আমি পিঙ্কির হাসপাতালের সামনে পায়চারী করছি। কোনায় একটা চা দোকান আছে; কিছুক্ষন পর পর সেখানে গিয়ে চা, সিগারেট খাচ্ছি। পিঙ্কি এখনো বের হয়নি। পিঙ্কি আমার স্ত্রী। আমি ওকে সন্দেহ করি। আমার শুধু মনে হয় পিঙ্কি হয়তো কাউকে পছন্দ করে। পিঙ্কি এখনো আমাকে পছন্দ করে অথবা ভালোবাসে এই কথাটা আমার বিশ্বাস হয় না। পিঙ্কি আমার থেকে অনেক বেশী সফল। ও এফসিপিএস পাশ করা, এমডি পাশ করা বেশ বড় ডাক্তার। এসোসিয়েট প্রফেসর। অনেক টাকা বেতন পায়, ভালো প্র্যাকটিস করে। চেম্বারে রোগীদের ভিড়। আমাদের যখন বিয়ে হয় তখন পিঙ্কি সদ্য এমবিবিএস পাশ করা একটা মেয়ে; যে পড়তে অনেক ভালোবাসতো। আর আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে সদ্য চাকরীতে ঢুকেছি। অনেকেই সেই সময় অবাক হতো; বলতো আসিফ এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করছো কেন; জীবনতো মাত্র শুরু। আরো কিছু ডিগ্রী নাও, কিছু চাকরী পরিবর্তন করো, আরো বড় পোস্টে উঠ, তারপরে বিয়ে। কিন্তু পিঙ্কির পরিবার আর দেরী করতে রাজি নয়। এমনিতেই তাদের ইচ্ছে ছিল একটা ডাক্তার ছেলের কাছে মেয়ের বিয়ে দিবে তাই তারা আরো তাড়াহুড়া করছিল যেন আমি সবকিছু ম্যানেজ করতে না পারি। কিন্তু দুর্মুখদের মুখে চুনকালি মেখে আমি পিঙ্কিকে বিয়ে করে আলাদা বাসায় উঠি। প্রথম দিকে আমাদের জীবনটা বেশ অন্যরকম ছিল। টাকা পয়সা ছিল না। আমরা কোনমতে সংসার চালাতাম। আমি সুযোগ পেলেই পিঙ্কিকে সাহায্য করতাম। পিঙ্কি মাঝে মাঝে হাপিয়ে উঠতো; একদিকে পড়াশুনা, সংসার কত কিছু ওকে সামলাতে হতো। এর মাঝে আমানের জন্ম। আমাদের একমাত্র ছেলে। ওর দেখাশুনা করা। আমি কখনো ভাবিনি এত কিছু সামলে পিঙ্কি ঠিক এফসিপিএস পাশ করবে অথবা এমডি পাশ করতে পারবে। কিন্তু পিঙ্কি কিভাবে জানি সব ম্যানেজ করে নিতো। কি সুন্দর দিন ছিল। আমার এখন ভাবতে খুব ভালো লাগে। আমাদের অর্থ বিত্ত ছিল না; আমি আর পিঙ্কি রাতে ছাঁদে গিয়ে চাঁদ দেখতাম। এটাই ছিল আমাদের বিলাসিতা। পিঙ্কি গুণগুণ করে গান গাইতো। আমি পিঙ্কির কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতাম। ব্যাপারটা আসলে অতটা সিনেম্যাটিক ছিল না। কেননা তখন প্রায় কারেন্ট থাকতো না; আমরা একটু বাতাস খাওয়ার জন্য ছাঁদে গিয়ে বসতাম। মশা কামড় দিতো। ভয় ভয় লাগতো। মাঝে মাঝে পিঙ্কি খুব আফসোস করতো ইশ আমাদের যদি টাকা থাকতো; আমরা যদি কোন ভালো এলাকায় থাকতে পারতাম। যেখান থেকে খুব সুন্দর আকাশ দেখা যাবে। এত লোডশেডিং থাকবে না; কানের কাছে সারাক্ষণ মশা গান গাইবে না। এলাকাটা ভালো হবে; একটুও ভয় লাগবে না। এখন আমরা বারিধারা ডিওইচস থাকি। বেশ পরিচ্ছন্ন এলাকা। আমাদের বাসাটাও একদম লেকের পাশে, নিরাপদ এলাকা; বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় আমি অনেক আমতা আমতা করছিলাম এতগুলো টাকা ভাড়া। পিঙ্কি অনেকটা জোর করেই বাসাটা ভাড়া নেয়।ও নিজেই ভাড়া দেয়। পিঙ্কি অনেক ব্যস্ত থাকে। এই হাসপাতাল; এর পরে চেম্বার; এর পরে অপারেশন থাকে কোথাও কোথাও। এখন আর আমাদের চাঁদ দেখা হয় না। বাতাসের গন্ধ নেয়া হয় না। সেই পুরানো দিনগুলোকে খুব মিস করি। মনে হয় ইশ কত না মধুর দিন ছিলো।
পিঙ্কিকে সন্দেহ করার কোন কারন আমার কাছে নেই। কিন্তু আমার শুধু মনে হয় আমার মত একজন ব্যর্থ মানুষকে পিঙ্কি কেন ভালবাসবে। পিঙ্কি একটুও বুড়ো হয়নি। বরং তার চেহারায় জেল্লা বেড়েছে। বেশ চকচক করে। খুব সুন্দর ড্রেস আপ করে; সবসময় খুব ফিটফাট। দেখলে আনায়সে ৩০ বচ্ছর বয়স বলে চালিয়ে দেয়া যাবে। অন্যদিকে আমার বয়স বেড়ে গেছে। চেহারায় বুড়ো বুড়ো ভাব। ভুঁড়ি হয়েছে। আমি যে সেই চাকরীতে ঢুকেছি এই ১৫ বচ্ছরে আমার তেমন একটা উন্নতি হয়নি। এখন আমি কোম্পানির জি এম হয়েছি। খুব ভারিক্কী টাইপের পোস্ট। কিন্তু আমার মাঝে মাঝে হাসি পায়। এই ১৫ বচ্ছরে দেশের মূল্যস্ফীতি যেভাবে বেড়েছে সেই ভাবে বেতন বাড়ে নি। কোম্পানির মালিক এই ব্যাপারে উদাসীন। আমারও কেমন জানি শিকড় গজিয়েছে। অন্য কোথাও যেতে ভয় লাগে। মনে হয় আমি কি পারবো। তবে একটা ব্যাপার ভালো কোম্পানির এমডি আমাকে তেমন কিছু বলে না। এই যে এক সপ্তাহ ধরে আমি অফিস থেকে আগে আগে বের হয়ে পিঙ্কির হাসপাতালের সামনে দাড়িয়ে থাকি এটা নিয়ে আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করার নেই।
পিঙ্কি প্রতিদিন রাহাতের সাথে বের হয়। রাহাত পিঙ্কির খুব কাছের একজন কলিগ। রাহাত তার বউকে নিয়ে আমাদের বাসায়ও বেশ কয়েকবার এসেছে। তার বউটা একটু চুপচাপ টাইপের। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমি মাঝে মাঝে জোকস বলে হাসানোর চেষ্টা করে দেখেছি। মেয়েটা একদম হাসে না। অন্যদিকে রাহাত একদম ব্যাতিক্রম। সারাক্ষান আড্ডা, হাসাহাসি, পুরো আসর জমিয়ে রাখে। আমি ভাবি ওরা যখন একসাথে থাকে তখন কিভাবে সময় কাটায়।
আজকেও পিঙ্কি রাহাতের সাথে বের হয়। রাহাত কি জানি বলছে পিঙ্কি হেসেই যাচ্ছে। তারা কিছুক্ষন দাড়িয়ে কথা বলে, রাহাত পিঙ্কিকে সিএনজি ঠিক করে দেয়, পিঙ্কি আমার সামনে দিয়ে চলে যায়। রাহাতও হোন্ডা নিয়ে চলে যায়। আমি আড়াল থেকে ওদের লক্ষ্য করছিলাম। আমি ভাবি পিঙ্কির সাথে কি রাহাতের কিছু চলছে। রাহাত যুবক ছেলে, সুদর্শন, লম্বা; ডাক্তার, কথায় রস কষ আছে। বেশ উদারমনা। নিজে হোন্ডা চালায়। পিঙ্কির নিশ্চয় ভালো লাগে। অন্যদিকে রাহাতের বউ একদম কথা বলে না; রাহাতেরও একজন মানুষ লাগে যার সাথে কথা বলা যায়; যতই চিন্তা করছি ততই বিশ্বাস আরো দৃঢ় হচ্ছে নিশ্চিতভাবে পিঙ্কির সাথে রাহাতের কিছু একটা আছে।
আমি একটু উদভ্রান্তের মত হাঁটতে থাকি। পার্কে ঢুকে বসে থাকি। তখন সন্ধ্যা। পার্ক খালি হচ্ছে। আমি জানি জায়গাটা নিরাপদ না। কিন্তু আজকে কেন জানি রিস্ক নিতে ইচ্ছে করছে। এই জীবন রেখে কি হবে। ব্যর্থতা আমাকে গ্রাস করে।
একটা মেয়ে আমার পাশে ঘুরাফেরা করছে। এই সময়ে পার্কে পতিতাদের উৎপাত শুরু হয়। অন্য সময় হলে খুব বিরক্ত হতাম। আজকে হচ্ছি না।
মেয়েটা কাছে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে বসুম তোমার সাথে।
আমি তাকাই। একটা মেয়ে ২০-২২ বচ্ছর বয়স হবে। মুখে সস্তা মেকাপ; মেয়েটা আমার পাশে বসে।
আমি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি।
কি নাগর তাকাও না কেন? মন খারাপ তোমার। আমি কিন্তু জানি মন ভালো করতে হয় কেমনে।
তুমি কখনো কাউকে ভালবাসছ?
মেয়েটা খিলখিল করে হাসতে থাকে; নাগর কয় কি? আমিতো প্রতিদিন ভালোবাসি প্রতিদিন ধোঁকা খাই।
কোনদিন সত্যিকারের প্রেম হয়েছিল?
হুম হয়েছিল। সেইতো আইনা এইখানে বেইচা দিলো। তার জন্যইতো আজকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। আবার মেয়েটা হাসতে থাকে।
মনের খারাপ ভাবটা কাটতে থাকে। আসলেইতো কিছুক্ষন আগেও মনে হচ্ছিল আমি মনে হয় পৃথিবীর সবচাইতে দুঃখী ব্যাক্তি। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষই কোন না কোন দিক থেকে দুঃখী। তবুও মানুষ সুখ খুঁজে বেড়ায় বেঁচে থাকার জন্য। আমি উঠে পড়ি হাঁটতে থাকি। বাসায় যাবো।
মেয়েটা পেছন থেকে ডাকতে থাকে আরে নাগর দেখি চলে যায়। এত কষ্ট নিয়ে কেন চলে যাও। আসো তোমার কষ্ট দূর করে দেই। আমি কষ্ট দূরের ম্যাজিক জানি।
বাসার সামনে এসে সিগারেট ধরাই। আমি জানি পিঙ্কি এখন বাসায় নেই। ও হয় চেম্বারে নাহয় কোন অপারেশন করতে গেছে। কিছুক্ষন আগে পিঙ্কি ফোন করেছিল বলেছে তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে।
কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দেয়। ড্রয়িং রুম অন্ধকার।
কিরে ড্রয়িং রুমে লাইট জ্বালাতে পারলি না।
ড্রয়িং রুমে লাইট জ্বলে উঠে। দেখি আমার আর পিঙ্কির কিছু বন্ধু বান্ধব। সবাই মিলে সমস্বরে বলছে
শুভ জন্মদিন। পিঙ্কির সামনে একটা কেক। পাশে আমান দাড়িয়ে আছে। আমি হতবাক হয়ে যাই। এত জিদে ভুলেই গিয়েছিলাম আজকে আমার জন্মদিন।
পিঙ্কি আমাকে ডাকতে থাকে;
সেই কখন থেকে আমরা সবাই তোমার জন্য বসে আছি। আসো কেক কাটো। শুভ জন্মদিন আসিফ। আমি যন্ত্রমানবের মত সামনে যাই কেক কাঁটি। সবাই চারপাশ থেকে চিৎকার করছে শুভ জন্মদিন। একটা বন্ধু টিপ্পনী কাটছে আসিফ তুই অনেক লাকি। আমার ঘোরের মত লাগে। একসময় একে একে সবাই চলে যায়। আমি আমানকে ঘুম পাড়িয়ে আসি।
পিঙ্কি আমাকে জিজ্ঞেস করে এই তোমার গিফট দেখেছো।
না।
উপরে তাকাও।
দেখি সেখানে আমার আর পিঙ্কির অনেকগুলো ছবি ফ্রেমে বাঁধানো। আমাদের বিয়ের ছবি আছে, প্রথম কক্সবাজারে যাওয়ার ছবি আছে। আমানের প্রথম দিনের ছবি। আহ কত স্মৃতি।
হটাত আমি জিজ্ঞেস করি পিঙ্কি তুমি কি এখনো আমাকে ভালোবাসো?
পিঙ্কি আমার প্রশ্নে একটু অবাক হয়।
হুম।
তোমার মনে হয় না আমি তোমার যোগ্য না; তুমি এখন কত বড় ডাক্তার, কত সফল তুমি।
পিঙ্কি আবার অবাক চোখে আমার দিকে তাকায়।
কি বলছ আসিফ। আমি কি সেই সব দিনের কথা ভুলতে পারি। আসিফ আমি আজকে যেই অবস্থানে এসেছি তার কৃতিত্ব আমার যতটা ঠিক ততটাই তোমার। তুমি আমাকে পড়াশুনা করতে উৎসাহ দিতে। কয়টা জামাই দেয়। কতদিন তুমি বাসায় তাড়াতাড়ি চলে এসেছ শুধুমাত্র আমানকে রাখার জন্য যেন আমার পড়াশুনায় কোন ডিস্টার্ব না হয়। কতদিন তুমি আমাকে খাইয়ে দিয়েছ। আমি যখন রাতে পড়াশুনা করতাম কতদিন তুমি জেগে থাকতে গভীর রাত পর্যন্ত যেন আমার ভয় না লাগে। কতবার তুমি নতুন জামা নাও নি শুধুমাত্র আমার এবং আমানের জন্য। কতদিন তুমি হেঁটে হেঁটে অফিসে গেছো যেন আমি সিএনজি করে হাসপাতালে যেতে পারি। তুমি কখনো চাকরী চেঞ্জ করতে না; কত ভালো ভালো অফার তুমি পেয়েছ। তোমার ভয় লাগতো যদি চেঞ্জ করতে গিয়ে কোন সমস্যা হয় তাহলে সংসার চলবে কিভাবে; আমার পড়াশুনা, আমানের খরচ; আসিফ যখন থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসি আজ তার থেকেও বেশী ভালোবাসি। অনেক বেশী ভালোবাসি।
আমি যে ব্যর্থ জীবনে;
কে বলেছে তুমি ব্যর্থ। আমার চোখে তুমি পৃথিবীর সবচাইতে সুদর্শন, সবচাইতে সফল এবং সবচাইতে ভালো মানুষটি যে তুমি।
আমি আমাদের ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি; চোখটা কেমন জানি ঝাপসা হয়ে আসছে।
#আমিনুলের গল্প সমগ্র।