#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [১৪]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
মাহিম জানে তাশফিন পিহুর সাথে তার দেখা করাবে না। তাশফিনের কাছে বারবার অনুরোধ করেও কোন লাভ নেই। যা করার তাকেই করতে হবে। মৌরির সাহায্য নেবে? কিন্তু মৌরিও তো তার উপর রেগে আছে। আজ যেভাবেই হোক মাহিম পিহুর সাথে দেখা করেই ছাড়বে। তাই আজ সকাল থেকেই দূর থেকে সে তাশফিনকে ফলো করছিল। তাশফিন সারাদিনে একবার অন্তত বোনের সাথে দেখা করতে যাবে। এই সুযোগেই মাহিম হসপিটালটা চিনে রাখবে। মাহিমের ভাবনা মতো হলোও এমন। তাশফিনের পিছু করে ঠিকই পিহুর কাছে পৌঁছে গেল। কিন্তু হসপিটালে ঢুকে পিহুর সাথে দেখা করতে তাকে বাধা দেওয়া হচ্ছে। কেননা ফ্যামিলি মেম্বার ছাড়া অন্য কারো পিহুর সাথে দেখা করার অনুমতি নেই।
-এভাবে তো কারো দেখা করার অনুমতি নেই। আপনি পেশেন্টের কে হোন?”
মাহিম চট করে বলে ফেলতে পারল না সে পিহুর কে হয়। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। পিহুর ব্যাপারটা আমি জানতাম না। যখন জেনেছি সোজা এখানে এলাম।”
-ঠিক আছে। আপনি কিছুটা সময় অপেক্ষা করুন। আমরা পেশেন্টের ভাইয়ের সাথে কথা বলে নিই। আপনার নামটা যেন কী?”
এই রে! তাশফিনের সাথে কথা বললে দু’মিনিটের মধ্যে তাকে হসপিটাল থেকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া হবে। সে যাতে পিহুর সাথে দেখা করতে না পরে এজন্যই তাশফিন হসপিটালে বলে রেখেছে। বেটা বদ বুদ্ধির রাজা। এতদূর এসে মাহিমও হার মানার পাত্র না। সে তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল,
-হ্যাঁ কথা বলতে পারেন। আমি মিথ্যা বলছি না। কিন্তু আমার একটু তাড়া আছে। আধঘন্টার মধ্যেই আমার ফ্লাইট। আসলে আজই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমি। এখন দেখা না হলে আর হয়তো…
মাহিম কথাগুলো বলতে বলতেও চোরা চোখে নার্সটার দিকে তাকাল। এটুকু মিথ্যা তাকে বলতেই হতো। নয়তো পিহুর সাথে দেখা করার সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
-এখান থেকে বের হয়ে আমি সোজা এয়ারপোর্ট যাব। এখন যদি আপনারা আমাকে অবিশ্বাস করে এখানেই আমার দেরি করিয়ে দিন, তাহলে হয়তো আমার একটু পরের ফ্লাইট মিস যাবে। ঢাকা শহরের রাস্তার জ্যামের কথাও নিশ্চয় জানা আছে।”
মাহিম মনে মনে প্রার্থনা করছে নার্সটা যেন আর সন্দেহ না করে। তাকে যেন পিহুর সাথে দেখা করতে দেয়। সে পিহুর কাছে যাবার আগ পর্যন্ত তাশফিনকে যেন না জানায়।
”
”
অনেকটা সময় ধরে আরিয়ান কারো অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু যার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে বেচারা পা ব্যথা বানিয়ে ফেলছে তার দেখা পাওয়ার খবর নেই। গাড়িতে বসে থাকলেও হতো। কিন্তু আরিয়ান গাড়িতে হেলান দিয়ে কলেজ গেটের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ফাইজা বন্ধুদের সাথে কথা বলতে বলতে গেট দিয়ে বেরিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটার দিকে নজর পড়ল। ঠিক গাড়িটা না। চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে থেমে গেল। এটা আপুর দেবর না? হ্যাঁ। উনিই তো মনে হচ্ছে। উনি এখানে কী করছেন? ফাইজা বন্ধুদের বলল,
-তোরা যা। আমার একটু কাজ আছে।”
-এখন আবার কী কাজের কথা মনে পড়ল তোর?”
-যা না তোরা। এত কথা বলিস কেন? কাজ আছে দেখেই তো বলছি।”
-যা খুশি কর। আমাদের কী?”
বন্ধুরা চলে গেলে ফাইজা রোড পার করে আরিয়ানের দিকে এগিয়ে আসছে। আরিয়ান ফাইজাকে তার দিকে আসতে দেখেই নড়েচড়ে দাঁড়াল। ফাইজা আরিয়ানের সামনে এসে বলল,
-আরে বিয়াই সাহেব না! কেমন আছেন?”
আরিয়ান যেন মাত্রই ফাইজাকে দেখেছে এমন ভাব করে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে আশ্চর্য হওয়া গলায় বলল,
-আপনি এই কলেজে পড়েন!”
-জি। কিন্তু আপনি এখানে আমাদের কলেজের সামনে কী করছেন?”
-একটা কাজে এসেছিলাম। ভাবিনি আপনার সাথে দেখা হয়ে যাবে।”
ফাইজা কলেজের গেটের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসে বলল,
-কাজে এসেছেন! ভালো ভালো। কিন্তু এখন তো কলেজ ছুটি।”
-হ্যাঁ। আপনি কি এখন বাসায় ফিরবেন?”
-হুম।”
-অসুবিধা না থাকলে আমার সাথে চলতে পারেন।”
-আপনার কাজ শেষ? না মানে আপনি তো কাজে এসেছিলেন।”
-অন্য একদিন আসব।”
গাড়িতে বসেও ফাইজা মুখ টিপে হেসেই যাচ্ছে। আরিয়ান সেদিকে লক্ষ করে মনে মনে ভাবছে,
-মেয়েটা আমাকে সন্দেহ করছে না তো!”
-আপনি আমাদের বাড়ি চিনেন?”
-হ্যাঁ?”
আরিয়ান অন্য কিছু ভাবছিল। তাই ফাইজার কথা শুনতে পায়নি। ফাইজা আবার বলল,
-বিয়ের সময় কিন্তু আপনাকে একবারও দেখিনি। আপনি আমাদের বাড়ি চিনেন?”
-আমি না চিনলেও আপনি তো চিনেন।”
-কথা জানেন দেখা যাচ্ছে। আপু কেমন আছে?”
-আমার মতো একটা দেবর থাকতে কেউ খারাপ থাকতে পারে?”
-নিজের প্রশংসা নিজেই করছেন!”
-অন্য কেউ তো করে না।”
-আপনি ভালো হলে কী হবে? আপনার ভাইটা তো একটা খাটাশ। উনাকে সামনে পেলে আমি পঁচা পুকুরে চুবিয়ে মারতাম।”
-আমার ভাইয়ের উপর আপনার অনেক রাগ জমে আছে।”
-থাকবে না? উনি যা করেছেন তা কি এত সহজে ভুলে যাব?”
-না। কিন্তু ওকে দিয়ে আমাকে বিচার করাটাও ঠিক হবে না। আমরা ভাই হলেও আমাদের মধ্যে অনেক অমিল।”
-সেটা তো আপনার সাথে প্রথম দেখা হওয়ার পরই বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা আপনি কী কাজে এসেছিলেন বললেন না তো।”
-তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ না।”
-আপনার কাজটা কি তা কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি। আমাদের গার্লস কলেজ। আর গার্লস কলেজের সামনে আপনার কী কাজ থাকতে পারে তা বোঝার জন্য আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। বেয়াইন আমাদের কলেজে পড়ে তাই না? কোন ডিপার্টমেন্ট? ফার্স্ট ইয়ার নাকি সেকেন্ড ইয়ার? নাম তো বলতেই পারেন।”
এই মেয়ের এক লাইন বেশি বুঝে ফেলায় আরিয়ান হতাশ হলো। তার এখানে আসার উদ্দেশ্য আসলে সে নিজেও জানে না। কেন এসেছে?
”
”
আরিয়ান ফুরফুরে মেজাজে বাড়িতে ঢুকলো। নিজের রুমের দিকে যাবার সময় কিচেন থেকে সালেহা খালার গলা শুনতে পেল। সাথে মৌরির কন্ঠে অস্পষ্ট কাতরানো।
-তোমাকে না করছিলাম। তোমার রান্না করতে হইব না। শুনলা না আমার কথা। হাত পুড়াইয়া ফেললা তো!”
গরম তেল হাতে ছিটে এসেছে। জায়গাটা ভীষণ জ্বালাপোড়া করছে। মৌরি ঠোঁট কামড়ে জ্বলুনি সহ্য করলেও চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছে। সালেহা খালা বুঝতে পারছে না তার এখন কী করা উচিত। মৌরি অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আরিয়ান কৌতূহল থেকেই দেখতে এসেছিল। কিচেনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে ছুটে এসে মৌরির হাত ধরল। ব্যস্ত গলায় বলল,
-কীভাবে পুড়েছে? ওহ গড! অনেকটা পুড়েছে। তুমি কিচেনে কেন এসেছ?”
মৌরি কিছু বলতে পারছে না। সালেহা খালা বলল,
-আমারই দোষ। আমি যদি ওর কথা না শুনতাম তাহলেই এমনটা হতো না।”
এখন এসব আলোচনা করার সময় না। দোষ যারই হোক এখন অতি শীঘ্রই পোড়া জায়গায় ঔষধ লাগাতে হবে। আরিয়ান সালেহা খালাকে বলল,
-খালা আপনি ফার্স্টএইড বক্স নিয়ে আসেন। আমার রুমে না পেলে মমের রুমে আছে দেখবেন। জলদি যান প্লিজ।”
মৌরি কাঁদছে। আরিয়ান মৌরির মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায় ভাবে বলল,
-কী করলে বলো তো!”
বরফ! পোড়া জায়গায় বরফ দিলে জ্বালাপোড়া কমে। আরিয়ান আশেপাশে খুঁজল। জীবনের প্রথম সে রান্নাঘরে এসেছে। কোথায় কী আছে কিছুই জানে না। আরিয়ান ফ্রিজ থেকে বরফ বের করে এনে মৌরির হাতের পুড়ে যাওয়া জায়গায় আলতো করে ধরলো।
-তুমি এসো। আজকের পর থেকে যেন তোমাকে কিচেনে আসতে না দেখি। চলো আমার সাথে।”
আরিয়ান মৌরিকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এসে সোফায় বসিয়ে দিয়েছে। ততক্ষণে সালেহাও ফার্স্টএইড বক্স নিয়ে চলে এসেছে। আরিয়ান ফার্স্টএইড বক্স খুলে অয়েন্টমেন্ট খুঁজছে। এমন সময় তাশফিন কোনো একটা কাজে বেরুচ্ছিল। মৌরিকে আরিয়ানের সাথে দেখে যথারীতিই সে রেগে গেল। দূর থেকে কটমট চোখে ওদের দু’জনকে দেখল। আরিয়ান মৌরিকে বলছে,
-একটু হয়তো জ্বালা করবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবার জ্বালা কমে যাবে।”
তাশফিন তীক্ষ্ণ চোখে এই দৃশ্য দেখে ওদের কাছে এগিয়ে এলো। দূর থেকে সে বুঝেনি মৌরির কিছু হয়েছে। কিন্তু কাছে এসে আরিয়ানকে মৌরির হাত ধরে রাখতে দেখে বলল,
-কী হচ্ছে এখানে?”
তাশফিন মৌরির দিকে তাকিয়ে দেখল ওর চোখে ভেজা। দাঁত কামড়ে রেখে সে হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। তাশফিন মৌরির হাতের দিকে লক্ষ করলে মুখের কঠিন ভাব সরে গিয়েছে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা ফোটে উঠল। সে মৌরির পাশে বসে আরিয়ানের থেকে মৌরির হাত ছাড়িয়ে এনে নিজে দেখতে দেখতে বলল,
-কী হয়েছে? পুড়ে গেছে! কীভাবে হয়েছে?”
আরিয়ান পোড়া জায়গায় মলম লাগাতে নিয়েছে তার আগেই তাশফিন হাত টেনে নিল। আরিয়ান মৌরির হাত ধরে বলল,
-হাত ছাড় ওর।”
আরিয়ানের কথা শুনে তাশফিন আগুন চোখে তাকাল। বলল,
-কেন ছাড়ব? ও আমার বউ।”
-বউ মানিস? হাত ছাড়। মলম লাগাব। কষ্ট পাচ্ছে।”
-আমার বউয়ের কষ্ট আমি বুঝব। ওকে মলমও আমিই লাগাব৷ তুই সাইডে থাক।”
-সব জায়গায় ঘাড়ত্যাড়ামি করিস না।”
-তুই সব জায়গায় অনাধিকার চর্চা করিস না। আমার বউয়ের ব্যাপার আমাকেই বুঝতে দে।”
তাশফিন আরিয়ানের হাত থেকে অয়েন্টমেন্ট ছিনিয়ে নিয়ে মৌরিকে তার দিকে ফিরিয়ে পোড়া স্থানে ফুঁ দিয়ে দিয়ে সযত্নে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে। মৌরি এতক্ষণ নিজের ব্যথা ভুলে গিয়ে তাকে নিয়ে দুই ভাইয়ের ঝগড়া দেখছিল। এরকম একটা পরিস্থিতিতেও মানুষ ঝগড়া করতে পারে! মৌরির ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে তাশফিনকে দেখছে। তাশফিন মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজ করছে। মাঝে মাঝে চোখ তুলে মৌরিকেও দেখে নিচ্ছে, মৌরির কষ্ট হচ্ছে কি-না। ঘুসি মেরে তাশফিনের নাক ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করলেও আরিয়ান নিজেকে কন্ট্রোলে রাখল। তাশফিনকে তো সে পরে দেখে নেবে আগে মৌরির ট্রিটমেন্ট হওয়া প্রয়োজন।
চলবে