#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [১৬]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
অনেকদিন পর আজ আবার সকলের ব্রেকফাস্ট টেবিলে একসাথে হয়েছে। তারেক চৌধুরী বিজনেসের কাজে দেশের বাইরে ছিলেন। গতকালই ফিরেছেন। লায়লা নতুন একটা হেয়ারস্টাইল করেছে। ভেবেছিল স্বামীর থেকে হয়তো প্রশংসা পাবে। কিন্তু তারেক চৌধুরী স্ত্রীকে দেখেও কিছু বলছেন না। তিনি ছেলেদের আসার অপেক্ষা করছেন। লায়লা এবার বলেই ফেলল।
-তুমি কি কানা? চোখে কম দেখো?”
তারেক চৌধুরী শান্ত স্বরে বললেন,
-কেন?”
-স্ত্রীর মাঝে কী কী পরিবর্তন এসেছে এটাও তোমার চোখে ভাসে না। কেমন হাসবেন্ড তুমি?”
-পরিবর্তন যদি একদিন আসত তাহলে হয়তো চোখে পড়ত। কিন্তু তোমার তো রোজ রোজই পরিবর্তন আসে।”
-নতুন একটা হেয়ারস্টাইল করেছি। কেমন লাগছে আমাকে?’
-ভালো।”
-শুধু ভালো।”
-অনেক ভালো।”
-না দেখেই বলছো!”
-দেখেছি।”
এই লোকের সাথে কথা বলাই বেকার। লায়লা স্বামীর সব রাগ বেচারা ফলফলাদির উপর দেখাতে লাগল। ছুরি হাতে শব্দ করে করে আপেল কাটতে লাগল। মৌরির রান্নাঘরে যাওয়া বারণ। সালেহা খালা তাকে রান্নাঘরে ঢুকতেই দেয় না। আরিয়ান খালার থেকে আরও একধাপ এগিয়ে। সে এসে শ্বশুর শাশুড়িকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বলল,
-শুভ সকাল বাবা।”
তারেক চৌধুরী ছেলের বউকে দেখলেন। বাড়িতে না থাকলেও মৌরির চিন্তা তার লেগেই ছিল। তাশফিন তো ঠিক না। বৌমাকে কখন কী বলে, করে কোন ঠিক আছে?
-বসো বৌমা।”
মৌরি বসলে তারেক চৌধুরী ওর হাতের দিকে দেখে বলল,
-হাতে কী হয়েছে?”
-কিছু না বাবা।”
মৌরি হাত পুড়ে যাওয়ার কথা বলল না। লায়লাও সত্যটা বলার প্রয়োজন মনে করল না। নিজের বউয়ের দিকে লক্ষ করে না দেখলেও ছেলের বউয়ের হাতের দিকে ঠিকই চোখ পড়েছে। তাশফিন, আরিয়ান দু’জনের একজনও এখনও আসছে না। তারেক চৌধুরী বললেন,
-তাশফিন কোথায়?”
তাশফিনের নাম নিতে নিতেই তাশফিন এসে হাজির হলো। লায়লা তাশফিনকে দেখে মনে মনে বলল,
-নাম না নিতেই শয়তান হাজির।”
তাশফিনের পেছনেই আরিয়ানকেও দেখা গেল। মৌরি পাশের চেয়ারটা খালি। আরিয়ান সেটায় বসার জন্য দ্রুত পায়ে তাশফিনের আগে চলে এলো। তাশফিনও ব্যাপারটা বুঝেছে। আরিয়ান চেয়ার টেনে বসতে যাবে সেসময় তাশফিন পেছন দিয়ে যাচ্ছিল। আরিয়ান বসার আগে সে পা দিয়ে চেয়ার ঠেলে দিল। ফলে আরিয়ান নিচে পড়ে গেল। তাশফিনের এই কাজে সবাই হতবাক। মৌরি তো মুখে হাত চেপে ধরেছে। লায়লা বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেছে। তারেক চৌধুরী কঠিন চোখে তাশফিনকে দেখছেন। কিন্তু তাশফিন নির্বিকার। যেন কিছুই করেনি সে। আরিয়ান নিচে পড়ে কোমরে ব্যথা পেয়ে কোকাচ্ছে। তাশফিন চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
-ওপস! মাই মিস্টেক। সরি ব্রাদার।”
মৌরি হতভম্ব ভাব কাটিয়ে আরিয়ানের কাছে বসে পড়ে বলল,
-তোমার লাগেনি তো?”
তাশফিনের এমন বেপরোয়া আচরণ সে আর সহ্য করবে না। যা খুশি তা করে যাবে কেউ কিছু বলবে না! অনেক হয়েছে। লায়লা চেঁচিয়ে উঠল,
-এটা কেমন বিহেভিয়ার তাশফিন! তুমি ইচ্ছে করে ওর চেয়ার টেনে নিয়েছ। তুমি জেনে-বুঝেই ওকে ফেলে দিয়েছ।”
তাশফিন সহজ গলায় বলল,
-ইচ্ছে করে ফেললে ক্ষমা চাইতাম না।”
-তোমার ক্ষমা চাওয়া না চাওয়া দিয়ে কোনকিছু পাল্টে যাবে না। আমার ছেলের কোমর ভেঙে তুমি ক্ষমা চাচ্ছ? আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব?”
-আগে হসপিটালে নিয়ে কনফার্ম হোন কোমর ভেঙেছে কি-না।”
লায়লা স্বামীর দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝাল গলায় বলল,
-দেখেছ তো তোমার ছেলে কী করেছে। তারপর চুপ করে আছো কেন? আমি আর সহ্য করব না। দিনদিন তোমার ছেলের জঙ্গলি আচরণ বেড়েই চলেছে। এমন করলে এক বাড়িতে থাকা যাবে কি-না আমাকে ভাবতে হবে।”
মৌরি আরিয়ানকে ধরে তুলতে সাহায্য করছে। লায়লার কথার জবাবে তাশফিন বলল,
-অনেক বেশি সমস্যা হলে চলে যেতে পারেন। কেউ আটকাচ্ছে না।”
তারেক চৌধুরী এবার ছেলের উদ্দেশ্যে ধমকে বললেন,
-চুপ করো। সাধারণ ভদ্রতা ভুলে গেছ?”
আরিয়ান কোমরে ভালোই ব্যথা পেয়েছে। দাঁড়াতে গিয়েই বেচারার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মৌরি বলল,
-দাঁড়াতে পারবে?”
-হুম।”
-তোমাকে রুমে নিয়ে যাই।”
-না। আমি ঠিক আছি।”
আরিয়ান জেদ করে এখানেই বসল। মৌরি আরিয়ানকে বসিয়ে দিয়ে নিজের চেয়ারে বসল। লায়লা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তাশফিনের সাথে সে আর এক বাড়িতে থাকতে পারবে না। হয় এই ছেলে বাড়ি থেকে যাবে। নয়তো সে। তারেক চৌধুরী নিজে বসে স্ত্রীকে বসতে বললেন। কিন্তু লায়লা বসবে না।
-আগে তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করো ও কী চায়? কেন আমাদের শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না?”
তারেক চৌধুরী ছেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-এই কাজ কেন করেছ?”
-একবার বলেছি। ভুলে চেয়ার সরে গেছে। আপনার স্ত্রীর ছেলেকে আহত করার ইনটেশন ছিল না।”
একটা বাচ্চা পোলাপানও বুঝবে তাশফিন যা করেছে জেনে-বুঝেই করেছে। মৌরি সত্যিই তাশফিনকে এখনও ১% ও চিনতে পারেনি। লোকটা তার ভাবনা থেকেও অনেক বেশি বদ। কাল রাতে তার বলা কথাগুলোর জন্যই কি আরিয়ানের সাথে এমনটা করল! মৌরি বলেছিল তাকে আরিয়ানের সাথে দেখে তাশফিন যেন না জ্বলে। তার প্রতি তাশফিনের ভালোবাসা না থাকলে জেলাস হওয়ারও অধিকার নেই।
কেউ না জানলেও আরিয়ান ঠিকই বুঝতে পারছে তাশফিন এটা কেন করেছে। আরিয়ান প্রতিশোধে জ্বলতে থাকা দৃষ্টিতে তাশফিনকে দেখছে। তাশফিন আরিয়ানের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে শীতল হাসল। তার এই হাসির মানে, তুই কী করতে পারবি তা আমার জানা আছে।
কাল রাতে মৌরির জেরার সম্মুখীন হয়ে তাশফিন কোনভাবে বিষয়টা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। আজকাল সত্যিই সে মৌরিকে আরিয়ানের সাথে দেখতে পারে না। কেন পারে না সে নিজেও জানে না। ভালোবেসে সংসার করার জন্য মৌরিকে বিয়ে করেনি৷ মৌরির ভাইয়ের জন্যই তার বোন হসপিটালে শুয়ে আছে। তাশফিন সিগারেট খেতে ছাদে গিয়েছিল। কিন্তু ওখানে আগে থেকেই আরিয়ান উপস্থিত ছিল। আরিয়ানকে দেখে ফিরে আসার জন্য দাঁড়ালেও পরে ভাবল, ছাদটা আরিয়ানের বাপের না। আরিয়ান আজকের দিনের ঘটনা নিয়ে আগে থেকেই তাশফিনের উপর রেগে ছিল। এখন তাশফিনকে এখানে দেখে বলল,
-জোর করে আর যা-ই হোক, কারো ভালোবাসা পাওয়া যায় না।”
-ভালোবাসার মতো ফালতু জিনিস আমার জীবনে চাইও না।”
-তাহলে কেন মৌরিকে কেয়ার করার নাটক করছিলি? তোর বউ তোর থেকে আমাকে বেশি ইম্পটেন্স দেয় এতে তোর জ্বলে!”
তাশফিন হাসল। সিগারেটের ধোঁয়া আরিয়ানের মুখে ছেড়ে বলল,
-বিয়ে করে আমি ফেলে রেখে চলে এসেছিলাম। আমার পেছনে এখানে এসেছে। এবাড়িতেও আমার জন্যই থাকছে। তুই মাঝখানে কোত্থেকে এলি বুঝতে পারছি না।”
-তোর জন্য এসেছে এটা ঠিক। কিন্তু তোর জন্য থাকছে এটা ভুল। মৌরি নিজে আমাকে বলেছে ও ওখানে আমার জন্য থাকছে।”
তাশফিনের ভ্রু কুঁচকে গেল। আরিয়ান বলে চলছে,
-তোর চোখের সামনে দিয়ে তোর বউকে উড়িয়ে নিয়ে যাব। তখন দেখব তোর ওভার কনফিডেন্স কোথায় যায়। মৌরি আমার সাথে থাকলে কতটা খুশি থাকে আর তোর সাথে থাকলে কতটা খুশি থাকে চোখটা খুলে একটু দেখার চেষ্টা করিস। তোর থেকে বেশি ও আমাকে বিশ্বাস করে।”
রাতের ওই কথাগুলোর প্রতিশোধ নিতেই তাশফিন তাকে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু আরিয়ানও এবার চুপ থাকবে না। তাশফিনকে জ্বালানোর জন্য যা যা করতে হয় সব করবে।
”
”
পিহুর কাছ থেকে আসার পর থেকে মাহিম বাড়িতে কারো সাথে ভালো করে কথা বলছে না। অল্পতেই রেগে যাচ্ছে। চেঁচামেচি করছে। ছেলের হটাৎ এমন পরিবর্তনে বাবা মা সহ পরিবারের সকলে চিন্তিত। পড়াশোনা শেষ করেও চাকরি পাচ্ছে না বলে মেজাজ খিটমিটে হয়ে গেছে। মাহিম ঘরেই বসে ছিল। বাইরে বেরোতেও তার ইচ্ছে করছে না। মা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। ছেলেটা তো এরকম ছিল না। তিনি ঘরের ভেতরে এসে সাবধানে কথা শুরু করলেন। মনের মধ্যে এই ভয় ছেলে যেন রেগে না যায়।
-কী হয়েছে রে বাপ? কোন কিছু কি তোকে যন্ত্রণা দিচ্ছে? আমাকে বল।”
মেয়েটা তাদের কারো কথা না শুনে ওবাড়িতে গিয়ে পড়ে আছে। মেয়ের সাথে দেখা করা কেন কথা বলারও সুযোগ নেই। এখন ছেলেটাও যদি দূর হয়ে যায়।
-তোর কী পেরেশানি? আমাকে বল। চাকরির জন্য পেরেশানি? তুই তো চেষ্টা করছিস। এমন তো না যে চেষ্টা না করে ঘরে বসে আছিস।”
মাহিম ব্যথাতুর দৃষ্টিতে মা’র দিকে তাকাল। মা’কে অবাক করে দিয়ে বলল,
-সব সময় এমন কেন হয় যে, বাবা মা’র কথাই সন্তানের শুনতে হবে। বাবা মা কেন সন্তানকে বোঝার চেষ্টা করে না?”
-আমরা তোদের দুই ভাইবোনকে বুঝি না? আমরা কি কখনও তোদের উপর কোনকিছু চাপিয়ে দিয়েছি?”
-মৌরি এখন বিয়ে করতে চায়নি। তোমাদের ছেলে পছন্দ হয়েছে তাই তোমরা ওকে জোর করলে। দোষ আমারও। আমিও তো তখন বোনের পক্ষ নিইনি।”
-তোর বোনকে আমরা জোর করেছি? আমি শুধু ছেলেটার সাথে একদফা দেখা করার জন্য জোর করেছি। বিয়ের সিদ্ধান্ত ওর উপর ছেড়ে দিয়েছিলাম।”
-মৌরি বাচ্চা মানুষ। ও কী বুঝে…
মাহিম মা’র সাথে বেশিকিছু বলতে পারল না। মনে মনে বলল,
-তাশফিন মৌরিকে ব্যবহার করে আমাকে কষ্ট দিতে চেয়েছিল। ও আমার বোনকে ভালোবাসেনি। কিন্তু এসবের তো কোন দরকার ছিল না। আমাকে পিহুর সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে আমি নিজে থেকেই শেষ হয়ে যেতাম। যেমন এখন হচ্ছি। তোমাদের বিশ্বাস ভরসা রাখার জন্য আমি পিহুকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছি মা। আমি এই অপরাধ, কষ্টের কথা কার কাছে বলব? আমার বোনও আমাকে ভুল বুঝেছে। আমার সাথে কথা বলে না। আমি কী করব মা?”
মাহিমের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তার বুকের ভেতরের যন্ত্রণায় কথা সে কাউকেই বলতে পারছে না।
”
”
মৌরি ঘরে ঢুকেই তাশফিনের উপর মনের সব রাগ ঝাড়তে লাগল।
-আপনি কি মানুষ? নিজের ভাইয়ের উপরও একটু দয়া হলো না? কোমর ভেঙে ফেলেছেন ছেলেটার। ও যদি এখন হাঁটতে না পারে?”
-তুমি আছো তো হুইলচেয়ার ঠেলার জন্য।”
মৌরি রাগ দেখালেও তাশফিন নির্বিকার। তার মাঝে অনুশোচনার ছিটেফোঁটাও লক্ষ করা যাচ্ছে না।
-আরিয়ান আমার পাশে বসতে চেয়েছিল তাই আপনি ওকে ফেলে দিয়েছেন। বউয়ের প্রতি এত ভালোবাসা। বউয়ের সাথে ভাইকে দেখলেও এতটা জ্বলেন তাহলে মুখে স্বীকার করেন না কেন?”
তাশফিন মৌরির কথা কানেও নিল না। মনোযোগ দিয়ে ফোনে গেমস খেলছে। মৌরি কতক্ষণ রাগভরা দৃষ্টিতে তাশফিনের দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেই বলল,
-এই লোক তো মানুষ না। এর উপর কেন রাগ করছি? উনার মনই শুধু পাথর না। নিজেও আস্ত একটা পাথর।”
মৌরি ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। তাশফিন ডেকে বলল,
-খালাকে বলে যাও আমাকে চা দিতে।”
-খালাকে এটাও বলি চায়ের সাথে একটু বিষ মিশিয়ে দিক।”
-কবুল না বলা স্বামীকে মেরে বিধবা হতে চাইলে বলতে পারো।”
-আমার সন্দেহ হচ্ছে বিষ দিয়েও আপনি মরবেন না। কারণ আপনি নিজের ভেতরই বিষ দিয়ে ভরা। খালাকে দিয়ে এটা সেটা আনিয়েই যাচ্ছেন। দুইটা মিনিট আরিয়ানের কাজ করার সময় দিচ্ছেন না। আমি নিজে যাচ্ছি। দেখি এবার আপনি কী করেন।”
চলবে