#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [১৭]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
তাশফিনের উপর রাগ থেকে মৌরি নিজে নিজে বিড়বিড় করতে করতে আরিয়ানের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। উঁকি দিয়ে দেখল আরিয়ান এখনও জেগে আছে কি-না। ঘুমিয়ে থাকলে আর ডাকবে না। আরিয়ান জেগেই ছিল। মৌরি বলল,
-আসব?
আরিয়ান মৌরিকে দেখে খুশি হয়ে বলল,
-আমার ঘরে আসতে তোমার অনুমতি নিতে হবে?
মৌরি মিষ্টি করে হেসে বলল,
-হবে না?
-না। এসো।
মৌরি ভেতরে এসে দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
-এখন কেমন আছো?
-যদিও হাঁটা-চলা করার মতো অবস্থায় নেই। তবু এটা ভেবে ভালো লাগছে তোমাকে দিয়ে কয়দিন সেবাযত্ন করাতে পারব।
-আহা আমার দেবরটা জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে। এতই সেবাযত্ন পাওয়ার ইচ্ছে থাকলে বিয়ে করিয়ে দেব। বউকে দিয়ে দিনরাত সেবা করিয়ে নিও।
-এটাও ভালো হবে। জীবনে একটা বউয়েরই অভাব শুধু।
-রাজি মনে হচ্ছে! পাত্রী কি পছন্দ করে রেখেছো?
আরিয়ান একজনের কথা মনে করে মিটমিট হাসল। মৌরি তা লক্ষ করে বলল,
-পাত্রীর কথা শুনে চেহারা লাল গোলাপি হচ্ছে! তার মানে নিশ্চয় কেউ আছে। অথচ আমার সাথে এখনও পরিচয় করালে না! বাহ, ভালো তো।
-আরে ইয়ার মৌরি, আমি নিজেই এখনও শিওর না। তোমার সাথে কীভাবে পরিচয় করাবো বলো?
-হুমম… মেয়েটা কে?
-আছে একজন।
-বুঝলাম। আমাকে বলতে চাচ্ছ না। ঠিক আছে। মেয়েটার থেকে তাড়াতাড়ি শিওর হয়ে বাড়িতে আমার জন্য একটা ঝগড়া করার মানুষ নিয়ে এসো। তোমরা কেউ বাড়ি না থাকলে একা একা বড্ড বোর হই।
-তুমি পাশে থাকলে কাজটা হয়তো অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।
-তাই নাকি? তাহলে মনে করো আমি তোমার সাপোর্টে আছি।
”
”
তাশফিনের বন্ধু রামিমের বিয়ের দিনতারিখ ঠিক হয়েছে। রামিম এত বড়ো একটা খুশি শেয়ার করার জন্য সবার আগে তাশফিনের কাছে কল করেছে। কিন্তু তাশফিন বেচারাকে যেসব কথা শোনাচ্ছে তাতে হয়তো ওর বিয়ে করার আগ্রহই চলে যাবে।
-বিয়ে করছিস! কেন?
রামিম অবাক হয়ে বলল,
-কেন মানে কি? এনগেজমেন্ট করেছি, বিয়ে করবো না?
-না মানে সেদিনই তো এনগেজমেন্ট হলো। এখনই বিয়ে করতে হবে কেন? কয়েকটা বছর সময় নে। দু’জন দু’জনকে আরও ভালো করে জানার চেষ্টা কর। এখন ওর যে দিকগুলো তোর ভালো লাগছে কয়েকদিন পর হয়তো এই দিক গুলোই বিরক্তির কারণ হয়ে উঠবে। তখন কী করবি? এনগেজমেন্ট ভেঙে ফেলা যায় ভাই। কিন্তু একবার বিয়ে হয়ে গেলে আজীবনের মতো ঝুলে যেতে হবে।
-তুই আমার বন্ধু! নাকি শত্রু?
-বন্ধু দেখেই তোর জীবন বাঁচিয়ে দিতে চাচ্ছি। শত্রু থাকলে নাচতে নাচতে তোর বিয়েতে যেতাম।
-তোর মতো বন্ধু থাকলে শত্রুর প্রয়োজন হবে না। আমি লাবণ্যকে ভালোবাসি শালা। আমাদের তিন বছরের রিলেশনের পর কত ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে দুই পরিবার মেনে নিয়েছে। এখন তুই পরামর্শ দিচ্ছিস আরও সময় নিতে! আমার ভালো তোর চাইতে হবে না বন্ধু। তুই শুধু আমার উপর একটা দয়া করিস। ভাবীকে নিয়ে আমার বিয়ের সবগুলো প্রোগ্রাম অ্যাটেন্ড করিস। আমি এতেই খুশি।
-তোর ভালোর জন্য বললাম দাম দিলি না। ঠিক আছে। বিবাহিত জীবনের দুঃখ শেয়ার করতে আমার কাছে অন্তত আসিস না।
-যাব না। আমি শালা তোর মতো গর্দভ না।
-বুদ্ধিমান হওয়ার নমুনা দেখছি তো।
-ফালতু বকে মেজাজ খারাপ করিস না। আমার জীবনের সবথেকে বড় খুশির খবর তোর সাথে শেয়ার করতে চাওয়াই আমার ভুল ছিল।
-গলায় ফাঁসের দড়ি পরেও যে কেউ খুশি হতে পারে তা তোকে না দেখলে জানতাম না।
তাশফিনের এরকম উদ্ভট কথাবার্তা শুনে রামিম রাগ করে কলই কেটে দিল। তাশফিন ফোঁস করে দম ফেলে বলল,
-গাধা!
”
”
মৌরির বিয়ের পরপর মাহিম আর ফাইজার কথাও পাকাপাকি হয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু মৌরির বিয়ের দিন ওরকম একটা ঘটনা ঘটলো। তারপর আর মাহিম ফাইজার কথা কেউ তুললো না। কিন্তু এখন তো অনেকটা সময় চলে গেছে। মৌরিও ওর শ্বশুরবাড়িতে ভালো আছে। ইদানিং মাহিমের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করে হালিমা স্বামীকে বললেন,
-এবার ছেলের বিয়ের ব্যাপারেও কিছু ভাবো।
-ভাবার তো কিছু নেই। কথা তো ঠিক হয়েই আছে।
-মুখে মুখে বলেছিলে ফাইজাকে মাহিমকে দিয়ে বিয়ে করিয়ে আনবে। পাকাপাকি কথা তো হয়নি।
-তোমার মনে হয় আমার বোন ওর মেয়ের বিয়ে আমার ছেলের সাথে না দিয়ে অন্য জায়গায় দিয়ে দিবে?
-আমি কি এটা বলেছি?
-তুমি কী করতে বলো তাহলে?
-আপাকে খবর দাও। সবাই বসে ভালো একটা দিনক্ষণ ঠিক করে অন্তত আংটি বা নাকের ফুল পরিয়ে রাখি।
-ঠিক আছে।
হালিমা কতক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু ভাবলেন। তারপর ভয়ে ভয়ে বলেই ফেললেন,
-ভাইয়ের বিয়ের কথাবার্তায় বোন থাকবে না? মৌরিকে আসতে বলবো? যা হবার ছিল তা তো হয়েই গেছে। এখন তো মেয়েও শ্বশুরবাড়িতে থাকছে। আমাদেরও উচিত হবে আগের সব ভুলে গিয়ে বিয়েটা মেনে নেওয়া।
মিজানুর রহমান শান্ত দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। হালিমা দৃষ্টি নামিয়ে নিল।
-বলে দেখো। কিন্তু আমার মনে হয় তোমার মেয়ে আসবে না। আমাদেরকে তার আর প্রয়োজন নেই।
-এভাবে কেন বলছো?
-প্রয়োজন থাকলে এভাবে আমাদের কথা না শুনে ওই বাড়িতে চলে যেত না। ওখানে গিয়েও তো আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইল না।
হালিমা স্বামীর কথার উত্তরে কিছু বলতে পারলেন না। মৌরি কেন এরকম করছে ও-ই জানে। মিজানুর রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-এই মেয়েকে আমি একটা ফুলের মতো করে বড় করেছি। পুরো দুনিয়া একদিকে ছিল আর আমার কাছে আমার মেয়ে একদিকে ছিল। এই মেয়েই শেষে আমাকে এতটা কষ্ট দিতে পারল!
”
”
হলুদ আর মেহেদীর অনুষ্ঠানে মৌরিকে নিয়ে যায়নি বলে রামিম ও তার হবু বউ তাশফিনের মাথা খেয়ে ফেলেছে। রামিম তো এটাও বলে দিয়েছে বিয়ের দিনও যদি ভাবীকে ছাড়া আসিস তাহলে আমার বিয়েতে তোর আসারই দরকার নেই। তাশফিন ভেবে পায় না এটা কি তার বন্ধু? নাকি মৌরির কোন আত্মীয়। ভাবীর জন্য এত ভালোবাসা!
বন্ধুর বিয়েতে যাবার কথা মৌরিকে কীভাবে বলবে এটাই বুঝতে পারছে না তাশফিন। রাতে বাড়ি ফিরে মৌরিকে ঘরে পায়নি। এই মেয়ে এখন বেশিরভাগ সময় আরিয়ানের আশেপাশে ঘুরে। তাশফিনের তো মনে হয় চেয়ার থেকে না ফেলে এটাকে ছাদ থেকে ফেলে দিলেই হতো। তাশফিন মৌরিকে সরাসরি ডাকতে না পেরে খালাকে ডাকছে।
-খালা। খালা, একটা মানুষ বাড়ি ফিরেছে তার কিছু লাগবে কি-না জিজ্ঞেস করতেও তো আসে মানুষ।
সালেহা খালা এসে বললেন,
-তোমার বিয়ের পরেও কি এই দায়িত্ব আমার?
-তাহলে কার?
-তোমার বউয়ের।
-আমার ব… তোমাদের আদরের বৌমা তার দায়িত্ব সম্পর্কে জানে বলে তো মনে হয় না।
আরিয়ানের ঘরে পানি ছিল না৷ মৌরি ওর ঘরে পানি রাখতে এসেছিল। এটুকু সময়ের মধ্যে যে তাশফিন চলে এসেছে বুঝতে পারেনি। তাশফিনের গলা শুনেই মৌরি তাড়াহুড়ো করে ছুটে এলো। তাশফিন ওকে দেখেও না দেখার ভান করে খালাকে বলল,
-আগে আমার সব কাজ তুমি করতে না? এখনও তাহলে তুমিই করবে। কেউ একজনের জন্য আগের নিয়ম পাল্টে যাবে কেন?
খালা বলল,
-পালটাইবো না কেন? বাড়িতে বউ আনছি। এখনও তোমার কাজ আমি কেন করমু? আমার বয়স বাড়তাছে। শরীরে আগের মতো শক্তি পাই না। শেষ জীবনে তুমি আমার দেখভাল করবা বলছিলা ভুইলা গেছো?
-আমার দেওয়া কথা আমি কখনও ভুলি না।তোমার দেখভাল আমিই করব। কিন্তু তাই বলে তুমি আমার দেখাশোনা করা বন্ধ করে দিবে?
দু’জনের ঝগড়া করা দেখে কেউ বলবে খালা এবাড়ির কাজের লোক! তাশফিনের সাথে খালার কোন রক্তের সম্পর্ক নেই। যেন মা ছেলের মধ্যে টকমিষ্টি ঝগড়া হচ্ছে। খালা মৌরিকে দেখে বলল,
-এইযে বউমনি কাজটা কিন্তু তুমি ঠিক করতাছো না। তোমার বরের দায়িত্ব তোমার। এতদিন তুমি ছিলা না তাই আমি দেখাশোনা করছি। এখন আমি আর পারব না বাপু।
মৌরি খালার উদ্দেশ্যে বলল,
-এত বড়ো একটা দামড়া ছেলের দায়িত্ব অন্যকে কেন নিতে হবে? নিজের দায়িত্ব নিজে নেওয়ার বয়স হয়নি? জিজ্ঞেস করুন তো খালা, অন্যকে কেন এত জ্বালাযন্ত্রণা করে?
মৌরি তাশফিনকে দামড়া বলেছে! এই মেয়ের সাহস দেখে তাশফিন হতভম্ব। খালা মৌরির কথা শুনে মুখ টিপে হাসল। তাশফিন খালার সামনে মৌরিকে কিছু বলতে না পেরে ঘরে চলে এলো। খালা এবার শব্দ করে হেসে বললেন,
-জব্বর শায়েস্তা করছো।
-এখনও তো কিছুই করিনি। পুরোপুরি সোজা না করা পর্যন্ত হাল ছাড়ছি না।
মৌরি রুমে আসার সাথে সাথেই তাশফিন বলল,
-তোমার তো সাহস কম না।
মৌরিও বলল,
-আপনার সমস্যা কী? ছোট বাচ্চা আপনি? চব্বিশ ঘণ্টা আপনার সেবাযত্নে কাউকে না কাউকে নিযুক্ত থাকতে হবে? আপনার থেকে তো থ্রি ফোরের বাচ্চারাও ভালো। নিজের কাজ নিজেরাই করতে পারে।
মৌরি কথা গুলো তাশফিনের ইগোতে হার্ট করলো। তাশফিন রেগে বলল,
-তোমাকে কিছু বলছি না বলে দিনদিন তোমার সাহস বেড়েই যাচ্ছে।
মৌরি তাশফিনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
-সাহসের দেখেছেন কী? আমি কতটা সাহসী আপনাকে দেখাব?
তাশফিন ভ্রু কোঁচকাল। এটা কি মৌরি? নাকি ওর চেহারায় অন্য কেউ! মৌরি হয়তো তাশফিনের ভালো করে চিনতে পারেনি। তাশফিনও কিছু কম না। সে মৌরির দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
-দেখি। তুমি দেখাতে চাইলে আমি আপত্তি করবো না।
তাশফিনকে এগিয়ে আসতে দেখে মৌরি ঘাবড়ে গেল। তাশফিনের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। মৌরি পেছাতে পেছাতে আলমারির সাথে বারি খেতো। কিন্তু তার আগেই তাশফিন ওর মাথার পেছনে নিজের হাত ধরে ফেলল। মৌরির দিকে ঝুঁকে এসে তাশফিন বলল,
-কই দেখাচ্ছ না কেন?
-কী দেখাব?
-সাহস। তুমি কতটা সাহসী আমিও দেখি।
তাশফিন মৌরির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। মৌরির চোখের দৃষ্টি অশান্ত হয়ে উঠেছে। সে তাশফিনের সামনে থেকে যাওয়ার পথ খুঁজছে।
-তুমি কতটা সাহসী এটা আমি অনেক আগেই জেনে ফেলেছি।
তাশফিনকে নিজের এতটা কাছে দেখে মৌরির শব্দগুলো জট পাকিয়ে গেল। তাশফিন ভাবল এটাই সুযোগ। সে বলল,
-কাল তুমি আমার সাথে এক জায়গায় যাবে। একান্ত বাধ্য হয়েই তোমাকে সাথে নিতে হচ্ছে। কাল কিন্তু আমার কথার অবাধ্য হইয়ো না মৌরি। তাহলে তোমার জন্যই খারাপ হবে।
চলবে