#copyrightalert❌🚫
#শ্রাবণ_রাতের_বৃষ্টিতে
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩১
ইটালিতে এখন প্রায় গভীর রাত। বাহিরে বেশ হাওয়া বইছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। বারান্দার দরজা খোলা রেখে আর্শি বিছানার সাথে গা এলিয়ে শ্রাবণের ফোনের অপেক্ষা করতে করতে কখন যে তার চোখ লেগে গেছে খবর নেই। শ্রাবণকে কল করেছিল একবার, রিং বেজেছে কিন্তু রিসিভ হয়নি। আর্শি জানে, শ্রাবণ ফোন সাইলেন্ট করে রাখে। তাই বারবার কল করেনি। দেখলে নিজেই কলব্যাক করবে। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ ফোন বেজে উঠলে ঘুম ছুটে যায় আর্শির। তড়িঘড়ি করে ফোন হাতে নিয়ে দেখে শ্রাবণে ভিডিও কল। আর্শি বিছানা ছেড়ে ডাইনিং রুমে এসে কল রিসিভ করে। ফোন রিসিভ করতে দেরি শ্রাবণের হড়বড়িয়ে বলা কথাগুলো কানে আসতে দেরি হয় না আর্শির! শ্রাবণ বলে,
“ইজ ইট ট্রু? তুমি রিয়েলি প্রেগন্যান্ট? আর ইউ ট্রায়িং টু প্র্যাংক উইথ মি?”
শেষোক্ত কথাটা আর্শির মন খারাপ করে দেয়। কণ্ঠস্বরে মন খারাপের রেশ ধরেই বলে,
“আপনার কেন মনে হয় আমি আপনার সাথে প্র্যাংক করব? আমি কি এটুকু বুঝি না, কোনটা সিরিয়াস ম্যাটার আর কোনটা ফানি ম্যাটার? টেস্টের রিপোর্ট সহ আপনাকে দিলাম, তারপরও যদি আপনার কাছে এটা ফানি মনে হয়! দ্যান আই হ্যাভ নো ওয়ার্ড টু সে ইউ। যখন বিশ্বাস হবে তখন কল করবেন। বায়!”
শ্রাবণ তাড়াহুড়া করে বলে,
“আরে শুনো তো! রাগ করছো কেন? আমার সত্যি বিশ্বাস হচ্ছিলো না। তাছাড়া তুমি আমি দুজনেই এখন পড়ালেখা, জব নিয়ে বিজি। বাট দ্যা মেইন ফ্যাক্ট ইজ, বর্তমানে আমরা দুইজন দুটি ভিন্ন দেশে থাকি। এমনকি আমাদের সাথে আমাদের পরিবারও নেই। তুমি আমার কনসার্নটা বুঝতে পারছ না।”
“বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি তো আর ইচ্ছে করে বেবি নেইনি।”
শ্রাবণ মুখে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে ক্লান্তিকর স্বরে বলে,
“ফরগেট ইট! কী করবে এখন?”
শ্রাবণের প্রশ্নের বিপরীতে আর্শিও পালটা প্রশ্ন করে,
“আপনি কী করতে বলছেন? এমন কোন কথা বলে বসবেন না, যেটার পর আমি আপনার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিব!”
শ্রাবণ বিস্মিত স্বরে বলে ওঠলো,
“আমার কথা শুনলে তুমি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিবে? তুমি এটা বলতে পারলে?”
“হ্যাঁ পারলাম। শ্রাবণ, আপনার কি মনে হচ্ছে না আপনি দিনকে দিন বদলে যাচ্ছেন? আপনি বাবা হতে চলেছেন, শ্রাবণ! কিন্তু আপনার মধ্যে সেটার কোনো উচ্ছাসতা নেই। আমি প্রথম থেকেই একটা বিষয়ে লক্ষ্য করেছি, আপনার মন মতো সবকিছু হলে সব ভালো। আপনার মন মতো একটা কিছু না হলে, কিছুই ভালো না। ইটস আওয়ার বেবি। আমি যদি সাহস করতে পারি, নিজের খেয়াল রাখতে পারি। তাহলে আপনি কেন ভয় পাচ্ছেন?”
“তুমি বুঝতে পারছ না…”
শ্রাবণকে কথা শেষ করতে দিলো না। ফোন কেটে আর্শি ইন্টারনেট অফ করে সেখানেই নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো। নিজে নিজেই স্বগোতক্তি করছে,
“বেবিতো আমিও এতো জলদি চাইনি। তাই বলে কি এখন…! উনি এটা মিন না করলেও পারতো। আরিয়াও তো প্রেগন্যান্ট। আশিক তো কতো খুশি। উনি কেন খুশি হতে পারলো না?”
কিছুক্ষণ নিরবে মন খারাপ করে থেকে পানি খেয়ে রুমে চলে গেলো। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শ্রাবণ বেবি না চাইলেও সে মানবে না। সকালে শ্রাবণের বাবা-মাকে কল করবে। যা বলার উনারাই বলুক।
________
পরেরদিন, শ্রাবণ অফিসে চিন্তিত হয়ে বসে আছে। নিজের ডেস্ক থেকে ইরিনা ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে। তারা একসাথে কয়েকজন একটক প্রজেক্টে আছে। প্রজেক্টের কাজ শেষই প্রায়। ফাইনাল রিপোর্টটা জমা দিবে। প্রজেক্টটাতে তাদের প্রায় বিশ দিনের মতো লেগেছে। এই কয়েকদিনের ভিতর শ্রাবণকে কখনো আজকের মতো উদাস ও চিন্তিত দেখেনি ইরিনা। ইরিনা শ্রাবণের কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলে,
“হেই শ্রাবণ, হোয়াট হ্যাপেন্ড? ইউ লুকিং টেনসড। এনিথিং রং?”
শ্রাবণ ইরিনার দিকে একবার তাকিয়ে কম্পিউটারে স্থির ডাটাবেজের শিটটার দিকে চেয়ে বলে,
“নো, আই অ্যাম ফাইন।”
“ডোন্ট হেজিটেট। প্লিজ টেল মি, হোয়াট হ্যাপেন্ড? ইউ নো? শেয়ারিং ইজ কেয়ারিং? হোয়েন ইউ শেয়ার ইউর প্রবলেম, ইউ উইল ফিল বেটার।”
শ্রাবণ উঠে দাঁড়ালো। তারপর বলল,
“কফি?”
“ইয়াহ শিউর।”
দুজনে অফিস থেকে বেরিয়ে একটা কফিশপে যায়।
_____
এদিকে শ্রাবণের বাবা-মা বেজায় খুশি। তাঁরা দাদা-দাদী হবেন। উনারা তো চাইছেন, ইটালি গিয়ে আর্শির সাথে কিছুদিন থেকে আসবেন। কিন্তু শ্রাবণের অসন্তুষ্টির কথা শুনে মিসেস সন্ধ্যা বললেন,
“শোনো, তুমি একদম শ্রাবণের কথায় মন খারাপ করবে না। ও হয়তো টেনশনে আছে। দুইদিন ওর সাথে কথা না বলে দেখো, একদম লাইনে চলে আসবে। আর তুমি কিন্তু ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করবে। হেলদি খাবার খাবে। যদিও জানি, তুমি হেলদি খাবারই খাও। আর রাত জাগবে না। আমার ফা*জিল ছেলের জন্যও রাত জাগবে না।”
আর্শি মৃদু হেসে বলে,
“জি মা। আমি নিজের খেয়াল রাখব। তাছাড়া আমার তিনজন রুমমেটও অনেক কেয়ারিং। তাছাড়া হেলেনা আন্টি, মানে আমার ফ্রেন্ড হ্যারির মা আজ সকালেই আমাকে দেখতে এসেছিলেন। সাথে করে নিজে রান্না করে কতোকিছু নিয়ে এসেছেন। তাই আপনারা চিন্তা করবেন না।”
শ্রাবণের বাবা বলেন,
“আমার ছেলেকে নিয়ে চিন্তা করবে না। ওর জন্য ওর বাপই যথেষ্ট। দিনকে দিন একরোখা হয়ে গেছে। ফোন করে ওকে ধো*লাই দিতে হবে।”
মিসেস সন্ধ্যা ফোড়ন কে*টে বললেন,
“তুমি কিছুই বলতে পারবে না! তোমার মুখ দিয়ে কথা বেরোয়? নিজে একরোখা কম? ও-কে তো আমি শায়েস্তা করব। আর আর্শি মা, তুমি খালি নিজের খেয়াল রেখো। পড়াশোনাটাও মন দিয়ে করো।”
“জি মা।”
“তাহলে রাখি এখন। তোমার তো ক্লাস আছে।’
“আজ আর নেই। এখন অ্যাপার্টমেন্টে ফিরব।”
“সাবধানে যাও।”
অতঃপর সালাম বিনিময় করে ফোন কা*টে আর্শি। পাশে বসা সোহা বলে,
“এখানকার এক রেস্টুরেন্টে ফুচকা পাওয়া যায়। যদিও টেস্টে বাংলাদেশের ফুচকার মতো হবে না। দই ফুচকা, মিষ্টি টকের ফুচকা। খেয়ে আসি চল। শুনেছি নতুন আইটেম হিসেবে ফুচকাটা যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশি ওয়েটারও বেশি সেখানে। যাবি?”
আর্শি ভেবে দেখলো, প্রস্তাবটা মন্দ না। অতঃপর মোনা, লিসা, হ্যারি ও পিটারকেও জানালো। তারপর ছয় জন মিলে সেখানে গেলো।
_______
রাত থেকে ইরিনা খুব ভয়ে আছে। তার কাছে একটা মেইল এসেছে। যদিও মেইল আইডিটা সে ট্র্যাক করতে ব্যার্থ হয়েছে। মেইলটাতে এমন লিখা ছিল যে, সে যদি শ্রাবণকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে ফাঁ*সাতে পারে, তবে বিনিময়ে সে পঞ্চাশ হাজার কানাডিয়ান ডলার পাবে। ইরিনা তাই খু্ব ভয়ে আছে। টাকার প্রতি তার লোভ নেই। কারণ সে জব থেকে যা বেতন পায় তা দিয়ে তার বেশ ভালো ভাবেই চলে যায়। তার উপর পরিবারেরও টেনশন নেই। সে এতিম। ইতোমধ্যে কিছুদিন আগে সে এনগেইজড হয়েছে। ছয় মাস পর তার বিয়ে। তাহলে তাকে কেন এরকম বাজে কাজের অফার দেওয়া হচ্ছে? নাকি চাকরিক্ষেত্রে নতুন এমপ্লয়ি হিসেবে কেউ তার সাকসেসে ঈর্ষান্বিত? এজন্য তাকে ফাঁ*সাতে জাল পেতেছে? কথাটা সে তার ফিয়ন্সেকে শেয়ার করলে তার ফিয়ন্সেও তাকে একই কথা বলেছে এবং এসব থেকে দূরে থাকতে বলেছে।
ভয় থেকে ইরিনা কাজে একটা ভুলও করে ফেলেছে। তখন ইরিনার ফিয়ন্সে ওর কাছে এগিয়ে আসে। ইরিনার ফিয়ন্সে ইরিনার কলিগ। সে এসে বলে,
“রিল্যাক্স ইরিনা, কনসানট্রেট ইন ইউর জব। স্টপ ওভারথিংকিং। ফোকাস ইন ইউর ওয়ার্ক।”
ইরিনা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।
অপরদিকে নাহিদ ইরিনার উত্তরের অপেক্ষা করছে। যদি রাজি না হয় তবে টাকার এমাউন্ট আরও বাড়িয়ে দিবে। কিন্তু কাজটা তার করাতেই হবে। আর্শির প্রেগনেন্সির খবরটাতে নাহিদকে আরও ক্ষে*পিয়ে তুলেছে। সবাই নিজেদের লাইফে খুশি, শুধুমাত্র সে ছাড়া। এটাই সে কোনো ভাবে মেনে নিতে পারছে না।
চলবে ইন শা আল্লাহ,
#copyrightalert❌🚫
#শ্রাবণ_রাতের_বৃষ্টিতে
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩২
আজ তিন দিন শ্রাবণ আর্শির কণ্ঠস্বরও শুনতে পারছে না। মূলত আর্শি শ্রাবণের কল রিসিভ করছে না। শেষমেশ শ্রাবণ আরিয়াকেও ফোন করেছে আর্শিকে মানানোর জন্য। কিন্তু শ্রাবণ বাচ্চা রাখতে রাজি না। আরিয়া শ্রাবণকে বুঝাতে চেয়েও পারেনি। উলটো বলছে, আর্শি বাচ্চা রাখতে চাইলে দেশে ফিরে যাক! এসব আরিয়া আর্শিকে জানালে আর্শি রেগে নিজেই শ্রাবণকে কল করে। শ্রাবণ তখন অফিসে। কিন্তু কাজে খুব একটা মন নেই। বারবার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে। ফোন সাইলেন্টও করেনি। আর্শি কল আসাতে সাথে সাথে রিসিভ করে। প্রথমে আর্শিই রুক্ষ স্বরে বলে,
“আপনি কি জানেন, শুধু ভালোবাসা দিয়ে পুরো জীবন চলে না। মিউচুয়াল রেসপেক্ট থাকতে হয়। কিন্তু আমার জন্য আপনার মনে কোনো রেসপেক্ট নেই। আমি মানুষ। কোনো বস্তু না যে, আপনার মনমতো চলব! আমারও কিছু ইচ্ছে, কথা আছে।”
শ্রাবণ বুঝে গেছে কালকের আরিয়ার সাথের কথাগুলো আর্শি জেনেছে। সে নিজের পক্ষে বলে,
“আমি তোমার ভালোর জন্য বলছি। তোমার জন্য আমি, তোমার বাবা-মা, ভাই-বোন, আমার বাবা-মা সবাই চিন্তা করবে। তুমি এটা বুঝতে পারছো না?”
আর্শি চোখ বন্ধ করে ঘন নিঃশ্বাস ছাড়লো। অতঃপর শান্ত স্বরে বলল,
“আমি ছোটো বাচ্চা না, শ্রাবণ! আপনি আমার ফ্রেন্ডদেরকে বিশ্বাস করেন না, ইটস অকে। আমি তো করি। আমি আর ৭-৮ মাস ইটালিতে থাকব। তারপর দেশে ফিরেই যাব। আর থিসিসের কাজ আরও আগে শেষ হলে আরও জলদি ফিরতে পারব। তাই বলে আপনি আমাকে এমন অযৌক্তিক শর্ত দিতে পারেন না। বাচ্চা আমি ক্যারি করব, তাই এখানে আমার মতামতটা বেশি প্রায়োরিটি পাবে। সবসময় আপনার ইচ্ছে, মতামত আমার উপর চাপাতে পারেন না।”
“তাহলে তুমি শুনছো না? বেবি রাখবেই?”
“হ্যাঁ, বেবি রাখব আমি।”
“ঠিক আছে। ওই কথাই রইল! থাকো তুমি তোমার মতো!”
অতঃপর শ্রাবণ ফোন কেটে দিলো। আর্শি নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে। শ্রাবণ শেষে এটা কী বলল? কী বুঝাতে চাইলো? আর্শির মস্তিষ্ক কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কেমন এলোমেলো সব। পাশ থেকে সোহা আর্শিকে আগলে নিয়ে বলে,
“তুই অতো চিন্তা করিস না। এমন কিছু ছেলে আছে যারা তাড়াতাড়ি বাচ্চা চায় না। মূল কারণ হচ্ছে ওরা চায় বউয়ের সাথে রো*মান্টিক মূহুর্ত যাতে নষ্ট না হয়। আমার ফ্রেন্ড অনার্স থার্ড ইয়ারে বিয়ে করেছিল। গ্রাজুয়েশনের আগ পর্যন্ত তো ও তেমন চিন্তাও করেনি, কিন্তু যখন গ্রাজুয়েশনের পর ওর হাসবেন্ড বেবি নিতে চাইতো না। বেবি নেওয়ার কথা বললেই রাগারাগি করতো। অথচ ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন ও-কে প্রেশার দিচ্ছিল। এই চার মাস আগে ও কনসিভ করেছে। মূলত ও ওর হাসবেন্ডের বিরুদ্ধে গিয়েই বেবি নিয়েছিল। প্রথমদিকে ওর হাসবেন্ড তেমন খুশি ছিল না। তবে এখন নাকি ওর কেয়ার করে। দেখবি ভাইয়াও কিছুদিন পর ঠিক হয়ে যাবে। তোদের বিয়েরও তো বেশি সময় হয়নি।”
আর্শি বিপরীতে কিছু বলল না। তার কিছু ভালো লাগছে না। মন খারাপের রেশ নিয়ে রুমে গিয়ে জানালার ধারে বসলো। লিসা আজ মাথাব্যাথার কারণে জলদি ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু আর্শির ঘুম আসছে না। শ্রাবণের কথা শুনে এখন তারও মাথা ধরছে। কড়া করে কফি খেতে চাইলো কিন্তু বেবির কথা চিন্তা করে সেটাও বাদ দিতে হলো। নিজে নিজেই বলতে থাকে,
“অভাগা যেদিকে যায় সাগর সেদিকেই শুকায়! এমনও তো আমি চাইনি। তাও আমার সাথেই এসব হয়।”
চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ থাকতে চাইলেও এসব চিন্তাই ঘুরেফিরে তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তাই অবশেষে নিজেকে ব্যাস্ত রাখতে একটা বই নিয়ে বসলো। এখন তাকে খুশি থাকতে হবে। মন খারাপ করলেও বেবির উপর এফেক্ট পড়বে।
_______
দেখতে দেখতে আরও কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেছে। আজ ইটালিতে রাতভোর লাগাতার বৃষ্টি হচ্ছে। আর্শি ফজরের নামাজ পড়ে আধো উষালগ্নের সূচনার সময় হালকা পাতির লেবুচা করে নিয়ে ব্যালকনিতে বসেছে। তার আগে খালিপেটে দুইটা খেঁজুর ও পানি খেয়েছে। ভোরের স্নিগ্ধ সময়টা তার খুব ভালো লাগছে। হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও আজ তার ভালো লাগে। কী আশ্চর্য! কাউকে ভালোবাসলে, তাকে প্রতিনিয়ত মনে করলে বুঝি তার পছন্দের সবকিছু নিজের অজান্তেই ভালো লাগতে শুরু করে? যদি সেটা নিজের অপছন্দ হয়! তবুও? চা খেতে খেতে ব্যালকনির গ্রিলের বাইরে হাত গ*লিয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখলো। তৎক্ষণাৎ তার সমস্ত কায়াতে যেন অদৃশ্য বিদ্যুৎ খেলে গেল।
গতকাল রাতেই তার শ্রাবণের সাথে কথা হয়েছে। শ্রাবণ এতোদিনে আর্শিকে বুঝতে পেরেছে। খুশি হয়েছে। যদিও নৈপথ্যে তিনটি মানুষের অবদান ছিল। আদিব, কলি ও ইরিনার। আদিব ও কলি নিজেদের বিয়ের রাতে বাসর ঘরে বসে নিজেদের বন্ধুদের ভালোর কথা ভেবেছে। আদিব শ্রাবণকে ফোনযোগে বুঝিয়েছে। ওদিকে কানাডায় ইরিনাও বুঝিয়েছে। অবশেষে তাঁরা সফলও হয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আদিব অফিস থেকে পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে পুরো পরিবারে ইটালিতে বেড়াতে যাবে। আদিব ও কলি ইটালির বিভিন্ন জায়গায় ঘুরবে। আর আর্শির বাবা-মা এক মাস বড়ো মেয়ের কাছে থাকবে। আর্শি শুধু চাইছে, এই দিনগুলো জলদি চলে যাক। তার বাবা-মা জলদি তার কাছে চলে আসুক। তার মনও তো এই সময় মাকে কাছে চায়।
______
আরিয়া মিসেস নেহার কোলে মাথা রেখে আচাড় খাচ্ছে। মুশফিকা বারবার নিষেধ করছে এতো আচাড় না খেতে, কিন্তু আরিয়া কি শোনে? তার ভাইয়ের বিয়ের সব অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে গত তিন দিন আগে। আজই সে মায়ের বাড়ি থেকে এখানে এসেছে। সামনে সেমিস্টার ফাইনাল। এখন কুইজ, এসাইনমেন্টের বাহার চলছে। আরিয়ার এসাইনমেন্ট অবশ্য সে নিজে করবে না। আশিক করে দিবে। আরিয়া শুধু মুখস্থ করে যাবে। মিসেস নেহা আরিয়াকে শুধায়,
“হ্যাঁ রে, তোর বোনের কী অবস্থা? মেয়েটা সেখানে একা থাকে।”
আরিয়া আচাড় খেতে খেতেই জবাব দেয়,
“এখন আপু খুব ভালো আছে। শ্রাবণ ভাইয়ার সাথে সব স্বাভাবিক। আর বারো-তেরো দিন পর আব্বু, আম্মু, ভাইয়া, ভাবি সবাই যাবে। আমারও যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছি কই? পরীক্ষাটার জন্য পারছি না।”
“তোরই তো কিছুদিন পর পাঁচ মাস হবে। তুই কীভাবে যাবি?”
“এমনিই যেতাম। সবাই যেভাবে যায়!”
তখন আশিক তার খালামণির রুমে এসে বলে,
“খালামণি, তুমি ওর সাহস জানো না! সত্যি সত্যি সেমিস্টার ফাইনাল না থাকলে যেতে জেদ করতো!”
আশিক আসতে আসতে কথা কিছু শুনেছিল। আরিয়া মুখ ফুলিয়ে বলে,
“বেশি কথা বলো তুমি! যাও এসাইনমেন্ট করো!”
“হ্যাঁ তাই করি! শুকরিয়া করো যে সব এসাইনমেন্টের গ্রুপ আমি তোমার সাথে করেছি। নয়তো কীভাবে করতে?”
“কেন? তোমারগুলোও তুমি করতে, আমারগুলোও তুমি করতে। সিম্পল!”
“তা তো বুঝাই যাচ্ছে। ভাগ্যিস! পরীক্ষাগুলো তুমি নিজেই দিবে!”
আরিয়া এবার উঠে বসে নালিশ করার সুরে মিসেস নেহাকে বলল,
“দেখো, খালামণি, তোমার এই ছেলেকে কিছু বলো। একটু এসাইনমেন্টে আমার টপিকগুলোও সে করছে বলে প্রতিনিয়ত কথা শুনাচ্ছে। আমি যে তার বাচ্চাকে একা পেটে নিয়ে বেরাচ্ছি! আমি কি বলেছি, তুমিও অর্ধেক নাও?”
আরিয়ার কথা শুনে মিসেস নেহা, আশিক, মুশফিকা সবাই হেসে ওঠলো! আর আরিয়া রাগ করে দুইটা আচাড়ের বয়াম নিয়ে হনহনিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যাচ্ছে। পিছন থেকে আশিক বলতে বলতে আসছে,
“আস্তে হাঁটো! পড়ে যাবে তো। তোমার আচাড় কেউ খাবে না।”
আরিয়া তো শোনার পাত্রী নয়। সে রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। আশিক দরজা নক করে,
“আরে আমি এসাইনমেন্ট করছিলাম তো। দরজা খুলো।”
অতঃপর আরিয়া দরজা খুলে ল্যাপটপটা আশিকের হাতে ধরিয়ে আবার দরজা লাগিয়ে দিয়েছে! বেচারা আশিক হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে ল্যাপটপ নিয়ে সোফায় গিয়ে বসে।
________
নাহিদ এখন সিলেটে আছে। সে বাড়িতে খুব কম থাকে। সিলেটের বাবার কম্পানির ব্রাঞ্চে বেশি সময় দেয়। সেই সাথে নিজের শেয়ার করা কম্পানিতেও। তার ইটালি যাওয়াটাও কিছু কারণে পিছিয়েছে। ওদিকে ইরিনাও তার প্রস্তাবে রাজি হয়নি। তাই সে নতুন প্ল্যান করতে সময় নিচ্ছে। ইদানীং তার নিজেকে শান্ত রাখতে হাই ডো*জের মে*ডিসিন নিতে হচ্ছে। হাই ডো*জের ঘুমের ঔ*ষুধ নিয়েও তার ভালো ঘুম হয় না। তার কাছে মনে হয়, সে সবচেয়ে বড়ো ফেইলর। তার জিততে হবে। সবাই তাকে হারিয়ে দিচ্ছে।
চলবে ইন শা আল্লাহ,