সন্দেহের কাঁটা পর্ব-০৪

0
2

#সন্দেহের_কাঁটা।
পর্ব:- চার।
লেখা:- সিহাব হোসেন

শ্রেয়ার ভেতরের জেদটা মনের মধ্যে যখন চেপে বসল, তখন থেকেই খেলার নিয়ম বদলে গেল। এরপর থেকে তৌফিক যখনই বাসায় আসত, শ্রেয়া আর নিজেকে লুকিয়ে রাখত না। সে পরিপাটি হয়ে সেজেগুজে তার সামনে যেত, হাসিমুখে গল্প করত। শ্রেয়ার এই পরিবর্তনে রাহুল কিছুটা খুশি হলেও তার মনের গভীরে সন্দেহের কালো মেঘ আরও ঘনীভূত হতে লাগল। শ্রেয়ার এই অতিরিক্ত সাজসজ্জা, এই অস্বাভাবিক সাবলীলতা, কোনোটাই রাহুলের কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না।
একদিন তৌফিক চলে যাওয়ার পর রাহুল আর থাকতে না পেরে শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করল,
– “তুমি হঠাৎ ওর সাথে এমন ফ্রি হয়ে গেলে কেন?”
– “তুমি তো এটাই চাইতে, তাই না?” শ্রেয়ার উত্তরে বিদ্রূপ ছিল।
– “কিন্তু তার মানে এই না যে তুমি তার সামনে এত সেজেগুজে থাকবে!”
– “সেটা আমার ব্যাপার। তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করবে না। মানসিকভাবে তুমি আমাকে অনেক যন্ত্র*ণা দিয়েছো। এখন আবার নতুন করে রা*গ দেখাচ্ছ কেন?”
– “দেখো শ্রেয়া, তুমি বোঝার চেষ্টা করো…!”
– “আমার যা বোঝার, তা বোঝা হয়ে গেছে। এর চেয়ে বেশি কিছু বললে আমি সোজা বাবার বাড়ি চলে যাব।”

রাহুল ভয়ে চুপ হয়ে গেল। এরপর থেকে শ্রেয়ার আচরণ পুরোপুরি বদলে গেল। সে সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকত, রাহুলের দিকে ফিরেও তাকাত না। তার এই অবহেলা রাহুলের সন্দেহকে আরও উসকে দিল।

অন্যদিকে, শ্রেয়ার এই মেকি ঘ*নিষ্ঠতায় তৌফিকের ভেতরের প*শুটা জেগে উঠল। সে দিনরাত অনলাইনে শ্রেয়ার সাথে কথা বলতে শুরু করল।
– “ভাবি, আমি যদি তোমাকে বউ হিসেবে পেতাম, তাহলে খুব খুব ভালোবাসতাম। তোমার কোনো কথার অবাধ্য হতাম না। যা বলতে, তাই শুনতাম।”
– “ও আচ্ছা।”
– “রাহুল তো সারাক্ষণ কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বাসায় এত সুন্দর একজন বউ রেখে ও কীভাবে কাজ করে, আমি বুঝি না। আমি হলে তো একটু পরপর বাসায় চলে আসতাম।”
– “বাহ! খুব ভালো তো।”
– “আমি জানি, একা থাকতে আপনার খুব কষ্ট হয়। কথা বলার মতো একজন মানুষ থাকলে সারাদিনটা সুন্দরভাবে কেটে যায়।”
– “হয়তো।”

তৌফিক কারণ ছাড়াই, রাহুল না থাকাকালীন সময়েও, বাসায় আসার চেষ্টা করত। কিন্তু শ্রেয়া তাকে কৌশলে বারণ করত,
– “রাহুল না থাকলে এসো না। আশপাশের মানুষ সন্দেহ করতে পারে।”
– “হুম, ঠিক। তাহলে চলুন না, আমরা দুজন একদিন ঘুরতে যাই?”

শ্রেয়া চুপ করে থাকত। দিনের পর দিন তাদের কথা চলতে লাগল। তৌফিক তাকে নানা রকম দামী উপহারের প্রলোভন দেখাত, কিন্তু শ্রেয়া সেসব গায়ে মাখত না। সে শুধু তার আসল রূপটা দেখার অপেক্ষায় ছিল।
শ্রেয়া তার এই অভিনয়ের প্রতিটি পদক্ষেপ তার বান্ধবী রুহিকে জানাত। সব শুনে রুহি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– “তুই যেটা করছিস, এটা ঠিক হচ্ছে না। আমি মানছি, তুই তৌফিকের আসল চরিত্রটা বের করার জন্য অভিনয় করছিস, কিন্তু এমন যেন না হয় যে, শেষ পর্যন্ত ওর কথার জালে ফেঁসে গিয়ে তুই নিজেই দুর্বল হয়ে পড়লি।”
– “এমন কখনোই হবে না।”
– “আচ্ছা, হবে না বুঝলাম। কিন্তু তাই বলে তুই নিজেকে এভাবে পুরোপুরি বদলে ফেললি, এটাও তো ঠিক হলো না।”
– “রাহুলকে কত বলেছি ওকে বাসায় এনো না, আমার অস্বস্তি হয়। কিন্তু ও আমার কথা শোনেনি, উল্টো আমাকেই সন্দেহ করেছে।”
– “আমার তো মনে হয়, তোর এই পরিবর্তনে সে এখন তোকে আরও বেশি সন্দেহ করছে। আর সন্দেহ করাটাই স্বাভাবিক।”
– “আমি তো এটাই চাই।”
– “তবে এমন কিছু করিস না, যাতে শেষে অনেক বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যায়। যাইহোক, তৌফিকের একটা ছবি দেখা তো আমাকে।”

শ্রেয়া ফোন বের করে তৌফিকের ছবি দেখাল। ছবিটা দেখামাত্র রুহির চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। সে বিস্ময়ে আর ঘৃ*ণায় বলে উঠল,
– “এই হা*রা*মিটা?”
– “কেন, তুই চিনিস ওকে?”
– “চিনব না মানে! এই হা*রামিটাই তো একটা বিধবা মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিয়েছে। ওর কারণেই মেয়েটা আজ সমাজ, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। নিজের সন্তানের দায় পর্যন্ত স্বীকার করছে না ও!”
– “কী বলিস এসব!”
– “হ্যাঁ, এটাই সত্যি।”
– “তাহলে মেয়েটা তার সন্তানের দাবি নিয়ে ওর পরিবারের কাছে গিয়ে সব বলছে না কেন?”
– “কীভাবে বলবে? ওর পাশে দাঁড়ানোর মতো তো কেউ নেই।”

সব শুনে শ্রেয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার মাথায় তখন নতুন এক পরিকল্পনা ঘুরছে। সে রুহিকে বলল,
– “আচ্ছা, তুই কি আমাকে ওই মেয়েটার সাথে একবার দেখা করিয়ে দিতে পারবি?”
– “হ্যাঁ, অবশ্যই পারব। কিন্তু ওর সাথে দেখা করে কী করবি?”
– “যদি এমন কিছু করা যায়, যাতে মেয়েটার সাথে তৌফিকের বিয়ে হয়?”
– “কিন্তু কীভাবে?”
– “সবটা আমাকে প্ল্যান করতে দে। তুই শুধু ওর সাথে আমার দেখা করার ব্যবস্থা করে দে।”

রুহি শ্রেয়াকে সেই মেয়েটির কাছে নিয়ে গেল। তার নাম নাসিমা, বয়সে তৌফিকের চেয়ে তিন-চার বছরের বড়। তার কাছ থেকে সবটা শুনে শ্রেয়া আর রুহি বেরিয়ে এল। শ্রেয়া বলল,
– “কত বড় হারামি হলে একজন মানুষ বয়সে বড় একজন মহিলার সাথেও এমন করতে পারে!”
– “আর রাহুল ভাইয়ের আক্কেল দেখ! শিয়ালের কাছে নিজের বাড়ির মুরগি ইচ্ছে করে পাহারা দিতে রেখেছে!”
– “একবার শুধু তৌফিকের মুখোশটা খুলতে দাও। তারপর রাহুলকেও এমন শিক্ষা দেব, যেন আর কোনোদিন কোনো স্ত্রীর বিশ্বাস আর আত্মসম্মান নিয়ে খেলার সাহস না পায়।”
– “হ্যাঁ, এটা করতেই হবে।”

তৌফিকের নির্লজ্জতা দিন দিন বাড়তে থাকল। সে কথার ছলে শ্রেয়ার আরও কাছাকাছি আসার চেষ্টা করত। শ্রেয়াও তার পাতা ফাঁদে পা দিয়ে কথা চালিয়ে যেতে লাগল, শুধু সঠিক সুযোগটির অপেক্ষায়। একদিন শ্রেয়া সরাসরি তাকে জিজ্ঞেস করল,
– “আজ পর্যন্ত কয়টা মেয়ের সাথে শারী*রিক ভাবে জড়িয়েছ?”
– “একটাও না, ভাবি।”
– “চুপ! একদম মিথ্যা বলবে না!”
– “সত্যি বলছি, আমি কারও সাথে কিছু করিনি। আমি একদম ভা*র্জিন।”
– “আবার যদি মিথ্যা বলো, তাহলে কিন্তু কথা বলা বন্ধ করে দেব।”
এবার তৌফিক একটু নরম হলো। আমতা আমতা করে বলল,
– “সত্যি বলতে, দুইজন।”
– “তো তাদের বিয়ে করলে না কেন?”
– “কারণ তারা ভালো ছিল না।”
– “তুমিও তো ভালো না। ভালো হলে কি বিয়ের আগে তাদের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে?”
– “আসলে ভাবি, আবেগের বশে হয়ে গেছে। ইচ্ছা করে কিছুই করিনি। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে, নিজেকে আর সামলাতে পারিনি।”
– “আমার সাথে দেখা করতে চাও, তোমার ভেতরের সেই প*শুটা যদি আবার জেগে ওঠে, তাহলে তো আমাকেও ছাড়বে না!”
– “না, না! আমি আপনাকে অনেক সম্মান করি।”
– “বেশ, তাহলে আমি তোমার সাথে দেখা করব। তবে যা যা জিজ্ঞেস করব, সব সত্যি বলতে হবে। মনে রেখো, তাহলেই তুমি যা চাইবে, তাই হবে।”
– “সত্যি বলছেন, ভাবি? আমি আপনার সব কথা শুনব।”
– “ঠিক আছে।”

পরিকল্পনামতো, শ্রেয়া খুব সুন্দর করে সেজেগুজে বাড়ি থেকে বের হলো। সে টের পাচ্ছিল, আজ রাহুল তাকে অনুসরণ করছে। আড়চোখে সে দেখতেও পেল, রাস্তার ওপারের দোকানে ক্যাপ আর মাস্ক পরে রাহুল বসে আছে। শ্রেয়া একটা রিকশা নিয়ে সেই পরিচিত পার্কে এসে বসল। রাহুল কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রইল। শ্রেয়া জানে, এই দৃশ্যটা তাদের সম্পর্কে নতুন করে একটা দেয়াল তুলে দেবে, কিন্তু তৌফিকের মতো বিষা*ক্ত সা*পকে তাদের জীবন থেকে সরাতে হলে এইটুকু ঝুঁকি তাকে নিতেই হবে।

কিছুক্ষণ পর তৌফিক এসে হাজির হলো। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক কথা বলার পর শ্রেয়া সরাসরি নাসিমার প্রসঙ্গ তুলল। প্রথমে তৌফিক ব্যাপারটা পুরোপুরি অস্বীকার করতে চাইল। কিন্তু যখন শ্রেয়া অভিমানের সুরে বলল,
– “না বললে কিন্তু আমি এখনই চলে যাব।”

তখনই তৌফিকের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ল। শ্রেয়াকে হারানোর ভয়ে সে গড়গড় করে সব বলে দিল। সে স্বীকার করল যে, নাসিমার গর্ভের সন্তানটি তারই। শ্রেয়া তো এটাই চাইছিল। তার কাজ শেষ। সে আর এক মুহূর্তও দেরি না করে সেখান থেকে উঠে চলে এল। আর তার কিছুক্ষণ পরই, বিধ্বস্ত, অসুস্থ অবস্থায় রাহুল বাসায় ফিরল।

ঘরে ফিরে শ্রেয়া রাহুলকে সবটা খুলে বলল। তৌফিকের পাঠানো নোংরা মেসেজগুলো তার সামনে তুলে ধরল। সব দেখে, সব শুনে রাহুল যেন পাথর হয়ে গেল। সে ধপ করে বিছানার ওপর বসে পড়ল। সে বুঝতে পারল, তার জীবনের কত বড় একটা ভুল সে করে ফেলেছে। যে বন্ধুকে সে অন্ধের মতো বিশ্বাস করত, সেই বন্ধুই তার পিঠে ছু*রি বসিয়েছে। রাহুল কান্নাভেজা চোখে শ্রেয়ার হাত দুটো চেপে ধরে বলল,
– “প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। শুধু শুধু তোমাকে সন্দেহ করেছি, যা আমার একদমই উচিত হয়নি।”
– “আমার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে হয়তো ওর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যেত। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি, এই সংসারের ওপর আমার মায়া আছে, তাই আমি ভুল পথে পা বাড়াইনি। কিন্তু তুমি যখন আমার কোনো কথাই শুনছিলে না, তখন বাধ্য হয়ে ওর আসল রূপটা তোমার সামনে আনার জন্য আমাকে এই নাটকটা করতে হলো। ভুল আমিও করেছি, সরি।”

রাহুল শ্রেয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
– “আমি আর কখনো কাউকে বাসায় আনব না। তুমি যেমন চাইবে, ঠিক তেমনই হবে। তবুও আমাকে ছেড়ে যেও না, প্লিজ।”
– “যাব না।”
– “তৌফিককে আমি এর শা”স্তি দেবই!”
– “এখনই উত্তেজিত হয়ে কিছু করো না। আমি যা বলব, তুমি শুধু সেটাই করবে।”
– “আচ্ছা।”

শ্রেয়ার পরিকল্পনা অনুযায়ী, নাসিমা আবার তৌফিকের সাথে যোগাযোগ শুরু করল। তার বাচ্চার বয়স এখন এক বছর। সে তৌফিককে ফোন করে জানাল যে, তার খুব একা লাগে, তৌফিককে কাছে পেতে ইচ্ছা করে। সে এও বলল যে, তাকে কোনো দায়িত্ব নিতে হবে না, শুধু যেন সে মাঝেমধ্যে তার কাছে আসে। তৌফিক হলো দেহের কাঙাল। সে আর কোনো কিছু না ভেবেই নাসিমার পাতা নতুন ফাঁদে পা দিল। সে ছুটে গেল নাসিমার কাছে।

চলবে….!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে