#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [২১]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
এত বড় বাড়িতে মৌরি আজ সম্পূর্ণ একা। শ্বশুর আব্বা বিজনেসের কাজে দেশের বাইরে আছেন। শাশুড়ি তার কোন বান্ধবীর বাড়ি গেছে। আরিয়ান কোথায় গেছে মৌরি জানে না। এমনিতে সালেহা খালা তার সাথে থাকত। আজ সকালে সালেহা খালা বাড়িতে গেছেন। তার বড় ছেলে অসুস্থ। একা বাড়িতে ভয়ে মৌরির কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। ভয় পাওয়ার জন্য একা বাড়িতে গা ছমছমে পরিবেশ কি কম ছিল? তার সাথে আবার আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করেছে। বাইরে প্রচুর বাতাস হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো ঝড়তুফান শুরু হয়ে যাবে। মৌরি হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাচুমাচু হয়ে বসে দোয়া-দরুদ পড়ছে।
-আল্লাহ আজকে ঝড়বৃষ্টি দিও না। প্লিজ আল্লাহ। তুমি তো জানো ঝড়বৃষ্টি আমি কত ভয় পাই। বাড়িতে একটা কাকপক্ষীও নেই। ভয়ে মরে গেলেও কেউ আমাকে বাঁচাতে আসবে না।
মৌরির দোয়া আল্লাহ শুনলো না। একটু পরেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎ চমকানো বাজ পড়া তো আছেই। মৌরি দু’হাতে কান চেপে ধরলো। বিকট শব্দে খুব কাছে কোথাও বাজ পড়েছে। মৌরি এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। এই মুহূর্তে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে হয়তো মৌরি ভয়ে কলিজা ফেটে মরেই যাবে।
আজ তাশফিনের বাড়ি ফেরার কথা ছিল। মৌরি কাঁপা হাতে আশেপাশে ফোন খুঁজতে লাগল। একটু খুঁজে ফোনটা পেয়েও গেল। ঠান্ডা পরিবেশেও বেচারি ঘেমে একাকার। কোনরকমে তাশফিনের নাম্বারে ট্রাই করল। তাশফিন তখন কাছাকাছি চলে এসেছে। প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। সামনের রাস্তা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে কল তুললে নিশ্চিত অ্যাক্সিডেন্টের হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। তাই তাশফিন কল তুললো না।
-প্লিজ কলটা তুলুন। আজ কল না তুললে আপনি বাড়ি এসে দেখবেন আমি মারা গেছি। অবশ্য আমার বাঁচা মরা দিয়েও আপনার কিছু আসে যায় না। আমি যে কিসের আশায় এখানে আছি নিজেও বুঝতে পারছি না।
মৌরি পরপর কয়েকবার ট্রাই করল। তারপরই বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে বাজ পড়ে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল। মৌরির দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে যাবার জোগাড় হলো। সে শব্দ করে কাঁদতে লাগল। ছোটবেলা থেকে মৌরি কোনদিনই একা ঘরে শোয়নি। জয়েন্ট ফ্যামিলি হওয়ায় চাচাতো, ফুপাতো বোনদের অভাব ছিল না। ছোট চাচার মেয়ে নিশা সেই সাত বছর বয়সে থেকেই মৌরির সাথে ঘুমায়।
কোনদিনও ঝড়বৃষ্টি শুরু হলে দু’জনই ভয়ে চিৎকার শুরু করে দিলে মা এসে সাথে থাকত। আজকে মা’র কথা ভীষণ মনে পড়ছে মৌরির।
-মা কোথায় তুমি? তোমার মেয়ে ভয় পাচ্ছে মা।
বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নামতে গিয়ে তাশফিন ফোন হাতে নিল। মৌরির এতগুলো মিসড কল! কারণ ছাড়া নিশ্চয় মৌরি এতবার কল করবে না। বৃষ্টিতে ভিজেই তাশফিন জলদি বাড়ির ভেতর ঢুকলো। পুরো বাড়ি অন্ধকার দেখে আগেই বুঝে গিয়েছিল মৌরি হয়তো ভয় পেয়ে তাকে কল করেছে। ইলেক্ট্রিসিটি নেই তাই অন্ধকার। কিন্তু বাড়ির মানুষ গুলো কোথায়? কেউ আলো জ্বাললো না কেন? ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে তাশফিন রুমের দিকে ছুটলো। রুমের বাইরে থেকেই মৌরির কান্নার শব্দ শুনতে পেলো। তাশফিনের বুকটা ধক করে উঠল। দরজার সামনে থেকেই তাশফিন ডাকল।
-মৌরি!
ডাকটা শুনেও মৌরি ভয়ে মাথা তুলে তাকাতে পারছে না। তাশফিন মৌরির কাছে এসে বসে ওর মাথায় হাত রাখল। মৌরি থরথরিয়ে কেঁপে উঠে মাথা তুলে চাইল। তাশফিনকে চোখের সামনে দেখে মৌরির কী হলো কে জানে, সে হু হু করে কেঁদে ফেলে তাশফিনকে জড়িয়ে ধরল। তাশফিন বাকরুদ্ধ। মেয়েটা এত পরিমাণ ভয় পেয়েছে!
-মৌরি! ভয় পাচ্ছিলে? দেখো আমি চলে এসেছি।
মৌরি ফোঁপাতে ফোঁপাতে অস্পষ্ট সুরে বলল,
-আপনি আসতে এত দেরি করলেন কেন? আমি যদি মরে যেতাম।
তাশফিন মৌরিকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। সে একটা কথাই ভেবে পাচ্ছে না মৌরিকে রেখে সবাই কোথায় গিয়েছে। মৌরির শরীরের কম্পন এখনও কমছে না। তাশফিন আলতো করে মৌরির পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
-আমি তো জানতাম না তুমি বাড়িতে একা আছো।
-আমি তো আপনাকে কল করেছিলাম।
-আ’ম সরি মৌরি। তখন তোমার কল তুলতে পারিনি।
মৌরি কিছু বলল না। অনেকটা সময় পর মৌরি কিছুটা শান্ত হলে তাশফিন জিজ্ঞেস করল,
-বাকি সব কোথায়?
-কেউ বাড়ি নেই।
-তোমাকে একা রেখে গেছে!
-হুম।
তাশফিনের রাগ হলো। নিজের উপর নাকি বাড়ির মানুষের উপর বুঝতে পারল না। মৌরি তার দায়িত্ব। বাকিদের থেকে কিছু আশা করা বোকামি। তার নিজেরই মৌরির খেয়াল রাখা উচিত ছিল।
”
”
পরের দিনও আরিয়ান ফাইজার অপেক্ষায় কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ছুটির অনেকটা সময় পরও সবাই বেরিয়ে গেলেও ফাইজার দেখা পাওয়া গেল না। আরিয়ান ভাবছে ফাইজা কি তার জন্য কলেজে আসা বন্ধ করে দিবে? আরে না। ফাইজা নিশ্চয় এতটাও ভীতু মেয়ে নয়। আরিয়ান বাড়ি ফিরে এলো। ফাইজা মৌরির বোন। ওর বিয়ে ঠিক হয়ে থাকলেও মৌরির নিশ্চয় অজানা থাকবে না। বাড়িতে পা রেখেই আরিয়ান সোজা মৌরির কাছে এলো। কোনরকম ভনিতা করে করে জিজ্ঞেস করল,
-তোমার বোন ওর কি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?
আরিয়ান কোন বোনের কথা জিজ্ঞেস করছে মৌরি প্রথমে বুঝতে পারল না।
-কোন বোন?
-ফাইজা। ও তোমার বোন না?
-হ্যাঁ। ফুপাতো বোন। ওর কথা জিজ্ঞেস করছো কেন?
-ওর কি সত্যিই বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?
-হুম। কেন জিজ্ঞেস করছো?
-পরে বলি। বিয়ে কার সাথে ঠিক হয়েছে?
মৌরি ঘটনা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে। আরিয়ান কি ফাইজাকে পছন্দ করে!
-আগে বলো কেন জানতে চাচ্ছ।
-প্লিজ মৌরি, জানাটা প্রয়োজন।
-ফাইজার বিয়ে আমার ভাইয়ের সাথে ঠিক হয়েছে। আমার ভাইকে তো চেনো? চেনো না? ওহ তোমাদের হয়তো দেখা হয়নি।
আরিয়ান কতক্ষণ হতবাক হয়ে মৌরির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
-ফাইজা তোমাদের বোন না!
-হ্যাঁ বোন। কাজিন বিয়ে ইসলামে জায়েজ আছে।
-তা হয়তো আছে। কিন্তু ভাইবোনের বিয়েটা কেমন ব্যাপার এটা! তাছাড়া ফাইজা রাজি?
-আরিয়ান তুমি কি ফাইজাকে পছন্দ করো?
-হুম। প্রপোজও করেছি। কিন্তু তোমার বোন বলেছে তোমার পরিবার নাকি আমার সাথে ওর বিয়ে দিবে না। কেন দিবে না জানতে পারি?
মৌরি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। কোন কথাই খুঁজে পেলো না। আরিয়ান কবে থেকে ফাইজাকে পছন্দ করতে লাগল! মানুষের মন সত্যিই বড় অদ্ভুদ। আরিয়ান নিজেই বলল,
-তাশফিনের জন্য তোমার পরিবার আমাদের উপর রাগ, না?
-ওরকম কিছু না। আর আমার ভাইয়ের সাথে ফাইজার বিয়ে অনেক আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে।
-ফাইজা তোমার ভাইকে ভালোবাসে?
-আমাদের দুই পরিবার বিয়েটা ঠিক করেছে?
-ফাইজা তোমার ভাইকে ভালোবাসে? হ্যাঁ বা না।
-আমি জানি না।
-ঠিক আছে। আমি জেনে নিব। আর ফাইজা যদি শুধুমাত্র পরিবারের কথাতে বিয়েটা করতে চায় তাহলে ওর বিয়ে আমার সাথে হবে।
কথাটা বলে আরিয়ান চলে যাচ্ছে। মৌরি বোকার মতো কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে পেছন থেকে ডাকল।
-আরিয়ান! এই পাগল, কী বলে গেল এসব। এই ছেলে পাগল টাগল হয়ে গেল নাকি?
”
”
তাশফিনের ফোন বেজেই যাচ্ছে। সে রুমে নেই। মৌরি ফোন হাতে নিয়ে দেখল স্ক্রিনে ‘ডক্টর’ লেখা। তার মানে হসপিটাল থেকে কল এসেছে। পিহুর কিছু হলো না তো! ফোন হাতে মৌরি তাশফিনকে খুঁজতে ছুটলো। কিন্তু আশেপাশে কোথাও তাশফিনকে না পেয়ে কল কেটে যাওয়ার আগে নিজেই রিসিভ করে কথা বলল।
-হ্যালো, মিস্টার চৌধুরী। আপনাকে ইমিডিয়েটলি একবার হসপিটালে আসতে হবে।
হাসপাতালে যেতে বলছে! কিন্তু কেন? সময় নষ্ট না করে মৌরি বলল,
-আমি মিসেস চৌধুরী বলছি। আমার হাজবেন্ড ফোন সাথে নেয়নি। পিহুর কি কিছু হয়েছে? আপনি আমাকে বলতে পারেন।
-পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। উনি কোমা থেকে বেরিয়ে এসেছেন।
পিহুকে মৌরি কোনদিন সামনাসামনি দেখেনি। কিন্তু মেয়েটার এমন অবস্থা তার ভাইয়ের জন্যেই হয়েছে। এটা ভেবেই মৌরির নিজেকে অপরাধী লাগত। আজ পিহুর সুস্থতার খবর শুনে সবথেকে বেশি খুশি মৌরিই হয়েছে। তাশফিনকে বোনের সুস্থতার কথাটা জানাতে মৌরি ছটফট করতে লাগল।
-কিন্তু উনি কখন ফিরবেন?
মৌরি অপেক্ষা করতে পারল না। পিহু কোন হসপিটালে আছে সে জানে না। কিন্তু বাকিরা নিশ্চয় জানে। মৌরি শাশুড়ির কাছে ছুটলো। কিন্তু সেখানে গিয়েও হতাশ হলো। শাশুড়ি মা বেরিয়েছেন। আরিয়ান কি বাড়িতে আছে? অবশেষে আরিয়ানকে বাড়িতে পেলো মৌরি।
-তোমার কাছে হসপিটাল থেকে কল এসেছে?
আরিয়ান কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
-তোমার বর অ্যাক্সিডেন্ট করে হসপিটালে পৌঁছে গেছে?
-না। পিহুর জ্ঞান ফিরেছে।
মৌরি যতটা খুশি নিয়ে কথাটা বলল আরিয়ান শুনে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহও প্রকাশ করল না।
-ওহ। তা আমাকে বলছো কেন? তোমার বরকে জানাও। বোনের মাঝে আত্মা তার।
-পিহু তোমার বোন না! এভাবে বলছো কেন তুমি?
আরিয়ান হেসে বলল,
-আমি তো তোমার বরেরই ভাই না। পিহুর ভাই হওয়া অনেক দূর।
আরিয়ানকে মৌরির পছন্দ থাকলেও ওর এই কথাগুলো মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। মৌরি কঠিন মুখে বলল,
-তুমি কি আমার সাথে হসপিটাল যাবে?
-এসব ঝামেলায় আমাকে কেন টানছো মৌরি।
-ঠিক আছে। তোমার যেতে হবে না। তুমি এটাও মনে রেখো আজকের পর থেকে তুমি আমার সাথে আর কথাও বলবে না।
তখনই তাশফিন বাড়ি ফিরে। দূর থেকে দু’জনকে একসাথে দেখে তাশফিনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। অনেক হয়েছে। এবার এর একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।
-সারাক্ষণ আমার বউয়ের সাথে চিপকে থাকে। ভাবীর প্রতি এত ভালোবাসা কেন?
তাশফিন এগিয়ে এলো। মৌরির চোখ তাশফিনের উপর পড়তে মৌরি ওর কাছে ছুটে এলো। খুশি খুশি মুখে তাশফিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
-আপনার জন্য অসম্ভব খুশির একটা খবর আছে। হসপিটাল থেকে কল এসেছিল। পিহুর জ্ঞান ফিরেছে।
তাশফিন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যি সত্যিই পিহুর জ্ঞান ফিরেছে! তাশফিনকে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৌরি বলল,
-কী হলো? বিশ্বাস হচ্ছে না? আপনি নিজেই একবার গিয়ে দেখুন।
তাশফিনের অবিশ্বাস করার কোন কারণই থাকে না। এই খবরটা শোনার জন্য সে প্রতিদিন অপেক্ষা করে থাকত। কবে পিহু ঠিক হয়ে আবার বাড়ি ফিরে আসবে। তাশফিন বেরোবার সময় মৌরিও যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তাশফিন ওকে বলল,
-এখন আমি যাই। তোমাকে পরে নিয়ে যাব।
মৌরি আপত্তি করল না। পিহু সুস্থ থাকলে এতদিন পর ভাইবোনের দেখা হবে। সে মাঝে না থাকাই ভালো।
চলবে