শ্রাবণ ঝরা মেঘ পর্ব-২৪

0
513

#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [২৪]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

নিজের ভুল বুঝতে তাশফিনের অনেক বেশি সময় লেগে গেল। একটা ভুল বোঝাবুঝি থেকে তাশফিন মৌরির সাথে এত বড় অন্যায় করে ফেলল! মাহিমকে শাস্তি দিতে গিয়ে আসল শাস্তি তো মৌরিকে দিয়েছে। প্রতিশোধের আগুনে তাশফিন সত্যিই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পিহু অনুসন্ধানী চোখে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ভাইয়ার মুখটা এরকম ছোট হয়ে গেল কেন? পিহু বলল,

-কী হয়েছে ভাইয়া? আমি সুইসাইড করতে চেয়েছিলাম এই কথা তোমাকে কে বলেছে?

তাশফিন বোনের কথা শুনতে পেলো না। ইতোমধ্যে অন্য একটা ভয় তাকে গ্রাস করে নিয়েছে। মৌরি যদি জানতে পারে মাহিম নির্দোষ ছিল। মাহিমের জন্য পিহুর অ্যাক্সিডেন্ট হয়নি। তাশফিন ভুল জেনেছিল। তখন কি মৌরি তাকে ঘৃণা করবে না? মেয়েটাকে তো কম কষ্ট দেয়নি। ওর সাথে ওর পরিবারকেও অপমান করা থেকে ছাড়েনি। আচ্ছা সব জেনে মৌরি কি তাকে ছেড়ে চলে যাবে? আজ মৌরির তাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভেবে তার বুক কাঁপছে কেন? তাশফিন কি মৌরিকে ভালোবাসতে শুরু করেছে?

-এই ভাইয়া! কী ভাবছো? জবাব দাও।

পিহুর চিৎকারে তাশফিনের ভাবনার সুতো কাটল। পিহু কিসের জবাব চাচ্ছে?

-কী বলছিলি?

পিহু অবাক চোখে চেয়ে বলল,

-কোন ধ্যান ধরেছিলে এতক্ষণ? আমার কথাই শুনোনি!

-আবার বল।

-তোমাকে কোন গরু বলেছে আমি সুইসাইড করতে চেয়েছিলাম?

-অ্যাক্সিডেন্টের আগে তুই মহুয়ার সাথে ফোনে অনেক কাঁদছিলি। মহুয়া জানত তোদের ব্রেকআপ হয়ে গেছে।

অবিশ্বাস্য গলায় পিহু বলল,

-আর ওই গরু সবাইকে জানালো আমি ব্রেকআপের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নিজের জীবনই শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। তুমিও এটা বিশ্বাস করেছ! বাহ, অসাধারণ!

তাশফিন পিহুর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। নিজের বিবেকের সামনেই দাঁড়াতে পারছে না সে মৌরির সামনে কীভাবে দাঁড়াবে? মৌরির পরিবার কি তাকে কোনদিনও ক্ষমা করবে? রুমে এসে তাশফিন মৌরিকে পেলো না। এই মেয়ে কোথায় থাকে? নিশ্চয় কোথাও আরিয়ানের সাথে বসে গল্প করছে। তাশফিন আজকের দিনটা বাড়িতেই কাটাল। যেভাবেই হোক মৌরির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।

মৌরি তখন সবে গোসল করে রুমে এসেছে। ভেজা চুলে এখনও তোয়ালে জড়ানো। মুখে, গলায় বিন্দু বিন্দু জলের কণা জমে আছে। মাথার তোয়ালে খুলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে। এমন সময় তাশফিন রুমে আসে। মৌরি আয়নার ভেতর দিয়ে তাশফিনকে রুমে আসতে দেখেছে। তাশফিন মৌরিকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়েছিল। এতদিন সব ঠিকঠাক থাকলেও সত্যিটা জানার পর এখন মৌরির চোখে চোখ রাখতে সংকোচ হচ্ছে। তাশফিন রুমে এসেও সরাসরি মৌরির দিকে না তাকিয়ে টুকটাক এটা সেটা করছে। মৌরি চুল মোছায় ব্যস্ত ছিল। অনেকক্ষণ ধরে তাশফিন কিছু খুঁজছে দেখে বলল,

-আপনি কি কিছু খুঁজছেন?

-হু? হ্যাঁ।

-কী খুঁজছেন বলুন আমি বের করে দিচ্ছি।

তাশফিন কিছুই খুঁজছে না। নিজেকে ব্যস্ত দেখাতে খোঁজার ভান করছিল। আজ তাশফিনের আচরণ মৌরির কাছেও কেমন ঠেকছিল। সে মনে মনে ভাবল,

-লোকটার হলোটা কী? অদ্ভুত আচরণ করছে।

মৌরি বেশি পাত্তা দিল না। সে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে হুট করে তাশফিন ওর হাত ধরে ফেলল। মৌরি আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাশফিনের দিকে তাকাল। কাজটা করতে তাশফিনেরও যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করতে হয়েছে। মৌরি ওভাবে তাকিয়ে আছে দেখেও তাশফিন ওর হাত ছাড়ল না। মৌরি মৃদু কন্ঠে বলল,

-কিছু বলবেন?

-হুম।

-বলুন।

-আমরা কি সব ভুলে নতুন করে শুরু করতে পারি না মৌরি।

তাশফিন মনের কথা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে পারে না। তাই সরাসরিই কথাটা বলে ফেলল। মৌরি বুঝতে পারছে না তাশফিন কী শুরু করার কথা বলছে। এমন কথা তাশফিন কোনদিন বলেনি।

-আমি আসলে ঠিক বুঝতে পারিনি।

-না বোঝার কিছু নেই। আমি তোমার সাথে আমার জীবন নতুন করে শুরু করার কথা বলেছি। আগে যা হয়েছে এখন থেকে সব ভুলে যাব। আমাদের দু’জনের মাঝে সবকিছু আবার প্রথম থেকে শুরু হবে।

মৌরি তাৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারল না। ফ্যালফ্যাল চোখে তাশফিনের দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটার হুট করে এমন অমূল পরিবর্তনের কারণ কী?

-মৌরি হয়তো আমি ভুল ছিলাম। আমি যা যা করেছি হয়তো তা করা ঠিক হয়নি। আমি যদি এখন বলি অতীতে আমার সব আচরণের জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। তুমি কি আমাকে ক্ষমা করবে না?


মাহিম হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারে পিহুকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পিহু সুস্থ হয়ে গেছে শুনে মাহিমের খুশির সীমা রইল না। ফাইজাকে বিয়ে করতে না করে দিয়েছে মাহিম। এতদিনে বুঝতে পেরেছে পিহু ছাড়া সে অন্য কাউকে বউ মানতে পারবে না। পরিবারের কথা ভেবে অন্য কাউকে বিয়ে করলেও মাহিম না পারবে সেই মানুষটাকে ভালো রাখতে। না পারবে নিজে ভালো থাকতে। মাহিম জানে তাশফিন কখনও পিহুর সাথে তার দেখা হতে দিবে না। তবুও মাহিম একটা বার নিজ চোখে পিহুকে দেখার জন্য ছুটে এসেছে। বউমনির ভাই আসার কথা আজ দারোয়ান জানালে তাশফিন ওকে ভেতরে আসতে দিতে বলল। তাশফিনের অনুমতি পেয়ে দারোয়ানের সাথে মাহিমও অবাক। মাহিম ভেতরে গিয়ে তাশফিনকে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল।

-অনেকদিন পর এলেন শালা সাহেব।

তাশফিনের কথার ধরন পুরোপুরি পাল্টে গেছে। ওর থেকে এরকম ভালো আচরণ পেয়ে মাহিম রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। তাশফিন স্বাভাবিক গলায় বলল,

-আসুন বসে কথা বলি।

মাহিম বোকার মতো বলেই ফেলল,

-তুই ছাড়া মুখ দিয়ে কথা বেরোতো না। আজ আপনি ডাকছো কোন খুশিতে?

তাশফিন বসতে বসতে বলল,

-বউয়ের বড় ভাইকে তুই ডাকা ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না।

-তোমার থেকে আমি ভদ্রতা আশাও করি না।

-তুমি না করলেও তোমার বোনের জন্য তোমাকে আমার সম্মান দিতেই হবে। বসছো না কেন?

মাহিম বসল। তাশফিনকে সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। নতুন কোন চাল চালছে? হঠাৎ এত ভালো হয়ে গেল কেন?

-আমার বোনকে তুমি বউ মানো? বিয়েটাও তো করোনি। কবুল না বলেই চলে এসেছিলে।

-ভাবছি বিয়েটা আবার করবো। সেজন্যই তো তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি। এবারের বিয়েতে সব সুন্দর, স্বাভাবিক হবে।

মাহিম ভাবছে দিনেদুপুরে এ নেশা করে আছে নাকি? কী সব অবাস্তব কথা বলছে। তাশফিন মাহিমের মাথা এতটা আউলিয়ে দিয়েছে সে যে পিহুর সাথে দেখা করতে এসেছিল এটাই ভুলে গেছে।

পিহু ভাইয়ের বিয়ের তোড়জোড় আয়োজন চালিয়ে দিয়েছে। ওয়েডিং ড্রেস কোন ডিজাইনারের থেকে বানাবে এটা জিজ্ঞেস করতে এসেছিল। এখানে এসে মাহিমকে তাশফিনের সাথে বসে থাকতে দেখে পিহুর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। মাহিম এখানে কী করছে? এতগুলো দিন পর পিহুকে চোখের সামনে দেখে মাহিম কিছুই বলতে পারল না। বিস্ময় কাটিয়ে পিহুই বলল,

-তুমি এখানে কী করছো?

তাশফিন বলল,

-মাহিম মৌরির বড় ভাই।

এই কথাটা পিহু সত্যিই জানত না। তার ভাই মাহিমের বোনকে বিয়ে করেছে! পিহুর মুখ খোলাই রয়ে গেল। তাশফিন বলল,

-মৌরি মনে হয় জানে না ওর ভাই এসেছে। আমি ওকে বলে আসি।

পিহু মাহিমকে একা রেখে তাশফিন চলে গেল। পিহুর বিস্ময় শেষ হচ্ছে না।

-তোমার বোন আমার ভাবী! মৌরি তোমার বোন? তুমি জানতে আমার ভাইয়ের সাথে তোমার বোনের বিয়ে হচ্ছে!

পিহুর কথায় বোঝা যাচ্ছে তাশফিন মৌরির বিয়ে কীভাবে হয়েছে এব্যাপারে পিহু কিছুই জানে না। বোনের থেকে লুকাতেই কি তাশফিন মাহিমের সাথে এত ভালো আচরণ করছে? অ্যাক্সিডেন্টের আগে ওদের ব্রেকআপ হয়ে গিয়েছিল তবুও পিহু মাহিমের সাথে সহজ ভাবেই কথা বলছে।

-আমরা এক হতে পারব না। কিন্তু আমাদের ভাইবোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ব্যাপারটা ভেবে মজা লাগছে। বোনের বিয়ের সময় জানতে এক্স গার্লফ্রেন্ডের ভাইয়ের সাথে বোনের বিয়ে দিচ্ছ।

মাহিম ওসব কোন কথায় গেল না। সে পিহুকে দেখছে। মাহিমকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে পিহু বলল,

-এক্স গার্লফ্রেন্ডের দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকলে জরিমানা হয়ে যাবে।

-তুমি কেমন আছো?

-চোখের সামনেই আছি। দেখে নাও কেমন আছি।

-আমার উপর তোমার রাগ অভিমান কিচ্ছু নেই?

-থাকার কথা ছিল?

-হয়তো।

মাহিম এসেছে শুনে মৌরির মনে একটাই শঙ্কা কাজ করছিল। মাহিম পিহু সামনাসামনি হয়ে গেলে কী হবে? কিন্তু এখানে এসে ওদের দু’জনকে কথা বলতে দেখে মৌরি হতবাক হয়ে রইল। পিহু তার ভাইয়ের উপর রাগ করে নেই?
মৌরিকে দেখে পিহু মাহিমকে বলল,

-ভাবী জানে তুমি আমার এক্স? না জানলে এখন জানাবো? বেচারি অনেক বড় ধাক্কা খাবে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে