#সংঘাতের_মেঘ
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ২
মেহেরজান এর যাওয়া পরেই রায়হান রুম থেকে বের হয়। আরিয়ানা রায়হানের সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল
“রায়হান ভাই আপু কি রাজি হয়নি!”
রায়হান ঠোঁটের নিচের দাড়ি চুলকে হালকা হেসে বলল
“আরে শালিকা তোমার বোন রাজি হোক আর না হোক। আমিই তোমার দুলাভাই হবো।”
বলেই রায়হান হেসে সেখান থেকে চলে গেল। আরিয়ানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসার রুমের দিকে অগ্ৰসর হলো।
বসার রুমে সবাই উৎসুক হয়ে বসে ছিলো। মেহেরজান চুপ করে বসে আছে। কিছুই বলছেনা সে। রায়হান আসতেই মেহেরজানের বাবা বলল
“কি হয়েছে বাবা তোমরা রাজি!”
রায়হান সোফায় বসতে বসতে বলল
“রাজি না হওয়ার কোনো করণ তো নেই আংকেল।”
রায়হানের কথার পর সবাই যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মেহেরজানের মা একটু মুচকি হেসে বললেন
“তাহলে তো এবার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় এসে গেল।”
মেহেরজান তখনও নীরব ছিল, তার চোখেমুখে এক অদ্ভুত ভাব। যেন সে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু কোনো এক কারণে আটকে যাচ্ছে। আরিয়ানা মেহেরজানের পাশে গিয়ে তার হাত ধরে চাপ দিল।
মেহেরজান অসহায় দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকাল। আরিয়ানার আর বুঝতে বাকি রাখল না, কী গভীর দ্বিধায় রয়েছে তার বোন। মেহেরজান বাবার ভয়ে মুখ খুলতে পারছে না, আর রায়হানের স্বভাব সে ভালো করেই জানে।
আরিয়ানা মেহেরজানের হাত ধরে আস্তে করে ফিসফিস করে বলল
“তুই যদি রাজি না থাকিস, তাহলে এখনই বলে দে। আমি আছি তোর পাশে।”
মেহেরজান চোখে পানি চলে এলো, কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা নিচু করে রইল। এদিকে, রায়হান আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বসে আছেন, যেন সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণে। মেহেরজানের মা-বাবাও কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে ছিলেন মেয়ের দিকে, যেন তারা কিছু অনুমান করছেন।
একটু পর মেহেরজানের বাবা চাপা স্বরে বললেন,
“মেহের, তুমি কি কিছু বলতে চাও?”
মেহেরজান একটু ইতস্তত করে, কিন্তু কোনো কথা বলতে পারল না। মুহূর্তটি যেন ভারী হয়ে উঠল।
মেহেরজানের মা মুচকি হেসে বললেন
“মেয়ে মানুষ তো লজ্জা পাচ্ছে হয় তো।”
সবাই বিষয়টা বুজতে পারলো। রায়হান একদৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে মেহেরজানের দিকে।
মেহেরজানের বাবা একটু গম্ভীর হয়ে বললেন
“মেহের, যদি তুই কিছু বলতে চাস, এখনই বল। তোর কোনো আপত্তি নেই তো?”
মেহেরজান এবার চোখ তুলে তাকাল, কিন্তু কথাগুলো তার ঠোঁটে আটকে গেল। এক মুহূর্তের জন্য সে নিজেকে নিঃস্ব মনে করল। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারল না, কিন্তু তার অন্তরবিদীর্ণ কষ্ট আর অস্বস্তি তার বোনের কাছ থেকে লুকানো রইল না।
আরিয়ানা এবার আর চুপ থাকতে পারল না। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল
“আপু ঠিক আরামদায়ক বোধ করছে না, বাবা। আমি মনে করি, ওকে একটু সময় দেওয়া উচিত।”
সবাই তখন চুপ হয়ে গেল।
তখনি মেহেরজানের দাদি রাবেয়া বেগম বললেন
“তোমরা বুঝোনা নিরবতা সম্মতির লক্ষণ। বিয়ের কথা আগাও তো বাপু।”
মেহেরজান একটা তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো। সে বুজতে পেরেছে এখন এখানে কিছু বলে লাভ নাই। মেহেরজান মনে মনে বলতে লাগল
“অন্য কোনো প্লান করতে হবে তাকে। বাবাকে বললেও লাভ নাই। বন্ধুর ছেলে বলে কথা। জীবনেও না করবেনা। আর এক হয়েছে দাদি রায়হান ভাই বলতে অস্থির। পিরিত দেখে বাঁচিনা। এই লুচু বেডারে তো আমি জীবনেও বিয়ে করবো না। নো নেভার।”
বলেই মুখ বাঁকালো মেহেরজান। যা রায়হানের চোখ এড়ালোনা। রায়হান বাঁকা হাসলো। তার সেই হাসিতে মেহেরজানের অস্বস্তি আরও বেড়ে গেল। সে জানে, এই বিয়েটা তাকে নিয়ে কেউ গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে না। তার মতামতকে একেবারে উপেক্ষা করা হচ্ছে।
রায়হান যখন সেই আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বসে, সবাই বিয়ের প্রস্তুতির কথা বলতে শুরু করল। মেহেরজানের মা বললেন
“আগামী মাসেই দিন দেখে কাজ শুরু করো। মেহেরের তো সব ঠিকঠাকই আছে। বড় কোনো আয়োজন করতেও হবে না।”
মেহেরজানের বাবা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন, রায়হানের বাবা সম্মতি দিয়ে বললেন
“হুম আবার কিছুদিন পর রায়হানের নির্বাচনের কাজ শুরু হবে। তাই ভাবছি নির্বাচনের আগেই বিয়েটা দিয়ে দেই ওদের।”
সবাই কথা বলতে ব্যস্ত আর রায়হান তখনও তার দম্ভিত হাসি মুখে ধরে রেখেছে। কিন্তু মেহেরজানের মন ততক্ষণে ভিন্ন কোনো পথে চলে গেছে। তার ভাবনায় ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরছে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথ।
————————
বেডের মাঝে গালে হাত দিয়ে গভীর চিন্তায় মত্ত মেহেরজান। হুট করে একটা আইডিয়া মাথা আসতেই চোখমুখ চিকচিক করে উঠলো তার। খুশিতে সে গান গেয়ে উঠলো
“চাঁন্দের বাতির কসম দিয়ে ভালোবাসিলি।
এখন আমারে চাঁন্দেও চিনে না আমারে সূর্যও চিনেনা।”
অন্যদিকে মেহেরজানের এমন গান দেখে হুট করেই হেসে দিলো রায়হান। ভালো যে মেহেরজানদের বাসায় গিয়ে ওর রুমে ছোট সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে এসেছিল বুদ্ধি করে। তা না হলে মেহেরজানের এমন সুরেলা কন্ঠের অদ্ভুত গান শুনতেই পেত না। হুট করেই রায়হানের মুখের হাসি চলে গেল। আচ্ছা মেহেরজান এত খুশি কেন? রায়হান আবার ও মনোযোগ দিয়ে তাকালো ল্যাপটপের দিকে।
মেহেরজান কাকে যেন কল করছে। মেহেরজান নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক রেখে বলে উঠলো
“হ্যালো, তুই ঠিক জায়গায় আছিস তো? সব রেডি তো?”
মেহেরজানের কন্ঠে আত্মবিশ্বাস স্পষ্ট ছিল। ওপাশ থেকে কেউ যেন তাকে নিশ্চিন্ত করল। মেহেরজানের মুখে এক ধরনের সপ্রতিভ হাসি ফুটে উঠল।
“ঠিক আছে, আমি কাল সকালেই সব কিছু ঠিক করে আসবো।”
বলে ফোনটা রেখে সে একরকম নিশ্চিন্তভাবে বেডে শুয়ে পড়ল।
রায়হান এবার আরও চিন্তিত হয়ে পড়ল। তার মন ভরে গেল অস্বস্তিতে। মেহেরজান কিছু একটা পরিকল্পনা করছে, আর সেটা নিশ্চয়ই তার বিয়ে নিয়ে।
নিজের দম্ভকে একপাশে সরিয়ে, রায়হান এবার সত্যিকারের চিন্তায় পড়ল।
“এই মেয়েটা কী করছে?”
———————
সকাল সকাল মেহেরজান উঠে রেডি হয়ে নিলো কলেজ যাওয়ার জন্য। একদম রেডি হয়ে খাবার টেবিলে যেতেই ওর মা নীলা বেগম বললেন
“কিরে আজ যে কলেজ যাবি কিছু বলিসনি তো।”
মেহেরজান খাবার প্লেট নিতে নিতে বলল
“আম্মু আজ একটা ক্লাস আছে। ওটা মিস করা যাবেনা।”
নীলা বেগম ধীর গলায় বললেন
“ওও”
আরিয়ানার একটু সন্দেহ হলো। কালই রাতেই তো মেহেরজান মুখ ঝুলিয়ে রেখেছিলো। আর সকালেই তার মন খুশি খুশি হয়ে গেল। ডাল মে কুছ কালা হে। নিজের মনেই এসব ভাবলো আরিয়ানা। সবার সামনে আর কিছু বলল। চুপচাপ খেলো শুধু।
মেহেরজান খাওয়া শেষে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলো কলেজের উদ্দেশ্যে।
অন্যদিকে রায়হানের ঠিকমতো ঘুম হয়নি মেহেরজানের হুট করে এমন আচরণ পরিবর্তনের কারণ ভেবে। কেবলি তার চোখটা লেগে এসেছিলো তখনি বিকট আওয়াজে তার ফোনটা বেজে উঠলো। রায়হান একরাশ বিরক্তি নিয়ে কলটা রিসিভ করে কানে ধরলো। কল রিসিভ হতেই অপর পাশ থেকে রায়হানের বডিগার্ড রাফি হড়হড়িয়ে বলতে লাগল
“ভাই ভাবি অন্য একটা ছেলের লগে পার্কে ঘুরতে আইছে।”
কথাটা কানে যেতেই লাফিয়ে সোয়া থেকে উঠে বসলো রায়হান। চিল্লিয়ে বলে উঠলো
“কি বলছিস তুই! তুই থাক ওখানে আমি আসছি।”
রাফিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলো রায়হান। তাড়াতাড়ি করে কোনমতে ফ্রেশ হয়ে, গাড়ির চাবিটা নিয়ে,পড়নের টিশার্ট ঝাড়া দিয়ে ছুটলো সে। চোখমুখ লাল হয়ে আছে। চোখ বেয়ে যেন রক্ত ঝড়ছে তার। ফর্সা মুখের রক্তাক্ত আভা যেন ক্রোমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছে।
রায়হানকে এমন অবস্থায় ওর মা দেখে রায়হানকে ডাকতে নিবে কিন্তু তার আগেই রায়হান সেখান থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেল।
রায়হানের মা আমেনা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজ মনেই বললেন
“ছেলেটার অতিরিক্ত রাগটা বরাবরই আমাকে চিন্তায় ফেলছে। কি যে হবে ছেলেটার। আল্লাহ তুমি আমার ছেলেটাকে রাগ কন্টোল করার ক্ষমতা দেও।”
রায়হান দ্রুত ড্রাইভ করে পার্কে পৌঁছালো। রায়হানকে আসতে দেখে রাফি এগিয়ে গেল ওর কাছে।
#চলবে
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)