শ্রাবণ যৌবন
-নাহিদ পারভেজ নয়ন
হুট করেই যেন বৃষ্টি টা শুরু হলো।
যদিও আষাঢ় মাস এ যে কোন সময় বৃষ্টি হতেই পারে!
তবে আমার খুবই বিরক্ত লাগলো,বৃষ্টিটা আরেক টু পরে আসলে কি এমন ক্ষতি হতো?
.
বৃষ্টির দোষ দিয়েও অবশ্য লাভ নেই,ছাতাটা আনলেই পারতাম।
সকালে রিমু অনেকবার বলেছিল যেন ছাতা নিয়ে বের হই, ইচ্ছা করেই নিইনি। ছাতা ফেলে আসার বদভ্যাস আছে আমার, এই ভয়েই বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ছাতা নিয়ে বের হইনা।আমার এই জীবনে কত ছাতা হারিয়েছি হিসেব নেই।
আগের বার তো রিমুর প্রিয় ছাতাটা অফিসে রেখে আসছিলাম!
অফিস ছিল বলেই পরে গিয়ে পেয়েছিলাম,অন্য কোথাও হলে সে ছাতার আশা বাদ দিতে হতো।
.
সকালে যখন বের হয়েছিলাম তখন আকাশে ভাল রোদ ছিল।
এজন্যই ছাতা নেয়ার আগ্রহ পাইনি!
আকাশ ভাল ছিল আধাঘন্টা আগেও তবে একটু আগে যখন বাস থেকে নামলাম তখন দেখলাম আকাশে মেঘ,বৃষ্টি বৃষ্টি হবে হবে ভাব।
চাইছিলাম কিছুক্ষন এমনি থাকুক,ততক্ষনে বাড়ি চলে যাবো!মিনিট দশেক এর হাঁটা পথ,দ্রুতই চলে যাবো!
কিন্তু আষাঢ় মাস বলে কথা,বাস স্টান্ডের পাশের আবাসিক এলাকায় ঢোকা মাত্রই ক্যাটস এন্ড ডগস শুরু হয়ে গেলো।
.
বৃষ্টির সময় এই আবাসিক এলাকা গুলোয় এই একটা সমস্যা কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা থাকেনা৷কোন গেটের সামনে দাঁড়ালে দাঁড়োয়ান রা বেশ উদ্ভট নজরে তাকায়। নিজে ভিজলেও সমস্যা ছিল না তবে সাথে ব্যাগ আছে তাতে অফিসের দরকারী ফাইল আছে,সেগুলো কোন ভাবে ভিজে গেলে বড় সমস্যায় পরতে হবে।
.
ঠিক সে সময় মনে হলো ডান দিকের গলির শেষে একটা ছোট চায়ের দোকান আছে।দুপুর বেলা নিশ্চয় ফাঁকাই থাকবে, ফাঁকা না থাকলে আরেক ঝামেলা হবে, এসব দোকানে ভীর করলে চা ওয়ালার মুখে অঙ্গভঙ্গি চেঞ্জ হয়। নিজের কারণে কেউ বিরক্ত হোক এটা কখনোই চাইনা।
.
নাহ, চায়ের দোকান পুরো ফাঁকাই।
চাওয়ালা দোকানের ভিতর লম্বা করে শুয়ে আছে। আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার সে আরাম করে চোখ বন্ধ করলো।
.
আমি মাথা টা মুছে বেঞ্চিতে বসলাম।এক কাপ চা চাইবো কিনা দ্বিধা দন্দে পড়লাম। চা চেয়ে এনার আরাম নষ্ট করার অধিকার আমার মোটেও নাই। আবার শুধু শুধু বসে থাকাও ব্যপার টা খারাপ দেখায়।
.
চা ওয়ালা বুঝতে পেরে নিজেই জিজ্ঞেস করলো,
-চা দিবো,
-হ্যাঁ,
-দুধ চা হবেনা!
-রং চাও চলবে!
-কড়া লিকার চলবে?
-হুম,সমস্যা নাই!
.
চা খুব একটা খাইনা। রিমুর চা খাওয়ার অভ্যাস আছে!
বাসায় থাকলে ও নিজের জন্য বানালে আমাকেও দিয়ে যায়।
সেই হিসেবে অভ্যাস না থাকলেও একেবারে কম খাওয়া হয়না।
চা এ চুমুক দিয়ে বেশ লাগলো,হয়ত বৃষ্টির কারণে।
ব্যপার টা খুচুড়ির মত, খিচুড়ির স্বাদ যেমন বৃষ্টির দিনে বেড়ে যায় ঠিক এই চায়ের স্বাদ টাও এই গরম আর বৃষ্টির কারণে বেড়ে গেছে।
.
তবে আমি চাচ্ছিলাম বৃষ্টি টা খুব দ্রুত কমুক, রিমু নিশ্চয় না খেয়ে বসে আছে।অনান্য দিন এক সাথে লাঞ্চ করা হয়না, সপ্তাহের এই দুটা দিনই শুধু লাঞ্চ করার জন্য পাওয়া যায়। বৃষ্টির কারণে তাতে বাঁধা আসুক মোটেও চাইনা।
.
চা খেতে গিয়ে বিল্ডিং গুলোর দিকে চোখ পরে যায়,যদিও প্রতিদিনই এসব দেখি আলাদা কিছু নেই।
এই এড়িয়ার বেশির ভাগ মানুষ নিঃসন্দেহে বড়লোক। এখান কার সব গুলো ফ্লাটই ডুপ্লেক্স। এখানকার একটা ফ্লাট কিনতে পারলে বেশ হতো৷ তবে রিমুর এসবে আগ্রহ নাই, ওর প্রয়াজন ছাদ ওয়ালা বাসা। যেন নিজের মত করে সে ছাদ ব্যবহার করা যায়৷ এই জন্যই অনেক কষ্টে একটা পুরাতন বাসা খুঁজে পেয়েছি৷ যদিও আমরা একা না, বাড়িওয়ালা চাচা নিচেই থাকে ওনার ওয়াইফ সহ।ওনার ছেলে থাকে বিদেশে, এ কারণে বলা যায় ছাদ টা পুরোটাই আমরাই ব্যবহার করতে পারি৷ আর সব চাইতে ভাল ব্যপার আশে পাশে তেমন বিল্ডিং ও নেই ছাদে যা ইচ্ছা তা করা যায়। একদিন তো, থাক সেসব কথা।
.
দোকানের ছেলেটা একনাগাড়ে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে,চোখের পাতাই ফেলছেনা। ছেলেটার বয়স কত হবে?
আমার থেকে কিছু কম।কি দেখতে তা জানার উদ্দেশ্য আমিও মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম পিছনের দিকে,পেছনের বিল্ডিং এর তিন তলায় একটা কম বয়সী মেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে আর হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দিচ্ছে৷
দেখেই বোঝা যাছে বেশ সুন্দরী মেয়েটা!
মেয়েটা হেসে হেসে কথা বলছে!
মেয়েটা কার সাথে কথা বলছে?
নিশ্চয় পছন্দের মানুষের সাথে।
কি বলছে?
হয়ত বলছে, দুজন একসাথে থাকলে বৃষ্টি বিলাস করতো।
এসব আইডিয়া করা সোজা,বৃষ্টির দিন প্রেমিক প্রেমিকারা এসবই বলে।প্রেমিক প্রেমিকাদের জীবন চলে ধরা বাঁধা নিয়মে।
.
রিমুও একসময় আমাকে বলতো তবে আমি রোমান্টিজম এর ধারের কাছেও থাকতাম না, আমি ওকে বলতাম বিয়ের পর এমন বৃষ্টি হলে ডিম আর খিঁচুরি রাঁধবা একসাথে খাবো৷
ইলিশ খিঁচুরি খাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও বলা হতোনা,ইলিশের প্রচুর দাম।
.
এই ছাদ ওয়ালা বাসা নেওয়ার অন্যতম একটা কারণ ছিল এক সাথে যেন বৃষ্টিতে ভেজা যায়৷ আমার তো আগে লজ্জা লাগতো আশেপাশের মানুষ দেখলে কি বলবে?
রিমু বলতো,মানুষের এত সময় নাই যে আমাদের দেখবে৷ বিয়ের পর এসব লজ্জা কেঁটে গেছে,লজ্জা করলে অনেক কিছুই মিস করতে হবে বুঝে গেছিলাম। বিয়ের পর প্রথম প্রথম প্রায় ছাদে উঠতাম দুজনে এখন আর হয়না তেমন৷ হয়ত বা ব্যাস্ততা আর রিদ্য হওয়ার পরে রিমুর মাঝে আর এসব রোমান্টিজম দেখা যায়না।
.
মেয়েটা র দিকে কতক্ষন তাকিয়ে আছি খেয়াল নেই৷ মেয়েটা যখন আমাদের দিকে তাকালো তখনি চোখ সরিয়ে নিলাম। মেয়েটা মনে হয় লজ্জা পেয়েছে,মেয়েটা দ্রুত ভেতরে চলে গেলো।আমার ভেতরে একটু অপরাধবোধ সৃষ্টি হলো,মেয়েটা কি ভাবলো কে জানে?
খানিক ক্ষন বাদে মেয়েটা আবার ফিরে এলো,এবার আর হাতে ফোন নেই। আমি আর তাকালাম না,তবে দোকানের ছেলেটা তাকিয়ে রইলো।
.
বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে দেখে আমি আর দেরী না করে চায়ের বিল দিয়ে উঠে পরলাম। ফোন বের করে রিমু কে কল করলাম,
-হ্যালো রি,কি করছো?
-কোথায় তুমি? না খেয়ে বসে আছি।
-রিদ্য খেয়েছে?
-হুম, ও সারাদিনই খায়।
-আমি চলে আসছি প্রায়।
-কোথায়?
-এইতো বৃষ্টির কারণে আটকা পরছি!রাতে খিঁচুড়ি খাবো, পোলার চাল আছে ঘরে?
-আছে,দুটা ডিম নিয়ে এসো তাহলে।
-আচ্ছা, শোন,
-কি?
-তোমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করছে?
-হঠাৎ করে?
-ইচ্ছা হতে পারেনা?
-পারে,
-আর আমি তোমাকে ভালবাসি!
-এত প্রেম কোথেকে আসছে?
-বৃষ্টি দেখে,
-বৃষ্টি দেখে?
-জি,বৃষ্টি অনেক কিছু মনে করিয়ে দেয়!
-তাহলে তো রোজ বৃষ্টি হোক এটাই চাইবো!
-হ্যাঁ, তা চাইতে পারো!
একটু অপেক্ষা করো, আমি ডিম নিয়ে আসছি।
-আসো!
.
ফোন রেখে আকাশের দিকে তাকালাম। রিমুও আমার কাছে আকাশের মত,হয়ত তার চেয়েও বেশি কিছু। আকাশ যেমন পৃথিবীকে সব দিয়ে যায়। বৃষ্টি,রোদ,চাঁদ,জোছনা আর বিশালতা।
তেমন রিমুও কম দেয়নি আমাকে, তার কাছে আমি সব পেয়েছি।দেয়ার বেলায় তাকে দেইনি কিছুই।
প্রকাশ করিনি কৃতজ্ঞতাও৷
বাসায় ফেরার পর বৃষ্টি হলে ওকে ছাদে নিয়ে গিয়ে বলে দিবো,
-রিমু তুমি আমার কাছে আকাশের মতোন। তার চেয়েও হয়ত বেশি কিছু!