#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [১৯]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
তাশফিনের সাথে তার বউকে দেখে সকলের মুখেই এক কথা। বিয়েতে কেন দাওয়াত দেয়নি। কী এমন হয়েছে যে না জানিয়ে চুপিচুপি বিয়ে করে ফেলতে হলো? আর এতদিন ভাবীকে লুকিয়ে রেখেছিল কেন? তাশফিন জানতো মৌরিকে নিয়ে এলে এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। এজন্যই সে মৌরিকে নিয়ে আসতে চাচ্ছিল না। তাশফিন সকলের প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেও কৌতূহলে অনেকে মৌরিকেও এসব প্রশ্ন করে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে। তাশফিনের এক বন্ধু, উঁহু বন্ধু বলা যায় না। একসময় ব্যাচমেট ছিল। কিন্তু এখন যোগান নেই বললেই চলে। রামিম হয়তো বিয়েতে ডেকেছে। ওই ছেলেটা একটু বেশিই আগ্রহ দেখাচ্ছে।
-তাশফিন তো কিছু বলবে না। আপনিই বলুন ভাবী। বিয়েটা কি পালিয়ে করেছিলেন? নাহলে দাওয়াত পেলাম না কেন?
মৌরি কী উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না। তাশফিনও হঠাৎ রেগে গেল। সে বলে উঠল,
-বিয়েতে কাকে দাওয়াত দেব, কাকে দেব না এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছা। দাওয়াত না পেলেও কি তুই জোর করে দাওয়াত নিবি? ছ্যাঁচড়ামির সব লিমিট ক্রস করে ফেলছিস দেখছি।
দু’জনের মাঝে গণ্ডগোল লেগে যাবার আগে বাকিরা ওদের সামলে নিলো। তাশফিনের যে বন্ধুরা আছে ওরা তাশফিনকে টেনে অন্য দিকে নিয়ে গেল। বাকিরা ওই ছেলেটাকে ধমকাচ্ছে।
-তোর এসব কথা বলার কোন দরকার ছিল? তুই তো জানিসই তাশফিন কেমন রগচটা। এক্ষুনি একটা গণ্ডগোল বাঁধিয়ে দিত।
ছেলেটাও তেজের সাথে জবাব দিল,
-দিলে দিত। ওকে আমি ভয় পাই নাকি? তোরা জানিস না। সেজন্য ওকে সাপোর্ট করছিস। বিয়ের দিন শালা অনেক বড় একটা ড্রামা করেছে। বিয়ের মাঝখানে কবুল না বলে চলে এসেছে।
-বাজে বকিস না।
-বাজে বকছি না। আমার ঠেকা পড়েছে এই শালার নামে মিথ্যা বানিয়ে বলার? যা সত্যি তা-ই বলছি। আমার কিছু রিলেটিভ বিয়ের সময় ওখানে উপস্থিত ছিল। ওরাই আমাকে জানিয়েছে। মেয়ের বাবা চাচারা হাতেপায়ে পর্যন্ত ধরেছে। এখন শালা বউকে সাথে নিয়ে এসে ভাব যে ধরছে! যেন আমরা কিছু জানি না।
তাশফিন বিয়েটা হুট করেই করে ফেলে। এতে কারো মাথা ব্যথা ছিল না। কিন্তু ইশতিয়াক যা বলছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে আজ বউকে নিয়ে এসেছে কেন? ইশতিয়াকের কথা অনেকেরই বিশ্বাস হতে চাইল না।
তাশফিনের বন্ধু মৌরি আর তাশফিনকে আলাদা নিয়ে এসে বলল,
-তুই মাথা গরম করার আর মানুষ পেলি না! ওই গাধা তো কলেজ টাইম থেকেই এমনিতে সবার পেছনে লাগে।
-আমার পেছনে লাগতে আসলে বাপের নাম ভুলে যাবে।
-আচ্ছা তুমি রাগিস না। রামিমের বিয়ে খারাপ করতে চাস?
-এজন্যই তো হাত তুলিনি। নয়তো দেখতি।
তাশফিনকে বোঝাতে না পেরে ছেলেটা মৌরিকে বলল,
-ভাবী আপনিই এই পাগলকে একটু বোঝান। এত তাড়াতাড়ি মাথা গরম হয়ে গেলে জীবনে চলবে কীভাবে?
ছেলেটা চলে গেলে মৌরি তাশফিনের দিকে তাকাল। মৌরি ভেবেছিল তাশফিন হয়তো শুধু তার সাথেই রাগ দেখায়। এখন বুঝতে পারছে তাশফিনের ব্যবহার সবার সাথেই একরকম। মৃদু গলায় মৌরি বলল,
-এতটা রাগ দেখানোর মতোও কোন কথা ওই ছেলে বলেনি। বন্ধু বন্ধুর বিয়েতে দাওয়াত চাইতেই পারে।
-ও আমার বন্ধু না।
-আচ্ছা ঠিক আছে বন্ধু না। কিন্তু আপনারা একজন আরেকজনকে চিনেন তো।
-এমন নামের চেনা অনেককেই চিনি। তাদের সবার কি আমার পার্সোনাল লাইফ নিয়ে কথা বলার রাইট আছে?
-অনেকেই এটা বোঝে না। তাই বলে কি আপনি সবার সাথে ঝগড়া করে বেড়াবেন?
রামিম তাশফিনকে ডাকছে। হয়তো এতক্ষণে ঘটনাটা ওর কানেও পৌঁছে গেছে। তাশফিন মৌরিকে বলল,
-আমরা একটু পরেই বেরবো।
-হুম।
মৌরিকে একা রেখে তাশফিন রামিমের কাছে চলে গেল। মৌরি এখানে এসে বুঝতে পারছে তাশফিনের সাথে আসাটা কত বড় ভুল ছিল তার। এই পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া তার জন্য অসম্ভব ব্যাপার। কয়েকটা ঘন্টা থেকেই দম বন্ধ হয়ে আসছে। লাবণ্য মৌরিকে ডেকে নিল। মৌরি স্টেজে উঠতেই মৌরিকে নিয়ে লাবণ্য ক্যামেরার সামনে পোজ দিতে লেগে গেল।
তাশফিন বলেছিল একটু পরে বেরোবো। কিন্তু মৌরি এখন তাশফিনকেই খুঁজে পাচ্ছে না। মৌরির ফোনটাও ব্যাটারি লো হয়ে অফ হয়ে গেছে। তাশফিনকে যে কল দিবে এই সুযোগটাও নেই।
-কোথায় গেলেন উনি? ফোনটাও এখনই অফ হতে হলো!
অনেকটা সময় অপেক্ষা করেও তাশফিনের দেখা পেলো না মৌরি। এবার মৌরির টেনশন হচ্ছে। মৌরিকে একা দাঁড়িয়ে টেনশন করতে দেখে রামিম বলল,
-তাশফিন হয়তো আশেপাশেই আছে। কল করে এক্ষুনি আসতে বলছি। আপনি টেনশন করবেন না ভাবী।
রামিম তাশফিনকে কল করছে। কয়েকবার রিং হবার পর তাশফিন কল তুলেছে। রামিম একটু সাইডে চলে গিয়ে চাপা রাগী কন্ঠে বলল,
-কোথায় তুই? ভাবী তোর জন্য কতটা অস্থির হচ্ছে জানিস তুই? এক্ষুনি এখানে আয়।
-আমি হসপিটালে যাচ্ছি।
রামিমের চোখ কপালে উঠে গেল।
-হসপিটালে যাচ্ছিস! কেন?
-পিহুর কিছু হয়েছে।
-তুই হসপিটালে যাচ্ছিস ভালো কথা। কিন্তু ভাবীকে এখানে একা ফেলে গেছিস কেন? ভাবীকে সঙ্গে নিতে যাওয়া যেত না।
-এতকিছু মাথায় ছিল না। হুট করে কল পেয়ে বেরিয়ে এসেছি।
-ভাবীকে এখন আমি কী বলব? তুমি কি কোনোদিনও মানুষ হবি না তাশফিন! নিজের বউয়ের প্রতি তোর এতটুকু দায়িত্ববোধ নেই? মেয়েটার মুখ দেখলে বুঝতে পারতি। আরেকটু হলেই কেঁদে ফেলবে।
-তুই ওকে কোনভাবে বাড়ি পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর। আমি এখন রাখছি। ড্রাইভ করছি, কথা বলতে পারব না।
কল কেটে রামিম অপরাধী মুখে মৌরির সামনে এসে দাঁড়াল। তাশফিনটা জন্মগতই গাধা। বিয়ের পরও এর সুবুদ্ধি হলো না। রামিমকে ফিরে আসতে দেখে অধৈর্য হয়ে মৌরি জিজ্ঞেস করল,
-কোথায় উনি?
-ভাবী মানে,, তাশফিন একটা ইমার্জেন্সিতে আটকে গেছে। আমি ড্রাইভার দিয়ে আপনাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি কোন চিন্তা করবেন না।
জলে টলমলে চোখে, নিভে আসা গলায় মৌরি শুধু এটুকু জিজ্ঞেস করল,
-উনি কি আমাকে রেখে চলে গেছেন?
”
”
গাড়িতে বসে পুরোটা পথ মৌরি কাঁদতে কাঁদতে এসেছে। না চাইতেও চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ভালো না-ই বাসুক। এতদিন একসাথে থেকেও তার প্রতি মানুষটার একটুও মায়া তৈরি হয়নি? কীভাবে তাকে একা ফেলে চলে যেতে পারল? তাদের সম্পর্ক তো অন্য সব সম্পর্কের মতো না। তারা স্বামী স্ত্রী। পৃথিবীতে একটা মেয়ের সবথেকে বিশ্বস্ত জায়গা তো বাবা আর স্বামীই হয়। মৌরির সেই বিশ্বাসের জায়গাটায় যে বড্ড নড়বড়ে। রামিমের ড্রাইভার মৌরিকে বাড়িতে পৌঁছে দিলে গাড়ি থেকে নেমে মৌরি ড্রাইভারকে ছোট্ট করে বলল,
-ধন্যবাদ ভাই।
চোখ মুছে সে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। রুমে যাবার সময় আরিয়ানের মুখোমুখি হয়ে গেলে আরিয়ান জিজ্ঞেস করল,
-এত জলদি ফিরে এসেছ! আমি ভেবেছিলাম অনেক রাত করবে। মমও বাড়িতে নেই। তুমিও ছিলে না। একা একা বোর হচ্ছিলাম।
আরিয়ান কথা বলতে বলতেই মৌরিকে ভালো করে লক্ষ করে বলল,
-তুমি কাঁদছো!
মৌরি হাসার চেষ্টা করে তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল,
-কাঁদবো কেন?
-উঁহু, তুমি কেঁদেছ। চোখ ভেজা।
-কাঁদিনি পাগল। গাড়ির বাতাসে চোখে পানি এসে গেছে।
-তো কেমন মজা করলে? আর তোমার বর মহাশয় কোথায়? উনাকে তো দেখছি না।
-আমাকে নামিয়ে দিয়ে কোথায় যেন গেছে। আরিয়ান আমার মাথাটা সামান্য ব্যথা করছে৷ আমি রুমে যাই? পরে তোমার সাথে কথা বলবো।
-আচ্ছা যাও।
মৌরি আরিয়ানের সামনে থেকে চলে এলো। নয়তো আরিয়ান বুঝে যেত তাশফিন তার সাথে আসেনি। মৌরি একা এসেছে। মৌরি লুকাতে চাইলেও অবশ্য আরিয়ান বুঝেই গেছে। মৌরি চলে গেলে আরিয়ান বলল,
-এই ভালো মেয়েটাকে জঙ্গলিটা যে কেন কষ্ট দিচ্ছে। তাশফিন ওকে ডিজার্ভই করে না। মৌরি আরও বেটার কাউকে পেতো।
”
”
হসপিটাল থেকে কল পেয়ে তাশফিন কারো কথা না ভেবে সোজা বোনের কাছে ছুটে এসেছে। এখানে এসে সে জানতে পারল পিহু নাকি হাত নাড়িয়েছে। যদিও খুব সামান্যই মুভমেন্ট করেছে। তারপরও এটা একটা ভালো লক্ষণ। পিহু এখন যেকোনো দিন কোমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
-আমার বোনের সাথে তখন কে ছিল ডক্টর? কার উপস্থিতিতে পিহু রেসপন্স করেছে?
-উনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছিল। পিহু সম্ভবত ছেলেটাকে চেনে। এই লোক আগেও আরও কয়েকবার এসেছে।
একটা ছেলে! তাশফিনের বুঝতে বাকি রইল না ছেলেটা কে। মাহিম এসেছিল। পিহুকে মাহিমের থেকে দূরে রাখার পরও মাহিম কোনো না কোন ভাবে পিহু পর্যন্ত পৌঁছেই যাচ্ছে। তাশফিন এই মুহূর্তে রাগটা মনে মনে চেপে নিল। মাহিমকে সে ছাড়বে না।
তাশফিন যখন বাড়ি ফিরল তখন রাত অনেকটা হয়ে গেছে। সে রুমে এসে দেখল মৌরি বিছানায় ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে। তাশফিন মৌরির মুখ দেখতে পেলো না। আজ মৌরির সাথে যে কাজটা করেছে তা মোটেও উচিত হয়নি। মৌরি ওখানে কাউকে চিনত না। এটা তাশফিনের ভাবা উচিত ছিল। মৌরি কি ঘুমিয়ে পড়েছে? সে কি মৌরির কাছে আজকের ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইবে? তাশফিন সোফায় বসে ঘাড় চেপে ধরে পিঠ হেলান দিল। মনে মনে বলল,
-মৌরি হয়তো রাগ করেছে। করাটাই স্বাভাবিক। ওকে ওখানে আমি নিয়ে গিয়েছিলাম। ও আমার দায়িত্ব ছিল।
মৌরি ঘুমায়নি। সে এখনও জেগে আছে। তাশফিন রুমে এসেছে বুঝতে পেরেই মৌরি অন্য পাশে ফিরে শুয়ে ছিল। যাতে তাশফিন বুঝতে না পারে মৌরি এখনও জেগে আছে। মৌরি হাত কামড়ে ধরে নীরবে কাঁদছে। তার চোখের পানি দিয়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। এই মানুষটা কোনদিনও তার হবে না এটা মৌরি আজ বুঝে ফেলেছে।
”
”
সকালে ঘুম ভেঙে চোখ খুলে তাশফিন মৌরিকে রুমে পেলো না। বসে থাকতে থাকতে কখন চোখ লেগে গেছে বুঝতে পারেনি। পুরো রাত এভাবে বসে ঘুমানোর ফলে এখন ঘাড় নাড়াতে পারছে না। সারা শরীর ব্যথায় টনটন করছে। দরজায় শব্দ করে তাশফিন সেদিকে তাকাল। ভেবেছিল মৌরি এসেছে। কিন্তু না, আজ সালেহা খালা চা নিয়ে এসেছে। খালা ঘরে এসে বলল,
-তোমার চা।
খালা চা রেখে চলে যাওয়ার সময় তাশফিন বলল,
-মৌরি কোথায় খালা?
-রান্নাঘরে। ওরে পাঠাবো?
-না।
তাশফিন ফোন হাতে নিয়ে দেখল ফোন সাইলেন্ট হয়ে আছে। কখন সাইলেন্ট হয়েছে? সে তো করেনি। রামিমের নয়টা মিসড কল দেখে বলল,
-গাধাটা বাসরঘরে ঢুকেও আমাকে কল করেছে নাকি?
তাশফিন কল ব্যাক করল। প্রথম কয়েকবার রিং হলেও রামিম তুলেনি। তাশফিন সময় দেখে বলল,
-এত সকালে কোথায় ওর ঘুম ভেঙেছে!
উঠে গিয়ে ফোন চার্জে বসিয়ে দিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মাত্রই চুমুক দিয়েছে। তখনই ফোন রিং হয়ে উঠল। কল রিসিভ করা মাত্রই ওপাশ থেকে রামিম চেঁচাতে লাগল,
-তুই মানুষ! কাল রাতে যে কাজটা করেছিস তারপর আর তোকে মানুষও বলা যায় না। অমানুষের মতো একটা কাজ করেছিস। মৌরি তো তোর নিজের বউ ছিল নাকি? ওকে ফেলে রেখে কীভাবে যেতে পারলি? তাকে কল করেছি, সে কোথায় মাঝরাস্তা থেকে ছুটে আসবে তা না করে আমাকে বলে মৌরিকে কোনভাবে বাড়ি পাঠিয়ে দে। আক্কেল জ্ঞান বেচে দিয়েছিলি? তোর এই কাজে মেয়েটা কতটা কষ্ট পেয়েছে ধারণা আছে তোর?
তাশফিন কট করে কল কেটে দিল। কারণ রামিম এখন থামবে না। বলেই চলবে। কাল রাতের ভুলের জন্য তারও অনুশোচনা হচ্ছে। কিন্তু এখন তো কিছু করার নেই। ভুল হয়ে গেছে। হ্যাঁ মৌরিকে সরি বলে ভুলটাকে শুধরে নেওয়া যায়। কিন্তু সকাল থেকে তো মৌরিরই দেখা নেই। তাশফিন চায়ের কাপ হাতে নিয়েই মৌরির খুঁজে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
চলবে
#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [২০]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
আরিয়ানের রুমের সামনে দিয়ে যাবার সময় তাশফিন একটু দাঁড়িয়ে ভেতরে মৌরি আছে কি-না বোঝার চেষ্টা করল। মনে হচ্ছে মৌরি ভেতরে নেই। তাশফিন নিচে চলে এলো। মৌরির সালেহা খালার সাথে কিচেনে থাকার কথা। কিন্তু কিচেনে এসেও তাশফিন মৌরির দেখা পেলো না। সালেহা খালা একটু আগেই তাশফিনকে চা দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন তাশফিনকে এখানে দেখে জিজ্ঞেস করল,
-রান্না তো এহনও শেষ হয় নাই। তুমি কি কিছু খাইবা?
-খাব না। মৌরি কোথায় খালা?
-বউমনি তো মনে হয় আরিয়ান বাবার সাথে।
মৌরি আরিয়ানের ঘরে নেই বুঝে একটু আগে খুশি হচ্ছিল। কিন্তু এখন মৌরি আরিয়ানের সাথে আছে জেনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সরি বলার উদ্দেশ্যে এসেছিল। কিন্তু এখন মুত চেঞ্জ হয়ে যাওয়ায় সরি না বলেই রুমে ফিরে গেল।
-রাতের ঘটনার জন্য মন খারাপ করে কোথাও বসে আছে ভেবেছিলাম। কিন্তু আমি এটা ভুলে গিয়েছিলাম এবাড়িতে তার মন ভালো করার মানুষের কমতি নেই। আমার সরি বলা না বলা দিয়ে কিছু আসে যায় না।
রামিম মাথা খারাপ করে ফেলছিল বলে তাশফিন আজ ওর সাথে দেখা করতে এসেছে। তাশফিনের সিলেট যাবার প্ল্যান হয়েছিল। সে বাবাকে ছাড়া নিজের একটা ব্যবস্থা দাঁড় করাতে চাচ্ছে। বাবার থেকে তাশফিন কিছুই চায় না। যখন তার সবথেকে বেশি বাবার প্রয়োজন ছিল তখন বাবা টাকার পেছনে ছুটেছে। এখন তার বাবারও প্রয়োজন নেই। আর বাবার টাকার তো না-ই।
-বল কী বলবি? বিয়ে করেছিস দুই দিনও হয়নি, কোথায় বউকে নিয়ে হানিমুনে যাবি। তা না করে তুই আমাকে দেখা করার জন্য মাথা খাচ্ছিস। আমার প্রেমে পড়েছিস? নাহলে এত টান কেন?
রামিম তাশফিনের ড্রেসআপ দেখে বলল,
-কোথাও যাচ্ছিস?
-হ্যাঁ। এখান থেকেই সিলেট যাব।
-মৌরিকে সরি বলেছিলি?
তাশফিন রামিমের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে বলল,
-কেন?
-কেন এই কথা তুই জিজ্ঞেস করছিস?
-হ্যাঁ করছি।
-প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা মানুষকে অন্ধ করে দেয় তাশফিন। যেমন তুই অন্ধ হয়ে আছিস। অন্ধ মানুষ যেমন কোনটা সঠিক, কোনটা ভুল পথ বিচার করতে পারে না। তুইও পারছিস না। প্রতিশোধের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। জীবনে ভালোবাসা এসেছে। তাকে দু’হাত বাড়িয়ে গ্রহণ কর।
-ফালতু জ্ঞান দিস না। আমি কাউকে ভালোবাসি না।
-তুই মুখে সারাদিন অস্বীকার কর। কিন্তু তোর মন জানে। ভালোবাসার নাটক করতে করতে মৌরিকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিস তুই।
-যে মেয়ের ভাই আমার বোনের জীবন থেকে ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছে। আমি তার বোনকে ভালোবাসবো।
-ভালোবাসার সময় তুই এটা দেখবি না সেই মানুষটা কার কী হয়। মৌরির ভাইয়ের অপরাধের শাস্তি তুই ওকে কেন দিবি?
-দিতে চাই না। আর তাইতো ওকে চলে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু ওই মেয়ে জেদ ধরে আমার সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
-জেদ না। তুই যেটাকে জেদ বলছিস সেটা ভালোবাসা। মৌরি তোকে ভালোবাসে।
-আমি বলেছি আমাকে ভালোবাসতে?
-বলতে হয় না। তোকেও তো কেউ বলেনি। তারপরও তো তুই ভালোবাসিস।
-বাসি না। কতবার বলব। তুই আমাকে ভালোবাসা নিয়ে জ্ঞান দিস না। ভালোবাসার তুই কী বুঝিস রে?
-বুঝি না। আর তাই তো বোঝার চেষ্টা করছি।
-বিয়ে করে দুই দিনেই এত পরিবর্তন! তুই বউয়ের আঁচল ধরে ঘরে বসে না থেকে আমার মাথা খেতে এসেছিস কেন? যা শালা। তুই বউয়ের কাছে গিয়ে ভালোবাসার পাঠ শিখ।
রামিম হতাশ হয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-তোকে আমি বুঝতে পারি না। সেদিন তুই যেভাবে মৌরির হাত ধরে নিয়ে এসেছিলি তাতে আমি কেন, যে-ই দেখেছে সবাই তোদের পারফেক্ট লাভিং কাপল ভেবেছে। একবারের জন্য আমিও কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম। লাবণ্য তো তোকে আদর্শ স্বামী বানিয়ে ফেলেছিস। কিন্তু তুই যখন মৌরিকে রেখেই চলে গেলি তখন আমার ভুল ভাঙল। তুই মেয়েটার সাথে বড্ড অন্যায় করছিস রে।
-তোর জ্ঞান দেওয়া শেষ? আমাকে সিলেট যেতে হবে ভাই। হুদাই তুই আমার টাইম খাচ্ছিস।
-একদিন পস্তাবি দোস্ত। যেদিন তোকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আমার আর কিছু করার থাকবে না।
-হু।
”
”
মৌরি ভেবেছিল তাশফিন তাকে একটা সরি হলেও বলবে। কিন্তু না, সে ভুল মানুষের থেকে আশা করে বসে ছিল। তাশফিন সরি বলেনি। এমনকি না বলেই যেন কোথাও বেরিয়ে গেছে।
তাশফিন ড্রাইভ করতে করতে মৌরির কথাই ভাবছে। ইচ্ছে করে ভাবছে এমন না। না চাইতেও রামিমের কথাগুলো মনে পড়ে মৌরির খেয়াল এসে যাচ্ছে। ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিতে পারছে না। শেষমেশ থাকতে না পেরে মৌরিকে কল করল।
মৌরি তখন ফোনের কাছে ছিল না। তাই প্রথম বার রিং হলে কল তুলতে পারেনি। এদিকে তাশফিন ভাবছে,
-ফোন রুমে ফেলে সে হয়তো আরিয়ানের সাথে আড্ডা দিচ্ছে।
তাশফিন আর কল দিতে চাইল না। তবুও কী মনে হয় এই শেষ বার দিল। এবং সাথে সাথে ওপাশ থেকে মৌরি কল রিসিভ করল। তাশফিন এতকিছু ভেবে কল দেয়নি। মৌরি হ্যালো হ্যালো করছে। কিন্তু তাশফিন কী বলবে বুঝতে পারছে না।
-হ্যালো। কথা বলছেন না কেন?
-মৌরি!
-হুম।
-আমি একটু সিলেট যাচ্ছি। আজ হয়তো ফিরতে পারব না।
মৌরি হতবাক হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। তাশফিন এই কথা বলার জন্য কল করেছে! সুস্থ টুস্থ আছে নাকি? মৌরি এটা আশা করেনি। তারপরও সে সহজ থেকে বলল,
-হুম।
তাশফিন কল কেটে দিতে পারছে না। আবার ওই কথাটাও বলতে পারছে না। দু’পাশেই নীরবতা দেখে মৌরি ভাবল কল কেটে গেছে হয়তো। তখনই তাশফিন বলে উঠল,
-সরি।
মৌরি অবাক হয়ে বলল,
-কিসের জন্য?
-তুমি জানো।
ছোট্ট একটা শব্দ। তবুও মানুষের মনের পাহাড় সমান অভিমান গলিয়ে দেওয়ার সামর্থ রাখে। মৌরি এই সরিটার আশাই করছিল। কিন্তু কেউ যে এতটা বেরসিক ভাবে সরি বলতে পারে এটা মৌরির জানা ছিল না। এই সরি শুনে রাগ ভাঙা তো দূর উল্টো রাগ বেড়ে যাবে। সুন্দর করে আরেকটু গুছিয়ে সরিটা বলা যেত না?
-এখন রাখি। ড্রাইভ করছি।
”
”
আরিয়ানের কোমর ঠিক হতে বেশ কিছুদিন লেগেছে। এই দিনগুলোতে সে একজনকে খুব বেশি মিস করেছে। তাই আজ একটু সুস্থ হয়েই গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। আরিয়ান গাড়ির মধ্যে বসে অপেক্ষা করছে। তার ঘড়ি নষ্ট? নাকি সময় ধীরে চলছে? এই অপেক্ষা কখন শেষ হবে?
কলেজ গেট দিয়ে বেরিয়ে পরিচিত সেই গাড়িটাকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফাইজার কপাল কুঁচকে গেল। এ কয়দিন দেখা যায়নি। আজ আবার এসেছে। ফাইজা আরিয়ানকে গাড়িতে বসে থাকতে দেখেও না দেখার ভান করে তাড়াতাড়ি চলে যেতে লাগল। কিন্তু আরিয়ান ঠিকই দেখে ফেলেছে। এই মেয়ে কি তাকে দেখে পালাচ্ছে? পালালেও লাভ নেই। আরিয়ান তাৎক্ষণাৎ গাড়ি থেকে নেমে রোডের এপাশে চলে গেল।
-হ্যালো। এইযে বিয়ান, দেখেও চলে যাচ্ছেন!
ফাইজার দাঁড়ানোর কোন ইচ্ছেই ছিল না। কিন্তু আরিয়ান ওর সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়িয়েছে। ফাইজা চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে বলল,
-হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে।
-এত তাড়া!
-আপনার কি আমার সাথে কোন কাজ আছে?
আরিয়ান ফাইজাকে ভালো করে দেখল। ফাইজার বিরক্তি সে-ও ধরতে পেরেছে। কিন্তু ফাইজা কেন বিরক্ত হচ্ছে এটা বুঝতে পারছে না। আরিয়ান নিজেও অনুভূতির এই লুকোচুরি চালিয়ে যেতে চায় না৷ তাই বলল,
-আপনাকে আমি পছন্দ করি। আপনি প্রেম ভালোবাসায় বিশ্বাসী না হলে আমি আপনার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতেও রাজি আছি।
ফাইজা হতভম্ব চোখে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা কি পাগল! কী বলছে এসব? ফাইজার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। কঠিন কন্ঠে সে বলল,
-ফাইজলামি করছেন!
-আপনার মনে হচ্ছে আমি ফাইজলামি করছি?
-জি অবশ্যই। নয়তো আপনার এটা জেনে নেওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
আরিয়ান বিশ্বাস করতে পারল না। সে ভাবল ফাইজা তাকে না করার জন্য মিথ্যা বাহানা দিচ্ছে।
-আচ্ছা! তো কার সাথে ঠিক হয়েছে বিয়ে?
-আমি আপনাকে বলতে বাধ্য নই।
-ফাইজা এসব ছেলেমানুষি মিথ্যা দিয়ে আজকাল আর কাজ হয় না।
আজব মানুষ তো! সত্য বলার পরেও বিশ্বাস করছে না।
-ঠিক আছে, আপনার বিশ্বাস করতে হবে না। কিন্তু আপনি আর কোনদিন এসব কথা বলার জন্য আমার সামনে আসবেন না।
-কেন বারবার তোমার সামনে এসে ভালোবাসি বললে তুমিও আমার প্রতি দুর্বল হয়ে যাবে এই ভয় পাচ্ছ?
-বাজে কথা বলবেন না।
-ভালো কথা শিখিয়ে দাও। তা-ই নাহয় বলব।
ফাইজা রেগেমেগে চলে যেতে লাগলে আরিয়ান পেছন থেকে ডেকে বলল,
-তুমি না বললেও কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব।
ফাইজা দাঁড়িয়ে পড়ে আবার ফিরে এলো। আরিয়ানের সামনে এসে বলল,
-আপনার ভালোর জন্য বলছি। ভুলেও এই কাজ করবেন না। আপনার ভাই যা নাটক করেছে! তারপর আপনি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলে আমার বাপ ভাই আপনার সাথে কী করবে আল্লাহই ভালো জানেন। আপনার ভাইকে তো কিছু করতে পারেনি। কিন্তু আপনার হাত-পা আস্ত রেখে ছাড়বে না এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি।
চলবে