শ্রাবণ ঝরা মেঘ পর্ব-২৫+২৬

0
517

#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [২৫]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

-এসো ভাবী। তোমার ভাই কতক্ষণ ধরে তোমার অপেক্ষা করছে। কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

মৌরি একজন মাহিমের দিকে তাকিয়ে পিহুর প্রশ্নের উত্তরে বলল,

-রুমে ছিলাম।

মৌরি একটা কথাই বুঝে উঠতে পারছে না পিহু যদি মাহিমের জন্যই সুইসাইড করবে, তাহলে এখন মাহিমকে সামনে দেখেও এত সহজ আছে কীভাবে? মাহিম পিহুকে ধোঁকা দিয়েছে। পিহুর ওকে ঘৃণা করার কথা। পিহু কি তার কথা ভেবে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে?
মাহিম অবশ্য সবটাই বুঝতে পেরেছে। পিহু কিছুই জানে না। তাশফিন ওর থেকে সত্যটা লোকাচ্ছে। পিহু বলল,

-ভাইয়ার বিয়েতে আমি ছিলাম না। আমার ভাইয়ের এতই তাড়া ছিল যে ছোট বোনকে রেখেই বিয়ে করে ফেলেছে। তাই ভাইয়ার শাস্তি, আমি আবার ওদের বিয়ে দেব।

মাহিম বোনকে দেখছে। তাশফিনের ভুল হয়তো ভেঙে গেছে। মৌরি তাশফিনের সাথে খুশি থাকলে ওদের বিয়ে নিয়ে মাহিমের কোন আপত্তি নেই।

-আমরা শীঘ্রই আপনাদের বাসায় যাব। আন্টি আঙ্কেলের সাথে এখনও দেখা হয়নি।

এবার তাশফিনের চেহারা দেখার মতো হলো। পিহু মৌরিদের বাড়িতে গেলে এমনিই সব জেনে যাবে। মাহিম তাশফিনের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসছে। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এতকিছু করেও লাভ হলো না। শেষমেশ নিজের বোনের চোখেও ভালো থাকতে পারবে না। মৌরি ও তার পরিবারের সাথে তাশফিন কী কী করেছে তা জানলে পিহু কোনদিন তাশফিনকে ক্ষমা করবে না। মাহিম বলল,

-ঠিক আছে যাবেন। আমরা আপনার যাওয়ার অপেক্ষায় থাকবো।

মাহিম বোনের থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় মৌরির মাথায় হাত রেখে বলল,

-তোদের বিয়ে কোন অবস্থায় কীভাবে হয়েছে সেটা আমি দেখব না। তুই কি এখন তাশফিনের সাথে খুশি আছিস? ওর মতো মানুষের সাথে সারাজীবন কাটাতে পারবি?

মৌরি হেসে জবাব দিয়েছে,

-সময় সব ঠিক করে দিবে ভাইয়া।

তাশফিন আজ মাহিমকে গেট পর্যন্ত ছাড়তে এসেছে। মাহিম বলল,

-এতটা ভদ্রতা সহ্য হবে না। আমি যেতে পারব।

তাশফিন এখন বুঝতে পারছে এই পুরো ঘটনায় কেউ ভুল থাকলে সেটা সে নিজে। মাহিমের কোন দোষ ছিল না। তাশফিন ইতস্তত ভাব কাটিয়ে উঠে বলল,

-তুমি চাইলে পিহুর কাছে সবটা বলে দিতে পারতে।

-হ্যাঁ বলতে পারতাম। কিন্তু আমি তোমার অপরাধের শাস্তি পিহুকেও পেতে দিতে চাই না।

-তোমাদের সাথে যা করেছি তাতে আমাকে এত সহজে ক্ষমা করে দেওয়া যায় না।

-ক্ষমা আশা করাটাও বোকামি।

-হুম। তবে তোমার বাবা মা’র কাছে আমাকে ক্ষমা চাইতেই হবে।

-কেন? তোমার বোন আমাদের ওখানে গেলে সব জেনে ফেলবে এই ভয় পাচ্ছ?

-না। পিহুর থেকে কোনকিছুই লুকাবো না। সময় হলে ওকে সবটাই বলবো।

-না বলাই ভালো হবে। পিহু ধোঁকাবাজদের পছন্দ করে না। সত্য বলে দিলে তুমিও পিহুর চোখে ধোঁকাবাজ হয়ে যাবে।


তাশফিন মৌরির বিয়ের আয়োজনে আরিয়ানও পিহুকে সাহায্য করছে। পিহু হসপিটাল থেকে ফিরে আরিয়ানের এক নতুন রুপই দেখছে। পিহু বলল,

-ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়েটাও সেরে ফেলি। মেয়ের নাম ঠিকানা বলো।

আরিয়ান মেহমানদের লিস্ট দেখতে দেখতে বলল,

-আগে তাশফিনের বিয়েটা কোনরকম ঝামেলা ছাড়া হয়ে যাক।

পিহু ভ্রু কুঁচকে বলল,

-ঝামেলা হবে আশা করছো কেন?

-তোমার ভাই মানুষ হিসেবে কেমন তা জানি বলেই ঝামেলা আশা করছি। আচ্ছা মৌরিদের বাড়িতে কখন যাবে?

-যাব কয়েকদিনের মাঝে।

-কাল পরশু গেলে কেমন হয়? আমিও ফ্রি আছি।

আরিয়ান তো জানে তাশফিন কী ঝামেলা পাকিয়ে রেখেছে। মৌরির বাবা মা তাশফিনকে জুতা পেটাও করতে পারে। জঙ্গলিটা ওসব নাটক করে তার প্রেমের রাস্তায় কাটা বিছিয়ে দিয়েছে।
এখন আবার বিয়ে করবি তাহলে প্রথম বিয়ের সময় কবুল না বলে চলে এসেছিস কেন?

আজকের সারাদিনের ঝামেলায় মৌরির সাথে একটুও সময় কাটাতে পারেনি। সন্ধ্যায় রুমে ফিরে তাশফিন বলল,

-তৈরি হয়ে নাও মৌরি। আমরা বেরোবো।

মৌরি কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চাইল,

-এই সাঁঝ সন্ধ্যায় কোথায় বেরুবেন?

-নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য নেই। যেদিকে দু-চোখ যাবে তোমাকে নিয়ে চলে যাব।

ইদানিং তাশফিনের সব পাগলামিই মৌরি প্রশ্রয় দিচ্ছে। আজও দিলো। তাশফিন যে শাড়িটা পছন্দ করে দিয়েছে সেটাই পরলো। মেয়ে হলেও সাজসজ্জার দিকে মৌরির খুব একটা আগ্রহ নেই। কিন্তু আজ মনের মতো সাজলো। গাড়ির চাবি নিতে এসে তাশফিন মৌরিকে দেখে চোখ ফেরাতে পারল না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
মৌরি রেডি হয়ে গেছে। তাশফিনের সামনে এসে বলল,

-চলুন।

কিন্তু তাশফিনের কানে তার কথা পৌঁছালে তো? মৌরি পায়ের পাতায় ভর দিয়ে তাশফিনের কানের কাছে গিয়ে জোরে বলল,

-এইযে মশাই, কোথায় হারালেন?

তাশফিন মৌরির এক হাত পেছনের দিকে পেঁচিয়ে ধরে মৌরিকে অনেকটাই নিজের কাছে নিয়ে এলো। এমন কিছুর জন্য মৌরি প্রস্তুত ছিল না। সে ঘাবড়ে গেলে তাশফিন তা লক্ষ করে হেসে বলল,

-বউয়ের মাঝেই তো হারাতে চাই। কিন্তু বউ কি সেই অনুমতি দিবে?

মৌরি তাশফিনের বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগল। তাশফিন মৌরির অস্থিরতা লক্ষ্য করে বলল,

-এত ছটফট করছো কেন? আমি কি তোমার কাছে আসতে পারব না?

-আজ আমাদের বেরোনোর প্ল্যান ছিল।

-প্ল্যান ক্যান্সেলও করা যায়।

-জি না মিস্টার। কতক্ষণ সময় নিয়ে কত কষ্ট করে সেজেছি। প্ল্যান ক্যান্সেল করলে আমার সময়, কষ্ট দুইটাই বৃথা যাবে।

-তোমার সাজসজ্জা তোমার স্বামীর জন্য করা উচিত। আমি দেখে ফেলেছি এটাই যথেষ্ট।

মৌরি একটু জোর লাগিয়ে তাশফিনের বাঁধন থেকে আলগা হয়ে বলল,

-যখন আপনার জন্য সাজবো তখন শুধু আপনিই দেখবেন। কিন্তু এখন আমি আপনার সাথে ঘুরতে যাওয়ার জন্য সেজেছি।

পিহু ফ্রিজ থেকে আইসক্রিমের বাটি নিয়ে মাত্রই এদিকে ফিরেছে, ভাইয়া ভাবী দু’জনকে একসাথে দেখে পিহু চেঁচিয়ে উঠল,

-এইযে বর কনে, কয়দিন পর দ্বিতীয় বার বিয়ের পিঁড়িতে বসবে। এখন কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি? ওহ, বাড়ি থেকে দূর ঝুটঝামেলা বিহীন দু’জন একান্তে কিছু সময় কাটাতে চাচ্ছ!

তাশফিন বোনের উদ্দেশ্যে বলল,

-তোর মুখটা আজকাল বেশি চলছে বলে মনে হচ্ছে না? সেলাই করে দিব?

-বাহ রে, চোখের সামনে সব দেখতে পারব। কিন্তু কিছু বললেই দোষ হয়ে যাবে।

-তোকে দেখতে কে বলেছে? চোখ বন্ধ করে রাখ।

তাশফিনের কথা মতো পিহু সত্যি সত্যিই চোখে হাত চেপে ধরে বলল,

-এখন থেকে আমি অন্ধ। চোখে কিছু দেখি না।


তাশফিন মৌরিদের বাড়িতে এসেছে। ওকে এখানে কেউ আশা করেনি। তাশফিন এই পরিবারের সাথে যা করেছে তারপর ওকে বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এরা তাকে আটকায়নি। বরং সে কেন এসেছে তা নিশ্চুপ থেকে শুনলো। তাশফিন সত্যিই অনুতপ্ত। ক্ষমা চাওয়ার মুখ তার নেই।

-আপনাদের সাথে যা করেছি তার জন্য আমি মন থেকে অনুতপ্ত। আপনারা হয়তো আমাকে ক্ষমা করবেন না। তারপরও আমি আপনাদের সবার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।

মাহিম তাশফিনকে কিছু বললো না। কিন্তু মৌরির চাচা উত্তেজিত হয়ে উঠল।

-সেদিন এতগুলো মানুষের সামনে আমাদের সম্মান নিয়ে যেভাবে খেলেছো তার জন্য ক্ষমা চাইতে এসেছ! তোমার মনে হয় আমরা তোমাকে ক্ষমা করে দিব?

-আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে এসেছি।

-তাতে কি? আমাদের সম্মান ফিরে আসবে? তোমার সাহস কী করে হয় এখানে এসে ক্ষমা চাওয়ার নাটক করার? আমরা যে তোমার হাত-পা এখনও আস্ত রেখেছি সেটাই তো তোমার কপাল।

মৌরির বাবা ভাইকে থামিয়ে দিলেন। তিনি অশান্তি পছন্দ করেন না।

-তুমি ক্ষমা চাইতে এসেছিলে, আমরা তোমার কথা শুনেছি। এখন তুমি আসতে পারো।

তাশফিন অসহায় মুখে সকলের দিকে তাকাল। গলায় কাতরতা ফুটিয়ে তুলে বলল,

-প্লিজ আঙ্কেল আমি সবকিছু ঠিক করতে চাই।

-সবকিছু তো ঠিকই আছে। আমার মেয়ে তোমার বাড়িতে আছে। বাবা মা পরিবার ছেড়ে ও তোমাকে বেছে নিয়েছে।

-মৌরি আপনাদের ছাড়া ভালো থাকতে পারবে না আঙ্কেল।

-না পারলে এতগুলো দিন থাকছে কীভাবে? কই আমার মেয়ে তো একবারও আমার কাছে এসে বলল না, বাবা রাগ ভুলে যাও। আমার তোমাদের প্রয়োজন।

তাশফিন কী বলবে? কীভাবে বলবে মৌরিকে সে-ই শর্ত দিয়েছিল মৌরি যদি ওবাড়িতে থাকতে চায় তাহলে নিজের পরিবারের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। তার কথা শুনেই মৌরি এতদিন বাবা মা’র সাথে দেখা করতে আসেনি। তাশফিনের নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। সব দোষ তার। চেষ্টা করেও এখন কোন কিছু ঠিক করতে পারছে না।

তাশফিন বাড়ি ফিরে এসে দেখে মৌরি পিহুর সাথে বসে গল্প করছে। পিহু ভাইকে দেখে বলল,

-ওইযে তোমার বাচ্চা বর ফিরেছে। হারিয়ে যায়নি।

তাশফিনের ফিরতে আজ একটু দেরি হয়েছে। মৌরি পিহুকে এটাই জিজ্ঞেস করতে এসেছিল, তাশফিন ওকে কিছু বলে গেছে নাকি। মৌরি দেখেই বুঝলো কোন কারণে হয়তো মানুষটার মন ভালো নেই। তাশফিনের পেছনে রুমে এসে মৌরি জিজ্ঞেস করল,

-কোথায় গিয়েছিলেন?

-এপর্যন্ত যা যা গণ্ডগোল করেছি সব ঠিক করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুই ঠিক করতে পারলাম না।

মৌরি ঠিক বুঝলো না। সে বলল,

-কী হয়েছে? এরকম বলছেন কেন?

তাশফিন মৌরির হাত ধরে ওকে কাছে টেনে এনে নরম গলায় বলল,

-আমি দুঃখিত মৌরি। তুমি সহ আরও অনেক মানুষের কষ্টের কারণ হয়েছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিলেও সে মানুষগুলো আমাকে ক্ষমা করতে পারছে না। আমি মানুষটা ভীষণ খারাপ। কোন সম্পর্কই শেষ পর্যন্ত আগলে রাখতে পারি না। নিজের দোষে সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যাও। তুমি যেও না।
এই ভুলে ভরা মানুষটার পাশে থেকো। তোমাকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছি মৌরি।

চলবে

#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [২৬]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

মৌরিকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। তাশফিন ভেবেছিল মৌরি হয়তো নিচেই আছে। সালেহা খালা চা নিয়ে এলে তাশফিন জিজ্ঞেস করে জানতে পারল মৌরি নিচে নেই।

-আজ তুমি চা নিয়ে এলে, মৌরি কোথায়?

-ঘরে নাই? সকাল থেকে তো দেখি নাই। আমি ভাবছি আজ হয়তো ঘুম ভাঙতে দেরি হইছে।

ঘুম ভেঙে তাশফিন মৌরিকে রুমে দেখেনি। নিচেও নেই তাহলে কোথায় গেছে? তাশফিন খালার হাত থেকে চা না নিয়েই মৌরিকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল। আরিয়ানের সাথে হয়তো গল্প করতে বসে গেছে। তাশফিন গিয়ে দেখল আরিয়ানের রুমের দরজার লক করা। সে ডাকতে লাগলে আরিয়ান ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে দিয়ে বিরক্তি মাখা গলায় বলল,

-সমস্যা কী তোর? মানুষের ঘুম নষ্ট করছিস কেন?

এতে বোঝা যায় আরিয়ানের ঘুম মাত্রই ভেঙেছে। মৌরি ওর সাথে নেই। তাহলে কি পিহুর সাথে? পিহুকে জিজ্ঞেস করলে পিহুও একই কথা বলল, সকাল থেকে সে মৌরিকে দেখেনি। তাশফিন চিন্তিত মুখে রুমে ফিরে এলো। ফোন হাতে নিয়ে মৌরিকে কল করলে মহিলা কন্ঠ বলছে ‘এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না’। তাশফিন ভেবে পাচ্ছে না এই সকালবেলা মৌরি গেল কোথায়?

মৌরি কাউকে কিছু না জানিয়ে নিজের বাড়িতে চলে এসেছে। তার ওই বাড়িতে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। এখন আর ওখানে থাকার কোন মানে হয় না। বিয়ের দিন তাশফিন তাকে ফেলে চলে গিয়েছিল তখনই মৌরি নিজের মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা করেছিল। যতটা কষ্ট আর অপমান তাশফিন তাকে করেছে সে সুদে আসলে সবটা ফিরিয়ে দিবে। কষ্ট তো তাশফিন পাবে। কারণ সে-ও এখন মৌরিকে ভালোবাসে। প্রথম বার তাশফিন তাকে বিয়ের আসরে ফেলে চলে গিয়েছিল এবার মৌরি ফেলে আসতে পারত। কিন্তু তার পারিবারিক শিক্ষা তাকে এতটা নিচে নামতে দেয়নি।
মেয়েকে দরজার সামনে দেখে মৌরির মা বিস্ময়ে কিছু বলতেই পারলেন না। এতগুলো দিন পর মেয়ে বাড়ি ফিরেছে। তিনি অভিমান প্রকাশ করবেন নাকি মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিবেন বুঝতে পারছেন না। মা’কে দেখে মৌরির গলা ভরে এলো। সে বলল,

-কেমন আছো মা?

-তুই! সাতসকালে তুই কোত্থেকে এসেছিস?

-নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছি মা।

মেয়ের কথাবার্তা তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। কী বলছে এই মেয়ে?

-আমাকে ভেতরে যেতে দেবে না?

-কী বলছিস এসব? ভেতরে কেন যেতে দিব না?

-তখন থেকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছ। মেয়েকে বাড়ি ফিরতে দেখে খুশি হওনি?

-খুশি কেন হবো না? তুই একা এসেছিস? জামাই আসেনি?

মা এখনও তার ফিরে আসার কারণ বুঝতে পারেনি। মৌরি এই মুহূর্তে মা’কে কিছুই জানালো না। একসাথে এত ধাক্কা মা নিতে পারবে না। মৌরিকে বাড়িতে দেখে সকলেই একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে, কেন এসেছে সে? প্রশ্নটা শুনে মৌরি কিছুটা রেগেই জবাব দিল,

-নিজের বাড়িতে এসেছি তবুও জিজ্ঞেস করছো কেন এসেছি! আমার বাড়ি আসা নিয়ে তোমরা খুশি না হলে আমি এক্ষুনি চলে যাব। কোথাও যাব জানি না। তবে আমি ওই বাড়িতেও ফিরে যাব না।

মৌরির বাবা হয়তো কিছুটা বুঝতে পেরেছেন। তিনি সকলে নিষেধ করে দিলেন এব্যাপারে মৌরিকে যেন আর কোন কথা জিজ্ঞেস না করা। মৌরির হুট করে চলে আসার মধ্যে মাহিম স্বাভাবিকতা খুঁজে পাচ্ছে না। দু’দিন আগেই মৌরিকে দেখে এসেছে। তাশফিনের পরিবার ওদের বিয়ের আয়োজন করছে। সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে তাহলে মৌরি এখন কেন চলে এসেছে। মাহিম বোনের ঘরে এলো। মৌরি কপালে হাত দিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে ছিল।

-কিরে মৌরিফুল, আজ তুই বাড়িতে আছিস তবুও পরিবেশ এত শান্ত কেন?

মৌরি ভাইয়ের দিকে তাকাল না। মৌরি এই পরিবারকে নিজের দাবি করে। কিন্তু এই কয়দিনে কেমন এরা সবাই তাকে পর করে দিয়েছে। তার বাড়ি আসা নিয়ে কেউ খুশি না। খুশি হলে এত প্রশ্ন করত না।

-মেয়েদের নিজস্ব কোন বাড়ি হয় না ভাইয়া। স্বামীর বাড়ি হয় আর বাবার বাড়ি হয়। তাদের নিজের বাড়ি এই দুই বাড়ির কোনটাই হয় না।

মাহিম বোনের পাশে এসে বলল। কপালের উপর থেকে মৌরির হাত সরিয়ে এলে বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

-আমি যে বাড়িটা করব সেটা শুধুমাত্র তোর বাড়ি হবে।

-সবাই এমন কেন করছে ভাইয়া। যেন আমি সবার পর।

-সবাই তো জানে না বাচ্চা। তুই তো কিছু বলছিসও না। কেউ তোর উপর রাগ না। আবার কেউ তোকে পরও করেনি।

-তাহলে আমাকে বাড়িতে দেখে সবাই কেন নানান প্রশ্ন করছে?

-বিয়ের পর মেয়েরা এরকম হুট করে একা বাড়ি চলে আসে না তো। সেজন্যই হয়তো।

-এটা বিয়ে ছিল? আর বাকি পাঁচটা বিয়ে এভাবে হয়?

-তুই কি একেবারে চলে এসেছিস?

-হুম।

মাহিম এবার বুঝতে পারছে, মৌরি ওবাড়িতে কেন গিয়েছিল। কিন্তু এসব করার আগে মৌরিটা কি একবারও ভাবেনি? এখন মৌরকে বোঝানো বৃথা যাবে। কারণ মৌরি ভেবে নিবে মাহিমও তাকে দেখে খুশি হয়নি। মাহিম বলল,

-ঘুমিয়ে পড় বাচ্চা। মাথা থেকে সবকিছু বের করে দিয়ে গাঢ়, লম্বা একটা ঘুম দে। আমি লাইট অফ করে দিয়ে যাই।

তাশফিন পুরোটা দিন মৌরিকে পাগলের মতো খুঁজেছে। শুধু তাশফিনই না আরিয়ানও খুঁজেছে। তাশফিন পুলিশে রিপোর্ট করতে চেয়েছিল। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা আগে মিসিং রিপোর্ট নেয় না ওরা।
নাওয়াখাওয়া বাদ দিয়ে তার ভাই কোথায় কোথায় ঘুরছে কে জানে? মৌরির জন্যও পিহু চিন্তিত। ওর সাথে খারাপ কিছু যেন না হয়। তাশফিন ড্রাইভ করার সময় ওর ফোন বাজছে। মৌরির কল হতে পারে ভেবে মাঝ রাস্তায় কার ব্রেক করে কল রিসিভ করল।

-হ্যালো মৌরি! মৌরি কোথায় ছিলে তুমি?

তাশফিনের কন্ঠে ভয় উৎকণ্ঠা ব্যাকুলতা ধরতে পেরে মাহিম হাসল। গলা পরিষ্কার করে জানাল,

-মৌরির ভাই বলছি।

তাশফিনের কপালে ভাঁজ পড়ল। এই সময় মাহিম কেন কল দিয়েছে! তাশফিন বলল,

-মাহিম এখন আমি ব্যস্ত আছি। তোমার সাথে পরে কথা বলি।

-আমারও তোমার সাথে কথা বলার শখ নেই। তারপরও একটা কথা বলতে কল দিয়েছি।

-আচ্ছা বলো। প্লিজ বেশি সময় নিও না।

-মৌরিকে খুঁজতে হবে না। ও আমাদের এখানে আছে।

মৌরি তার বাবার বাড়ি যেতে পারে এটা তাশফিনের মাথাতেই ছিল না। সে আসল জায়গায় খোঁজ না করে কোথায় কোথায় খুঁজছিল। তাশফিন যেন স্বস্তি পেল।

-মৌরি তোমাদের ওখানে? তুমি জানো না আমি কতটা টেনশনে ছিলাম। থানায় মিসিং ডায়েরিও করিয়ে ফেলতাম। মৌরি আমাকে বলে যেতে পারত।

মাহিম নিরব থেকে ভাবছে, এটাই সেই তাশফিন যার বিয়ের দিন মৌরিকে ফেলে যেতে কষ্ট হয়নি। একটা বার হয়তো ভাবেওনি মৌরির কী হবে। সেই তাশফিন আজ তার বোনের খুঁজে পাগলের মতো ঘুরছে।

-মৌরি কোথায়? আমি এক্ষুনি ওকে নিতে আসছি। তোমার বোন আমার জান বের করে দিয়েছে। ওকে বলো আমি ওকে নিতে আসছি।

তাশফিন মাহিমকে আর কিছু বলতে না দিয়ে কল কেটে দিয়েছে। পুরোটা দিন কী পরিমাণ মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছে বলে বোঝাতে পারবে না। মৌরি তাকে বলে যেতে পারত।
তাশফিন যখন মৌরিদের বাড়িতে পৌছেছে তখন মৌরি ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাতের খাবার শেষ করে সকলেই যার যার রুমে চলে গিয়েছিল। এই সময় তাশফিনের আগমন কেউ ভালো ভাবে নিতে পারল না। ভেতরে পা রেখেই তাশফিন বলল,

-মৌরি কোথায়? ওকে বলুন আমি এসেছি।

মৌরির চাচা সেদিনই বলে দিয়েছিল পরের বার তাশফিন এবাড়িতে পা রাখলে নিজের পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার জন্য ওর পা দু’টো আস্ত রাখবে না। আজ রাতের বেলা তাশফিনের বাড়িতে এসে হৈচৈ করা উনার পছন্দ হলো না।

-তুমি আবার এসেছ? তোমাকে সাবধান করে দিয়েছিলাম আমাদের বাড়িতে যেন তোমার পা না পড়ে।

-আমার বউ আপনাদের বাড়িতে এলে আমাকে তো ওকে নিতে আসতেই হবে। মৌরিকে ডাকুন, আমি ওকে নিয়েই চলতি যাব।

মৌরিকে ডাকা হলো। ঘুমঘুম চোখে সে তাশফিনের সামনে এসে দাঁড়াল। তাশফিন চিন্তিত মুখে বলল,

-তুমি এখানে আসবে আমাকে বলে আসতে পারতে। তুমি জানো আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

মৌরি তাশফিনের চোখে নিজের জন্য অস্থিরতা দেখছে। যা সে দেখতে চেয়েছিল। তাশফিন মৌরির হাত ধরে বলল,

-বাবার বাড়িতে আসতে ইচ্ছে হলে তুমি আমাকে বলবে। আমি তোমাকে নিয়ে আসবো। আর কোনদিন আমাকে না বলে এসো না।

বাড়ির প্রতিটা মানুষ মৌরির দিকে তাকিয়ে আছে। মৌরি এখন কী বলবে সেটা শোনার অপেক্ষা করছে।

-চলো। বাড়িতে সবাই টেনশন করছে।

মৌরি তাশফিনের থেকে হাত ছাড়িয়ে নিল। তাশফিন অবাক চোখে মৌরির দিকে তাকালে মৌরি বলল,

-এটাই আমার বাড়ি।

তাশফিন হেসে বলল,

-হ্যাঁ এটাও তোমার বাড়ি। কিন্তু এখন তোমার স্বামীর বাড়িই তোমার বাড়ি।

-কোন স্বামী?

-তাশফিন হতভম্ব চোখে মৌরির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মৌরির কী হয়েছে বুঝতে চেষ্টা করছে। বোকার মতো তাশফিন বলল,

-আমি তোমার স্বামী না?

-আপনি তো কবুলই বলেননি তাহলে আমার স্বামী কীভাবে হলেন? আমি আপনার সাথে যাব না। আর কোনদিন আপনি আমাদের বাড়িতে আসবেন না।

-মৌরি, কী বলছো তুমি এসব! আমাদের মাঝে তো সবকিছু ঠিক হয়ে গিয়েছিল। তাহলে তুমি কেন এমন করছো?

-আমার যা বলার ছিল আমি আপনাকে বলে দিয়েছি। এবার আপনি আসতে পারেন।

কথা শেষ করে মৌরি দাঁড়াল না। রুমে চলে গেল। তাশফিন মৌরির পেছনে যেতে চাইলে মৌরির চাচা ওকে আটকে নেয়। তাশফিনের উপর প্রথম থেকেই উনার একটা রাগ চাপা ছিল।

-মৌরি কী বলেছে তুমি শুনেছ। যাও এবার।

-আমাকে ছাড়ুন। মৌরির সাথে আমার কথা বলতে হবে।

-আর কোন কথা নেই।

-প্লিজ আমাকে যেতে দিন।

-বলেছি না মৌরির সাথে তোমার আর কোন কথা নেই।

বলেই তিনি তাশফিনকে ধাক্কা দিয়ে দিলেন। আগের তাশফিন হলে হয়তো দেখতো না সামনে কে আছে। উল্টো প্রতিবাদ জানাতো। কিন্তু এখনের তাশফিন সম্পর্কের সম্মান দিতে শিখেছে। কিন্তু মৌরির চাচা থেমে থাকলেন না। তিনি তাশফিনকে ধাক্কা দিতে দিতে দরজার সামনে পর্যন্ত নিয়ে এলো। মাহিম সহ প্রতিটা মানুষ এই ঘটনা দেখছে। কেউ কিছু বলতে না। এমনকি মৌরির বাবাও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তাশফিন মৌরির বাবার উদ্দেশ্যে বলল,

-আঙ্কেল আপনি কিছু বলুন। মৌরির সাথে আমাকে শেষ একটা বার কথা বলতে দিন। ও কেন এমন বলছে আমার জানতে হবে। প্লিজ আঙ্কেল। মাহিম তুমি তো কিছু বলো।

কেউ কিছুই বলল না। মৌরির চাচা তাশফিনকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন। এই ছেলের পায়ে ধরা বাকি রেখেছিলেন বিয়েটা ছেড়ে যেন না চলে যায়। তাশফিনকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পেরে বুকের ভেতর চাপা পড়ে যাওয়া আগুন কিছুটা শীতল হয়েছে। বাড়ি থেকে বের করে দিলেও তাশফিন চলে গেল না। বাড়ির পেছন দিকে এসে মৌরির ঘরে যাবার উপায় বের করতে লাগল।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে