#শ্রাবণ_দিনের_বৃষ্টিতে
#পার্ট_১০
#Writer_Liza_moni
আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে দীপ্ত। হাসপাতালের করিডোরে মরা কান্না কাঁদছে দীপ্তর মা। দীপ্তর মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে দীপ্তর হবু বউ জয়শ্রী।
মর্গের কোনো এক বেডে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে হিতৈষী। দীপ্তর ভাই দীপু আয়রাকে ফোন করে জানাল সবটা।রাত প্রায় নয়টার কাছাকাছি। অনেক সময় হয়ে যাওয়ার পর ও যখন দীপ্ত বাড়ি ফিরে আসেনি তখন দীপু তার ফ্রেন্ডদের কে নিয়ে হিতৈষীদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।মাঝ রাস্তায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত দীপ্ত আর হিতৈষী কে দেখে আপনা আপনি চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো।
আয়রার কানে যখন গিয়েছিল কথাটা যে হিতৈষী আর দীপ্তর খুব খারাপ ভাবে এক্সিডেন্ট হয়। আয়রার হাত থেকে মোবাইল পড়ে যায়।
আয়রা, আয়রার মা আর প্রান্ত কে নিয়ে হসপিটালে আসে। আয়রার মা পাগলের মতো দীপুর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,,
আমার মেয়ে কোথায়? আমার হিতৈষী কোথায় ? আমার হিতৈষী ঠিক আছে তো?
দীপু চুপ করে রইলো।
কী হলো দীপু দা। আপনি চুপ করে আছেন কেন? আমার আপু কোথায়? দীপ্ত দা কোথায়?
দীপ্ত দা আইসিইউতে।আর হিতৈষী দি,,,
হিতৈষী দি,,কী দীপু দা,,?
হিতৈষী দি আর আমাদের মাঝে নেই আয়রা।
আয়রার মায়ের বুকের উপর যেনো কেউ পাথর দিয়ে চাপা দিয়েছে। তিনি শ্বাস নিতে ভুলে গেছেন।
আয়রা কয়েক পা পিছিয়ে গেল।প্রান্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।কী শুনলো সে?
প্রথম দেখায় যে মেয়েটাকে তার ভালো লেগে গিয়েছিল। সেই মেয়েটা কিনা আর এই পৃথিবীতে নেই।
আয়রার মা আয়রার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,,,
এই ছেলে মিথ্যা কথা বলছে তাই না। আমার হিতুর কিচ্ছু হয়নি। আমার হিতু ঠিক আছে। আমার হিতৈষী কখনো আমাদের ছেড়ে যেতে পারে না।
আয়রা মাকে বুকের মাঝে আগলে ধরলো। কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না সে। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে।
আইসিইউ থেকে ডাক্তার বের হয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললো,,
আই এম সরি। পেশেন্ট কে আমরা অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারিনি।
মুহূর্তের মধ্যে সবাই কান্নায় ভেঙে পড়ে। দীপ্ত কে নিয়ে গিয়ে হিতৈষীর পাশে রাখা হয়। দুই জন খুব শান্তিতে ঘুমাচ্ছে।তারা কত লাকি। প্রিয়জন হারিয়ে জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে দুই জন একসাথে সত্যি সত্যি লাশ হয়ে গেল।উপরে গিয়ে নিজেদের মতো থাকবে তারা। তাদের কে আর কেউ চাইলে ও আলাদা করতে পারবে না।
হিতৈষীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আয়রা। হিতৈষীর লাশ দেখে জ্ঞান হারায় আয়রার মা।প্রান্ত দীপ্ত আর হিতৈষীর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,, কয়জনের ভাগ্যে জোটে ভালোবাসার মানুষটার সাথে এক সাথে মরার?
অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর।কথাটা যেনো আয়রার সাথে মিলে গেছে। কাঁপা কাঁপা হাতে হিতৈষীর মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে মিনমিনে গলায় বললো,,,
এত স্বার্থপর কেন রে তুই আপু?আমরা তোকে কতটা ভালোবাসি তুই জানতি না? আমাদের ছেড়ে যেতে তোর একটুও কী কষ্ট হয়নি? তুই এত পর ভাবতি আমাদের?এত তাড়াতাড়ি কেন চলে গেলি আমাদের ছেড়ে?আজ আবার আয়জা আপুর মৃত্যুর কথা মনে পড়ে গেল। আমার মা যে মরে যাবে হিতৈষী আপু। আমার মা যে তোকে খুব ভালোবাসে।উঠ না আপু।এই আপু উঠ না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি এখন কার সাথে ঝগড়া করবো?এই হিতৈষীর আপু উঠনা?বোন উঠনা। তোর কিচ্ছু হয়নি। তুই একদম ঠিক আছিস। তুই এত তাড়াতাড়ি মরতে পারিস না।
বলতে বলতে হিতৈষীর লাশকে বুকের মাঝে জড়িয়ে
ধরে চিৎকার করে কান্না করে দিল আয়রা।
দীপ্তর মা বলে উঠলো,,
আমার দোষ।সব দোষ আমার। আমি যদি ওদের সম্পর্ক মেনে নিতাম তাহলে আজ আর আমাকে আমার ছেলে হারাতে হতো না। আমার দীপ্ত সোনা উঠ না বাবা। আমি তোদের সম্পর্কে আর বাঁধা দিবো না। আমি দিব্বি ফিরিয়ে নিলাম।
আয়রা হিতৈষীকে শুয়ে দিয়ে দীপ্তর মাকে বললো,,
এখন কেন সম্পর্ক মেনে নিবেন? এখন কেন দিব্বি তুলে নিচ্ছেন? আমার বোন তো এতিম তাই না?আমরা ওর কিছু না।ওরা আর ফিরে আসবে না দেখে এখন নাটক করছেন আপনি? আপনি হ্যাঁ আপনি আমার বোনকে মেরে ফেলেছেন।যদি না আপনি দীপ্ত দার সাথে অন্য কারো বিয়ে ঠিক করতেন তাহলে আজ শেষ বারের মতো তাড়া দেখা করতে যেতো না।আর না আমার বোনটা,,,,,
আয়রা কান্না করে দিল।
.
.
চিটাগাং থেকে ফিরে এসে যে হিতৈষীর মরা মুখ দেখতে হবে তা ভুলেও কল্পনা করননি আয়রার বাবা।
আয়রার বাবাকে দেখে আয়রার মা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,, আমার আয়জার মতো আমার হিতৈষী ও চলে গেলো। আমার কলিজা টা ছিঁড়ে যাচ্ছে।
ড্রইং রুমের ফ্লোরে শুইয়ে রাখা হয়েছে হিতৈষীর লাশ।ঘর ভর্তি মানুষ। হিতৈষীর পাশে পাথরের মত শক্ত হয়ে বসে আছে আয়রা। সোফায় মাথায় হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে প্রান্ত। এখন সকাল ৬টা বাজে।এত সকালে ও অনেক মানুষ এসে ভীড় জমিয়েছে আয়রাদের বাড়িতে।
আয়রার চোখ থেকে এক ফোঁটা ও পানি পড়ছে না। কেমন চুপ হয়ে গেছে।সব কিছু শান্ত চোখে দেখছে।
আয়রার বাবা কাঁপা কাঁপা পায়ে হেঁটে এসে হিতৈষীর পাশে এসে বসলো। চিটাগাং যাওয়ার সময় হিতৈষী আবদার করেছিল।তার জন্য যে সুন্দর দেখে পায়েল নিয়ে আসে।বাবা পকেট থেকে দুই জোড়া পায়েল বের করলেন।এক জোড়া রেখে আরেক জোড়া খুব যত্ন করে হিতৈষীর পায়ে পড়িয়ে দিলেন।
মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে। পরিবারের সবাই যেনো পাথর হয়ে গেছে। হিতৈষী যে এত তাড়াতাড়ি তাদের ছেড়ে তার নিজের মা বাবার কাছে চলে যাবে তা ভাবতে ও পারেননি তারা।
আজ আবারো সেই পুরনো ক্ষত তাজা হলো। আজ আয়জার মৃত্যু বার্ষিকী ছিল।আর আজই হিতৈষীকে চির বিদায় দিতে হবে।
.
.
বাইরে ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। মেঘের গর্জনে চার পাশ মুখরিত। আয়রার গাছের ফুল গুলো কেমন সতেজতা হারিয়ে নুয়ে পড়ছে।
আয়রার বাবা কিছু মুরব্বির সাথে কথা বলছেন। হিতৈষী কে কবর দেওয়া হবে নাকি দাহ করা হবে?
একজন মুরব্বি বলে উঠলো,,
মেয়েটা যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি তখন তাকে কবর দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।ওকে ওর ধর্মের নিয়ম মোতাবেক দাহ করা উচিত।
হ্যাঁ ঠিক বলেছেন।যদি মেয়েটা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতো তাহলে অবশ্যই তাকে দাফন করা হতো।
সবার যুক্তি শুনে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে বৃষ্টি থামলে হিতৈষী কে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে। এবং তাকে দাহ করা হবে।
আয়রার মা এই পর্যন্ত চার বার জ্ঞান হারিয়েছে।ডাক্তার এনে তাকে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দেওয়া হয়েছে। না হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। অতিরিক্ত শোক সহ্য করতে না পেরে তিনি স্টোর্ক ও করতে পারেন।
.
.
বেলা প্রায় ১১টা।এখনো বৃষ্টি থামার নাম নেই। আকাশ ও যেনো কান্না করছে। প্রকৃতি যেনো হাসছে।চার দিকে সতেজতা বিরাজ করছে। হিতৈষীকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি করা হয়ে গেছে। এখন শুধু বৃষ্টি থামার অপেক্ষা।
আয়রার কেন জানি মনে হচ্ছে,,
হিতৈষী আর দীপ্ত হাসছে খুব।তারা যেনো অনেক খুশি।
হিতৈষী কে এখন আর কেউ এতিম বলার সাহস পাবে না।কারন সে এখন তার পরিবারের কাছে চলে গেছে। এখন আর সে এতিম না।কারো আশ্রয়ে আর তাকে থাকতে হবে না।
প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয়। হিতৈষী কে নিয়ে যাওয়ার সময় আয়রা হিতৈষীর লাশ বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠে। আয়রার মাকে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে ঘুম পারিয়ে রাখার ফলে তিনি শেষ বারের মত আর হিতৈষী কে দেখতে পায়নি।
.
.
রাত অনেক হয়েছে। আয়রা নিজেকে রুমের মধ্যে বন্ধি করে রেখেছে। কিছু ভালো লাগছে না তার। হিতৈষীর কথা মনে পড়লেই চোখ থেকে আপনা আপনি পানি গড়িয়ে পড়ছে।
জন্ম যখন নিয়েছো।মরতে তো এক দিন হবেই।
এই তো বছর ছয় এক আগেই এলি
বর্ষার মাঝে,,,
আবার চলেও গেলি
শ্রাবণ দিনের বৃষ্টিতে,,,,
পরপারে ভালো থাকিস তোর পরিবারের সাথে। দীপ্ত দার সাথে।ভালো থাকিস পোড়া মুখী।হত ভাগী। স্বার্থপর হিতৈষী।
চলবে,,,, 🍁