#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [১৮]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
মৌরি তাশফিনের সাথে কোথাও যেতে রাজি না। বাড়িতেই ভালো আছে সে। কিন্তু তাশফিন রাতে কোথায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল? নিজে যেখানে খুশি যাক। মৌরি কি বাধা দিয়েছে? তাকে কেন সঙ্গে নিতে চাচ্ছে?
সকাল থেকে তাশফিন মৌরিকে চোখে চোখে রাখছিল। রাতে বলে রাখার পরেও এই মেয়ে এখনও তৈরি হচ্ছে না কেন? মৌরি নিচে থেকে এসে সোজা আরিয়ানের ঘরে যেতে চাইলে তাশফিন রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকল।
-কোথায় যাচ্ছ?
-দেখতেই পারছেন।
-রাতে তোমাকে কিছু বলেছিলাম।
-আমার স্মৃতিশক্তি দূর্বল। সকাল হতে হতে ভুলে গেছি।
-রেডি হও। আমার সাথে বেরোবে তুমি।
-কোথায়?
-বন্ধুর বিয়েতে।
মৌরি চোখ উলটিয়ে তাশফিনকে দেখছে। মনে মনে ভাবছে, বাবাহ! সজ্ঞানে বলছে? নাকি মাথায় টাথায় বারি খেয়েছে। মৌরিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তাশফিন বলল,
-যাওয়ার ইচ্ছে নেই? ইচ্ছে না থাকলে যেতে হবে না।
-আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমাকে সাথে নেওয়ার আপনারই ইচ্ছে নেই। আমার ইচ্ছে অনিচ্ছে আপনি জানতে চাচ্ছেন না।
-তুমি যাবে?
মৌরি একটু ভেবে বলল,
-আপনি এত করে বলছেন, তার উপর আবার না গেলে আপনার বন্ধু কী না কী মনে করবে। কতক্ষণে বের হবেন?
-একটু পরেই।
-ঠিক আছে। আমি তৈরি হচ্ছি।
তাশফিন ভাবেনি মৌরি এত সহজে যেতে রাজি হয়ে যাবে। বন্ধুর বিয়ে বললে হয়তো মৌরি যাবে না। এই ভাবনা থেকেই রাতে জানায়নি। কিন্তু মৌরি এত সহজে যেতে রাজি হওয়াতেও আবার সন্দেহ লাগছে। তাশফিন এত ভাবলো না। যেতে চাচ্ছে যাক।
”
”
মৌরি তৈরি হয়ে তাশফিনকে খুঁজতে খুঁজতে আরিয়ানের রুমের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। আরিয়ান ওকে দেখতে পেয়ে ডাকল।
-এই মৌরি!
মৌরি কয়েক কদম পিছিয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-হ্যাঁ বলো।
-কোথাও যাচ্ছ?
-হ্যাঁ। তোমার কিছু লাগবে?
-না। কিন্তু তুমি কোথায় যাচ্ছ?
-তোমার ভাইয়ের বন্ধুর বিয়েতে।
মৌরি তাশফিনের সাথে যাচ্ছে শুনে আরিয়ানের ভালো লাগল না। তার কোমর ভেঙে ঘরে বসিয়ে রেখে নিজে বউকে নিয়ে বন্ধুর বিয়েতে যাচ্ছে। আরিয়ান বিড়বিড় করে বলল,
-একবার শুধু ঠিক হয়ে নিই। এর শোধ তো আমি নিবোই।
তাশফিনকে খুঁজতে খুঁজতে মৌরি বিরক্ত হয়ে গেল। তাকে তৈরি হতে বলে নিজেই একা চলে গেল নাকি? যেতেও পারে। এই লোকের সাথে বিশ্বাস নেই।
-দূর! উনার সাথে যেতে রাজি হওয়াই আমার ভুল ছিল।
মৌরি ঘরে ফিরে যাচ্ছিল। লায়লা তখন সদ্য ঘুম ভাঙা ফোলা চেহারা ও এলোমেলো চুলের সাথে হাই তুলতে তুলতে রুম থেকে বেরোচ্ছে।
-ও বাবা গো!
হঠাৎ শাশুড়ীকে এভাবে দেখে মৌরি ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বেচারি দোয়া পড়ে বুকে ফু দিচ্ছে। লায়লা চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
-আমাকে দেখে ভয় পেয়েছ!
মৌরি লজ্জিত মুখে কিছু বলতে পারল না। লায়লা ওর দিকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
-কোথাও যাচ্ছ?
-হ্যাঁ।
-তাশফিনের সাথে যাচ্ছ?
-হুম।
লায়লা মনে মনে ভাবল তাশফিন ইদানীং মৌরির উপর রাগছে না। এর মানে কি বউদের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হতে শুরু করেছে?
-কোথায় যাচ্ছ?
-উনার বন্ধুর বিয়ে।
কথাটা শুনে লায়লা মৌরির পা দেখে মাথা পর্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বলল,
-এভাবে তুমি বিয়েতে যাচ্ছ?
লায়লার কথার ধরনে মৌরি নিজেকেই একবার দেখল। উদ্ভট কিছু পরে ফেলেছে নাকি? বিয়ের অনুষ্ঠানে মানুষ লং জামা পরে না? লায়লা মৌরির কাছাকাছি চলে এলো।
-তুমি কি সত্যিই বর্তমানে যুগে বাস করছো মৌরি? নাকি টাইম ট্রাভেল করে অন্য কোন সময় থেকে চলে এসেছ?
-কেন মা? এই ড্রেসটা কি ভালো না?
-খুব ভালো। তোমাক খুব সুন্দর লাগছে। কিন্তু কোথায় কী পরে যেতে হবে এই সেন্সটা তো থাকতে হবে ডিয়ার। ড্রেসিং সেন্স বলে একটা কথা আছে জানো তো। তুমি এখন চৌধুরী বাড়ির বউ। এত সাধারণ ভাবে তুমি বরের বন্ধুর বিয়েতে যেতে পারো না।
-তাহলে কীভাবে যাব?
এই মেয়ে দেখা যাচ্ছে কিছুই জানে না। এত বড়লোক বাড়ির বউ হয়ে এসেছে। কিন্তু মনটা এখনও আগের মতোই মধ্যবিত্ত রয়ে গেছে। লায়লাকেই কিছু করতে হবে। সে মৌরির হাত ধরে হতাশ গলায় বলল,
-আমাকেই তোমাকে শিখাতে হবে। চলো আমার সাথে।
-কোথায়?
”
”
-চোখ খুলে বলো দেখি আয়নার ভেতর ওটা কে?
মৌরি ধীরে ধীরে চোখ খুলে আয়নায় নিজেকে দেখে চিনতে পারল না। এটা কি সত্যিই সে! মেকআপে চেহারা এতটা পাল্টে দিতে পারে? নিজেকেই অচেনা লাগছে। লায়লা মৌরির চোখের ভাষা বুঝতে পেরে গর্ব করে বলল,
-কী চিনতে পারছো না তো?
মৌরি এখনও নিজেকেই দেখছে। পার্লার তো দূর কোনদিন ঠোঁটে একটু লিপস্টিকও দেয়নি। সাজগোজ কোন কালেই পছন্দ ছিল না। ঘরকুনো স্বভাবের হওয়ায় তেমন বাইরেও যেত না। ওর জীবন চার দেয়ালের ভেতরেই কেটেছে। কিন্তু একটা ঘটনা তার পুরো জীবনটাকে পাল্টে দিয়েছে। মৌরি কখনও ভেবেছিল তার সাথে এমনটা হবে? যাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল সে বিয়ের আসরে ছেড়ে চলে আসবে। মৌরি বাবা মা পরিবারের কথা না শুনে সেই মানুষটার বাড়িতে এসে থাকতে শুরু করবে। এখানে এসে বুঝতে পেরেছে একই ছাদের নিচে কয়েকজন মানুষ বছরের পর বছর বসবাস করলেও তারা পরিবার হয়না। তার স্বামী বাবার স্ত্রীকে মা বলে মানে না। সৎভাইকে দু-চোখে দেখতে পারে না। শাশুড়ীর নিজেরও সংসার নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা নেই। তিনি গহনাগাঁটি, মেকআপ আর পার্টি নিয়েই থাকতে পছন্দ করেন। শ্বশুর আপনজন নামক এই দূরের মানুষ গুলোর জন্য টাকার পাহাড় তৈরি করে ফেলছে। কিন্তু তিনি নিজেও জানেন টাকা দিয়ে কখনও সুখ কেনা যায় না।
-মৌরি এই, কোথায় হারিয়েছ? তাশফিন অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে। এবার হয়তো তোমাকে রেখেই চলে যাবে।
লায়লার ডাকে মৌরির ধ্যান ভাঙল। দীর্ঘ এক ঘন্টারও বেশি সময় নিয়ে লায়লা তাকে সাজিয়েছে। মৌরির খেয়ালই ছিল না। তাশফিন তাকে না পেলে সত্যি সত্যিই চলে যাবে। লায়লা মৌরির হাতে ছোট্ট একটা পার্স ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-যাও এবার।
পার্সটা এতই ছোট যে এটাতে মৌরির ফোনও আটবে না। মৌরি পার্সের দিকে দেখলে লায়লা বলল,
-এটা স্টাইল করার জন্য। তুমি এতকিছু বুঝবে না। কিন্তু এটা পুরোটা সময় হাতে নিয়ে ঘুরবে। ভুলেও গাড়িতে রেখে যাবে না।
মৌরি বেরোতে বেরোতে ভাবল,
-এটা যখন কোন কাজেই লাগবে না তাহলে শুধু শুধু হাতে নিয়ে ঘোরার মানে কী?
তাশফিন মৌরিকে ডেকে ডেকে বিরক্ত হয়ে এবার রাগ উঠে যাচ্ছে। এদিকে রামিম কল করে মাথা খারাপ করে ফেলছে। মৌরির রাগ তাশফিন রামিমের উপর দেখাচ্ছে।
-লেট হলে কী করবো? তুই আর তোর হবু বউই তো বলেছিল ভাবীকে সাথে না নিয়ে গেলে আমিও যেন না যাই। এখন ভাবীকে নিয়ে যেতেই দেরি হচ্ছে। বসে থাক। আজকে বিয়ে না করতে পারলে কাল করবি।
রামিমের সাথে কথা বলতে বলতে সামনের দিকে তাকিয়ে তাশফিনের কথা বন্ধ হয়ে গেল। সে ফোন কানে ধরেই অপলক দৃষ্টিতে মৌরির দিকে তাকিয়ে আছে। মৌরি হেঁটে আসতে আসতে তাশফিনের মুগ্ধ দৃষ্টি লক্ষ করেছে। সে তাশফিনের সামনে চলে এলেও তাশফিন কিছু বলতে পারল না। বেচারা চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেছে। মৌরি মুচকি হেসে বলল,
-আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি। আপনি আসুন।
মৌরি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকানোর চেষ্টা করছে। তাশফিন এখনও ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এটা কে ছিল? তার বউই? মৌরি! তাশফিন মাথা ঝাঁকিয়ে হুঁশ ফিরালো।
-আমাদের বিয়ের দিনও কি মৌরিকে এমন লাগছিল? আজব কারবার! নিজের বউকেই চিনতে পারছি না।
বিয়ের দিন তাশফিন মৌরিকে তেমনভাবে লক্ষ করে দেখেনি। মৌরির দিকে হয়তো ভালো করে তাকানোর প্রয়োজনই মনে করেনি৷ কিন্তু আজ মৌরিকে দেখে চোখ সরাতে পারছে না এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
-সাধারণ ভাবে দেখতেই ওকে ভালো লাগে। কিন্তু এভাবেও খারাপ লাগছে না।
তাশফিন নিজেও হয়তো বুঝতে পারছে না সে মৌরির প্রশংসা করছে। তাশফিন গাড়িতে বসার সময়ও মৌরিকে দেখল। মনে মনে ভাবল, এটা নিশ্চয় মিসেস চৌধুরী কাজ। উনি ছাড়া এ কাজ আর কারো হতেই পারে না। তাশফিন নিজে সিট বেল্ট লাগিয়ে মৌরিকে বলল,
-সিট বেল্ট লাগিয়ে বসো।
-হুম।
তাশফিন গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে। পথে যেতে যেতেও সে অনেকবার মৌরিকে দেখেছে। প্রতি বারই মৌরি ধরে ফেলেছে। শেষবার মৌরি বলেই ফেলল,
-আমার মুখে কি কোনকিছু লেগে আছে?
মৌরির হঠাৎ এই প্রশ্ন তাশফিন বুঝতে না পেরে বলল,
-কেন?
-আপনি বারবার আমার দিকে দেখছেন তো। এজন্য মনে হচ্ছে মুখে হয়তো কালি টালি লেগে আছে।
-মিসেস চৌধুরীর সাথে তোমার ভালোই সখ্যতা হয়েছে দেখা যাচ্ছে।
-কেন? বউ শাশুড়ী সারাক্ষণ ঝগড়া করলে আপনার কি তেমনটা ভালো লাগত?
-শ্বশুর, শাশুড়ী, দেবর সবাইকে দলে নিয়ে নিয়েছ।
-আমি কোন ফুটবল টিম বা ক্রিকেট টিম বানাতে আসিনি যে সবাইকে নিয়ে দল বানাবো।
-তাহলে কেন এসেছ?
-প্রতিটা মেয়ে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে যে কারণে আসে। আমিও সেজন্যই এসেছি।
মৌরি জানালা খুলে বাইরের দিকে মুখ করে বসে আছে। তাশফিন ড্রাইভ করতে করতে ওকেই দেখে যাচ্ছে। পুরোটা পথ দু’জন আর একটা কথাও বললো না।
গাড়ি থেকে নামার সময় মৌরি বলল,
-আমি আগে কখনও এত মানুষের ভীড়ে যাইনি।
-ভয় লাগছে?
-হুম।
-তাহলে এসেছ কেন?
মৌরি ভেবেছিল তাশফিন হয়তো তার ভয় দূর করতে কিছু বলবে। কিন্তু সে ভুলেই গিয়েছিল, আর যা-ই হোক। এই লোকের থেকে ভালো কিছু আশা করা বোকামি। গাড়ি থেকে নেমে মৌরি একাই ভেতরে চলে যেতে চাইলে তাশফিন ওর হাত ধরে ফেলে বলল,
-তোমার বন্ধুর বিয়েতে এসেছ? তাহলে একা একা চলে যাচ্ছ কেন? আমার বন্ধুর বিয়েতে এসেছ। আমার সাথে ভেতরে যাবে। এটা সাধারণ ভদ্রতা।
মৌরি রাগী মুখে বলল,
-এখন আমাকে আপনার থেকে ভদ্রতা শিখতে হবে?
-তুমি শিখতে চাইলেও আমি শেখাতে পারব না। আমার হাতে এত সময় নেই।
মৌরির এত রাগ হলো। এক মুহূর্তের জন্য তার ইচ্ছে করল এখান থেকেই সে বাড়ি ফিরে যাবে। মৌরি আরও রাগ দেখাবে বা সত্যিই বাড়ি ফিরে যাবে কি-না এটা ভাববার আগেই তাশফিন ওর হাত ধরে হাঁটতে লাগল। ফলে মৌরিকেও তাশফিনের সাথে সাথেই যেতে হচ্ছে।
তাশফিনকে মৌরির হাত ধরে আসতে দেখে লাবণ্য রামিমকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
-তোমার বন্ধু না বউকে ভালোবাসে না। এটাই কি তার ভালো না বাসার নমুনা! দু’জন হাত ধরে ধরে আসছে।
রামিম বন্ধুর হাবভাব বুঝতে না পেরে কনফিউজড হয়ে বলল,
-আজ সকালেও আমাকে গালি দিচ্ছিল কেন আমি মৌরিকে নিয়ে আসতে বলেছি। এদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেলে আমাদের সামনে কিছুই ঠিক না হওয়ার নাটক কেন করছে? বন্ধু কি ভাবছে ওর বিবাহিত জীবনে আমি নজর লাগাবো?
লাবণ্য বলল,
-তুমি যেমন, তোমার বন্ধুও তেমন। দু’জনই জীবনে কী চাও তা নিয়ে কনফিউজ। পেয়ে গেলে চাও না। না পেলে কান্নাকাটি করো। সব পুরুষই কি তোমাদের মতো হয়?
চলবে