সবিতা পর্ব-০৪

0
4

সবিতা
পর্ব:০৪
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

সবিতা এখন এনজিওর শেল্টার হোমেই আছে। রোজ নিজেকে একটু একটু গড়ছে।
দিনে সেলাই শেখে, সন্ধ্যায় কম্পিউটার ক্লাস, রাতে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ।
এক ধরনের ছন্দে চলতে থাকা এই দিনগুলো হঠাৎ বদলে গেল এক বিকেলে।

সেইদিন এনজিওতে আয়োজিত ছিল একটি ওয়ার্কশপ—
“সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা”
ওয়ার্কশপে স্পিকার ছিলেন নওরীন আফরিন, একজন সাইকোলজিস্ট এবং লেখিকা।

ছিমছাম পোশাক, মিষ্টি গলা, আত্মবিশ্বাসী চোখ—
সবিতার মনে হলো, এই প্রথম একজন নারীকে দেখে তার নিজের প্রতি ভরসা বাড়ছে।

নওরীন যখন বলছিলেন—

– “নিজেকে দোষারোপ করো না। যে চলে আসে, সে সাহসী। যে প্রতিবাদ করে, সে বেঁচে থাকার জন্য লড়ে। তুমি যদি নিজেকে ভালোবাসো, তাহলেই তুমি জীবনের কাছে দায়মুক্ত।”

সবিতার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
তার ভিতরের ক্ষতগুলো যেন কারও কথায় সাড়া দিচ্ছে।

ওয়ার্কশপ শেষে সবিতা নওরীনের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। মুখ নিচু করে।

নওরীন হাসেন, বলেন,
– “তোমার চোখ অনেক কিছু বলে। তোমার গল্প শুনতে পারি?”

তাদের কথোপকথন শুরু হয় ধীরে ধীরে।
দিনের পর দিন, সবিতা তার জীবনের প্রতিটা যন্ত্রণার কাহিনি খুলে বলে।
নওরীন শুধু শোনেন না, তাকে জড়িয়েও ধরেন।

একদিন নওরীন বলেন—

– “তুমি চাও, আমি তোমার একটা কেস ফাইল করে রাখি? চাইলে আইনি সহায়তা, থেরাপি ও একটা শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করে দিতে পারি।”

সবিতা চমকে ওঠে।
সে কখনো ভাবেইনি কেউ তার পাশে এভাবে দাঁড়াবে।

কিন্তু ঠিক তখনই—
আবার এক ঝড় উঠে যায়।

একদিন এনজিওর অফিসে আসে দুই পুলিশ ও সবিতার শশুর।

তিনি এসে বলেন—

– “আমাদের বউমা হারিয়ে গেছে। অনেক খুঁজছি। এখন শুনছি এখানে আছে। তাকে নিতে এসেছি।”

নওরিন তখন সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,

– “মেয়েটির নিজের মতামত ও সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করে কেউ তাকে নিতে পারবে না। আপনারা চাইলে আইনগতভাবে দাবি পেশ করুন। তবে এখন ওর সিদ্ধান্ত ওর নিজের।”

সবিতা প্রথমবার এতটা নিরাপদ অনুভব করে।

সেই রাতে সবিতা চুপচাপ নওরীনকে জিজ্ঞেস করে,

– “আপু, আমি লেখাপড়া করতে চাই, নতুন করে সবকিছু শুরু করতে চাই।তাহলে কি বয়স দোষ হয়ে দাঁড়াবে?”

নওরীন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,
– “বয়স নয়, সংকল্পই সব। তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে ভর্তি করিয়ে দেব।”

সবিতার চোখে আশার আলো জ্বলে ওঠে।
এক নতুন যাত্রার শুরু।
নওরীন আপুর উৎসাহে সবিতা ভর্তি হয় একটি বেসরকারি কলেজের অনলাইন প্রোগ্রামে।
পুরো স্কলারশিপে।
সকালে সেলাই, বিকেলে পড়াশোনা, রাতে নিজের ডায়েরির পাতা খুলে বসা—এভাবেই কাটে তার দিনগুলো।

একদিন নওরীন হঠাৎ বলল,
– “তুমি কি জানো, তোমার জীবনের গল্প যদি তুমি নিজেই লেখো, তাহলে সেটাই হয়ে উঠবে অন্য নারীর সাহস?”

সবিতা অবাক হয়ে চেয়ে থাকল।
সে কখনো ভাবেনি তার যন্ত্রণার ভেতরেও কারো পথ দেখানোর আলো লুকিয়ে থাকতে পারে।

সে লিখতে শুরু করে—
প্রথম পাতায় লেখে—

> “আমি ছিলাম কারো ঘরের বউ, অথচ সেই ঘরটা আমার ছিল না কোনোদিন।
আমি এখন কারো স্ত্রী নই, কারো মেয়ে নই—আমি শুধু আমি।”

প্রথমে ছোট ছোট লেখালেখি।
তারপর একটা ব্লগ খুলে ফেলে নওরীনের সহায়তায়।
নাম দেয়: “জীবনযুদ্ধিনী”।

প্রতিদিন হাজার হাজার মেয়ে তার পোস্টে মন্তব্য করে।
অনেকেই লিখে—
“তুমি আমার মতো…”, “তুমি না লিখলে বুঝতাম না আমি একা নই।”

সবিতার ভিতরে এক নতুন শক্তি জন্ম নেয়।
তার কণ্ঠস্বর এখন শুধু তার না, অনেকের কণ্ঠ।

কিন্তু পুরোনো অন্ধকার তো চুপ করে বসে থাকে না।

একদিন, তার ব্লগে একটা কমেন্ট আসে—

“তোমার নাম তো আন্নি।তুমি সাইফের বউ ছিলে না? এত বড় বড় কথা বলার আগে আয়নায় নিজের মুখ দেখে নে।”

সবিতা প্রথমে ভয় পায়।
তারপর লেখে এক জবাব—

> “হ্যাঁ, আপনি সঠিক ধরেছেন,আন্নি সাইফের স্ত্রী। কিন্তু সে আন্নি নিজেকে ভেঙে চুরে সবিতা হিসেবে তৈরি করেছে।সবিতা এখন তার নিজের পরিচয়ে দাঁড়াতে শিখেছে।
সবিতা ভাঙিনি, সবিতা তৈরি হয়েছে।”

এই পোস্ট ভাইরাল হয়ে যায়।
দেশজুড়ে অনেক মিডিয়া তার সাক্ষাৎকার চায়।

নওরীন একদিন বলে,
– “তুমি যদি চাও, আমরা তোমার লেখা দিয়ে একটি বই প্রকাশ করব। তুমি সম্মেলনে যাবে, অন্য নারীদের সামনে কথা বলবে।”

সবিতার চোখ ছলছল করে ওঠে।
সে ছোট করে বলে—
– “আমি পারবো তো?”

নওরীন জবাব দেন,
– “তুমি তো সেই দিনই পেরেছিলে যেদিন ঘর ছেড়ে বেঁচে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে।”

সবিতার বই “জীবনযুদ্ধিনী” প্রকাশের পর সে এক নতুন পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ওঠে।
বিভিন্ন জায়গা থেকে সে সেমিনার, টক শো-তে ডাক পায়।
তাকে “মহিলা ক্ষমতায়ন” বিষয়ক এক সরকারি সেমিনারে বক্তা হিসেবে ডাকা হয়।
মঞ্চে উঠে সে বলে—

> “আমি কাঁদতে কাঁদতে ঘর ছেড়েছিলাম, আজ সেই কান্না দিয়ে পথ গড়েছি।”

হলজুড়ে করতালি।
কেউ একজন বসে আছে শেষ সারিতে—চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে মঞ্চের দিকে।
সে সাইফ।

হ্যাঁ, সে ফিরে এসেছে।

সাইফের মনোভাব বদল, না কি মুখোশ?

সেমিনার শেষে সবিতাকে গেটের বাইরে পায় সাইফ।
একটা চায়ের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে বলে—
– “তুমি এত বড় হয়ে যাবে বুঝি নি কখনো। আমি তো ভাবতেও পারিনি।”

সবিতা জবাব দেয় না।
চোখে একরাশ তীব্র ঠাণ্ডা।

সাইফ বলে—
– “ভুল হয়ে গেছে আমার, আমি তোমাকে বুঝতে পারি নি। তুমি ফিরে আসো না প্লিজ…”

সবিতা হেসে ফেলে।
আর বলে,আমাকে যদি আন্নি ভেবে নিতে আসেন তাহলে আমি যেতে পারবো না,কারণ আন্নি এখন মৃত।
আর যদি সবিতাকে ফেরত নিতে আসেন,
তাকেও নিয়ে যেতে পারবেন না।
কারণ,,,,,
সবিতা থেমে গেলো।
কিন্তু সে একটা চিঠি বের করে সাইফের হাতে দেয়।

চিঠির শিরোনাম—
“যে মেয়েটা একদিন তোমার ছিল, সে আজ মৃত।কিন্তু এখন যাকে দেখছো সে একান্তই নিজের।”

সাইফ পেছনে হাঁটা দেয়।
এই প্রথম সে বুঝতে পারে, ক্ষমতা কাকে বলে।
আর এটাও পরিষ্কার বুঝতে পারে আন্নি আর তার জীবনে কখনোই ফিরবে না।

সবিতার সামনে নতুন পথ

নওরীন আপু বলে—
– “তুমি চাইলে বিদেশে একটা স্কলারশিপের সুযোগ আছে, লেখালেখির ওপর।”

সবিতা চুপ করে থাকে।
তার মনে পড়ে তার মতো হাজার মেয়ের কথা।
সে বলে—

– “আমি থাকব। আমি চাই আমার মতো মেয়েরা যখন ভেঙে পড়বে, তখন আমি তাদের যেনো পাশে দাঁড়াতে পারি। যেমন তুমি আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলে।”

নওরীন গর্বিত চোখে তাকায়।

একদিন…

এক সন্ধ্যায় শেল্টার হোমে আসে এক কিশোরী।
মুখ থেঁতলে গেছে, চোখে ভয়।

সবিতা কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে—
– “তোমার নাম কী?”

মেয়েটি ফিসফিসিয়ে বলে—
– “রাইয়া…”

সবিতা তাকে জড়িয়ে ধরে।
নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সমস্ত ভয়, যন্ত্রণা, অভিমান… সব কিছু মিলিয়ে একটাই কথা বলে—

> “তুমি এখন নিরাপদ, রাইয়া। আজ থেকে তুমিও একজন জীবনযুদ্ধিনী।”

[চলবে…]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে