#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [১৫]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
পিহুকে দেখে মাহিমের পা দু’টো যেন বরফের মতো জমে গেল। দরজার সামনে থেকে কোনমতেই ভেতরে যেতে পারছে না। পিহুকে এ অবস্থায় দেখতে হবে কল্পনা করেনি। ওরা দু’জন মিলেই তো সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল। তারপরেও পিহু কেন এমনটা করল? পিহু বেডে শুয়ে আছে। মাহিম এসে সামনে দাঁড়ালেও পিহু তার দিকে তাকাল না। মাহিম যেন একটু একটু কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকল,
-পিহু।”
ডাকটা এতটাই ক্ষীণ শোনালো যে মাহিম নিজেই শুনতে পেল না। পিহুর হাত নিজের হাতে নিলে মাহিমের বুকের ভেতর কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয়ে গেল।
-কেন করলে পিহু? এমনটা তো কথা ছিল না।”
মাহিমের গাল বেয়ে টুপ করে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
-তুমি বললে আমি তোমার জন্য গোটা পৃথিবীর মানুষের সাথে যুদ্ধ করতে পারতাম। তুমি বলেছিলে আমাকে ছাড়া থাকতে তোমার কষ্ট হবে। কিন্তু তুমি মানিয়ে নিতে পারবে। তুমি এটা কেন বলোনি আমাকে ছাড়া তোমার বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে যাবে। তাহলে আমি কোনদিনও তোমাকে ছাড়তাম না।”
মাহিম পিহুর হাতের উপরের পিঠে ঠোঁট ছুঁইয়ে চোখ বন্ধ করে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগল। ওভাবেই অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর মাহিম সোজা হয়ে বসে চোখ মুছে নিজেকে শক্ত করল।
-এখনও সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। অনেক হয়েছে। আর কিন্তু সহ্য করব না৷ এবার তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও। আমাকে আমার ভুল শুধরে নেওয়ার একটা সুযোগ দাও। কথা দিচ্ছি, তোমাকে কোনরকম অভিযোগ করার সুযোগ দিব না।”
”
”
তাশফিন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে অনেকক্ষণ। মৌরি খুশি মনে টইটই পুরো বাড়ি ঘুরছে। তার খুশির কারণ তাশফিনের তার প্রতি এতটা যত্ন নেওয়া। আরিয়ান বেরোবার আগে মৌরিকে দেখতে এসেছিল। ওকে রুমে না পেয়ে আশেপাশে খুঁজতে লাগল। সেসময় মৌরিও সদর দরজা দিয়ে ঢুকছে। আরিয়ান মৌরিকে দেখে এগিয়ে গিয়ে রুক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করল,
-কোথায় গিয়েছিলে?”
মৌরি আরিয়ানকে দেখল। এই ছেলের আবার কী হয়েছে? এভাবে কথা বলছে কেন?
-তুমি কি আমার উপর রেগে আছো?’
-তোমার উপর আমি রাগব কেন? অধিকার আছে আমার?”
আরিয়ানের হঠাৎ রাগের কারণ মৌরি সত্যিই বুঝতে পারছে না।
-একশো বার আছে। দশটা না পাঁচটা না। তুমি আমার একটা মাত্র দেবর।”
-থাক। আমি তোমার কে তা আমার বোঝা হয়ে গেছে। তখন তোমার বরের সামনে বলতে পারোনি। তোমার বর আমাকে অপমান করেছে। তুমি তখন চুপ ছিলে।”
রাগের কারণ তাহলে এটা! মৌরি মনে মনে বলল,
-হায় কপাল! এ তো দেখি মেয়েদের থেকেও বেশি অভিমানী।”
মৌরি মুখে বলল,
-আসলে তোমাদের ভাইদের মাঝে আমি থার্ড পার্সন হতে চাচ্ছিলাম না। তাই…
-তাশফিন নিজের মুখে বলেছে ও তোমাকে স্ত্রী মানে না। তুমি এবাড়িতে থাকো ও চায় না। তোমাকে কষ্ট দেয়। তোমার খেয়াল রাখে না। তাহলে আজ কী প্রমাণ করতে আমাকে তোমার হাতে মলম লাগাতে দিল না?”
মৌরি বিড়বিড় করে বলল,
-এটার জবাব তো আমিও চাইব।”
তাশফিনের থেকে জবাব পরেও নেওয়া যাবে। কিন্তু এই অভিমানী ছেলেকে, আচ্ছা ছেলেদের ক্ষেত্রেও কি অভিমানী বলা যাবে? মৌরি আরিয়ানের অভিমান কমাতে বলল,
-আচ্ছা পরের বার থেকে এমন কোন পরিস্থিতি তৈরি হলে আমি তোমার পক্ষে থাকব। তুমি শুধু আমার দেবরই না। আমার খুব ভালো বন্ধুও।”
”
”
কলেজ শেষে ফাইজা বন্ধুদের সাথে আইসক্রিম খেতে এসেছে। বন্ধুরা সবাই গল্পে মেতে আছে। ওয়েটারকে ডেকে অর্ডার দিয়ে সামনের টেবিলেই আরিয়ানকে দেখে ফাইজার চোখ আটকে গেল। এই লোক এখানে কী করছে? গতকাল কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। আজ এখানে? লোকটা কি ইচ্ছে করে সে যেখানে যাচ্ছে সেখানে সেখানে উপস্থিত হচ্ছে! নাকি পুরোটাই কাকতালীয় ব্যাপার। ফাইজাকে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সোনালী বলল,
-কী দেখছিস রে? ওদিকে কী আছে?”
বলতে বলতে সোনালী ফাইজার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনের টেবিলে তাকাল। আরিয়ানকে দেখে বেচারি বসে বসেই ক্রাশ খেয়ে ফেলল।
-ও-এম-জি! ছেলেটা কী হ্যান্ডসাম!”
ফাইজা সোনালীর দিকে তাকিয়ে চোখ পাকাল। ছেলে দেখলেই এই মেয়ের মাথা খারাপ হয়ে যায়। ফাইজা নিজেকেই প্রশ্ন করছে,
-এই লোক কি আমাকে ফলো করছে?”
কথাট শুনতে পেয়ে সোনালী কৌতূহলী কন্ঠে বলল,
-চিনিস একে?”
-না।”
-কেন চিনিস না? চেনাজানা থাকলে একটু কথা বলতে পারতাম।”
-তোর জন্য পৃথিবীর সব ছেলের সাথে কি আমার চেনাজানা থাকতে হবে? লুচ্চা মেয়ে কোথাকার!”
ফাইজার কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখল আরিয়ান উঠে তার দিকে হেঁটে আসছে। ফাইজা মনে মনে বলল,
-এই ব্যাটা আবার এদিকে আসছে কেন?”
ছেলেটা তাদের দিকে আসছে! সোনালী ফাইজার হাত শক্ত করে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,
-ছেলেটা কি আমার দিকে দেখছে! আমাদের দিকেই আসছে দেখ।”
আরিয়ান ওদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। ফাইজার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
-কেমন আছেন বিয়ান?”
বিয়ান ডাকছে! কাকে? সোনালী কনফিউজ হয়ে ফাইজার দিকে দেখল। বোনের দেবর নিজে থেকে এসে তার সাথে কথা বলছে। ফাইজা তো আর উনাকে না চেনার অ্যাক্টিং করতে পারে না। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুখে হাসি টেনে তাকে বলতে হলো,
-আলহামদুলিল্লাহ। আপনি এখানে?”
সোনালী এখনও বুঝতে পারছে না ফাইজা কি ছেলেটাকে চেনে? আরিয়ান সোনালীর দিকে তাকিয়ে বলল,
-আমি কি এখানে বসতে পারি?”
সোনালী গদগদ গলায় বলল,
-অবশ্যই।”
আরিয়ান চেয়ার টেনে ওদের সামনে বসে বসল। আরিয়ানের উপস্থিতিতে ফাইজা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সোনালী বলল,
-আপনি কি ফাইজাকে চেনেন?”
আরিয়ান ফাইজার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝে গেল। সে হেসে বলল,
-আপনার ফ্রেন্ড আপনাকে আমার পরিচয় দেয়নি।”
সোনালী টেবিলের নিচ দিয়ে ফাইজার হাতে জোরে চিমটি কাটল। কটকট দৃষ্টিতে ফাইজার দিকে তাকিয়ে বোঝাল, তোর খবর তো আমি পরে নেব। সোনালী আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে হাসি আরও প্রসারিত করে বলল,
-ওর কোন কথা মনে থাকে না। স্মৃতিশক্তি দূর্বল। আপনিই বলুন।’
সোনালীর আদিখ্যেতা দেখে ফাইজার গা জ্বলছে। সে-ই মুখ খুলল,
-উনি মৌরি আপুর দেবর।”
-আমাদের বিয়াই!”
আরিয়ানের এখানে আসা ফাইজা কিছুতেই মেলাতে পারছে না। সেদিন নাহয় বলেছিল কলেজে দরকারে এসেছে। কিন্তু আজ এখানে কী দরকার থাকতে পারে? ফাইজা ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশের টেবিলে দেখল। এই টেবিল ছাড়া অন্য টেবিলে কলেজের কোন মেয়ে নেই। ফাইজা জিজ্ঞেস করল,
-আজকেও কি আপনি কোন কাজে এসেছেন?”
আরিয়ান বুঝতে পারছে ফাইজা তাকে সন্দেহ করছে। তাই সে বলল,
-বন্ধু ফুল চকোলেট নিয়ে তার নিব্বি গার্লফ্রেন্ডের রাগ ভাঙাতে ব্যস্ত। ওসব আবার আমি দেখতে পারি না। তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে রোদে না পুড়ে এখানে এসে বসাই বেটার মনে হয়েছে।”
ফাইজা মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক তাকে ফলো করে এখানে আসেনি তাহলে। সোনালী আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করে বসল,
-ওসব আপনি দেখতে পারেন না কেন? নিজের গার্লফ্রেন্ড রাগ করলে আপনি ওসব করেননা বুঝি?”
আরিয়ান আড়চোখে ফাইজাকে দেখে বলল,
-এসব প্যারা নিতে পারব না বলেই এখনও সিঙ্গেল আছি।”
-বলেন কি! আপনার গার্লফ্রেন্ড নেই?”
-থাকাটা কি বাধ্যতামূলক?”
-না। কিন্তু বর্তমান যুগে আপনার মতো ছেলে নিজেকে সিঙ্গেল দাবি করলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।”
আরিয়ানের সাথে সোনালীর কথা যেন শেষই হচ্ছে না। আজ ফাইজা অবশ্য চুপ আছে। অনেকটা সময় পরেও যখন আরিয়ানের বন্ধুর দেখা পাওয়া গেল না তখন ফাইজা বলল,
-আপনার বন্ধু তো দেখছি এখনও আসেনি।”
-কল করে দেখি কাজ হয়েছে কি-না।”
আরিয়ান পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল করল। ফোনে কথা বলা শেষ করে জানাল,
-গাধাটা গার্লফ্রেন্ডের চক্করে পড়ে আমাকে ভুলে গেছে।”
ফাইজা উঠে দাঁড়াল। সোনালীর যাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও ওকে টেনে তুলে বলল,
-আমাদের এখন যেতে হবে। অনেক দেরি হয়ে গেছে।”
-কিছু মনে না করলে আমি আপনাদের ড্রপ করে দেব?”
-না, ধন্যবাদ। তার প্রয়োজন নেই।”
ফাইজা আরিয়ানকে রেখেই সোনালীকে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল। আরিয়ান ওদিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। যেতে যেতে সোনালী বলল,
-প্রথমে কেন মিথ্যা বলেছিলি তুই উনাকে চিনিস না?”
-কারণ আমার বান্ধবীর চরিত্র নষ্ট।”
”
”
রাতে তাশফিন বাড়ি ফিরে মৌরিকে খুঁজে। আশেপাশে দেখতে না পেয়ে রুমে চলে আসে। তাশফিন যখন রুমে আসে মৌরি তখন হাতে মলম লাগাচ্ছিল। তাশফিন আড়চোখে মৌরিকে দেখে। মৌরির মনে তখনের পর থেকে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। তাশফিনের দিকে তাকিয়ে মলম লাগাতে গিয়ে বেখেয়ালে পোড়া জায়গাটায় জোরে লেগে গেল। মৌরি ব্যথায় ককিয়ে উঠল।
-আহ! উফ।”
মৌরি জোরে জোরে ফুঁ দিতে লাগল। তাশফিন শার্টের বোতাম খুলছিল। মৌরির গলা পেয়ে এদিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে এগিয়ে আসছিল। মৌরি ভেবেছিল তাশফিন তার কাছে আসবে। তার হাত থেকে মলম নিয়ে নিজেই লাগিয়ে দিবে। কিন্তু তাশফিন মাঝপথে থেমে গেল। নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পেতে না দিয়ে ওয়ারড্রব থেকে টিশার্ট বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। মৌরি এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সে মুখ বাঁকিয়ে বলল,
-খবিশ লোক। বদ, অসভ্য, অভদ্র, জাহিল, নিষ্ঠুর,পাষাণ!”
তাশফিনকে বেরোতে দেখে মৌরি চুপ করে গেল। তখন আরিয়ানের সামনে দরদ উথলে পড়ছিল। এখন একা ঘরে বউয়ের দিকে তাকিয়েও দেখছে না।
-আপনি তখন যে কথাগুলো বলেছিলেন সেগুলো কি শুধু মুখের কথা ছিল?”
তাশফিন মৌরির দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইল তার সাথে কথা বলছে কি-না। মৌরি উপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল।
-তখন তো খুব বড় মুখ করে বলছিলেন। এখন তাহলে কী হলো?”
-কী বলছিলাম?”
-আমার বউয়ের কষ্ট আমি বুঝব। ওকে মলমও আমিই লাগাব।”
মৌরি কথাগুলো ভেঙানোর মত করে বলল। তাশফিন যেন ওর কথা শুনেও শুনেনি। মৌরি থামল না। বলেই চলল,
-ওসব কি শুধুমাত্র আরিয়ানকে দেখানোর জন্য ছিল? আরিয়ান মলম লাগিয়ে দিচ্ছিল দেখে কি আপনি জেলাস ফিল করছিলেন? নিজের ভাইকে নিয়েও জেলাস হোন! কিন্তু জেলাসি তো তখন হওয়ার কথা ছিল যদি আপনি আমাকে ভালোবাসতেন। তার মানে কি আপনি আমাকে ভালোবাসেন!”
মৌরির কথা শুনে তাশফিন থতমত খেয়ে গেল। মৌরি তাশফিনের রিয়াকশন দেখে ঠোঁট টিপে হাসছে। তাশফিন গলা ঝেড়ে বলল,
-নিজের মনের খুশির জন্য যা খুশি তা ভেবে নিলেই হয়!”
-আমাকে তো আপনি ভাবতে বাধ্য করছেন।”
-মনের মধ্যে কোনরকম ভুল ধারণা পুষো না।”
-তাহলে আমাকে আরিয়ানের সাথে দেখলে আপনিও আর জেলাস হবেন না।”
চলবে