শ্রাবণ ঝরা মেঘ পর্ব-১৩

0
508

#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [১৩]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

আরিয়ান ছেলেটাকে প্রথম দিকে মৌরির সুবিধার মনে হয়নি। কেমন সন্দেহজনক লেগেছে। রহস্য করে কথা বলতো। কিন্তু আস্ত আস্তে আরিয়ানের আচরণে মৌরির ধারণা পাল্টে গেছে। ছেলেটা খারাপ না। ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক ভালো না হলেও মৌরিকে নিজের বলেই মানে। তাইতো এত করে বলার পরেও মৌরি আরিয়ানের কথা ফেলতে পারল না। আরিয়ান প্রথমে মৌরিকে শপিংমলে নিয়ে এসেছে।

-তোমার যা খুশি নিতে পারো। সময় কিন্তু এক ঘন্টা। এই এক ঘন্টায় তুমি পুরো মল খালি করে ফেললেও আমি কিছু বলব না।”

-কিসের খুশিতে এই অফার?’

-তুমি আমার সাথে এসেছ। এর থেকে বড় কোন খুশির কারণ লাগবে?”

মৌরি হেসে ফেলল। মজা করেই বলল,

-ভাবীর সাথে ফ্লার্ট করছো?”

-আফসোস! ভাবী হওয়ার আগে কেন তোমার সাথে দেখা হলো না।”

-তোমার ভাইয়ের কপাল ভালো ছিল এজন্য।”

-হুম। কিন্তু সে তো তোমার মূল্য দিচ্ছে না। পেয়ে গিয়ে অবহেলা করছে।”

-এখন অবহেলা করছে। এজন্য হয়তো একসময় আফসোস করবে। কিন্তু তখন আর কাজ হবে না।”

মৌরি কোনকিছুই পছন্দ করতে পারল না। সে ঘুরে ঘুরে দেখছে তো ঠিক। কিন্তু কিছুই ভালো লাগছে না। আরিয়ান মৌরির পেছনে ঘুরতে ঘুরতে হতাশ হয়ে বলল,

-বুঝেছি। আর ঘুরতে হবে না। তুমি দাঁড়াও। আমি যা পছন্দ করব তা-ই নিবে।”

মৌরি দাঁড়িয়ে আছে হটাৎ পেছন থেকে কেউ তার চোখ চেপে ধরল। মৌরি মানুষটার হাত ধরেও বুঝতে পারল না এটা কে। আরিয়ান মেয়েটাকে দেখছে। মৌরির চেনা কেউ?

-কে? আমি চিনতে পারছি না।”

মেয়েটা মুখে হাসি নিয়ে বলল,

-না চিনলে চোখও ছাড়ব না।”

কন্ঠ শুনে মৌরি খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল,

-ফাইজা, তুই! শয়তান মেয়ে, চোখ ছাড়।”

ফাইজা মৌরির চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিল। মৌরি পেছন ফিরে ফাইজাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-কেমন আছিস তুই?”

ফাইজা মৌরিকে এখানে আশা করেনি। অপ্রত্যাশিত এই দেখায় ফাইজা খুশি প্রকাশ করার উপায় পাচ্ছে না। সে মৌরিকে ছাড়ছেই না।

-আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো আপু? কতদিন পর তোমাকে দেখলাম। তুমি এমন কেন? আমাদের একেবার ভুলে গেলে?”

মৌরি ফাইজাকে ছাড়িয়ে বলল,

-ভুলিনি।”

ফাইজা মন খারাপ করে বলল,

-ভুলোনি। আবার মনেও রাখো নি৷ তুমি অনেক বাজে। তোমার সাথে আর কথাই বলব না।”

আরিয়ান দুই বোনের মাঝে বাইরের মানুষ হয়ে গেল। সে এখানে আছে তা হয়তো কারো মনেই নেই। আরিয়ান দু-হাত বুকে ভাঁজ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দুই বোনের মানঅভিমান দেখছে।

-একা এসেছিস?”

-বান্ধবীর সাথে এসেছি। তুমি কার সাথে এসেছ?”

এবার মৌরির আরিয়ানের কথা মনে পড়ল। সে এতক্ষণ ভুলেই গিয়েছিল। মৌরি আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে লজ্জিত ভাবে হেসে বলল,

-ভুলেই গিয়েছিল। ওর নাম আরিয়ান। আমার দেবর।”

ফাইজা আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে নাক ফুলিয়ে বলল,

-ওহ তাহলে আপনার জন্যই আপু আমাকে ভুলে গেছে! আগে তো আমাকে ছাড়া বাড়ি থেকে বের হতে চাইত না। আমি হাত ধরে রাস্তা পার করে না দিলে চলত না। এখন আপনাকে নিয়ে ঘুরছে, না!”

মেয়েটার এরকম অভিযোগ শুনে আরিয়ান হেসে ফেলল। বলল,

-আপনি নেই। তাই আমাকে দিয়েই কাজ চালাচ্ছে।”

দীর্ঘ দিন পর দুই বোনের দেখা হয়েছে। এত তাড়াতাড়ি ওদের গল্প শেষে হবে না। আরিয়ান অলরেডি এক কাপ কফি খেয়ে ফেলেছে। এখন মনে হচ্ছে দ্বিতীয় কাপের জন্যে অর্ডার দিতে হবে। ফাইজা এক এক করে বাড়ির সকলের কথা বলে ফেলেছে। এবার মৌরির কথা জিজ্ঞেস করল,

-শ্বশুরবাড়িতে তোমার মন টেকে আপু? বাড়ির কথা মনে পড়ে না?”

মৌরির হাসিখুশি মুখ মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে গেল। আরিয়ান ব্যাপারটা লক্ষ করে বলল,

-আমরা ভাবীকে এতটাই আনন্দে রেখেছি যে বাড়ির কথা মনে পড়ার সময় পায় না।”

আরিয়ানের কথা শুনে ফাইজা তেতে উঠে বলল,

-আপনি আমার আর আপুর মাঝে কথা বলছেন কেন?”

মৌরি ফাইজাকে চোখ রাঙিয়ে বলল,

-কেমন ভাবে কথা বলছিস তুই!”

আরিয়ান ফাইজার কথাতে কিছু মনে করছে না। হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ে। এই মেয়ের সাথে রাগ করার কোন মানে নেই। বরং মেয়েটার কাটকাট কথা বলার ধরন মজাই লাগছে। সে হাসি মুখে বলল,

-কারণ আপনার আপু এখন আমার ভাবী।”

-কচুর ভাবী। আপনার ভাইকে তো দেখেছি। রামছাগল একটা।”

মৌরি কঠিন গলায় ধমক দিয়ে বলল,

-ফাইজা!”

তাশফিনের উপর মেয়েটার প্রচুর রাগ বোঝা যাচ্ছে। আরিয়ান নিজেও ফাইজার সাথে সুর মিলিয়ে বলল,

-ঠিকই। শুধু কি রামছাগল? গাধা, বেকুব সব।”

ফাইজা মনে করেছিল এই লোকটাও তার ভাইয়ের মতোই হবে। দুই ভাই-ই শয়তান। কিন্তু ছেলেটা মনে হচ্ছে তার ভাইয়ের মতো না।

-আপনার ভাইকে সামনে পেলে আমি যে কী করব! বলে দিবেন উনাকে। আমার সামনে যেন না আসে। যে আমার আপুকে কষ্ট দেয় আমি তাকে দু-চোখে দেখতে পারি না।”

-বলে দেব। আরও কিছু বলতে হবে?”

-উনি একটা বাজে লোক। আমি উনাকে ভালো মানুষ মনে করেছিলাম। কিন্তু উনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খারাপ লোক। আপনিও কি আপনার ভাইয়ের মতো?”

-মোটেও না। আমরা দু’জন দুই মেরুর।”

-এটাই ভালো। আপনি কিন্তু আমার আপুর খেয়াল রাখবেন। আপনাদের বাড়িতে আমার আপুর অযত্ন হলে আমি কিন্তু আপনাকেও ছাড়ব না।”

-আচ্ছা। ধরে রাইখেন।”

মৌরিকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে না করলেও ফাইজার যেতে হলো। কারণ বাড়ি থেকে অনেক আগে বের হয়েছে। বেশি দেরি হলে আবার সবাই টেনশন শুরু করে দিবে। ফাইজা চলে গেলে মৌরির মনটাও খারাপ হয়ে গেল। আরিয়ান তাকে আরও কোথাও নিয়ে যেতে চাইলেও মৌরি বলল,

-ভালো লাগছে না আরিয়ান। বাড়ি চলো।”

-ঠিক আছে। তোমার ইচ্ছে।”

মৌরি গাড়িতেও মন খারাপ করে চুপ করে থাকলে আরিয়ান বলল,

-এটা কিন্তু ঠিক হলো না। আমি তোমার মন ভালো করার জন্য বাইরে নিয়ে এসেছিলাম। এখন দেখছি আমিই তোমার মন খারাপের কারণ হলাম।”

-তুমি আমার মন খারাপের কারণ হতে পারো না।”

-তাহলে ঝটপট মুড ঠিক করে নাও। আমি গান চালাচ্ছি। তোমার চেহারায় বিষন্নতা মানায় না।”

আরিয়ান গান চালিয়ে দিয়েছে। মৌরি বিষন্ন মুখে বসে রইল। আরিয়ান মৌরিকে দেখে নিজেই কথা শুরু করল।

-তোমার বোন কিন্তু তোমার মতো না। অনেক কথা বলে।”

-ওর কথা তুমি শুনেছ কোথায়? কান পচিয়ে দিতে পারে।”

-কয়েক মিনিটেই বুঝেছি।”

-তুমি কিন্তু ওর কথাতে কিছু মনে করো না। ও ওরকমই। মনে যা আসে বলে ফেলে। বলার আগে ভাবে না।”

-বাচ্চা মানুষের কথাতে আমি কিছু মনে করি না।”

আরিয়ানের বলার ধরন দেখে মৌরি হেসে ফেলল। আরিয়ান তাশফিনের থেকে পুরোটাই বিপরীত। তাশফিন যতটা বদমেজাজি, অহংকারী, দাম্ভিক আরিয়ান ততটাই ভদ্র, মিশুক ও হাসিখুশি।


আরিয়ান আর মৌরি মল থেকে বেরোবার সময় তাশফিন ওদের দেখেছে। তাশফিন রামিমের সাথে এসেছিল। রামিম তার ফিয়ন্সের জন্য কিছু কিনবে। তাশফিনকে জোর করে ধরে নিয়ে এসেছে। তাশফিনের মনোযোগ ফোনে ছিল। ওরা ঢুকছে মৌরি বের হচ্ছে। রামিম কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তাশফিনের চোখ হঠাৎ ফোন থেকে সরলে মৌরিকে দেখে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। মৌরি হয়তো তাকে দেখেনি। তাশফিন ঘুরে মৌরিকে দেখল। আরিয়ানের সাথে এসেছ ও! মৌরিকে আরিয়ানের গাড়িতে উড়তে দেখে তাশফিনের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। রামিম পেছন ফিরে তাশফিনকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে বলল,

-দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?”

রামিমের কথা তাশফিনের কানে ঢুকছে না। আরিয়ানের গাড়ি চলে যাচ্ছে। সে এখনও চলন্ত গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। রামিম কাছে এসে বলল,

-কী দেখছিস? কার গাড়ি? কে ছিল?”

-কেউ না।”

-কেউ না হলে ওভাবে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছিস কেন? আয়।”

-হুম।”


বাড়িতে পা রেখেই তাশফিন মনে মনে মৌরিকে খুঁজছে। সে মৌরিকে এবাড়িতে রেখেছে মাহিমকে শাস্তি দিতে। কিন্তু মৌরি তো এখানে দিব্যি আছে। আরিয়ানের সাথে বাড়তি খাতিরও জমে গেছে। তাশফিন রুমে এসেও মৌরিকে পেল না। অনেকটা সময় পর মৌরি নিজেই রুমে এসেছে। তাশফিন ফিরেছে এই কথা সালেহা খালার কাছে শুনেছে।

-আপনার কিছু লাগবে?”

তাশফিন বেডে হেলান দিয়ে বসে ফোন চাপছিল। মৌরির গলা শুনে ওর দিকে তাকাল। শীতল কণ্ঠে বলল,

-তুমি এখানে কেন এসেছ?”

মৌরি ঠিক বুঝল না। প্রশ্নাত্মক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-মানে?”

-পিকনিকে এসেছ?”

-আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।”

-না বোঝার তো কিছু দেখছি না৷ আমার বাড়িতে তুমি পিকনিক করতে আসোনি নিশ্চয়।”

-আপনার কেন মনে হলো আমি আপনার বাড়িতে পিকনিক করতে এসেছি।”

-তোমাকে দেখে তো এমনই মনে হচ্ছে। জোর করে আছো। তারপরও দিব্যি খাচ্ছ-দাচ্ছ, ঘুরছো। কোনভাবেই মনে হচ্ছে না তুমি এখানে অসুখী আছো।”

-আমাকে অসুখী দেখলে আপনি খুশি হতেন মনে হচ্ছে।”

-তোমার খুশি অখুশি দিয়ে আমার কাজ নেই। কিন্তু একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নাও। এই বাড়িতে যতদিন আছো, আমার কথা ছাড়া বাড়ির বাইরে পা দেওয়ার সাহস করবে না।

মৌরি বুঝতে পারছে না তাশফিন হঠাৎ কোন কারণে তার সাথে এত বাজে ব্যবহার করছে। সে কী এমন কাজ করেছে যার জন্য এত কথা শোনাচ্ছে। ওয়েট। বাড়ির বাইরে যাবার কথা বলল না? হ্যাঁ। তার মানে আরিয়ানের সাথে বেরিয়েছিল বলেই মশাইয়ের এত রাগ! মৌরি তাশফিনের রাগের কারণ স্পষ্ট করে জানার জন্য বলল,

-এখন কি আমাকে কোথাও যেতে হলে আপনার অনুমতি নেয়া লাগবে?”

-অন্তত যতদিন এখানে আছ ততদিন লাগবে।”

-কেন?”

তাশফিন তীক্ষ্ণ চোখে মৌরিকে দেখছে৷ মৌরি মুখভঙ্গি স্বাভাবিক।

-কারণ তোমার নামের সাথে এখন আমার নাম জুড়ে আছে। তুমি কোথায় যাচ্ছ, কার সাথে মিশছো সেটা আমাকে জানাতে বাধ্য তুমি। এবাড়ি থেকে যাওয়ার পর তুমি যা খুশি তা-ই করো। তোমার ব্যাপারে জানার আমার কোন ইন্টারেস্ট থাকবে না। কিন্তু যতদিন এখানে আছো। তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে। আর তুমি এখানে ঘুরতে আসোনি৷ খুব তো বড় মুখ করে বলেছিলে বউয়ের দায়িত্ব পালন করতে এসেছ। এখন পর্যন্ত তেমন কোন দায়িত্ব পালন করতে দেখলাম না। অবশ্য ঘোরাঘুরি করে সময় পেলে তো দায়িত্ব পালন করবে।”

-আরিয়ানের সাথে শপিংয়ে গিয়েছিলাম সেজন্য এত কথা বলছেন তো? ঠিক আছে। পরের বার থেকে কোথাও যাওয়ার হলে আপনাকে বলব। আপনি যে নিয়ে যাবেন না এটা অবশ্য আগে থেকেই জানি। তবুও আমার বলা আমি বলব। নয়তো দেখা যাবে আজকের মতোই কথা শোনাবেন। নিজে নিয়ে যাবেন না। আবার অন্যের সাথে যেতে দেখলেও বলবেন আমি শ্বশুরবাড়িতে পিকনিক করতে এসেছি। মানুষের তো প্রয়োজন থাকতে পারে না। এক ভাই নিজে থেকে নিয়ে যেতে চাইবে। আরেক ভাই কথা শোনাবে। মানুষ করবে তো করবেটা কী হ্যাঁ?”

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে