সংঘাতের মেঘ পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
32

#সংঘাতের_মেঘ
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ৪(অন্তিম পর্ব)

ঘড়িতে রাত দেড়টা…
রায়হান সর্তকতার সাথে বারান্দা টপকে রুমে প্রবেশ করলো। বারান্দার দরজা খোলা থাকায় রায়হানের বেশ সুবিধা হলো।

মেহেরজান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রায়হান একটা মলিন মুচকি হাসি দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো মেহেরজানের মুখের সামনে।

মনে করতে লাগল আজ সন্ধ্যার কথা। তার সাথে মেহেরজানের বাবার কথপোকথন।

তার রিকুয়েস্ট করার কথা। সে পারেনি সেই অনূরোধকৃত পিতাকে ফিরিয়ে দিতে। তাকে যে প্রমিস করতে হয়েছে যে সে সরে যাবে মেহেরজানের জীবন থেকে। তার হয়তো নিজের ভালোবাসাকে নিজের করে পাওয়া হলোনা এ জীবনে। রায়হান জীবনে সব কিছুই পেয়েছে। হয়তো নিজের ভালোবাসা ছাড়া। মেয়েটা বুঝতেই চাইলো না তার ভালোবাসা।

চোখের কাণিশে জমা হওয়া পানিতে আলতো করে মুছে মুচকি হাসি দিয়ে বলল
“মেহের যা হেরে গিয়ে জিতিয়ে দিলাম তোকে। ভালো থাক তুই।”

মেহেরজানের গালে হাত বুলিয়ে ওর কপালে একটা গভীর চুমু খেল। মেহেরজান ঘুমের মাঝেই কেঁপে উঠলো।

রায়হান ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো, মেহেরজানের মুখের উপর একবার শেষবারের মতো তাকিয়ে নিলো। যেনো সেই মুখের প্রতিটি রেখা মনের গভীরে খোদাই করে নিতে চাইলো। সে জানে, আর কখনো এই মেয়েটির মুখে সে তাকাতে পারবে না। সিসি ক্যামেরাটা খুলে নিলো।

বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে, মনে হলো যেন মনের ভেতর বিশাল এক শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু প্রতিজ্ঞা ছিলো, প্রতিশ্রুতি ছিলো মেহেরজানের বাবার কাছে। সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে হবে।

বারান্দা টপকে, রায়হান অন্ধকার রাতের মধ্যে মিশে গেলো। কিন্তু তার হৃদয় জানে, সে চিরকাল মেহেরজানের ভালোবাসার জন্য অপেক্ষায় থাকবে, যদিও তা কখনোই তার হবে না।

——————-

সকালের তীব্র রোদের ঝলকানিতে ঘুম ভেঙে গেল। তখনি তার রুমে ছুটে এলো আরিয়ানা। আরিয়ার ঠোঁটে হাসি দেখে মেহেরজান ভ্রুকুচকে তাকালো সেদিকে। আরিয়ানা লাফিয়ে বেডে উঠে বলল
“আপু রায়হান ভাই বিয়েতে না করে দিছে।”

মেহেরজান নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছেনা। মেহেরজান আরিয়ানার কথা শুনে স্থির হয়ে বসে পড়লো। তার মন যেন থেমে গেছে, মাথার ভেতরে চিন্তার ঝড় বইছে। রায়হান না করে দিয়েছে? এমনটা কিভাবে সম্ভব? কাল রাতেও তো সে…

তারপর ধীরে ধীরে, মনে পড়তে লাগল সেই অদ্ভুত স্বপ্নের মতো মুহূর্তগুলো। রায়হানের উপস্থিতি, তার গালে মৃদু স্পর্শ, কপালের সেই গভীর চুম্বন। সে ঘুমের ঘোরে অনুভব করেছিল, কিন্তু বাস্তব ভেবেছিল কি না, তা নিয়ে তখন খুব একটা ভাবেনি।

“কিন্তু কেন?” মেহেরজান শেষমেশ অস্পষ্টভাবে জিজ্ঞেস করলো।

আরিয়ানা হেসে বলল
“কেন জানিনা। শুধু বলেছে যে, তার সিদ্ধান্ত পাকা, বিয়ে সে করবে না। মাও অবাক, সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে সে।”

মেহেরজান যেন শূন্যে ঝুলছে। রায়হানের এমন সিদ্ধান্তের পেছনে কি কারণ থাকতে পারে? কেন সে এমন করলো? ভালোবাসার কোনো ইঙ্গিত না দিয়ে, এক রাতের মাঝেই কেন সে তাকে ছেড়ে চলে গেল?

মেহেরজানের বাবা তব্দা মেরে বসে আছে। সকালেই রায়হানের বাবা ফোন করে আফসোস নিয়ে বলেছেন ছেলে নাকি তার বেঁকে বসেছে সে কিছুতেই বিয়ে করবেনা। তার কথা যে রায়হান রাখবে ভাবেনি সে।

মেহেরজান বেশ খুশি হয়েছে। নিজেকে মুক্ত মুক্ত মনে হচ্ছে তার কাছে।

———————

দেখতে দেখতে কেটে গেছে তিনটা বছর। পরিবর্তন এসেছে সবকিছুর মাঝেই। পরিবেশ, পরিস্থিতি,মানুষিকতা এমনকি জীবনের ও। দুবছর হলো মেহেরজানের বিয়ে হয়েছে। তবে তা কাব্যের সঙ্গে। যে একজন দায়িত্বশীল পুরুষ তার একান্ত নারীর জন্য। পারিবারিকভাবে বিয়েটা হলেও দুজনের মধ্যে ভালোবাসার কোনো অভাব নেই। একে অপরকে পাগলের ন্যায় ভালোবাসে। কাব্য নিজের ব্যস্ততা পাশে রেখেই নিজের প্রিয়তমার জন্য সময় বের করে। যেমন আজকে তারা দুইজন মিলে ঘুরতে এসেছে শাপলাবিলে। কাব্য নীল রঙের পাঞ্জাবী পড়ে নৌকা চালছে। আর মেহেরজান নীল শাড়ী পড়ে শাপলা দেখছে আর মুহূর্তটাকে উপভোগ করছে।

বেশকিছু সময় সেভাবেই অতিবাহিত করে তারা নৌকা ছেড়ে বিলের কিনারার বসলো। মেহেরজানের লম্বা চুলগুলো উড়ছে মৃদু বাতাসের তালেতালে। কাব্য সেদিকে কিছুসময় মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ধীর কন্ঠে বলল
“ভালোবাসি প্রিয়তমা।”

মেহেরজান মুচকি হেসে কাব্যের হাতে হাত রেখে ওর কাধে মাথা এলিয়ে দিলো।

কাব্য খানিকবাদে বলল
“আইসক্রিম খাবে?”

মেহেরজান হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ালো। কাব্য উঠে দাঁড়ালো আইসক্রিম আনার জন্য।

আইসক্রিমের দোকানে যেতেই একটা এগিয়ে এলো কাব্যের কাছে। পড়নে তার কালো পাঞ্জাবী। হাতে দামি ঘড়ি। চোখে সানগ্লাস। ফর্সা লম্বা সুঠাম দেহের পুরুষটিকে একপলক দেখে কাব্য ভ্রু কুচকে বলল
“আমি কি আপনাকে চিনি!”

লোকটি হাসলো। তারপর ধীর কন্ঠে বলল
“আপনি আপনার স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসেন তাইনা!”

কাব্য চোখ তুলে দূরে বসে থাকা মেহেরজানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে উঠলো
“হুম অনেক। কিন্তু আপনি কে বললেন না তো।”

লোকটি আবার ও হাসলো। তার হাসিতে কি যে ছিলো। সে আবার ও বলে উঠলো
“আগলে রাইখেন নিজের ভালোবাসাকে। সবার কপালে ভালোবাসা থাকেনা।”

কাব্য অস্পষ্ট সুরে বলে উঠলো
“রায়হান”

লোকটি কাব্যকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সানগ্লাস ঠিক করে রওনা হলো। কাব্য পলকহীন তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার দিকে।

মুহূর্তেই তুমুল বর্ষণ শুরু হলো। ধ্যান ভাঙলো কাব্যের। লোকটি চোখের আড়াল হয়ে গেছে অনেক আগেই। মেহেরজান তার কাছে দাঁড়িয়ে বলল
“চলুন না বৃষ্টিতে ভিজি।”

কাব্য রাজি হলো মেহেরজানের কথায়। দুইজন ভিজতে লাগলো।

অন্যদিকে কালো গাড়ির কাঁচ ভেদ করে রায়হান সবটা দেখে তপ্তশ্বাস ফেলল। আর মনে মনে বলতে লাগল

“ভালোবাসা সবার কপালে থাকে না। ভালো থাকুক আমার না পাওয়া ভালোবাসা তার ভালোবাসার কাছে।”

#সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে