#সংঘাতের_মেঘ
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ৩
রাফি রায়হানের এমন রূপ দেখে খানিকটা ভয় পেলেও ইশারায় মেহেরজানকে দেখিয়ে দিলো। রায়হান তাকিয়ে দেখলো মেহেরজান আর একটা ছেলে পাশাপাশি বসে আছে। রায়হান হনহনিয়ে সেদিকে গেল।
মেহেরজান হুট করেই রায়হানকে দেখে চমকে গেল। মেহেরজান একবার ওর বন্ধু নিরবের দিকে তাকিয়ে আবার ও রায়হানের দিকে তাকিয়ে বলল
“রায়হান ভাই আপনি এখানে কি করছেন!”
রায়হান অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো নিরবের দিকে। গম্ভীর কন্ঠে মেহেরজানকে বলল
“মেহেরজান এই মুহূর্তে বাড়ি যাও।”
মেহেরজান কিছু আরো বলতে নিবে তার আগেই রায়হান হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলো
“এই ছেলে এখনো এখানে কি করছো! মেহেরজান শুধু রায়হান তালুকদারের। তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাও।”
নীরব রায়হানের এমন হুঙ্কারে ভয় পেয়ে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে যায়।
নীরবকে যেতে দেখে মেহেরজান রায়হানকে কিছু বলতে নিবে তার আগেই রায়হান একটা থাপ্পড় বসিয়া দিলো মেহেরজানের গালে।
আর চেঁচিয়ে বলতে লাগলো
“আমার সঙ্গে ফাতরামি করতে আসবিনা একদম। ভালোবাসি বলে পাড় পেয়ে যাবি এটা ভাবিস না। ভুলে যাস না আমি কে!”
মেহেরজান অবাক হয়ে গেল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো বেশ কিছু মানুষ তাঁদের দেখছে। অপমানে মেহেরজানের চোখ ভরে এলো। মেহেরজান ছুটে চলে গেল। রায়হান চোখ বুজে পরপর কয়েকটা তপ্ত শ্বাস ফেললো। রাগ যেন এখনো কমেনি তার। মেহেরজান শুধু তার। সে কেন অন্য ছেলের সঙ্গে থাকবে।
————————
টানা চারটা ক্লাস নিয়ে বেশ ক্লান্ত কাব্য । আরো একটা ক্লাস করানোর পর আবার কোচিং করাতে হবে। কিন্তু তার শরীর আর চলছে না। ক্লান্ত ভঙ্গিতে চেয়ার এ বসে ফোন স্ক্রল করতে লাগলো সে। তখনি তার ডাক পড়লো। হেডস্যার ডেকেছে তাকে। ফোনটা পকেটে রেখে কাব্য রওনা হলো হেডস্যারের রুমের দিকে।
হেডস্যারের রুমের সামনে গিয়ে কাব্য ভিতরে যাওয়ার পারমিশন চাইলো। হেডস্যার মাথা উঠিয়ে কাব্যকে দেখে মুচকি হাসি দিয়ে কাব্যকে ভিতরে এসে বসতে বলল। কাব্যও মুচকি হাসি দিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে বলল
“স্যার কিছু জরুরি কথা কি!”
স্যার একটু গম্ভীর কণ্ঠেই বললেন
“জরুরি বটেই। আমার মেয়েটা এই নিয়ে দুবার ম্যাথে ফেল করেছে। এমন করলে কেমন করে হয় বলো তো। আমি একটা স্কুলের হেডস্যার আর আমার মেয়ে নাকি ফেল করে প্রতিবার।”
কাব্য হেডস্যারের কথায় সম্মতি দিয়ে বলল
“আসলেই বিষয়টি বেশ জরুরি। একটা টিচার রেখে দেন তাহলে।”
হেডস্যার হেসে বললেন
“তুমি থাকতে আমার ম্যাথ টিচার খোঁজা লাগে। আমার মেয়েটাকে কোনোমতে পাশটা করিয়ে দেও কাব্য।”
কাব্য খানিকটা ইতস্তত হয়ে বলল
“কিন্তু স্যার!”
“কোনো কিন্তু না কাব্য তুমিই পারবে আমি জানি।”
কাব্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
“আচ্ছা স্যার। তবে আমি যেভাবেই পড়া আদায় করি আপনি তা জানেন। এই নিয়ে কিন্তু আমি কিছু শুনবোনা স্যার।”
“আমি জানি তো। মারো ওকে আমার কোনো সমস্যা নেই।”
“আচ্ছা স্যার আমি কাল থেকে আপনার মেয়েকে পড়াতে যাবো ইনশাআল্লাহ।”
কাব্যর কথায় হাসি ফুটে উঠলো হেডস্যারের ঠোঁটে। কাব্য আরো কিছু কথা বলতে লাগলো।
——————-
মেহেরজান ছুটতে ছুটতে পার্ক থেকে বেরিয়ে এলো। তার হৃদয় ভারী হয়ে আছে, মাথার ভেতর রায়হানের থাপ্পড় আর অপমানের দৃশ্যগুলো বারবার ফিরে আসছে। পার্কের লোকেরা তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল, আর সেই লজ্জা তাকে আরও পুড়িয়ে দিচ্ছিল। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল, কিন্তু সে দ্রুত বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল।
বাড়িতে ঢুকতেই তার মা চমকে উঠলেন। মেহেরজানের চোখমুখের অবস্থা দেখে তিনি সবকিছু বুঝতে পারলেন। মেহেরজানের মা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মেহেরজান আগে থেকেই জানত কী হতে যাচ্ছে। তার মা তাকে আগে থেকেই সাবধান করেছিলেন—রায়হানের সামনে কিছু বলা যাবে না, কারণ তাদের পরিবার রায়হানের পরিবারের কাছে ঋণী।
মেহেরজান কোনো কথা না বলে সোজা মায়ের ঘরে ঢুকে গেল। তার মা চিন্তিত মুখে বললেন
“মেহেরজান, কী হয়েছে? এইভাবে কেন আসলে?”
মেহেরজান ঠোঁট চেপে ধরে বলল
“আম্মু, তুমি জানো আমি এই বিয়ে করতে চাই না। আজ রায়হান আমাকে থাপ্পড় মেরেছে, সবার সামনে। সে আমাকে কোনো সম্মান দেয় না, আর আমি ওকে ভালোবাসি না।”
তার মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীরে ধীরে বললেন
“মা, আমি জানি রায়হান রাগী, কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই। আমরা ঋণী, রায়হানের বাবা তোমার বাবাকে যখন সাহায্য করেছিলেন, তখন আমাদের হাতে বিকল্প ছিল না। এখন তারা আমাদের এই ঋণ শোধ করতে বলছে। তুমি যদি রায়হানকে বিয়ে না করো, আমরা সবাই বিপদে পড়ব।”
মেহেরজান হতাশায় বলল
“আম্মু, তোমরা ঋণ শোধ করতে পারো, কিন্তু আমি কেন নিজের জীবন বিসর্জন দেব? কেন আমাকে এই বোঝা নিতে হবে?”
তার মা চোখ মুছতে মুছতে বললেন
“তোমার বাবার কথাও ভাবতে হবে মা। আমরা সব হারিয়ে ফেলব। রায়হানকে চটিয়ে দেওয়া যাবে না।”
মেহেরজান বুঝতে পারল, এই মুহূর্তে তার মা-বাবা তার পাশে নেই। তারা কেবল ঋণ শোধের কথা ভাবছে, আর সে যেন নিজের ইচ্ছের কোনো মূল্যই পায় না।
মেহেরজানের নিজেকে অসহায় লাগছে। তার সাথেই কেন এমন হলো। জীবনটা তো এমন না হলেও পারতো। তার কপালে কি রায়হানের মতোই মানুষ আছে। মেহেরজানের কিছু ভালো লাগছে না। সে তো বেশি কিছু চায়নি একটা ভালো মানুষকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসাবে চেয়েছে। হয়তো তার কপালে নেই। কিন্তু তার বাবা মা কিভাবে পারলো তাকে এভাবে বলি দিতে। মনের মধ্যে একরাশ অভিমান এসে জমা হলো বাবা মার জন্য।
মেহেরজান একমনে ভাবতে থাকে, কিভাবে তার বাবা-মা তাকে এই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। সে যে কখনোই রায়হানের মতো একজন রাগী, অহংকারী মানুষকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসাবে ভাবতে পারেনি। অথচ, ঋণের বোঝা আর পারিবারিক সম্মান রক্ষার জন্য তাকে এই বলি দেওয়া হচ্ছে। মেহেরজানের মনের মধ্যে এক অসম্ভব তিক্ততা ছড়িয়ে পড়ে।
মেহেরজান গভীর শ্বাস নিয়ে নিজের কক্ষে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। তার মাথায় অনেক চিন্তা ঘুরছিল, কিন্তু সে একটাই সিদ্ধান্তে আসলো—এই বিয়েতে তার সম্মতি নেই। কিছু একটা করে তাকে এই বিয়ে থেকে মুক্তি পেতেই হবে। নিরবকে মানানোর চেষ্টা করতে গিয়েছিলো সে। যেন নিরব রায়হানকে গিয়ে বলে যে সে আর নিরব একে অপরকে ভালোবাসে। কিন্তু কাজের কাজ হওয়ার আগেই তো সবটা ঘেটে দিলো রায়হান।
মেহেরজান কয়েকটা দার্ঘশ্বাস ফেলে এগোলো ওয়াশরুমের দিকে। একটা লম্বা শাওয়ার নিতে। মনটাকে শান্ত করা বেশ প্রয়োজন তার।
——————-
অন্যদিকে রায়হান বেশ কিছুসময় তব্দা মেরে বসে রইলো পার্কেই। পরমুহূর্তেই তার মনে পড়লো রাগের বশে সে কি করছে। মেহেরজানের গায়ে হাত তুলেছে সে। রায়হান নিজের মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। পার্কের নিস্তব্ধতা যেন তার ভেতরের অশান্তিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। মেহেরজানের গায়ে হাত তোলা—এটা তো সে কখনোই ভাবেনি করবে! কিন্তু রাগের বশে, পরিস্থিতির চাপে, তার ভেতরের অস্থিরতা এমন একটা কাজ করিয়ে ফেলেছে, যা সে চাইলেও আর ফিরিয়ে নিতে পারবে না।
রায়হানের মনে হলো, মেহেরজানকে সে যতই নিজের বলে দাবি করুক, ভালোবাসার নামে তাকে আটকে রাখুক, এই পথ সঠিক নয়। নিজের কাজের পরিণতি নিয়ে ভাবতে গিয়ে রায়হানের চোখের সামনে ভেসে উঠলো মেহেরজানের অপমানিত মুখ। সে কি মেহেরজানকে সত্যিই ভালোবাসে, নাকি নিজের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে তাকে পেতে চায়?
রায়হান যেন নিজের ভেতরের দ্বন্দ্বে পুড়তে লাগল। মেহেরজান যদি সত্যিই নিরবকে ভালোবাসে, তবে কি সে তার ভালোবাসাকে বাঁধা দিতে পারে? কিন্তু আবার, রায়হান মেহেরজানকে নিজের করে পেতে চায়। এই দোটানার মধ্যে পড়ে তার ভেতরের রাগ, হতাশা, এবং দুর্বলতা একসঙ্গে তাকে গ্রাস করতে থাকে।
রায়হান উঠে দাঁড়ালো। তার মন বলছে, এবার কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। কিন্তু কীভাবে, তা সে জানে না।
নিজের উপরি নিজের রাগ হলো রায়হানের। পরপর ঘুষি বসিয়ে দিতে লাগল পাশের গাছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। রাফি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তখনি সেখানে হাসান আসলো। রায়হানকে আটকিয়ে বলল
“কি করছিস রায়হান! রক্ত বের হচ্ছে তো। পাগল হয়ে গেছিস। কি হয়েছে বল আমায়!”
রায়হান লাল চোখ নিয়ে হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল
“আমি কি খুব খারাপ হাসান!”
হাসান ভ্রুযুগল কুচকে রায়হানের দিকে তাকালো। হাসান কিছু বলতে নিবে তার আগেই রায়হান উঠে দাঁড়ালো। হাসানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টালমাটাল পায়ে সেখান থেকে চলে গেল রায়হান।
হাসান রায়হানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক দৃষ্টিতে।
#চলবে
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। রেসপন্স করবেন।)