শ্রাবণ ঝরা মেঘ পর্ব-২২+২৩

0
520

#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [২২]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

-ভাইয়া!

তাশফিনের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে ডাকল পিহু। এতগুলো দিন পর বোনের মুখ থেকে ভাইয়া ডাকটা শুনে তাশফিন আবেগ ধরে রাখতে পারল না। সে খুশিতে হাসছে ঠিকই। কিন্তু সেই হাসির সাথে চোখের পানিও ঝরে পড়ছে। পিহুরও হাসি কান্না একসাথেই দেখা দিয়েছে। তাশফিন ভারী পা দু’টো টেনে পিহুর কাছে এসে দাঁড়াল। পিহুকে সে সুস্থ দেখছে এটা যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না।

-কেন এত জ্বালিয়েছিস? ভাইকে টেনশন দিতে বরাবরই তোর ভালো লাগত। তাই বলে এবারেরটা কিন্তু বেশি হয়ে গেছে।

পিহু তাশফিনের দিকে তাকিয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

-সরি ভাইয়া।

পিহুর কাছে সরি বলাটা যতটা সহজ তাশফিনের কাছে এই দিনগুলো অপেক্ষা করা তার থেকেও হাজার গুণ বেশি কঠিন ছিল। প্রতিটা দিন হসপিটাল থেকে একটা কল আসার অপেক্ষা করে থেকে দিনশেষে নিরাশ হতে হয়েছে। তবে তাশফিন আশা ছাড়েনি। তার বিশ্বাস ছিল পিহু একদিন ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবে। তাশফিন ডক্টরের সাথে কথা বলেছে। অ্যাক্সিডেন্টে পায়ে ব্যথা পাওয়ায় পিহু এখনও একা একা হাঁটতে চলতে পারবে না। কিন্তু চাইলে ওকে বাড়িতে নিয়ে গিয়েও বাকি ট্রিটমেন্ট টুকু করা যাবে। তাশফিন পিহুকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়াই ঠিক মনে করল।

-আমাকে কবে বাড়ি নিয়ে যাবে ভাইয়া?

-আজই।

কথাটা শুনে পিহু খুশি হয়ে গেল। উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,

-সত্যি!

-হুম।

তাশফিন অন্য কাউকে না জানালেও বাবাকে এই খবরটা জানানো প্রয়োজন মনে করল। পিহুর সুস্থতার খবর শুনে তারেক চৌধুরী সব কাজ ফেলে এক দিনের ভেতরে দেশে ফিরে এলেন। বাড়িতে না গিয়ে তিনি সোজা হাসপাতালে এসেছেন। স্বামীর আসার খবর শুনে ইচ্ছে না থাকলেও লায়লাকে আসতেই হলো। তাশফিন পুরোটা দিন হসপিটালে কাটিয়ে দিয়েছে। মৌরি বাড়ি বসে থেকে শান্তি পাচ্ছে না। তাকেও কেউ নিয়ে যেত। মৌরি তাশফিনকে কল করে জেনেছে পিহুকে আজই বাড়ি নিয়ে আসবে তাই ফিরতে একটু দেরি হচ্ছে। পিহু এতদিন পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে ওকে ওয়েলকাম জানাতে কিছু তো করতে হবে। কিন্তু কী করবে? মৌরি সালেহা খালার কাছে ছুটলো। খালা আজ সকালেই ফিরেছে।

-খালা পিহু কী খেতে সবথেকে বেশি পছন্দ করে?

মৌরির উৎসাহ দেখে খালা হেসে বলল,

-ওই মেয়ের পছন্দের খাবার পিজ্জা বার্গার বাইরের সব ছাইপাঁশ জিনিস। ঘরের খাবার খাইতে চায় না। তাশফিন বাবা ধরে বেঁধে জোর করে খাওয়ায়।

-উনি বোনকে অনেক ভালোবাসে, না?

-পৃথিবীর সব ভাইয়েরাই তো বোনরে ভালোবাসে।

মৌরির নিজের ভাইয়ের কথা মনে পড়ল। তার ভাইও তাকে অসম্ভব ভালোবাসে। আচ্ছা পিহুর সুস্থ হয়ে যাবার কথা কি ভাইয়াকে জানাবে? না, যদি ভাইয়ার জন্যই পিহুর এই অবস্থা হয়ে থাকে তাহলে ভাইয়াকে না জানানোই ভালো। তারেক চৌধুরী, তাশফিন পিহুকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। পিহু যতদিন পুরোপুরি সুস্থ না হচ্ছে ততদিন ডক্টর হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে বলেছে। তাশফিন হুইলচেয়ার ঠেলে সদর দরজায় পা রাখতেই উপর থেকে ওদের উপর কিছু পড়ল। সাথে সাথে প্রচণ্ড জোরে একটা শব্দ হলে পিহু ভয় পেয়ে চোখ বুঁজে ফেলেছিল। কিন্তু চোখ খুলে সারপ্রাইজ পেয়ে খুশি হয়ে উঠল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাশফিনের দিকে ফিরে বলল,

-তুমি এসব করেছ না!

তাশফিন কিছুই করেনি। তার মাথাতেই ছিল না এসব। তবে এসব কে করেছে তা বুঝতে অসুবিধা হলো না। মৌরি পিহুর সামনে না এলেও দূর থেকে সে পিহুকে খুশি হতে দেখে নিজেও খুশি হচ্ছে। সালেহা খালার সাথে পিহুর কথা শেষ হলে তাশফিন ওকে রুমে নিয়ে এলো। পিহু এখনও বুঝতে পারছে না সে ঠিক কতদিন পর বাড়ি ফিরেছে। তার কাছে দু-তিন দিনই মনে হচ্ছে। পিহুর সাথে আরও অনেকটা সময় কাটিয়ে তাশফিন নিজ রুমে ফিরল। ওর পেছন পেছনই মৌরিও এসেছে। তাশফিন মৌরির দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা মাখা কন্ঠে বলল,

-থ্যাংকস মৌরি।

মৌরি কিছু বলল না। সামান্য হাসল শুধু। আজকের দিনটা হসপিটালেই কেটে গেছে। তাশফিন ওয়াশরুমে শাওয়ার নিতে ঢুকলো। শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েও মৌরিকে রুমে দেখে বলল,

-তুমি পিহুর সামনে যাওনি!

-পিহু হয়তো আমাকে চিনবে না।

-হুম। পিহু এখনও জানে না ওর ভাই বিবাহিত। আজকে একটু রেস্ট নিক। কাল তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেব।

মৌরি মাথা নেমে হু বললেও মনে মনে ভয় পাচ্ছে পিহু যখন জানবে সে মাহিমের বোন তখন কী তার সাথে কথা বলবে?


মাহিম বাড়ি ফিরে বাবা চাচা ফুপু সবাইকে একসাথে দেখে কিছুটা অবাকই হলো। মা তাকে জানালো বাবা তার আর ফাইজার বিয়ের কথা বলতে সবাইকে ডেকেছেন। মাহিম এব্যাপারে কিছুই জানত না। তাকে না জানিয়েই সবাই সব ঠিক করে ফেলে। তার সিদ্ধান্তের কি কোন মূল্য নেই।

-আজ সবাই বসবে আমাকে জানানোরও প্রয়োজন মনে করলে না মা?

-তুই তো সব জানিসই।

-হুম। আমি তো সব জানি। তোমরা জানালে ফাইজার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছ। আমি জেনে বসে রইলাম। আমি কী চাই এটা কেউ জানতে চাইলে না। এখনও তোমরা নিজেরাই ঠিক করছো বিয়েটা আমাকে কবে করতে হবে। ঠিক আছে। তোমরা তারিখ ঠিক করে ফেললে আমাকে জানিয়েও দিও।

-এভাবে বলছিস কেন বাবা? আমরা কি তোর খারাপ চাই?

-ভালো চাইতে গিয়েই তো নিজেদের অজান্তে খারাপ চেয়ে ফেলছো মা।

ছেলের এমন কথা শুনে মা থমকে গেলেন। মাহিম দু’হাতে মুখ চেপে ধরে বিছানায় বসে পড়ল। মা গিয়ে ছেলের পাশে বসলেন। কাঁধে হাত রেখে বললেন,

-তুই কি বিয়েটা করতে চাস না?

-আমার চাওয়া না চাওয়াতে কার কী আসে যায়?

-আমার আসে যায়। তুই বল। ফাইজাকে তোর পছন্দ না?

-মৌরি আর ফাইজা আমার জন্য আলাদা না মা। ফাইজাকে আমি কোনদিন ওরকম চোখে দেখিনি। সবকিছু আমার জন্য অনেক বেশি কঠিন হয়ে যাচ্ছে মা।

-এই কথা তুই আগে কেন বলিস নি বাবা।

-তোমাদের খুশি এটাতে ছিল।

পরিবারের খুশির কথা ভেবে ছেলেটা নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। মা হয়ে তিনি নিজের ছেলেকে বুঝতে পারেননি।


রাতে তাশফিন পিহুর ঘরে যাবার সময় আরিয়ান সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়াল। তাশফিন ওকে পাত্তা দিল না। পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে আরিয়ান হাত মেলে বাধা দিল। এবার তাশফিন বিরক্তি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

-কী চাস?

তাশফিনকে হতভম্ব করে দিয়ে আরিয়ান ওর কলার চেপে ধরল। তাশফিন বাধা দেওয়ার সময় পেলো না। তার আগেই আরিয়ান বলে উঠল,

-তোর জন্য আমি আমার ভালোবাসাকে হারাতে যাচ্ছি। তুই সব নষ্ট করেছিস। এখন তুই-ই সব ঠিক করে দিবি। কীভাবে দিবি আমি জানি না। কিন্তু তোর জন্য যদি ফাইজাকে হারাতে হয় তাহলে মৌরিকে নিয়েও আমি তোকে সুখে থাকতে দিব না।

তাশফিন বোকার মতো কতক্ষণ আরিয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে পরমুহূর্তে হো হো করে হেসে উঠল। আরিয়ান ওকে হাসতে দেখে আরও বেশি রেগে গিয়ে কলার ধরে ঝাঁকাতে লাগল। তাশফিন একটু জোর খাটিয়ে আরিয়ানের হাত কলার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাসতে হাসতেই বলল,

-ফাইজা! মৌরির বোন?

তাশফিনের হাসি থামছেই না। এদিকে আরিয়ান রেগে বোম হচ্ছে। এখন শুধু ফাটার অপেক্ষা।

-শেষমেশ আমার শালিকা! উম ওয়েট, চেহারা মনে করে নিই। বিয়ের দিন হয়তো দেখেছিলাম। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তোর চয়েস তো খারাপ জানতাম। কিন্তু এক্ষেত্রে তোর পছন্দের প্রশংসা করতে হয়। তা সমস্যা কী? পছন্দ করিস, প্রপোজ কর। মেয়ে মেনে গেলে বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠা। ওপস, এবার বুঝেছি। ওর পরিবার মানবে না, না? হুম। ফাইজার বিয়ে তো আমার শালার সাথে ঠিক হয়ে আছে। দেখেছিস না জেনে প্রেমে পড়ার কত প্যারা। আমাকে আগে জিজ্ঞেস করে নিতি। আমিই বলে দিতাম।

তাশফিন এখনও মুচকি মুচকি হাসছে। আরিয়ান রাগ সামলে পারল না। অকস্মাৎ তাশফিনের মুখে ঘুসি মেরে বসল। তাশফিন প্রস্তুত ছিল না। ছিটকে একটু দূরে গিয়ে পড়ল।

-অনেক হাসি পাচ্ছে না! তোর হাসি আমি বের করে দিব।

তাশফিন নিচে পড়ে গিয়েও হাসছে। আরিয়ানাকে অসহায়ত্ব সে স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে। এটা এমনিতেই প্রেমে ব্যর্থ হয়ে দেবদাস হয়ে আছে। এর গায়ে আর হাত তুললেই কী? তাই তাশফিন আরিয়ানের এই ভুল মাফ করে দিল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

-আহ-হা হা রে! প্রেমে ব্যর্থ! বুঝতে পেরেছি। আমার সহানুভূতি তোর সাথেই আছে। কিন্তু এরকম মাথা গরম করলে তো হবে না৷ প্রথম বারের অপরাধ মাফ করা যায়। কিন্তু দ্বিতীয় বার একই অপরাধ করলে শাস্তি দিতে হয়।

পিহুর ঘরের দরজার কাছ থেকে তাশফিন ফিরে এসেছে। কারণ একটু উঁকি দিয়ে দেখেছে পিহু ঘুমিয়ে পড়েছে। পিহু একটু সুস্থ হলেই তাশফিন জানতে চাইব পিহু কেন তাকে এত বড় শাস্তি দিতে চাচ্ছিল। ওরকম একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভাইয়ের কথা একবারও মনে পড়ল না?
রুমে এসেও আরিয়ানের কথা ভেবে তাশফিনের ঠোঁটের কোন থেকে হাসি সরছে না। মৌরি লক্ষ্য করে বলল,

-আপনি হাসছেন!

-হুম।

-কেন?

-হাসির কারণ ঘটেছে।

মৌরি আরেকটু লক্ষ্য করলে দেখতে পেল তাশফিনের ডান গালে হালকা মতো কিসের একটা দাগ। মনে হচ্ছে একটু কালো হয়ে আছে।

-আপনাকে কি কেউ মেরেছে?

তাশফিন গালে হাত দিলে ব্যথা টের পেলো। গাধাটা জোরেই মেরেছে। মৌরি তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে বলল,

-প্রেমে ব্যর্থ হওয়া এক প্রেমিক।

মৌরি কিছুই বুঝতে পারল না। সে বোঝার চেষ্টাও করল না।

সকালে তাশফিন পিহুর কাছে গেলে পিহুর সবার আগে যে কথাটা জিজ্ঞেস করল তা হলো,

-ভাইয়া কাল বাড়িতে একটা মেয়েকে দেখেছি। মনে হয় না ওকে আগে দেখেছি। মেয়েটা কে? কাজের লোকও মনে হয়নি।

চলবে

#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [২৩]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

-ভাইয়া কাল বাড়িতে একটা মেয়েকে দেখেছি। মনে হয় না ওকে আগে দেখেছি। মেয়েটা কে? কাজের লোকও মনে হয়নি।

পিহু যে মৌরির কথা বলছে এটা বুঝতে পেরে তাশফিন কতক্ষণ চুপ করে থাকল। একটু সময় নিয়ে খুব শান্ত স্বরে বলল,

-ও তোর ভাবী।

পিহু চোখে মুখে একঝাঁক কৌতূহল দেখা দিয়েছে। সে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

-আরিয়ান বিয়ে করে ফেলেছে?

তাশফিন অসহায় মুখে পিহুর দিকে তাকাল। পিহু কি বুঝতে পেরেও ওর সাথে মজা করছে! তাশফিন জানে তার বিয়ে নিয়ে পিহু অনেক স্বপ্ন দেখে রেখেছে। সে পিহুকে ছাড়াই বিয়ে করে নিয়েছে এটা জানলে মেয়েটা কষ্ট পাবে। তবুও তো সত্য লুকিয়ে লাভ নেই। পিহু এখনও আগের মতোই তাশফিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তাশফিন বলল,

-আরিয়ান তোর ভাই?

-না।

-কয়টা ভাই আছে তোর?

-এক পিসই। তুমি।

-তাহলে তোর ভাবী মানে আমারই বউ। এই সামান্য হিসেবটা বুঝছিস না!

-হিসেব গোলমেলে লাগছে। আমি কয়টা দিন হসপিটালে ছিলাম। তার মধ্যেই তুমি বিয়ে করে নিয়েছ!

কয়দিন হসপিটালে ছিল! সাড়ে তিন মাস সময়কে ওর কাছে কয়দিন মনে হচ্ছে? ভাই বিয়ে করেছে এতেই পিহু খুশি। কিন্তু তাই বলে ভাইকে যে একটু নাকানিচুবানি খাওয়াবে না তা কী করে হয়? পিহু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বলল,

-আমি কাল বাড়ি এসেছি। তুমি এখনও ভাবীর সারা আমার দেখা করাওনি। আমাকে বিয়েতেও রাখোনি। তুমি আসলে কেমন ভাই হ্যাঁ? আমি কি তোমার সৎবোন? সৎবোন হলেও তো আরিয়ান আমাকে ওর বিয়েতে দাওয়াত দিবে। তুমি নিজের ভাই হয়ে বোনের সাথে এত বড় অন্যায় করতে পারলে!

তাশফিনের কাছে কোন কৈফিয়ত নেই। সে অপরাধী মুখে দাঁড়িয়ে রইল। পিহু এখনই এত রাগ করছে, যখন জানবে মৌরি মাহিমের বোন তখন কী করবে?

মৌরি মুখ নিচু করে পিহুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পিহু জহুরি চোখে মৌরিকে দেখে গম্ভীর গলায় বলল,

-তুমি আমার ভাবী?

-হুম।

-মাথা নিচু করে রেখেছ কেন? আমার দিকে তাকাও।

মৌরি মাথা তুলে তাকাল। পিহুর এমন আচরণে মৌরি বেশ ভীত হয়ে আছে। বেচারির মুখের দিকে তাকিয়ে পিহুর হাসি পেলেও হাসি চেপে রেখে বলল,

-তুমি আমাকে চেনো?

-হুম।

-চিনলেও আবার চিনে নাও। আমি তোমার ননদ। বাংলা সিনেমার দজ্জাল ননদ গুলোর থেকেও খারাপ ননদ বুঝেছ?

তাশফিন পিহুর উদ্দেশ্যে বলল,

-থাম তো এবার।

-তুমি কোন কথাই বলো না। দু’জন এত দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছ? কাছাকাছি দাঁড়াও দেখি আমার ভাইয়ের সাথে ভাবীকে কেমন মানিয়েছে।

মৌরি তার নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল। তাশফিন এসে ওর পাশে দাঁড়াল। পিহু ভাই ভাবীকে একসাথে দেখে আর অভিনয় চালিয়ে যেতে পারল না। সে খুশিতে চিৎকার করে উঠে বলল,

-মাশা-আল্লাহ! কী সুন্দর মানিয়েছে তোমাদের! আমার ভাইয়ের পছন্দ নিয়ে কোনকালেই সন্দেহ ছিল না। পুতুলের মতো সুন্দর করে ভাবী নিয়ে এসেছ। তোমরা আমার কাছে এসো।

মৌরি ভেবেছিল পিহু রাগ করবে। কিন্তু তাশফিন জানত পিহু নাটক করছে। মৌরি পিহুর কাছে গেলে পিহু ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-আমাকে ছাড়া বিয়ে করেছ তো কী হয়েছে? আমি তোমাদের আবার বিয়ে দেব। শুধু একবার নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে দাও।


মৌরি আরিয়ানের সাথে কথা বলছে না। এটা নিয়েও আরিয়ান বিরক্ত। সেদিন নাহয় রাগের মাথায় হসপিটালে যেতে না করে দিয়েছিল। তাই বলে মৌরি তার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিবে?
ওদিকে ফাইজারও কোন খোঁজ খবর নেই। আরিয়ান মৌরির পথ আটকে দাঁড়িয়ে বলল,

-তুমিও রাগ করছো? কথা বলবে না? বাড়িতে তুমি কথা বলো না। ওদিকে তোমার বোন কলেজে আসে না। আমি কি পাগল হয়ে যাব?

মৌরি অনুসন্ধানী চোখে আরিয়ানকে দেখে বলল,

-তুমি কি সত্যিই ফাইজাকে নিয়ে সিরিয়াস?

-টাইমপাস করার হলে আমি তোমাকে বলতাম?

-কিন্তু ফাইজার তো বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।

-বিয়ে ঠিক হওয়া আর বিয়ে হয়ে যাওয়ার মাঝে অনেক পার্থক্য।

-ফাইজা ওরকম মেয়ে না।

-আমিও যেমন তেমন ছেলে না।

দূর! এই ছেলে নাছোড়বান্দা। একে বোঝানোর সাধ্য মৌরির নেই।

-আমার পরিবার মানবে না।

-তুমি মানাবে। বন্ধুর জন্য এটুকু পারবে না মৌরি? আমি তোমার বন্ধু না হলেও দেবর। একবার ভাবো, আমি ফাইজাকে বিয়ে করলে তোমরা দুই বোন সারাজীবন একসাথে থাকতে পারবে।

মৌরি মনে মনে বলল,

-পুরান পাগলের ভাত নাই। এই নতুন পাগল কোত্থেকে আমদানি হলো?

তাশফিন পিহুর থেকে জানতে চায় সেদিন কী হয়েছিল। কিন্তু কথাট বলার সঠিক সময় বের করতে পারছে। পিহু এখনও অসুস্থ। এই সময় জিজ্ঞেস করাটা কি ঠিক হবে? আর কয়টা দিন যাক। কিন্তু পিহু তো হাতে-হাত রেখে বসে থাকার মেয়ে না। সে বলেছে আবার ভাইয়ের বিয়ে দিবে মানে দিবেই। এই বিষয়ে পিহু তারেক চৌধুরীর সাথেও কথা বলেছে। পিহুর কথা শুনে তারেক চৌধুরী এটুকু বুঝলেন যে পিহু এখনও কিছুই জানে না। তাশফিন কীভাবে, কেন মৌরিকে বিয়ে করেছে।

-আঙ্কেল আমরা কিন্তু ভাইয়ার বিয়ে আবার দেব।

পিহুর খুশির জন্য তারেক চৌধুরী হেসে বললেন,

-আচ্ছা দিব।

-তুমি কিন্তু এখন থেকেই আয়োজন শুরু করে দাও। কিন্তু ভাইয়া ভাবীকে আগে থেকে কিছু জানতে দিও না।

-হুম।

দিন সাতেকের মধ্যেই পিহু অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। এখন নিজে নিজে হাঁটতেও পারে। তাশফিনের বিয়ের ভূত পিহুর মাথায় ভালো ভাবেই চেপে। পিহু হুইলচেয়ার থেকে উঠে নিজে নিজে হাঁটার চেষ্টা করছে। একা দাঁড়াতে সমস্যা হয় না। কিন্তু বেশিক্ষণ হাঁটলে পা কাঁপতে শুরু করে। আরিয়ান তখন কোথাও বেরুচ্ছিল। পিহু হাঁটতে গিয়ে টলে উঠলে আরিয়ান ভাবল পিহু হয়তো পড়ে যাচ্ছে। সে ছুটে এসে পিহুকে ধরে ফেলল।

-সমস্যা কি পিহু? একা হাঁটতে না পারলে চেষ্টা করার প্রয়োজন কী?

পিহু অবাক হয়ে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে রইল। তাশফিনের থেকে মায়া মমতা ভালোবাসা প্রত্যাশা করা যায়। কিন্তু আরিয়ানের থেকে পিহু কখনও এসব আশা করে না। আরিয়ান পিহুকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল,

-আরও কয়টা দিন সময় দিলে এমনিতেই হাঁটতে পারবে। জোর করে হেঁটে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মানে নেই।

পিহু বিস্ময় ধরে রাখতে না পেরে বলেই ফেলল,

-তুমি ঠিক আছো? নাকি আমাকে চিনতে ভুল করছো? আমি পিহু।

-আমি জানি তুমি পিহু।

-তাহলে আমার এত খেয়াল রাখছো কেন?

-তুমি না চাইলে রাখব না।

-তোমার কী হয়েছে বলো তো? প্রেমে ট্রেমে পড়েছ! হ্যাঁ, প্রেমেই পড়েছ। নাহলে হঠাৎ এত পরিবর্তন আসতো না।

-বুদ্ধি আছে মাথায়।

পিহু হেসে জিজ্ঞেস করল,

-মেয়েটা কে?

-আছে একজন।

-এখনও পটাতে পারোনি?

-পটাতে চাই না। বিয়ে করতে চাই।

-হায়! তোমার মুখ থেকে কোনদিনও এসব কথা শুনব আমি ভাবতেও পারিনি। সমস্যা কী? মেয়ে রাজি না? নাকি পরিবার মানছে না?

-মেয়ে পরিবার সবই ত্যাড়া। কেউই মানছে না।

-লেগে থাকো। হয়ে যাবে।

-হুম। তুমিও একা একা হাঁটার চেষ্টা করো না।

ফাইজার বিয়ে ভেঙে গেছে। মাহিম না করে দিয়েছে। এতে অবশ্য ফাইজা কষ্ট পায়নি। বরং ভালোই হয়েছে। কিন্তু এই কথাটা ফাইজা আরিয়ানাকে জানায়নি। সে এখনও সমানতালে আরিয়ানকে ঘুরিয়ে যাচ্ছে। তার প্রতি আরিয়ানের এত ব্যাকুলতা ফাইজা মনে মনে উপভোগ করছে। আজও আরিয়ান ফাইজাকে দেখে গাড়ি থেকে নেমে এসেছে। আর ফাইজা ওকে দেখে এমন একটা ভাব করছে যেন সে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে। আরিয়ান রিকোয়েস্ট করেই যাচ্ছে।

-ফাইজা প্লিজ। তুমি জানো না আজ পর্যন্ত কতগুলো মেয়ে আমার পেছনে ঘুরেছে। এমনকি আমার মমের পেছনে মেয়ের মা-রা এখনও ঘুরে।

-তো? এসব আমাকে জানাচ্ছেন কেন?

-জানাচ্ছি একারণে তোমার মনে যেন আমার জন্য একটু দয়া হয়।

-দয়া চান নাকি ভালোবাসা?

-অফকোর্স ভালোবাসা। কিন্তু তুমি তো দিতে নারাজ।

-আমি হ্যাঁ বলে দিলে কী হবে?

-কী আর হবে? আমাদের বিয়ে।

-জেগে জেগে স্বপ্ন দেখলে সেই স্বপ্ন কোনদিনও পূরণ হয় না। আমার পরিবারকে জানাতে পারবেন?

-মানিয়ে নেব।

-অসম্ভব। আমার বাবা চাচা তো আপনাদের নামই শুনতে পারে না।

আরিয়ান দাঁড়িয়ে পড়ল। অসহায় কন্ঠে বলল,

-তাশফিনের জন্য আমি কেন শাস্তি পাব?

-কারণ আপনি উনার ভাই।

-সৎ ভাই। তাশফিনের মা বাবা আলাদা। আমার মা বাবা আলাদা। যদিও এখন তাশফিনের বাবা আমার মমের হাসবেন্ড।

ফাইজা এই কথাটা জানত না। উনারা আপন ভাই না? এজন্যই কি মৌরি আপুর বিয়েতে আরিয়ানকে দেখেনি?


তাশফিন পিহুর সাথে খোলাখুলি কথা বলতে এসেছে। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর পিহু একবারের জন্যও ওর অ্যাক্সিডেন্টের কথা তুলেনি। তাশফিন অবশ্য আগেই জানে। ওটা অ্যাক্সিডেন্ট না, সুইসাইডই ছিল। তবুও সে পিহুর মুখ থেকে শুনতে চায়।

-তুই কতদিন হসপিটালে ছিলি জানিস?

-হুম। খালা বলেছে। খালা এটাও বলেছে তুমি আমার জন্য কতটা টেনশনে ছিলে।

-কী হয়েছিল সেদিন?

পিহু কতক্ষণ চুপ করে থাকল। তাশফিন উদ্বিগ্ন হয়ে পিহুর দিকে তাকিয়ে আছে। ওসব স্মৃতি মনে করা কষ্টের। পিহু মৃদু স্বরে বলল,

-তোমাকে একটা কথা জানানো হয়নি।

-কোন কথা?

-আমি একটা ছেলেকে পছন্দ করতাম।

-শুধুই পছন্দ?

-আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্কও তৈরি হয়েছিল।

-তারপর?

-সম্পর্কের শুরুতেই মাহিম বলতো আমাদের বিয়ে কোনদিনও সম্ভব হবে না। তবুও আমি ওকে জোর করেছি। আসলে ভাইয়া ওকে আমি অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলাম।

-হু, পরে।

-ও ওর পরিবারের একমাত্র ছেলে। সেদিক দিয়ে পরিবারের সব দায়িত্বই ওর উপর। মাহিম ওর বাবা মা’কে কখনও নিরাশ করতে চায়নি। ওর এক কাজিনের সাথে ওর বাবা মা আগেই বিয়ে ঠিক করে রেখেছিল। আমি এটা জানতাম।

পিহুর কথা শুনতে শুনতে তাশফিনের কপালে চিন্তার রেখা দেখা দিতে লাগল। পিহু যা বলছে তা মাহিমের কথার সাথে মিলে যাচ্ছে। তার মানে কি মাহিম কখনও পিহুকে মিথ্যা বলেনি! এমন হলে তো মাহিম পিহুকে ধোঁকাও দেয়নি।

-আমার অ্যাক্সিডেন্টের দিন আমরা ব্রেকআপ করে ফেলি। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু এটাই আমাদের নিয়তি বলে মেনে নিয়েছিলাম। মাহিমও সেদিন অনেক কেঁদেছিল।

তাশফিন এপর্যায়ে আর থাকতে পারল না। উত্তেজিত হয়ে বলে বসল,

-দু’জনের সম্মতিতে ব্রেকআপ হলে তুই সুইসাইড করতে গিয়েছিলি কেন?

তাশফিনের কথা শুনে পিহুর মুখ হাঁ হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য গলায় বলল,

-আমি সুইসাইড করতে গিয়েছিলাম! কে বলল?

-তুই সুইসাইড করতে চাসনি?

-কী আশ্চর্য! আমি সুইসাইড করতে চাইব কোন দুঃখে? এসব পাগলামি কথা তোমাকে কে বলেছে? কান্নাকাটি করছিলাম ঠিক আছে। তাই বলে আমি এতটাও পাগল নই যে নিজে নিজে মরতে যাব। ছোট একটা স্কুল বাচ্চা রাস্তা পেরোতে গিয়ে গাড়ির সামনে চলে এসেছিল। ওকে বাঁচাতে গিয়ে পেছন থেকে একটা ট্রাক এসে আমাকেই উড়িয়ে দেয়। তারপর তিন মাস পর হসপিটালে আমার চোখ খুলে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে