#শ্রাবণ_দিনের_বৃষ্টিতে 🖤
#পার্ট_৫
#Writer_Liza_moni
আয়রা মায়ের রুম থেকে বের হয়ে আসার সময় চোখ পড়লো সেখানের টেবিলের উপর রাখা মোবাইলের দিকে।আলো জ্বলছে। আয়রার ভ্রু কুঁচকে গেল।সেদিকে এগিয়ে গিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে চার্জ হচ্ছে। আয়রার চোখ কপালে। কারেন্ট নাই অথচ মোবাইলে চার্জ হচ্ছে?
আয়রার হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল তখন প্রান্ত কলিং বেল বাজিয়ে ছিল। কারেন্ট ছাড়া তো আর কলিং বেল বাজবে না।
আয়রা এই সব ভাবছিল আর সেই সময় লাইট জ্বলে উঠলো। আয়রা চার দিকে চোখ বুলিয়ে দেখলো। মোবাইলটা রেখে টেবিলের উপর রেখে আয়রা মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।
ড্রইং রুমে আসতেই আবার কলিং বেল বেজে উঠলো। আয়রা গিয়ে দরজা খুলে দিল।মা আর হিতৈষী দাঁড়িয়ে আছে। হিতৈষী প্রায় ভিজে গেছে বৃষ্টিতে।
হিতৈষী আর মাকে দেখে আয়রা অভিমানী কন্ঠে বললো,,
আমাকে একলা ফেলে কোথায় চলে গেছিলা তোমরা?
হিতৈষী কিছু বললো না। রুমে চলে গেল।
মা সোফায় এসে বসলেন।লাইট গুলোর লাইনে একটু সমস্যা হচ্ছিল।মিটারে আর বোর্ডে কারেন্ট থাকলে ও লাইটের লাইনে ছিল না।
ওহহ,, হিতৈষী আপু ঠিক করছে নাকি?
হুম।ও তো এই সব বিষয়ে অনেক অভিজ্ঞ।
আয়রা গিয়ে মায়ের পাশে বসলো। হিতৈষী আপু টা আমার অনেক কিছু জানে।
তোর মতো মাথা মোটা নাকি আমার হিতৈষী?
আয়রা আর কিছু বললো না। এখন যে হিতৈষীর গুনগান শুনতে হবে তা খুব ভালো করেই জানে আয়রা।
.
.
প্রান্ত ড্রইং রুমে কথার আওয়াজ পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।এত সময় সে ইচ্ছে করেই রুম থেকে বের হয়নি।
ড্রইং রুমে এসে আয়রার মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,,
আন্টি আয়রা পিচ্চি কে বাড়িতে একা ফেলে কোথায় গেছিলেন?
আর বইলো না বাবা। পাহাড়ি এলাকার সব কিছু
একটু গোল মেলে। কারেন্টের লাইনে সমস্যা হইছিলো।
ওহ ঠিক করলো কে?
হিতৈষী।
প্রান্ত অবাক হলো ভীষণ।মানে সিরিয়াসলি আন্টি?
সত্যি। হিতৈষী ঠিক করছে। আমার মেয়ে হিতৈষীর সব কিছু সম্পর্কে জানার আগ্রহ অনেক বেশি।পুরো পুরি না পারলে ও অল্প কিছু তাকে পারতেই হবে।
আমার দুই মেয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। হিতৈষী যেমন দেখতে মিষ্টি।ঠিক তেমনি কাজে ও।
আর আয়রা,,ও তো নাম্বার ওয়ান অলস,ঘ্যাড়তেড়া , রাগী,জেদি। দেখতেই মাশাআল্লাহ।আর কাজে নাউযুবিল্লাহ।
আয়রা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মায়ের দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে বললো,,
দিলো তো ক্রাশের সামনে আমার বদনাম করে। ক্রাশের সামনে এই সব কথা না বললেই যেনো পেটের ভাত হজম হয়না । আমার মা দুনিয়ায় এক পিস।
আয়রা আর দাঁড়ালো না সেখানে। রুমে চলে আসলো।আর কিছুক্ষণ দাঁড়ালে মা তার সব হিস্ট্রি ক্রাশের সামনে ফাঁস করে দিতো।
আয়রা কে চলে যেতে দেখে প্রান্ত হাসলো। না আন্টি আপনি ভুল বলছেন কিছুটা। আয়রা পিচ্চি কিন্তু অনেক সুন্দর আর্ট করতে পারে।
মেয়ে আমার শুধু এটাই জানে ভালো।আর কিছু তাকে দিয়ে হবে না।
.
হিতৈষী রুমে এসে ড্রেস চেঞ্জ করে নিল। ভালো লাগছে না কিছুই। বুকের ভেতর কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। এমন মনে হচ্ছে যেনো কিছু একটা হারিয়ে ফেলবে সে। কোনো কিছুতেই শান্তি লাগছে না তার।
আয়রা পড়ার টেবিলে বসে কলম কামড়াচ্ছে।বীজ গনিতের ব ও মাথায় ঢুকে না তার। সূত্র মুখস্থ করে ঠিক কিন্তু কয়েক দিন পর সেটা খেয়ে ফেলে।
আগামীকাল ক্লাস টেস্ট আছে।কী যে হবে আল্লাহ জানেন।
আয়রার একটা সরল অঙ্ক কিছুতেই মিলছে না।পড়ার টেবিলে বসে আয়রা গনিত যে তৈরি করেছে তাকে ইচ্ছে মতো বকলো কিছুক্ষণ।কি প্যাচ ছিল ঐ লোকের মাথায়।জিলিপির প্যাচ থেকে ও বেশী।মরছে তো মরছে আমাদের কত গুলো প্যাচ কষতে দিয়ে গেছে। শালা বুইড়া দাদু।
আয়রা একটা খাতা আর কলম নিয়ে হিতৈষীর রুমে চলে গেল। অনার্স ২ বর্ষে পড়ে হিতৈষী।ম্যাথ নিয়ে।
বলতে গেলে হিতৈষী আয়রার গনিতের টিচার।
আয়রা হিতৈষীর রুমের সামনে গিয়ে দেখলো ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। আয়রার ভ্রু কুঁচকে গেল নিজ থেকেই।
এমন কখনো হয়নি। হঠাৎ করে হিতৈষী রুমের দরজা বন্ধ করে রাখলো কেন?
আয়রা দরজায় টোকা দিলো কয়েক বার। হিতৈষী তখন শুয়ে ছিল। চোখের কোনা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার। ভাঙ্গা গলায় বললো,,
আয়রা বোনু আমার এখন ভালো লাগছে না।পরে আসিস।
আয়রা শুনে ও পাত্তা দিলো না হিতৈষীর কথা। হিতৈষী কান্না করছে তা খুব ভালো করেই জানা হয়ে গেছে আয়রার।আজ ৬ বছর ধরে দেখছে সে হিতৈষীকে। নিজের বোন ছাড়া অন্য কিছু ভাবে না সে হিতৈষীকে।
দরজা খুল।অঙ্কটা বুঝতে পারছি না।বুঝাই দে। আগামীকাল ক্লাস টেস্ট আছে।
হিতৈষী বুঝলো দরজা না খোলা অব্দি আয়রা এখান থেকে যাবে না। শোয়া থেকে উঠে চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে দরজা খুলে দিল। আয়রা আঙ্গুল দিয়ে কলম ঘুরাতে ঘুরাতে রুমে ঢুকে বললো দরজা বন্ধ করে দে।
হিতৈষী দরজা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় বসলো। আয়রা বিছানায় শুয়ে পড়লো।হিতৈষীর দিকে তাকিয়ে বললো,,
কী হয়েছে তোর ?আমাকে বল,,
না কিছু হয়নি তো।কী হবে?
আয়রা শোয়া থেকে উঠে বসলো।হিতৈষীর এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,,
শুন আপু,,
আমি তোর নিজের বোন না। তোর ধর্মের ও না। ভাগ্যের এক অদ্ভুত পরিবর্তনের ফলে তুই আজ আমাদের বাড়িতে থাকিস। আমার মাকে মামুনি বলিস। আমার বাবাকে বাবাই বলিস। আমাকে নিজের ছোট বোনের মত ভালোবাসিস।আজ এত গুলো দিন আমরা এক সাথে থাকছি।আর আমরা বুঝতে পারবো না যে তুই ভালো নেই?
হিতৈষী আয়রাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলো। আমার সাথেই কেন এমন হয় বলতো আয়রু?মা,বাবাকে হারিয়ে, এতিম হয়েছি।যে মানুষটাকে এত ভালোবাসি সেই মানুষটার কিছু দিন পর অন্য কোথাও বিয়ে করে ফেলবে। কেন আমার আপন মানুষ গুলো আমার কাছ থেকে হারিয়ে যায় বলনা ?
আয়রা হিতৈষীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,,দিপ্ত ভাইয়া তার পরিবার কে তোর কথা জানায়নি?
হিতৈষী আয়রাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসলো। চোখের পানি মুছে বললো,, জানিয়েছে।
কী বলেছে তার পরিবার?
আমি এতিম। আমার কোনো পরিচয় নেই। আমি হিন্দু হয়ে মুসলিম পরিবারে থাকি।
তাতে কী হয়েছে?এই সব কিছুর আগে হলো আমরা সবাই মানুষ। তুই আমাদের ধর্মের না।এর জন্য কী আমরা তোকে পর ভেবেছি কোনো দিন?আর কে বলছে তুই এতিম? আমার মা বাবা কী তোকে তাদের মেয়ের মতো ভালোবাসে না?
আমি তো এই সব বলিনি আয়রা। দীপ্তর মা বলেছে ।
আয়রা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হিতৈষী যেদিন এই বাড়িতে এসেছিল সেদিন ও শ্রাবণ দিনের বৃষ্টি ছিল।
আয়রার বড় বোন আয়জা কে দাফন করে বাড়ি ফেরার সময় অসহায় হিতৈষীকে রাস্তার ধারে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ছিলেন আয়রার আব্বু আফজাল সাহেব।বড় মেয়ের মৃত্যুতে একদম ভেঙ্গে পড়েছিলেন আয়রার মা, বাবা।
হিতৈষী কে নিজেদের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন তারা।কখনো হিতৈষী কে জোর করেনি নিজের ধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য। হিতৈষী কে শুধু বলে ছিলেন চাইলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে পারো।আর না চাইলে আমাদের মুসলমানদের বাড়িতে মূর্তি পূজা করা যাবে না। মন্দিরে গিয়ে পূজা করতে হবে।
সেদিন আর হিতৈষী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি। তার নিজ ধর্ম নিয়েই আছে সে।
.
.
জানিস হিতৈষী আপু,,
তোর মধ্যে মাঝে মাঝে আমি আমার আয়জা আপুকে দেখতে পাই।কী অদ্ভুত তাই না,, আমার আয়জা আপু যে দিন আমাদের ছেড়ে চলে গেল ঠিক সেই দিন তুই আমাদের পরিবারে আয়জা আপু হয়ে আসিস।
হিতৈষী চোখের পানি মুছলো। অনেক বছর যাবত তার জানা হয়নি। আয়জা কী করে মারা গেছে?আজ আয়রা থেকে সেটা জেনে নেওয়া যাবে।
আচ্ছা আয়রা তোর আয়জা আপু কী করে মারা গিয়েছিল?
আয়রা হিতৈষীর দিকে তাকালো। কিছু বললো না।আজ বহু দিন পর আয়জা কে খুব মিস করছে আয়রা।
.
.
বৃষ্টি রীতিমতো এখন বিরক্ত লাগছে প্রান্তর।পড়ছে তো পড়ছেই।থামা থামির নাম নেই। পাহাড়ি এলাকায় বৃষ্টির দিনে নেটওয়ার্কে খুব সমস্যা করে। বাড়িতে ভিডিও কলে শান্তি তে একটু কথা ও বলতে পারছে না সে।মা,বাবা, ছোট ভাই,আর বোনকে খুব মিস করছে। আগামীকাল সকাল থেকে কাজ শুরু তার।
কাজ শেষ হবে কখন আর বাড়িতে যাবে কখন সেটা নিয়েই ভাবছে সে। খুব চুপচাপ স্বভাবের হওয়ার ফলে কারো সাথে ঠিক বনছে না তার।সম বয়সী কোনো ছেলে থাকলে ও হতো।
.
.
চলবে,,,, 🍁