#সন্দেহের_কাঁটা।
পর্ব:- এক।
লেখা:- সিহাব হোসেন।
“আমার বন্ধু বাসায় এলে আজকাল দেখি তুমি একটু বেশি সেজেগুজে বসে থাকো। এর কারণটা কী?”
রাহুলের প্রশ্নটা শ্রেয়ার কানে যেতেই ওর মুখটা মুহূর্তে কঠিন হয়ে উঠলো। ওর শান্ত চোখ দুটোতে দপ করে জ্বলে উঠলো আগুন। তীব্র ঘৃণায় স্বামীর দিকে তাকিয়ে সে বলল,
– ” কী বলতে চাইছো তুমি? তোমার কি মনে হয় আমি ওর জন্য সেজে থাকি?”
– “এখন তো তাই মনে হচ্ছে।” রাহুলের কণ্ঠে ছিল চাপা অভিমান আর হতাশা।
– “তোমার যা মনে হয়, সেটাই ভেবে নাও। আমি কখন সাজবো, কখন বসে থাকবো, সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার।” শ্রেয়ার কণ্ঠস্বরে ছিল স্পষ্ট অবজ্ঞা।
– “ও আচ্ছা! তাহলে তো ভালোই বেড়েছো তুমি। এই কথা যদি তোমার মা-বাবাকে না বলেছি, তো আমার নামও রাহুল নয়।”
এইটুকু বলতেই শ্রেয়া যেন রা*গে ফেটে পড়ল। সে চিৎকার করে বলল,
– “খবরদার! যদি আমার মা-বাবাকে একটা কথাও বলেছো, তাহলে আমি নিজেকে শেষ করে দেবো!”
শ্রেয়ার চোখেমুখে এমন এক হিংস্রতা আর জেদ ছিল, যা দেখে রাহুল স্তব্ধ হয়ে গেল। আর কোনো কথা বাড়ালো না সে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। নিজের কারখানায় এসে এক কোণে একটা চেয়ারে নির্জীবের মতো বসে রইলো সে। মাথার ভেতর হাজারো চিন্তা তোলপাড় করছে। কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। বার বার মনে হচ্ছে, শ্রেয়া আর তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু তৌফিকের মধ্যে কিছু একটা চলছে। যে শ্রেয়া একসময় তৌফিককে দেখলে এড়িয়ে চলতো, এমনকি ঠিকমতো কথাও বলতো না, সেই মেয়েই এখন তৌফিক বাসায় এলে পরিপাটি করে সেজেগুঁজে বসে থাকে।
বদলের শুরুটা ঠিক কোথা থেকে, তা রাহুল মেলাতে পারে না। দুই বছর আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিল তাদের। শ্রেয়া ছিল অসম্ভব সুন্দরী, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ছিল তার লজ্জা। অচেনা তো বটেই, পরিচিত পুরুষদের সামনেও সে আসতো না। বাইরে বের হলে আপাদমস্তক বোরখায় ঢেকে রাখতো নিজেকে। আর এখন? এখন সে আঁটসাঁট সালোয়ার-কামিজ পরে, ওড়নাটা দায়সারা ভাবে কাঁধের একপাশে ঝুলিয়ে রাখে। অথচ একসময় এই ওড়না দিয়েই সে নিজের মাথা আর শরীর যত্ন করে ঢেকে রাখতো। বোরখা পরা তো কবেই ছেড়ে দিয়েছে, নামাজও আর পড়ে না। সারাক্ষণ ফোন নিয়ে পড়ে থাকে। ফোনের স্ক্রিনে সর্বক্ষণ আঙুল চলে, আর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকে রহস্যময় হাসি। ফোনটা লক করা থাকে, রাহুল হাতে নিলেই তুমুল কাণ্ড শুরু করে দেয়, খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়। এই অশান্তি রাহুলের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে।
হঠাৎ এমন আমূল পরিবর্তনের কারণ কী? এই চিন্তায় রাহুলের রাতের ঘুম উবে গেছে, খাওয়া-দাওয়ায় রুচি নেই। অথচ শ্রেয়ার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। রাহুল এই যন্ত্রণাগুলো কাউকে বলতেও পারে না। বাবা-মা গ্রামে থাকেন, তাদের এসব বললে দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়বেন। একমাত্র বন্ধু তৌফিক, কিন্তু সন্দেহের তীর তো তারই দিকে! বাকি বন্ধুদের ওপর ভরসা করার মতো সাহস রাহুলের নেই।
রাহুলের শহরের বুকে ছোট একটা কারখানা আছে, যেখানে তিন-চারজন কর্মচারী কাজ করে। আসিফ নামের একটি ছেলে ব্যবসা শুরুর দিন থেকেই ওর সাথে আছে। বয়সে রাহুলের চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট হবে, কিন্তু ছেলেটা বেশ বিচক্ষণ। সে রাহুলের সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে বলল,
– “ভাই, আপনাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। কিছু হয়েছে?”
– “না, তেমন কিছু না। ”
– “ছোট ভাই হিসেবে আমার সাথে বলতে পারেন। এটুকু বিশ্বাস রাখতে পারেন, আমার দ্বারা আপনার কোনো ক্ষতি হবে না।”
রাহুলের ভেতরটা যেন একটা আশ্রয় খুঁজছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল,
– “চিন্তা তোমার ভাবিকে নিয়ে। সে কেমন যেন বদলে গেছে। আগের মতো আর আমাকে ভালোবাসে না মনে হয়।”
আসিফ একটা অদ্ভুত মুচকি হাসলো। তারপর ধীরেসুস্থে বলল,
– “আপনি তো ভাই সারাক্ষণ ব্যবসার পেছনে পড়ে থাকেন। সেই সকালে আসেন আর ফেরেন গভীর রাতে। একবার ওই বেচারির কথা ভেবে দেখেছেন? একা একা থাকতে থাকতে তার দম বন্ধ হয়ে আসাটাই স্বাভাবিক। আবার শুক্রবার ছুটির দিনটাতেও দেখি তৌফিক ভাইয়ের সাথে ঘুরে বেড়ান, নয়তো তাকে বাসায় নিয়ে এসে আড্ডা দেন। ভাবিকে একটু সময় দিন, দেখবেন সব আগের মতো হয়ে গেছে।”
রাহুলের মনে হলো, আসিফের কথাটা মিথ্যা নয়। সে কি সত্যিই শ্রেয়াকে সময় দেয়নি? তার মনে একটা নতুন প্রশ্ন জন্ম নিল, তবে কি এই সময় না দেওয়ার সুযোগেই শ্রেয়া তৌফিকের দিকে ঝুঁকে পড়েছে?
আসিফ ইতস্তত করে বলল,
– “ভাই, কিছু মনে না করলে একটা কথা বলবো?”
– “বল।”
– “তৌফিক ভাই কিন্তু সুবিধের লোক না। মেয়ে মানুষ দেখলে তার মুখ দিয়ে লালা ঝরে। সিনিয়র, জুনিয়র, বিবাহিত-অবিবাহিত,কোনো বাছবিচার নেই। যাকে পছন্দ হয়, তাকে পাওয়ার জন্য পা*গল হয়ে যায়। আমার মনে হয়, ওকে আর বাসায় না আনাই ভালো।”
– “আরে না! ও যেমনই হোক, আমার সাথে এমন করবে না।”
– “লুচ্চাদের কোনো জাত-কুল নেই, ভাই।”
আসিফের সোজাসাপ্টা উত্তরে রাহুল চুপ করে গেল।
রাতে বাসায় ফিরে রাহুল দেখলো, শ্রেয়া বিছানায় হেলান দিয়ে ফোন টিপছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। সেই হাসিতে এমন এক আবেশ, যা রাহুলের জন্য নয়। রাহুল যে ঘরে ঢুকেছে, সেদিকে তার কোনো খেয়ালই নেই। রাহুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফ্রেশ হয়ে এসে শ্রেয়ার পাশে বসলো। শ্রেয়া নির্বিকার। রাহুলই নীরবতা ভাঙলো,
– “ভাবছি, এই শুক্রবারে তোমাকে নিয়ে গ্রামে যাবো। অনেকদিন হলো মা-বাবার কাছে যাই না।”
– “তুমি যাও। আমার যাওয়ার ইচ্ছা নেই। আর হ্যাঁ, আমাকে কিছু টাকা দিও। কাল এক বান্ধবীর সাথে দেখা করতে যাবো।”
– “কোন বান্ধবী?”
– “রুহি ছাড়া আর কে?”
রাহুলের বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। ইদানীং এই রুহির সাথে তার দেখা করার পরিমাণটা বড্ড বেশি বেড়ে গেছে। রাহুলের মনে হলো, এটাই সুযোগ শ্রেয়াকে অনুসরণ করার।
গভীর রাতে ঘুমের ঘোরে রাহুলের ঘুম ভেঙে গেল। পাশে হাত দিয়ে দেখলো, শ্রেয়া বিছানায় নেই। ভাবলো হয়তো বাথরুমে গেছে। সে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন শ্রেয়া ফিরলো না, তখন তার মনে তীব্র সন্দেহ দানা বাঁধলো। সে বিছানা থেকে উঠতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে দেখলো, শ্রেয়া বেলকনি থেকে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকছে। তার হাতে ধরা মোবাইল ফোন, যার স্ক্রিনের আলোয় তার মুখটা রহস্যময় দেখাচ্ছে।
দৃশ্যটা দেখে রাহুলের বুকের ভেতরটা যেন বরফশীতল হয়ে গেল। সন্দেহের যে কাঁটা এতদিন শুধু খচখচ করছিল, আজ রাতে তা যেন গভীরে বিঁধে গেল। রাহুলের পৃথিবীটা এক মুহূর্তে দুলে উঠলো।
পরদিন সকালে রাহুলের ঘুম ভাঙলো একরাশ ক্লান্তি আর মন খারাপের বোঝা নিয়ে। কারখানায় যাওয়ার জন্য মনটা সায় দিচ্ছিল না। তার ভেতরের অবিশ্বাস আর যন্ত্রণা তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছিল না। সে সিদ্ধান্ত নিল, আজ সে কারখানায় যাবে না। আজ সে সত্যের মুখোমুখি হবে। শ্রেয়াকে অনুসরণ করবে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে রাস্তার ওপারে একটা দোকানের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল। বুকের ভেতরটা হাতুড়ির মতো পেটাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরই শ্রেয়া বেরিয়ে এল, আর তাকে দেখে রাহুলের পৃথিবীটা যেন মুহূর্তে দুলে উঠল। এ কোন শ্রেয়া! পরনে আকাশী রঙের ঝলমলে এক চুরিদার, যা তার শরীরের প্রতিটি বাঁক ফুটিয়ে তুলেছে। চোখে কালো সানগ্লাস, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক আর খোলা চুলগুলো বুকের একপাশে আলতো করে সাজানো। তার হাঁটার ভঙ্গিতে এমন এক আত্মবিশ্বাস, যা রাহুলের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা। নিজের স্ত্রীকে এই রূপে সে আগে কখনো দেখেনি। তার মনে হলো, কোনো বান্ধবীর সাথে দেখা করতে কেউ এভাবে যায় না। এ সাজ অন্য কারো জন্য।
একটা রিকশা ডেকে শ্রেয়া উঠে বসতেই রাহুল দ্রুত একটা অটোরিকশা নিয়ে তার পিছু নিল। শ্রেয়া শহরের এক নির্জন পার্কে এসে নামল। রাহুল কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনায় অপেক্ষা করতে লাগল। শ্রেয়া পার্কের ভেতরে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল, আর ঠিক তখনই সেখানে প্রবেশ করল সে, রাহুলের প্রিয় বন্ধু, তৌফিক।
দৃশ্যটা দেখার সাথে সাথে রাহুলের মাথাটা বন বন করে ঘুরতে শুরু করল। পায়ের তলার মাটি যেন সরে যাচ্ছে। তাহলে তার সন্দেহই সত্যি হলো! তার অগোচরে, তার ছাদের নিচে, তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু আর তার স্ত্রী এক নোংরা খেলায় মেতেছে! তীব্র ঘৃ*ণায় আর কষ্টে তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো। কাঁপা কাঁপা হাতে সে ফোনটা বের করে তাদের হাসাহাসি আর অ*ন্তর*ঙ্গ মুহূর্তগুলো ভিডিও করতে লাগল। প্রতিটি সেকেন্ড তার বুকে ছুরির মতো বিঁ*ধছিল।
ভিডিওটা করে ফোন পকেটে রেখে সে আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াতে পারল না। টলতে টলতে কারখানায় এসে নিজের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। কিন্তু শরীরটা আর তার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। মনে হচ্ছে র*ক্তচাপ বেড়ে গেছে, চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে।
ওর অবস্থা দেখে আসিফ ছুটে এল। সে রাহুলের অবস্থা বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ তাকে ধরে নিয়ে গেল কাছের এক ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার পরীক্ষা করে কিছু ওষুধ দিয়ে বললেন বাসায় গিয়ে পুরোপুরি বিশ্রাম নিতে।
আসিফ বলল,
– “চলেন ভাই! আমি আপনাকে বাসায় রেখে আসি।”
– “না, আমি যাবো না। আমি ঠিক আছি।”
– “আপনি একদম ঠিক নেই। চলুন। সুস্থ হলে তারপর কারখানায় আসবেন।”
আসিফ প্রায় জোর করেই রাহুলকে ধরে নিয়ে বাসার দরজার সামনে এলো। কলিংবেল চাপতেই শ্রেয়া দরজা খুলে দিল। দরজায় বিধ্বস্ত চেহারার রাহুলকে দেখে সে চমকে উঠল। উদ্বিগ্ন হয়ে শ্রেয়া রাহুলের কপালে হাত রাখতে যেতেই রাহুল তীব্র ঘৃ*ণায় তার হাতটা সরিয়ে দিল। তার দৃষ্টিতে ছিল এমন এক আ*গুন যা শ্রেয়াকে মুহূর্তে পুড়িয়ে দিচ্ছিল। কোনো কথা না বলে সে স্ত্রীর সামনে থেকে সরে গিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
চলবে…..!