছি।সবিতা থেকে আর কখনোই আমি আন্নি রুপে ফিরে যেতে চাই না।
—
সবিতা তার নতুন বই লিখতে শুরু করল, যা ছিল তার জীবনের আরেকটি মাইলফলক। বইটির নাম ছিল ‘স্বাধীনতার স্বপ্ন’, যেখানে সে নিজের অভ্যন্তরীণ মুক্তি, সম্পর্কের দুর্বলতা এবং আত্মবিশ্বাসের পুণঃউৎপাদন নিয়ে লিখলো। এটি ছিল তার অভ্যন্তরীণ যাত্রার একটি প্রতিচ্ছবি, যেখানে সে প্রতিটি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে নিজের অবস্থান নির্মাণ করেছিল।
বইটি যখন প্রকাশিত হলো, তখন সেটি খুব দ্রুত সাড়া ফেলল। পাঠকরা বইটির গল্প এবং তাতে থাকা সাহসিকতা ও শক্তি সম্পর্কে অনেক ভালো মতামত দিল। সবিতা বুঝতে পারছিল, তার লেখালেখির মাধ্যমে সে শুধু নিজের কষ্টের কথা বলছে না, বরং অনেক মানুষের আড়ালে থাকা কষ্টের গল্পকেও ফুটিয়ে তুলছে।
___________
এক সন্ধ্যায়, তাওহীদ সবিতার কাছে এসে বলল—
– “সবিতা,তোমার লেখা শুধু মানুষের মন স্পর্শ করে না, তা তাদের অন্তরের গহীনে পৌঁছে যায়। তুমি যদি এই লেখার মাধ্যমে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারো, তাহলে অনেক মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারবে। তোমার বইয়ের ক্লাস শুরু করতে পারো।”
সবিতা কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তার মনে হচ্ছিল, এটা যেন তার জীবনের পরবর্তী ধাপ হতে পারে। কিন্তু সে জানত, এটি সহজ হবে না। লেখক হিসেবে সে নিজের কিছু জ্ঞান শেয়ার করতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটা ঠিক কিভাবে করবে, তা বুঝতে পারছিল না।
– “তাওহীদ, তুমি ঠিক বলেছ, কিন্তু আমি জানি না, কীভাবে শুরু করতে হবে। আমি তো নিজেই শিখছি।”
তাওহীদ হাসি দিয়ে বলল—
– “তুমি তো জানো, যে কোনও যাত্রা প্রথম পদক্ষেপ দিয়ে শুরু হয়। তুমি যা শিখেছ, তা অন্যদের শিখিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তুমি আরও বেশি কিছু অর্জন করতে পারবে।”
এখন সবিতার মনের মধ্যে একটা নতুন স্বপ্ন জেগে উঠেছিল। সে ভাবছিল, কি দারুণ হবে যদি সে তার লেখা বা অভিজ্ঞতা শেয়ার করে অন্যদের সঙ্গে।
______
সবিতা এবার তার পরবর্তী বইটি লেখার পরিকল্পনা করল। এটি ছিল তার জীবনের সংগ্রাম, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার গল্প, এবং সেখান থেকে তার পরবর্তী পথের শুরু। বইটির নাম রাখল ‘অজানা পথে যাত্রা’, যেখানে সবিতা তার অভ্যন্তরীণ যাত্রা, আত্মবিশ্বাসের প্রাপ্তি এবং জীবনের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার গল্প বলেছিল।
এই বইটি অন্য অনেক মানুষের মতামত এবং তাদের জীবনকেও প্রতিফলিত করেছিল।সবিতা বুঝতে পারছিল, লেখালেখির মাধ্যমে সে শুধু নিজের কষ্টের গল্প শেয়ার করছে না, বরং অন্যদেরও জীবনকে আলোকিত করছে।
________
সবিতা জানত, তার জীবনে এখনও অনেক কিছু বাকি রয়েছে। তাকে নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে হবে, নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে। তবে সে জানত, তার ভেতরের শক্তি আর বিশ্বাস তাকে কখনোই পথভ্রষ্ট করবে না। সে যে পথই বেছে নিক, সেটি তার জন্য নতুন অভ্যন্তরীণ শান্তির এবং স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাবে।
সবিতার বইয়ের ক্লাসের প্রথম সেশন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে।সবিতা তার লেখালেখি আর জীবনের গল্পগুলো শেয়ার করার জন্য প্রস্তুত ছিল। সেমিনারের দিন, সে বুঝতে পারছিল, এই মুহূর্তটি তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের শুরু।
সবিতা সেমিনারের রুমে প্রবেশ করল, তার মুখে এক অদ্ভুত শান্তি ছিল। আগে যে সবিতা ভয়ে নিজের লেখা শেয়ার করতে পারেনি, আজ সে সেই লেখাগুলো শত শত মানুষকে উপস্থাপন করতে চলেছে। তাওহীদ তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তাকে সাহস দিতে।
যতক্ষণ ক্লাস চলছিল, সবিতা বুঝতে পারছিল, তার লেখার মাধ্যমে সে শুধু মানুষদের গল্প শোনাচ্ছে না, বরং তাদের অভ্যন্তরীণ যাত্রার একটা অংশ তৈরি করছে। অনেকেই তার গল্প শুনে চোখে জল নিয়ে বলেছিল—
– “আপনার লেখা আমাদের জীবনের বাস্তব চিত্র, আমরা মনে করেছি আমাদের একান্ত বেদনা শুধু আমাদেরই, কিন্তু আপনি দেখালেন, আমরা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত।”
সবিতার চোখে জলের ঝরনা ছিল, কিন্তু সে জানত—এই আবেগগুলো শুধু তার নয়, সবার ছিল। এই বই, এই ক্লাস, যেন তার জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা ছিল।
তাওহীদও তার জীবনের পথে সবিতার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে অনুভব করছিল, সবিতার প্রতি তার শ্রদ্ধা এখন শুধু বন্ধুত্বের দিকে অতিক্রম করেছে না, একটা গভীর সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাওহীদ একদিন সবিতার সঙ্গে বসে বলল—
– সবিতা, আমি তোমাকে দেখে শিখেছি, তুমি শুধু লেখালেখি করে না, তুমি অন্যদের মনোযোগও পরিবর্তন করতে পারো। এই বইয়ের ক্লাস তোমার এক নতুন দিগন্তকে উন্মোচন করেছে। আমি চাই তুমি আরও অনেক মানুষের জীবনে এই পরিবর্তন নিয়ে আসো।”
সবিতা তার হাসি দিয়ে বলল—
– “তাওহীদ, তোমার সহযোগিতা ছাড়া আমি কিছুই করতে পারতাম না। তোমার পাশে থাকার কারণে আমি অনেক কিছু শিখেছি।”
তাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য শক্তিশালী বন্ধন তৈরি হচ্ছিল। তারা একে অপরের মধ্যে অন্য ধরনের শক্তি দেখতে পাচ্ছিল, যেখানে শুধু ভালোবাসা নয়, সম্মান আর শ্রদ্ধাও ছিল।
—
বইয়ের ক্লাসের সফলতা দেখে, সবিতা আরও অনেক নতুন উদ্যোগ নিতে শুরু করল। সে শিখতে চেয়েছিল, সমাজে মানুষের দুর্বলতাগুলো কীভাবে উঠে আসে এবং কীভাবে তাকে শক্তি হিসেবে পরিণত করা যায়। সে নিজের ক্লাসে বিভিন্ন ধরনের সেমিনার আয়োজন করেছিল যেখানে মানুষ নিজেদের গল্প শেয়ার করতে পারতো।
এই ক্লাসগুলো ছিল শুধু তার জীবনের অভিজ্ঞতা বা লেখার পাঠ নয়, বরং এক ধরনের সেশনের মতো যেখানে মানুষ তাদের নিজের ভেতরের শক্তি খুঁজে পেতে পারতো। সবিতা বুঝতে পারছিল, একসময় তার লেখালেখি শুধু কথামালার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, এটি মানুষের বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যাবে।
__
সবিতা যখন তার বইয়ের প্রথম প্রকাশনার আয়োজন করল, তখন তার মনে এক আশ্চর্য রকমের অনুভূতি ছিল। বইটি এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে তার ব্যক্তিগত জীবনের লড়াইগুলোকে একজন অনুপ্রেরণার রূপে পরিণত করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে যখন সে মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজের লেখার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে শুরু করল, তখন তার কণ্ঠে এক ধরনের দৃঢ়তা এবং আবেগের ছোঁয়া ছিল।
– “আমি লিখেছি শুধু আমার গল্প নয়, বরং সেইসব মানুষের গল্প যারা নিঃশব্দে কষ্টে ভুগছে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের জীবনে সবসময় অন্ধকার আসে, কিন্তু সেই অন্ধকারের মাঝে যদি একটু আলো থাকে, তাহলে আমরা জীবনকে অন্যভাবে দেখতে পারি।”
এতটা সময়ে, সবিতা বুঝতে পারছিল, তার বই আর সেমিনার শুধুমাত্র তার নিজের জন্য ছিল না, বরং এটা আরও অনেক মানুষের জন্য ছিল যারা নিজেদের কষ্টের সাথে একাকী ছিল।
_____
সবিতার নতুন লক্ষ্য,
সবিতা বুঝেছিল, তার জীবন শুধু তার নিজের জন্য নয়, আরও অনেক মানুষের জন্য। তাকে তার লেখার মাধ্যমে পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে হবে। সে তার লক্ষ্য ঠিক করে ফেলেছিল—এখন সে শুধু তার অভ্যন্তরীণ শক্তির বিকাশে মনোযোগী হবে না, বরং সে নিজের চিন্তা-ভাবনা দিয়ে সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে।
একদিন, সবিতা তার শখের ঘরে বসে একটি নতুন বইয়ের কাজ শুরু করল, যার নাম ছিল—“জীবনের নতুন দিগন্ত”। এটি ছিল তার সবচেয়ে বড় কাজ, যেখানে সে মানুষের জীবনের ব্যথা, আনন্দ, লড়াই ও জয়কে একত্রিত করেছিল।
সবিতার জীবন এখন এক নতুন দিগন্তে পৌঁছেছে। সেমিনারের সফলতা এবং তার নতুন বই “জীবনের নতুন দিগন্ত”-এর প্রস্তুতির মাঝে সে যেন নিজের ভিতরের শক্তি, অভ্যন্তরীণ শান্তি এবং আত্মবিশ্বাসের নতুন এক স্তরে পৌঁছে গেছে। এখন তার কাছে স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন নয়, বাস্তবতার দিকে ধাবিত হতে শুরু করেছে।
__________
সাইফ, যাকে সবিতা একসময় কেবল এক কাপুরুষ হিসেবে চিনেছিল, এখন সে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনকে দেখতে শিখেছে। সাইফ তার অতীত ভুল বুঝতে পেরে সবিতার সঙ্গে মাঝে মধ্যেই আলাপ করতে আসে।
সাইফের মনোভাবের পরিবর্তন সবিতার জন্য এক ধরনের আশার আলো হয়ে উঠল।
সাইফ, সবিতার প্রতি আগের চেয়ে অনেক বেশি শ্রদ্ধাশীল হয়েছে। একদিন সাইফ সবিতার কাছে গিয়ে বলল—
– “আমি জানি, আমরা একসাথে থাকতে পারি না,আমার ইচ্ছা থাকলেও তুমি আর নিবে না আমাকে,তবে আমি চাই, তোমার পাশে ছায়ার মতো থাকতে। তোমার পথে যা কিছু বাধা আসুক না কেন, এখন থেকে আমি সামলাবো।।”
সবিতা ধীরে ধীরে মাথা নত করে বলল—
– “সাইফ, তুমি যা বলেছ, তার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু এখন আমাকে শুধু নিজের পথে হাঁটতে হবে।”তোমার সাহায্য লাগবে না।
সাইফ তার মুখে এক কঠিন হাসি দিয়ে বলল—
– “আমি জানি, তুমি নিজের পথ খুঁজে পেয়েছ। আমার সাহায্যের তোমার কোনো দরকার নাই।তবুও আমি জোর করেই থাকবো।
কারণ তুমি আমার সেই আলোর রশ্মি, যে কিনা জীবনের অন্ধকারকে উজ্জ্বল করতে পারে।”
তুমি ছাড়া আমার জীবনের অঅন্ধকার কখনোই দূর হবে না।
চলবে_______