সবিতা
দ্বিতীয় পর্ব
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ
দিনের আলো আর রাতের অন্ধকার, একে অপরকে অতিক্রম করতে গিয়ে কখনো এক হয়, কখনো দুই।
আন্নির জীবনটা যেন এই দুইয়ের মাঝে ভাসমান।
একটা সময় ছিল, যখন সাইফের প্রতি তার বিশ্বাস ছিল আকাশের মতো বড়—প্রেমে ছিল অটুট। কিন্তু এখন সে বিশ্বাস, সেই ভালোবাসা—সবই যেন একে একে সরে গেছে।
দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আন্নির জীবনে যেন কোনো পরিবর্তন নেই। এক এক করে সময় পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু জীবনযাত্রার শীতলতা যেন কোনোভাবেই দূর হয় না। দিনের আলোও তার জন্য এখন আর আগের মতো উজ্জ্বল নয়, তার চারপাশে সব কিছু যেন ধূসর হয়ে গেছে। এক সময় সাইফের সাথে প্রতিটি দিন নতুন অনুভূতি নিয়ে আসতো, এখন তার মনে হয়, দিনগুলো একইরকম—শুধু সময় কাটছে, কিছুই পরিবর্তন হচ্ছে না।
আজ আবার এক নতুন সমস্যা সৃষ্টি হলো।আবার নতুন একটি ঘটনা আন্নির মনকে আরো ভেঙে ফেলল।
তার বান্ধবী, রহিমা, ফোন করে জানালো,
— “তুই জানিস, সাইফ কি করছে? আজ বাইকের পেছনে এক মেয়ে নিয়ে ঘুরছিল। তুই কী করে এসব সহ্য করছিস? তুই তো জানিস, সাইফের আচরণ কেমন ছিল বিয়ের আগে। কিন্তু এখন তো তার কিছুই ঠিক নেই!”
আন্নি ফোনের স্ক্রীনে একমুঠো স্থির হয়ে যায়।
তার হাত কাঁপছিল, ফোনটা এতটাই শক্ত করে ধরেছিল যে, মনে হচ্ছিল সারা পৃথিবী তার হাত থেকে ছড়িয়ে পড়বে। সে কী বলবে? কীভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করবে? সাইফের সঙ্গে তার সম্পর্ক তো অনেক আগেই ভেঙে গেছে, কিন্তু কোথাও ভেতরে একটা ভয় ছিল—শুধু তার নিজের দুঃখ গোপন করার চেষ্টা।
সে জানতো, সাইফ এখন আর আগের মতো নেই।
যতটুকু ভালোবাসা ছিল, ততটুকু আর নেই।
বিয়ের আগে সাইফ যেমন তাকে উষ্ণ ভালোবাসায় ঘিরে রাখতো, এখন সে পুরোপুরি বদলে গেছে। সে যেন একটা অচেনা মানুষ হয়ে গেছে, যার পাশে আর আন্নি থাকতে পারে না।
হঠাৎ ফোনটা হাত থেকে পড়ে যায়।
মনে হয় যেন পৃথিবীটা মাথার উপর ঘুরতে থাকে।
কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই সে।
কী বলবে? কী করে নিজেকে বোঝাবে যে, সাইফের এমন আচরণ তার কাছে নতুন নয়।
আন্নির নিজের পরিস্থিতি এমন হয়েছে, যে সে নিজেও জানে না, কেন সে এখনও সাইফের সঙ্গে রয়ে গেছে।
সে কি সত্যিই তার সঙ্গে ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক রাখতে চায়? না কি সে শুধুমাত্র অভ্যাসের জায়গায় আটকে গেছে?
আজকাল আন্নি মনে করে, সাইফের কাছে সে শুধুই একটা কুকুরের মতো, যার দায়িত্ব শুধু রান্নাঘরে কাজ করা, কাপড় কাচা, আর বাড়ির সব কিছু দেখতে থাকা।
সাইফ তার প্রিয় মানুষ ছিল—এটা সত্য, কিন্তু আজকের সাইফ তাকে আর আগের মতো প্রিয় নয়। সেই ভালোবাসা কেমন যেন মুছে গেছে।
এখন আন্নি বুঝতে পারছে—সাইফের সঙ্গে তার সম্পর্কটা যেন এক গহীন সাদাকালো অন্ধকারের মধ্যে চলে গেছে।
তখন ভালোবাসা ছিল, এখন শুধু নিঃসঙ্গতা, বিষণ্নতা আর হতাশা।
এখন সাইফের মনেও আর কোনো জায়গা নেই আন্নির জন্য।
এটা যেন জীবনের এক কঠিন রিয়েলিটি, যে এক সময় তাকে ভালোবাসত, সে আজ আর তাকে খেয়ালও করে না।
তার কেবল কানে একটা শব্দই বাজছে—“তুই থাকলে থাক, না থাকলে চলে যা।”
এখন আর আন্নির কোনো স্বপ্ন নেই, শুধু একটাই চিন্তা—কীভাবে একদিন এই জগৎ থেকে পালাবে?
তবে পালাবে কোথায়? সে জানে না।
কিন্তু প্রতিদিন, প্রতিটি দিন, সাইফের এই নিষ্ঠুরতায় এক একটা গহীন ক্ষত সৃষ্টি হয় তার হৃদয়ে।
……………
গভীর রাত,নিস্তব্ধ চারপাশ,ঘড়ির কাঁটা যখন একটাকে ছুঁয়েছে, তখনও আন্নি দরজার দিকে তাকিয়ে বসে আছে।চোখে ঘুম নেই, মনে শুধু অপেক্ষা—সাইফ কখন ফিরবে।
রাত প্রায় দুটো— কেবল দরজার খচখচ শব্দে তার অপেক্ষা ভাঙে।
অবশেষে দরজা খুলে যায়। সাইফ, নির্বিকার মুখে, একটাও কথা না বলে ঘরে ঢুকে, জুতা খুলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
আজ রাতেও সাইফ ফিরলো অনেক দেরিতে। আজকেও দরজা খুলে ঢুকেই যেন সমস্ত দুনিয়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলো সে। একটাও কথা নয়, একটাও দৃষ্টি নয়—শুধু বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। আন্নি পাশে বসে ছিল নীরবে, ঠিক আগের রাতগুলোর মতো। একটা সময় সে আর অপেক্ষা করে না—কারণ সে জানে, এখন তার পাশে বসা একজন স্বামী নয়, একজন অভিমানহীন অপরিচিত পুরুষ।
আন্নি তাকিয়ে ভাবে, মনে হয় এক অপারিচিত মানুষ পাশে ঘুমিয়ে আছে। অথচ একসময় এই মানুষটাই তো তার চোখে ছিলো জীবন, স্বপ্ন, ভালোবাসা।
মনে প্রশ্ন জাগে বার বার—সে কি একদিন
ভালোবেসেছিল এই মানুষটিকে?
………..……
ভোর হতেই যেন যুদ্ধের মাঠে নামে আন্নি। রান্নাঘরের ভেতর গনগনে আগুন আর তাড়াহুড়ার শব্দ। শ্বশুরের সরকারি অফিস, সাইফের কলেজ—সবার সময়মতো খাওয়া চাই।
আজকের সকালটা যেনো আরও বিশৃঙ্খল। ঘড়ির কাঁটায় যেন আগুন ধরে গেছে। শ্বশুর সময়মতো অফিসে যাবেন, সাইফেরও কলেজ আছে। আন্নি তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে ছুটে যায়—সবজির ভাজি, ডাল, আর ভাতের আয়োজন। রাইস কুকার হঠাৎ কারেন্ট চলে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে গ্যাসে বসায় ভাতের হাঁড়ি।
এমন সময় শাশুড়ির ডাক—
“আন্নি, একটু আয় তো রে।”
আন্নি কাঁটা চামচ ফেলে, আঁচলে হাত মুছে দৌড়ে যায় শাশুড়ির রুমে।
কোনো দ্বিধা না করেই সে ছোটে। অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে তার এই ছুটে চলা। সংসার যেন এক বিশাল নাট্যমঞ্চ, আর সে সেখানে নেপথ্যের শিল্পী।
শাশুড়ি হয়তো গলার হারটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না,ভেতরে হয়তো শাড়ির ভাঁজ ঠিক করতে বলবে,কিংবা আলমারিতে কিছু খোঁজার দরকার হয়েছিল
কিন্তু রান্নাঘরে তখনও জ্বলছে গ্যাসের আগুন আর তার উপর চাপা পাত্রে ভাত।
মুহূর্তের মধ্যে পোড়া গন্ধে ভরে যায় পুরো বাড়ি।
শ্বশুর দরজা ঠেলে বের হয়ে এসে গম্ভীর গলায় বলেন,
“ঘরে আগুন লাগছে নাকি?”
আন্নির বুকের মধ্যে কেঁপে ওঠে একটা আশঙ্কার ঢেউ।
ছুটে যায় সে রান্নাঘরে।
কালো ধোঁয়ায় ভরে গেছে চারপাশ।
হাঁড়ির নিচে জ্বলে যাওয়া ভাত, আর তার ওপরে জমে থাকা পোড়া ধোঁয়া যেন আন্নির ভিতরকার কষ্টকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে।
চুলার সামনে দাঁড়িয়ে তার গলা শুকিয়ে যায়।
ঠিক তখনই সাইফ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
চোখ জ্বলে তার, মুখে ঘৃণা— গর্জন করে বলে—
“তুই সারাদিন করিস টা কী রে? ঘরে খালি শুয়ে বসে থাকিস,শুয়ে বসে খাস!”
একবেলার ভাত ঠিকঠাক রান্ধতে পারিস না?
এই বলে তার চুলের মুঠি ধরে এমন টান দেয়, যেন সে কোনো প্রিয়জন নয়, একেবারে ঘৃণার পাত্র।যেন সে তার স্ত্রী নয়, এক অপরাধী।
দুইটা চড় গালে এসে পড়ে সশব্দে।
আন্নির কান ঝিম ঝিম করে ওঠে। মাথার ভেতর যেন একটা সাইরেন বাজে—না, এটা তার ভালোবাসা হতে পারে না, এ ছেলে তো তার স্বপ্নের মানুষ ছিল না!
জ্বালা লাগে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি জ্বলে ওঠে আত্মসম্মান।
ঘরটা কেঁপে ওঠে, কিন্তু কারও মুখে প্রতিবাদের শব্দ নেই।
শ্বশুর-শাশুড়ি দাঁড়িয়ে থাকেন নির্লিপ্ত, নীরবে। যেন কিছুই দেখেননি, যেন কিছুই ঘটেনি।
একবারও কেউ বলে না, “সাইফ, এটা কি করছো?”
যেন কিছুই হয়নি।কারও মুখে কোনো প্রতিবাদ নেই, কেউ সাইফকে থামায় না। যেন আন্নির প্রতি এই আচরণই স্বাভাবিক, যেন এটা তার প্রাপ্য।
হ্যাঁ ঠিকই তো,
এটাই তো এই ঘরের নিয়ম—স্বামীর হাতে স্ত্রীর অপমান, আর চারপাশের মৌন সমর্থন।
আন্নির চোখে জল আসে না।
দীর্ঘ সময়ের গুমোট যন্ত্রণায় কান্নাগুলো হারিয়ে গেছে কোথাও।
ভেতরে কেবল একটা প্রশ্ন গুমরে ওঠে—
“এই মানুষটার হাত ধরেই তো আমি পালিয়ে এসেছিলাম। এই ছিল তার ভালোবাসা?”
আন্নির বুকের ভেতর যেন কিছু একটা ধ্বসে পড়ে। সে শুধু ভাবতে থাকে—
“এই কি সেই সাইফ, যে একদিন বলেছিল, ‘তোর জন্য সব ছেড়ে দিব’? এই কি সেই সংসার, যার জন্য আমি বাবা-মাকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম?”
তার ভেতরে জমে ওঠা শূন্যতা আজ যেন আরও ভারি হয়ে আসে।
সে জানে, ভালোবাসা পুড়ে গেছে আজকের ভাতের মতোই—নরম, নিরীহ, অথচ অবহেলার আগুনে অচেনা এক অন্ধকারে রূপান্তরিত।
ভাতের হাঁড়ির মতো পুড়ে যাচ্ছে তার সব স্বপ্ন। প্রেম, ভালোবাসা, বিশ্বাস—
একসময় সাইফ বলেছিল,
“তুই আমার জীবন, আন্নি।”
আজ সাইফ যেন বলে—
“তুই শুধু দায়িত্ব।”
একসময় সাইফ বলেছিল,
“তুই ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না, আন্নি।”
আর আজ সাইফ যেন বলে—
“তুই থাকলে থাক,না থাকলে না থাক।”
অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয় আন্নি।
“এই ঘর না থাক, আমার নিজের মান থাকুক।”
কোনো ব্যাগ নেয় না, কোনো টাকা নয়, এমনকি পরনের ওড়নাটাও ঠিকঠাক টেনে নেয়নি সে।
চোখে ছিল কেবল জেদ, আর বুকভরা দুঃখ।
চুপচাপ বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়—
এই শহরের ব্যস্ততা আর আলো-ছায়ার ফাঁকে হারিয়ে যেতে চায় এক নারীর না বলা গল্প।
চলবে………