শ্রাবণ ঝরা মেঘ পর্ব-২৭+২৮

0
497

#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [২৭]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

মৌরির ঘরের জানালা খোলা থাকলেও কোন লাভ হলো না। এত উঁচুতে উঠার মতো হাতের কাছে কিছুই পেলো না। উপায় না পেয়ে তাশফিন মৌরির নাম ধরে জোরে জোরে ডাকছে। বিরক্ত মৌরি কতক্ষণ কোন পাত্তা না দিলেও শেষে জানালা লাগিয়ে দিলো। তাশফিন এটাই ভেবে পাচ্ছে না এতদিন মৌরিকে তাড়িয়ে দিয়েও আসতে চায়নি। এখন তো তাদের মাঝে সব ঠিক হয়ে গেছে। ওরা বিয়েও করতো। তাহলে মৌরি কেন চলে এসেছে। তাশফিন মৌরিকে ছাড়া বাড়ি ফিরলে পিহু নানান প্রশ্ন করতে লাগল। যে প্রশ্নের উত্তর গুলো তাশফিনের কাছেও নেই। ভাইয়ের থেকে কিছু জানতে না পেরে পিহু মাহিমকে কল করলো।

-ভাইয়া তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিল পরে কী হয়েছে বলো তো। ভাবীই বা এলো না কেন? ভাইয়া একা ফিরেছে।

মাহিম সত্যটা এখন পিহুকে বলতে পারলো না। মৌরি একেবারে চলে এসেছে। আর কোনদিন ওই বাড়িতে যাবে না।

-ভাবী কবে আসবে?

-চলে আসবে।

-চলে আসবে তো বুঝেছি। কবে চলে আসবে সেটা বলো।

-বাবার বাড়ি এসেছে। কয়েকটা দিন তো থাকতে দিবে।

-না থাকতে দিব না। কারণ ভাবী বাড়িতে না থাকলে আমার ভাইয়ের চেহারায় অমাবস্যার অন্ধকার নেমে আসে। বউকে এত ভালোবাসে কী বলব!

মাহিম নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মৌরির মতো সোজা মানুষ একবার বেঁকে বসলে তাকে মানানো সহজ হবে না। তাশফিন কোন পর্যন্ত পারবে কে জানে।


মৌরির হঠাৎ চলে যাওয়াটা আরিয়ানের কাছে খটকা লেগেছে। তাশফিনের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে গণ্ডগোল তো কিছু হয়েছে। কী হয়েছে তা জানতে আরিয়ানের কষ্ট করতে হবে না। ফাইজাকে জিজ্ঞেস করলেই ভেতরের কথা জেনে ফেলা যাবে। কিন্তু ফাইজাও আজ ঠিকঠাক মতো আরিয়ানের সাথে কথা বলছে না। ওকে দেখেই চেতে যাচ্ছে। সে আবার কী ভুল করলো।
আরিয়ান ফাইজার হাত ধরলে ফাইজা রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,

-হাত ছাড়ুন।

আরিয়ান তাড়াহুড়ো করে হাত ছেড়ে দিল। বেচারা অসহায় মুখ বানিয়ে বলল,

-আমার দোষটা কী তা তো বলবে? আজ আবার কোন কারণে রাগ করেছ?

-দোষ আপনার ভাইয়ের। আপনি জানেন মৌরি আপু আপনার ভাইকে ছেড়ে চলে এসেছে।

ধাক্কাটা আরিয়ানেরও খুব ভালো করেই লাগলো। কয়েক মুহূর্ত সে কোন কথা বলতে পারলো না।

-মৌরি সত্যি সত্যি চলে গেছে?

ফাইজা ব্যাঙ্গ করে বলল,

-না মিথ্যা মিথ্যা গেছে। আপু চলে এলে আপনার কি মনে হয় আমার পরিবার ওই বাড়িতে আমার বিয়ে দিবে?

তাশফিন জঙ্গলির সংসার ভাঙলে আরিয়ান খুশিই হতো। কিন্তু এখন তো তাশফিনের সংসারের উপর তার ভবিষ্যত সংসার নির্ভর করছে দেখা যাচ্ছে। আরিয়ানের নিজের গালে চড়াতে ইচ্ছে করছে।

-মৌরি তাশফিনের সাথে থাকবে না। এতে আমার দোষটা কি? এটা ওদের দু’জনের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। ওদের জন্য আমাদের ভালোবাসা কেন সংকটে?

শত্রুর দুঃখে যে আরিয়ান খুশি হবে এই উপায়টাও রইল না। সে রেগেমেগে বাড়ি ফিরে এলো। এসেই তাশফিনকে খুঁজে ওর কলার চেপে ধরলো। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

-তোর সমস্যা কী? কেন ভালো মানুষ হয়ে দুনিয়ায় এলি না। যেদিকে যাস একটা না একটা ঝামেলা বাধিয়েই ছাড়বি। মৌরি কেন চলে গেছে? ওকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করছিস না কেন?

এবার নিয়ে আরিয়ান দ্বিতীয় বার তার কলার ধরেছে। তাশফিনের রেগে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু রাগের বদলে সে কৌতূহল বোধ করল। ঠান্ডা মাথায় জানতে চাইল,

-এবার কেন কলার ধরেছিস? এখন আবার আমি কী করেছি?

-কী করেছিস জানিস না? মৌরি নাকি তোকে ছেড়ে চলে গেছে!

-হুম গেছে। তারপর।

-তারপর তোর মাথা। মৌরি যদি তোকে ডিভোর্স দেয় তাহলে কি ফাইজা আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে? নাকি ওর পরিবারই মানবে।

তাশফিনেরও এখন দুঃখের দিন চলছে। তবুও সে হাসি আটকাতে পারলো না। ওকে হাসতে দেখে আরিয়ান আরও রেগে গেল। তাশফিন কলার থেকে আরিয়ানের হাত ছাড়িয়ে বলল,

-মৌরি আমার সাথে সুখে শান্তিতে থাকলেই তোর বিয়ে, সংসার, বউ বাচ্চা টিকে যাবে নাকি? তাহলে তোর এখন দায়িত্ব দাঁড়ায় মৌরিকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে আমাকে সাহায্য করা।

আরিয়ান মরে গেলেও তাশফিনকে সাহায্য করবে না। কিন্তু সাহায্য না করলে তার অবস্থাও তাশফিনের মতোই হয়ে যাবে। তাশফিন বলল,

-মৌরি তো তোর বন্ধু। এখন তোর প্রথম কাজ মৌরির সাথে যেভাবেই হোক আমার দেখা করিয়ে দেওয়া।

-আমি কীভাবে দেখা করাবো?

-তুই ওকে তোর সাথে দেখা করতে বল। কিন্তু তোর জায়গায় সেখানে আমি যাব।

-মরার আগ মুহূর্তেও তোকে সাহায্য করতাম না, যদি না ফাইজাকে সত্যিকারে ভালোবেসে ফেলতাম।

-এটাই ভালোবাসা রে পাগলা। নইলে তোর কাছে সাহায্য চাওয়ার চেয়ে আমি দশ তলা বিল্ডিং থেকে ঝাপ দেওয়া পছন্দ করতাম।


না চাইতেও আরিয়ানের তাশফিনকে সাহায্য করতে হচ্ছে। যদিও জানে এতে বিশেষ লাভ হবে না। মৌরি তার সাথেও দেখা করতে চাচ্ছিল না। আরিয়ান বন্ধুত্বের দোহাই টোহাই দিয়ে রাজি করিয়েছে। আরিয়ান তাশফিনকে হুশিয়ার করে বলে দিয়েছে,

-নিজের ভালোবাসার খাতিরে শুধু তোকে সাহায্য করেছি। কিন্তু এটুকুই শেষ। আমার থেকে এর বেশি আশা রাখিস না।

তাশফিন কিছু বললো না। হাসলো শুধু। আরিয়ান মৌরিকে ওই রেস্টুরেন্টেই আসতে বলেছে যেখানে তাশফিন আর মৌরির প্রথম দেখা হয়েছিল। এটাকেই কি কো-ইন্সিডেন্ট বলে! তাশফিন গাধাটাকে মনে মনে গালি দিচ্ছে। সে এখানে মৌরিকে মানিয়ে বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছিল। কিন্তু এখানে এলে মৌরির কি আগের স্মৃতি মনে পড়বে না? তার মনে হয় কপালই খারাপ।
মৌরি ধারণা করতে পারেনি আরিয়ান নিজে না এসে তাশফিনকে পাঠাবে। আরিয়ানের কথায় বিশ্বাস করার একটাই কারণ ছিল, মৌরি জানে ওদের দু’জনের মধ্যে কোন মিল নেই। একজন আরেকজনকে শত্রু মনে করে। রেস্টুরেন্টে ঢুকে তাশফিনকে দেখে মৌরি ফিরে যেতে নিয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে তাশফিন উঠে তার সামনে চলে এসেছে। মৌরি কঠিন কন্ঠে বলল,

-পথ ছাড়ুন।

-মৌরি প্লিজ। চলেই যখন এসেছ তাহলে আমার কথাগুলোও শুনে যাও। প্লিজ।

-শেষমেশ আপনি আরিয়ানকেও ব্যবহার করেছেন!

-আরিয়ান নিজে থেকে সাহায্য করতে চেয়েছে। কারণ আরিয়ানও চায় তুমি বাড়ি ফিরে যাও।

এতগুলো মানুষের মাঝে এখানে সিন ক্রিয়েট হবে ভেবে মৌরি তাশফিনের সামনে একটা টেবিলে এসে বসলো। তাশফিন কী বলবে তার জানা আছে।

-তুমি কেন এমন করছো মৌরি। তুমি তো আমাকে ভালোবাসে।

-ভালোবাসি! কে বললো?

তাশফিন মৌরির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের প্রথম দেখা করার দিনের মৌরির সাথে আজকে তার সামনে বসে থাকা মৌরির মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য। প্রথম দিন মৌরি তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেও ঘাবড়াচ্ছিল। আজ কেমন চোখে চোখ রেখে আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলছে।

-আচ্ছা তুমি আমাকে ভালো না বাসো। কিন্তু আমি তো তোমাকে ভালোবাসি।

-সেটা আপনার সমস্যা।

তাশফিনও বুঝে ফেলেছে মৌরির মন এত সহজে গলবে না। সে আর কী করলে মৌরি তাকে ক্ষমা করবে?

-আমি তো ক্ষমা চেয়েছি মৌরি। মেনে নিয়েছি ভুল আমার ছিল। যখন আমি নিজের ভুল সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলাম তখন তুমি আমাকে ছেড়ে যাওনি। এখন আমি নিজের বুঝতে পেরে স্বীকারও করে নিয়েছি। তাহলে এখন কেন তুমি আমাকে ছেড়ে যাচ্ছ।

মৌরি তাশফিনের কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। সে চোখ ঘুরিয়ে রেস্টুরেন্টটা দেখছে।

-এই জায়গাটা চিনতে পারছেন তো? মনে আছে আমাদের প্রথম দেখা এখানে হয়েছিল।

-মনে আছে।

-আপনি প্রথমে আমার পরিবারের বিশ্বাস অর্জন করলেন। তারপর আমার বিশ্বাসও জিতে নিলেন। আপনি যদি শুধু আমার পরিবারকে হাত করে আমাকে বিয়ে করতেন তাহলেও হয়তো আপনার প্রতি আমার এত রাগ থাকতো না। আপনাকে আমি ক্ষমা করে দিতাম। কিন্তু আপনি আমার পরিবারের সাথে আমার বিশ্বাস, ভালোবাসা নিয়েও খেলেছেন। আমি এতটাই বোকা ছিলাম আপনার মিষ্টি মিষ্টি মিথ্যা কথাগুলো ধরতে পারিনি। এজন্যই নিজের উপর রাগ হয়েছিল। পরিবারকে দোষ দিতে পারতাম না। কারণ পরিবারের সাথে আপনি তো আমারও পছন্দ ছিলেন। একারণেই আপনি আমাকে ফেলে চলে যাওয়ার পরেও আমি আপনার বাড়িতে গিয়েছিলাম। আপনি আমাকে এত অপমান করেছেন, এতবার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমার কি খারাপ লাগতো না? নাকি আমার আত্মসম্মান ছিল না? সবকিছু সহ্য করেও আমি এই দিনটার অপেক্ষাতে ছিলাম। এখন আপনি বুঝতে পারবেন কাউকে ভালোবেসে তার থেকে অবহেলা, অপমান পেলে কতটা কষ্ট হয়।

-তুমি আমাকে কষ্ট পেতে দেখতে চাও তো?

-হ্যাঁ চাই।

-আমাকে কষ্ট পেতে দেখলে তুমি খুশি হবে?

মৌরি তো এমনটাই চাইত। তাহলে এখন কেন কথাটা বলতে গিয়ে গলা ভরে আসছে। মৌরির তো বলা উচিত, আপনি আমাকে কম কষ্ট দেননি। এখন আমিও আপনাকে কষ্ট পেতে দেখতে চাই। আপনাকে কষ্ট পেতে দেখলে আমি খুশি হবো। তাশফিন মৌরির জবাব শোনার জন্য তাকিয়ে আছে। মৌরি দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল,

-আমি আসছি। যথেষ্ট সময় নষ্ট হয়েছে। আপনার সাথে কথা বলার আমার কোন ইচ্ছে নেই। দয়া করে আপনি আর আমাকে বিরক্ত করবেন না।

মৌরি চলে যাচ্ছে। তাশফিন পেছন থেকে ডেকে বলল,

-আমার প্রশ্নের জবাব কিন্তু দিয়ে গেলে না। বলে যাও, আমাকে কষ্ট পেতে দেখলে তুমি খুশি হবে তো? তুমি হয়তো জানো না। তোমার খুশির জন্য আমি সবকিছু করতে পারি।

চলবে

#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [২৮]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে মৌরির বুক ভার হয়ে রইল। চোখে কি কিছু পড়েছে? নাহলে চোখ জ্বালা করছে কেন? এমনটাই তো চেয়েছিল। তাহলে আজ কেন নিজের মনকে কঠিন করে রাখতে পারছে না। এলোমেলো পা ফেলে মৌরি এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় এত এত গাড়ি চলছে সেদিকে খেয়াল নেই। পেছন থেকে একটা গাড়ি ক্রমাগত হর্ণ বাজিয়ে যাচ্ছে। চোখ মুছে মৌরি রাস্তা থেকে সরে গিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটছে। গাড়িটা এবার পেছন থেকে এগিয়ে এসে ধীর গতিতে মৌরির সাথে সাথে চলছে। মৌরি পাশে তাকিয়ে গাড়ির ভেতর তাশফিনকে দেখে মুখের ভাব কঠিন করে ফেলল। তাশফিন জানালার কাচ নামিয়ে মাথা বের করে মৌরির উদ্দেশ্যে বলল,

-আমাকে কষ্ট পেতে দেখতে হলে তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। যেভাবে রাস্তার মাঝ দিয়ে হাঁটছিলে তাতে… গাড়িতে বসো। তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।

লোকটা নিজেকে কী ভাবে! একটু আগে এতগুলো কথা শুনিয়ে এসেছে তবুও তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে চাচ্ছে। মৌরি উত্তর না করে হাঁটতে থাকল। তাশফিনও গাড়ির স্পিড কমিয়ে মৌরির সাথে সাথে আসছে।

-আমার উপর রাগ আছে বুঝলাম। কিন্তু আমার গাড়ির উপর তো রাগ নেই। উঠে এসো।

-আপনি যান তো। আমি যাব না।

-বাসায় যাবে না তাহলে কোথায় যাবে?

-বাসায় যাব না বলেছি?

-এক্ষুনি তো বললে।

-বলেছি আপনার সাথে আপনার গাড়িতে যাব না।

-তুমি কি মনে করছো আমি তোমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাব? আরে ভয় পেয়ো না। নিজের বউকে কেউ কিডন্যাপ করে না।

এই লোকের সাথে কথা বলাই বেকার। মৌরি ট্যাক্সি নিতে গেলে তাশফিন গাড়ি থেকে নেমে এলো।

-মামা যাবেন?

লোকটা মৌরির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-কই যাবেন?

মৌরি ঠিকানা বললে লোকটা যেতে রাজি হয়ে গেল। মৌরি ট্যাক্সিতে উঠবে তখনই তাশফিন এসে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলতে লাগল,

-ওই গাড়িটা দেখছেন মামা? গাড়িটা এই আপামনির হাসবেন্ড এর। এত বড় গাড়ি রেখেও আপামনি রাগ করে আপনার ট্যাক্সিতে যেতে চাচ্ছে। আপনিই বলুন, এটা কি ঠিক? স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একটু আধটু ঝগড়া হতেই পারে। আপনার সাথে মামীর ঝগড়া হয় না? মামী কি আপনাকে ছেড়ে চলে যায়।

মৌরি তাশফিনের উপর মহা বিরক্ত। একটা মানুষ কী পরিমাণ বেহায়া হলে, আপনার সাথে থাকব না। এই কথাটা সোজাসুজি বলে দেওয়ার পরও বউ বউ করে পেছনে আসে! ট্যাক্সি ড্রাইভার লোকটা তাশফিনের কথা শুনে হাসছে। উনার ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে এরকম অভিজ্ঞতা কম হয়নি। তিনি মুখে হাসি নিয়ে মৌরির মান ভাঙাতে বললেন,

-পৃথিবীর সব স্বামীরা হইলো বেচারা শ্রেণীর। বউয়ের রাগ ভাঙানোর জন্য কতকিছু যে করতে হয়! তবুও রাগ ভাঙে না। রাগ কইরো না গো মা। তোমার স্বামীর গাড়িতে করেই চলে যাও। বাড়ি গিয়া যত মন চায় ঝগড়া কইরো। স্বামী স্ত্রী’র ঝগড়া নিজেদের মধ্যেই থাকা ভালো।

মৌরি বলতেই যাচ্ছিল, আমাদের মধ্যে কোনকিছু নেই। এখন আমরা আলাদা হয়ে গেছি। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই তাশফিন ট্যাক্সি ড্রাইভারের হাত ধরে হ্যান্ডশেক করতে করতে বলল,

-মামা একমাত্র আপনিই আমার দুঃখ বুঝেছেন। আমার বউয়ের রাগ বাকিদের থেকে একটু বেশিই। এতভাবে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু বউ মানছেই না।

-রাগ কইরো না মা। তোমার স্বামীর সাথে বাড়ি চলে যাও।

লোকটার সামনে মৌরি তাশফিনকে কিছু বললো না। এই ট্যাক্সি ছেড়ে অন্য ট্যাক্সির দিকে যেতে লাগলেও তাশফিন ওর পেছনে আসছে।

-ভাই যাবেন?

-হুম উঠেন।

মৌরি ট্যাক্সিতে উঠতে গেলে তাশফিন এবারও ওকে থামিয়ে দিলো। ডান হাত উঁচিয়ে তার গাড়িটা দেখিয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল,

-ওই গাড়িটা দেখছেন মামা?

তাশফিন এবার পুরো কথা বলতে পারলো না। মৌরি রেগেমেগে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

-আপনার সমস্যা কী? কেন বিরক্ত করছেন?

বিরক্ত করছেন কথাটা শুনে ট্যাক্সি ড্রাইভারের মানবতা জেগে গেল। তাশফিনের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,

-কী ভাই? পথেঘাটে একা মেয়ে দেখলেই বিরক্ত করতে হয়? আপাকে কেন বিরক্ত করছেন?

তাশফিন ভ্রু কুঁচকিয়ে তাকালো। হাসি আটকাতে না পেরে বলল,

-থাম ভাই। হিরো সাজার আগে জেনে নে আমি তোর আপার কী হই?

লোকটা তাশফিনের কথা বিশ্বাস করলো বলে মনে হলো না। তাই নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করল,

-আপা উনি আপনার কিছু হোন?

-তোর আপা আমার বউ হয়। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমি তোর দুলাভাই। দুলাভাইয়ের সামনে হিরো সাজা মানায় না।

মৌরি বুঝতে পারছে তাশফিনের কথা শুনে গাড়িতে না উঠলে তাশফিন এমনই করবে। এতদিনে এইটুকু চিনতে পেরেছে। তাই মৌরি কথা না বাড়িয়ে তাশফিনের গাড়ির দিকে এগোতে লাগল। তাশফিন লোকটাকে বলল,

-থ্যাংকস ভাই। তুই হিরো সাজতে না আসলে তোর আপা এত সহজে মানতো না।

তাশফিন দৌড়ে এসে মৌরির জন্য গাড়ির দরজা খুলে দিল। মৌরি বিনাবাক্যে গাড়িতে উঠে বসলো। তাশফিন ড্রাইভিং সিটে বসে নিজের সিট বেল্ট লাগিয়ে নিল। মৌরি তাশফিনের দিকে তাকাচ্ছে না। তাশফিন হঠাৎ মৌরির দিকে ঝুঁকে এসে ওর সিট বেল্ট লাগিয়ে দিতে লাগলো। হঠাৎ তাশফিনের এমন কাজে মৌরি হতবাক। তাশফিন এতটাই কাছে চলে এসেছে মৌরি শ্বাস ফেললে তাশফিনের ঘাড়ে পড়বে। একারণে মৌরি শ্বাস বন্ধ করে বসে আছে। তাশফিন ইচ্ছে করেই সিট বেল্ট লাগিয়ে দিতে অনেক সময় নিচ্ছে। মৌরি আর পারলো না। এবার বলেই উঠল,

-কী করছেন আপনি? নিজের জায়গায় বসুন।

-কী করছি দেখতে পারছো না? সিট বেল্ট লাগিয়ে দিচ্ছি।

-আপনার কি মনে হয় আমি সিট বেল্ট লাগাতে পারি না?

-পারলে তো লাগাতেই।

-আপনি ছাড়ুন। আমি নিজে লাগিয়ে নিব। সরুন বলছি। কথা শুনছেন না?

তাশফিন বিরক্তি নিয়ে বলল,

-উফ চেঁচিয়ে তো কান খারাপ করে ফেললে। শেষ, সরে যাচ্ছি। আমি কাছে এলে এতো ভয় পাও কেন? আমি বাঘ না ভাল্লুক? খেয়ে ফেলবো তোমাকে?

-আপনার গাড়িতে উঠেছি বলে মনে করবেন না আমি আপনার কোন বাজে কথা শুনবো। রাস্তায় সিন ক্রিয়েট চাচ্ছিলাম না। তাই বাধ্য হয়ে আপনার গাড়িতে বসতে হয়েছে।

মৌরির কথা যেন তাশফিনের কানেই ঢুকছে না। সে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,

-তুমি ঝগড়া করতে পারো না এটা ভাবা আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল ছিল। ঝগড়া করতে পারা তো মেয়েদের জন্মগত গুণ। এই গুণ না দিয়ে আল্লাহ কোন মেয়েকে দুনিয়ায় পাঠায়নি। আমার বোঝা উচিত ছিল, আমার বউও ঝগড়ায় কম যাবে না।

তাশফিনের মুখে বারবার বউ ডাক শুনে মৌরি বিরক্ত হচ্ছে। বলে তো দিয়েছে তাদের মধ্যে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। তবুও কেন এত বউ বউ করে?
বাড়ির কাছাকাছি এসে মৌরি তাশফিনকে গাড়ি থামাতে বললে তাশফিন চোখ বাঁকিয়ে বলল,

-ভাবছো তো তোমাকে আমার গাড়ি থেকে নামতে দেখলে তোমার বাড়ির লোক ভাববে আমাদের মাঝে সব ঠিক হয়ে গেছে।

মৌরি উত্তর দিল না। সিট বেল্ট খুলে গাড়ি থেকে নেমে গেল। যে কারণে মৌরি বাসা থেকে অনেকটা দূরে নেমে গেছে সেটাই ঘটলো। মাহিম ঠিকই মৌরিকে তাশফিনের সাথে ফিরতে দেখে ফেলেছে।


লায়লা পিহুকে সবকিছু জানিয়ে দিয়েছে। তাশফিন বিয়ের দিন কী কী করেছে কিছুই বলা বাকি রাখেনি। এখানে আসার পরও তার ভাই মেয়েটাকে কম অপমান করেনি। ভাইয়ের উপর পিহুর রাগের সীমা রইল না। নিজের বোনের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে অন্য একজনের বোনের জীবনকে নাটক বানিয়ে দিল। পিহু তাশফিনের সাথে কথা বলছে না। তাশফিনও এটা লক্ষ্য করে পিহুর সাথে কথা বলতে গেলে পিহু রাগ চেপে রাখতে পারলো না।

-মৌরি কেন চলে গিয়েছে ভাইয়া?

এতদিন পিহু মৌরিকে ভাবী ডাকত। আজ ওর মৌরিকে নাম ধরে ডাকা শুনে তাশফিন অবাক হলো।

-অবাক হচ্ছো কেন? তুমি তো মৌরিকে বিয়ে করোনি। তাহলে ওকে ভাবী ডাকবো কেন?

পিহু অন্য কারো কাছ থেকে শোনার আগে তাশফিনই বলতে চেয়েছিল। কিন্তু তা আর হলো না। পিহুকে কে জানিয়েছে এটাও তার অজানা না।

-তুইও আমাকে ভুল বুঝবি?

-ভুল না বোঝার মতো কোন কাজ করেছ তুমি?

-আমার ভুল হয়ে গেছে পিহু। এই ভুলের জন্য সকলের কাছে ক্ষমা চাওয়া শেষ। তবুও কেউ ক্ষমা করতে রাজি না।

-তুমি যা করেছ তা ভুল না ভাইয়া। না জেনে কিছু করলে সেটাকে ভুল বলা হয়। কিন্তু জেনে-বুঝে করলে সেটাকে অন্যায় বলে। ভুলের জন্য ক্ষমা পাওয়া যায়। কিন্তু অন্যায় করলে তার শাস্তি পেতে হয়।

-মৌরিকে হারানোর শাস্তি আমার জন্য অনেক বেশি হয়ে যাবে রে।

-হারাতে দিবে কেন? ভাবীকে হারাতে দিলে সেটা তোমার আরও বড় অপরাধ হবে। এই অপরাধের জন্য অন্তত আমি তোমাকে কখনও ক্ষমা করবো না। তুমি ভাবীকে বাড়ি ফিরিয়ে আনো।

-চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখছি না। কিন্তু তোর ভাবীর মন গলাতে আমি ব্যর্থ।

-হার মেনে নিলে তো হবে না। অভিমানের পাহাড় যত উঁচুই হোক। ভালোবাসার সামনে অভিমান বেশিক্ষণ টিকে না।


মৌরি এবাড়িতে আসার পর সবকিছুই একটা নিয়মের ভেতর এসে পড়েছিল। অন্তত সকাল, রাতে খাবার টেবিলে সবাই একসাথে থাকত। কিন্তু মৌরি চলে যাওয়ার সাথে সাথে সব নিয়মও ভেঙে গেছে। সবকিছুই আবার আগের মতো হয়ে গেছে। তারেক চৌধুরী এবার মালয়েশিয়া থেকে ফিরে জানতে পারলেন মৌরি চলে গেছে। কেন গেছে এটাও অজানা না। আজ রাতে খাবার টেবিলে তাশফিন, আরিয়ান কাউকেই দেখা গেল না। পিহু এসে বসেছে ঠিক কিন্তু তার খেতে ভালো লাগছে না। লায়লা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

-তখন থেকে খাবার সামনে নিয়ে বসে আছো। খাচ্ছ না কেন?

-খাবার গলা দিয়ে নামছে না। তুমি খেয়ে আসো।

বলেই তারেক চৌধুরী উঠে চলে গেলেন। লায়লা স্বামীর জন্য খাবার রেখে উঠে যেতে পারবেন না। ক্ষিধে পেলে রাতে ঘুম হবে না। আবার উঠে খেতে হবে। পিহুও কতক্ষণ বসে থেকে চলে গেল।

তাশফিন বাইরে বেরিয়ে এসে একটা সিগারেট জ্বালালো। রুমে থাকলে মৌরির স্মৃতি চোখে ভাসে। নিজের রুমে থাকা এখন তার জন্য আজাব হয়ে গেছে। সবকিছুতে মৌরির ছোঁয়া অনুভব করে। মনে হয় মৌরি আশেপাশেই আসে। ডাকলেই চলে আসবে। কিন্তু তাশফিন জানে মৌরি আসবে না।
আরিয়ান মাত্র বাড়ি ফিরেছে। দরজা দিয়ে ঢুকতে তাশফিনের সাথে দেখা হয়ে গেলে আরিয়ান প্রথমে কিছু না বলে চলে যাচ্ছিল। একটু এগিয়ে গিয়েও কী মনে করে যেন ফিরে এলো। তাশফিনের সামনে দাঁড়িয়ে মুখে হাসি নিয়ে বলল,

-মৌরি আসেনি, না! হুম। বউ বাড়ি এলে এসময় এখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতিস না। বউয়ের সামান্য রাগ ভাঙাতে পারিস না কী পুরুষ মানুষ হয়েছিস!

আরিয়ানের মুখের উপর সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে তাশফিন বলল,

-ফাইজাও মৌরিরই বোন। শোকর কর আমার বউয়ের মতো ঘাড়ের রগ যেন ত্যাড়া না হয়। তাহলে তোর অবস্থাও আমার মতো হতে বেশি সময় লাগবে না।

আরিয়ান যতই তাশফিনকে খোঁচা দিক। সে মনে মনে জানে মৌরির সাথে তাশফিনের সবকিছু ঠিক না হলে ফাইজার সাথেও তার বিয়ে হবে না।

চলবে
এডিট ছাড়া পর্ব। বানান ভুল ক্ষমা করবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে