শ্রাবণ ঝরা মেঘ পর্ব-১২

0
547

#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [১২]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

তাশফিনের মেজাজ আজ অন্য দিনের থেকেও বেশি খিটমিটে হয়ে আছে। সামান্য একটা বিষয় নিয়ে কীভাবে ছেলেটাকে ধমকে দিল। ছেলেটা ভুল বশত তাদের গাড়ির সামনে চলে এসেছিল। সময় মতো ব্রেক না করলে বড় কিছু একটা ঘটে যেতে পারত। আজ আসার পর থেকে তাশফিনের আচরণ লক্ষ করে তার বন্ধু রামিম বলল,

-অল্পতে রেগে যাওয়া তোর স্বভাবের মধ্যে পড়ে। কিন্তু আজ তো তোর রেগে যাওয়ার মতো কোন কারণ ঘটেনি। সামান্য একটা বিষয়। তারপরও কেন বেচারার উপর রাগটা দেখালি?”

-সামান্য বিষয়! আমার গাড়ির নিচে চাপা পড়ে কেউ মারা যাবে এটা তোর কাছে সামান্য বিষয় বলে মনে হয়?”

-ছেলেটা তো আর ইচ্ছে করে মরতে আসেনি। জীবন সবারই প্রিয় ভাই। কেউ ইচ্ছে করে জীবন দিতে চায় না।”

চায়! কেউ কেউ হয়তো চায়। তারা না চাইলেও তাদেরকে বাধ্য করা হয়। যেমন পিহুকে বাধ্য করা হয়েছে। পিহু কি কখনও ওরকম কিছু করতে চেয়েছিল? মাহিম ওকে অমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে।
তাশফিন বাড়ি ফিরে দেখতে পেল গেটের সামনে মাহিম দাঁড়িয়ে আছে। দারোয়ান ওকে ভেতরে যেতে দিচ্ছে না। তাশফিনের গাড়ি গেট দিয়ে ঢোকার সময় মাহিম ওর সামনে চলে এলো। এত অপমানের পরও এই বেহায়া ছেলে আবার বোনকে দেখতে চলে এসেছে? বোনের জন্য এত ভালোবাসা! তাশফিন গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে মাহিমের উদ্দেশ্যে বলল,

-এবার কিন্তু তোমার বোনই দেখা করতে চায় না। আমি বারণ করিনি।”

-আমি মৌরির সাথে দেখা করতে আসিনি।”

-ওহ তাহলে আমাকে দেখতে এসেছ? দেখা হয়ে গেছে। এবার পথ ছাড়ো।”

-আমি পিহুর সাথে দেখা করতে চাই তাশফিন। তুমি একটা বার আমাকে পিহুর সাথে দেখা করতে দাও। তারপর আমি আর কোনদিনও তোমার পথে আসব না।”

তাশফিন তীক্ষ্ণ চোখে ছেলেটাকে দেখছে। এই ছেলে কি তার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে? নাকি ভাইবোন দুইটাই সমান ঘাড়ত্যাড়া।

-আমার চেহারা দেখে আমাকে ভালো মানুষ ভেবে ভুল করো না। আমি মোটেও ভালো মানুষ নই। পরের বার তোমার মুখে আমার বোনের নাম শুনলে তোমার ওই মুখটাই হয়তো আর থাকবে না।”

-তুমি আমাকে মারো। আমি মানা করব না। শুধু একবার পিহুর সাথে আমার দেখা করিয়ে দাও।”

তাশফিন বুঝল এর সাথে কথা বললে নিজেরই মেজাজ হারাতে হবে। বাধ্য না হলে কারো গায়ে হাত তুলে না সে। কিন্তু এই মাহিমকে তাকে বাধ্য করতে চাচ্ছে। তাশফিন দারোয়ানকে বলল,

-এ যদি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মারাও যায় তবুও একে ভেতরে আসতে দিবে না। আমি একে ভেতরে দেখার সাথে সাথেই তোমার চাকরি আজীবনের মতো চলে যাবে।”

কথাটা বলে তাশফিম জানালার কাঁচ তুলে দিয়ে ভেতরে চলে গেল। মাহিম ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। পিহুর সাথে দেখা না করে সে কোথাও যাবে না।

তাশফিন রুমে এসে দেখে মৌরি শুয়ে আছে। এই অসময়ে ঘুমচ্ছে! কয়েকটা চুল মৌরির মুখের উপর এসে পড়েছে। নিঃশ্বাস ফেলার সাথে সাথে চুলগুলোও সামান্য দোল খাচ্ছে। তাশফিন নিঃশব্দে মৌরির সামনে গিয়ে বসল। চব্বিশ ঘণ্টা এক ঘরে থাকলেও মৌরির সাথে তার কথা খুব কমই হয়। সে ইচ্ছে করেই কথা বলে না। প্রথমদিন তাদের রেস্টুরেন্টে দেখা করার কথা তাশফিন এখনও ভুলতে পারে না। তাকে দেখে মৌরি এতটাই নার্ভাস হয়ে পড়েছিল যে কথা বলার সময় গলা কেঁপে উঠছিল। সেই মেয়ে এখন তাশফিনের ধমক খেয়েও ভয় পায় না।

-এতটা জেদি হবে ভাবিনি। তোমাকে সহজসরল কোমল মনে করেছিলাম। কিন্তু তার সাথে জেদটাও যে এত বেশি জানা ছিল না।”

চুলগুলো মৌরিকে বিরক্ত করছে। মৌরি ঘুমের মধ্যেই কয়েকবার নড়ে উঠেছে। তাশফিনের রাগ হলো। হতচ্ছাড়া চুল মেয়েটাকে ঘুমের মাঝেও তো একটু শান্তি দিবি৷ জেগে থাকলে তো বারো ঘন্টা থেকে দশ ঘন্টাই কাঁদে। এত বেশি কাঁদতে পারে! কথার আগে চোখে পানি চলে আসে৷ তাশফিন মৌরিকে না জাগিয়ে সাবধানে মুখের উপর থেকে চুল গুলো সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। সে হাত বাড়িয়ে চুল গুলো ছুঁয়েছে মাত্র এমন সময় মৌরি চোখ খুলে তাকিয়ে উঠল। তাশফিন ওখানেই থমকে গেল। এই মেয়ে কি এতক্ষণ জেগে ছিল? মৌরি তাশফিনকে এতটা সামনে দেখে নিজেও কেমন স্ট্যাচু হয়ে গেছে। দু’জনের কেউই চোখের পলক ফেলছে না। দু-তিন মিনিট পর তাশফিন মৌরির মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে হুড়মুড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। গলা পরিষ্কার করে কঠিন গলায় বলল,

-এই মেয়ে ঘুমানো ছাড়া আর কোন কাজ নেই তোমার? যখন রুমে আসি দেখি তুমি ঘুমিয়ে আছো। এত ঘুম আসে কোত্থেকে?”

তাশফিন কী বলতে কী বলেছে নিজেও জানে না। মৌরি কী ভাবছে? সে কেন মৌরির এতটা কাছে গিয়েছিল, মেয়েটা ভুলভাল না বুঝলেই হয়। মৌরি এখনও তাশফিনের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লোকটা কি পাগল? আবোলতাবোল কী বলছে এসব? মৌরিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তাশফিন গলায় জোর এনে বলল,

-ভূত দেখছো? ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন? দেখো মেয়ে, উল্টাপাল্টা কিছু বুঝে নিবে না। তুমি যা ভাবছ তেমন কিছুই না।”

-আমি কী ভাবছি?”

তাশফিন চোখ ছোট ছোট করে মৌরির দিকে তাকাল। তার সাথে রসিকতা করছে?

-তুমি জানো না?”

মৌরি শব্দ করে হাই তুলে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,

-জানি না। এজন্যই তো জিজ্ঞেস করছি। আপনি তো জানেন আমি কী ভাবছি। তাহলে আমাকেও একটু জানিয়ে দিন।”

-আমার সামনে বেশি স্মার্ট সাজতে হবে না।”

-ঠিক আছে। সাজলাম না। কিন্তু আপনি আমার চুলে হাত দিচ্ছেন কেন? একটা মেয়ে ঘুমিয়ে আছে আপনি তার সুযোগ নিচ্ছেন?”

মৌরির কথা শুনে তাশফিন হতভম্ব। এই মেয়ে তার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করছে? ভাবছে মৌরির ঘুমের সুযোগ নিয়েছে! তাশফিন রেগেমেগে বলল,

-আমাকে সুযোগ নিতে হবে কেন? মেয়েটা আমার বউ। অধিকার আছে আমার।”

তাশফিন মুখ ফসকে কত বড় সত্য স্বীকার করে নিয়েছে তা পরে সে নিজেও বুঝতে পারল। মৌরি এটুকুই শুনতে চেয়েছিল। মৌরি কিছু বলল না। তাশফিনের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে সে। তাশফিন মৌরিকে হাসতে দেখে রাগ করতে যেয়েও ওকে কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তাশফিন চলে গেলে মৌরি একা একাই হাসছে।

-আজ মুখে স্বীকার করলেন। একদিন মন থেকেও মেনে নিবেন। আর সেদিনই আমার জিত হবে।”

আজ মৌরিকে অন্য দিনের থেকে খুশি খুশি লাগছে। ওকে একা হাসতে দেখে সালেহা বলল,

-কী গো মা, একা একা হাসতাছো। কারণ কর?”

-কারণ কিছু একটা ঘটেছে খালা।”

-বাবার সাথে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে?”

মৌরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

-না গো খালা। সে এখনও অনেক দেরি।”

-আর বেশি দেরি নাই। পুরুষ মানুষ যতই কঠিন হোক। মাইয়া মানুষের ভালোবাসার সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। বাবাও পারব না। দেখো না এখন থেকেই কেমন তোমার আগেপিছে ঘুরে।”

-কই ঘুরে? আমি তো দেখি না।
তুমি দেখবাই না। ওইদিন তুমি আরিয়ান বাবার সাথে বাগানে হাঁটতাছিলা না। সেইদিন বাবা কিন্তু তোমাদের একসাথে দেখছে। আমার সামনেই কফি ফেলে দিছে। আসলে তোমারে আরিয়ান বাবার সাথে দেখে রাগ করছে৷ এই রাগ কই থেকে আসে জানো? ভালোবাসা থেকে।”

মৌরি কপাল কুঁচকে ঠোঁট কামড়ে ধরে সালেহা খালার কথা শুনছে। আরিয়ানের সাথে তাকে দেখে তাশফিন জেলাস হচ্ছিল! সত্যি? তাহলে তো তাশফিনের জেলাসি আরও বাড়িয়ে দিতে হয়।


আজ অনেকদিন পর তারেক চৌধুরী বাড়ি আছেন। এবং পরিবারের সবার সাথে খেতে বসেছেন। তারেক চৌধুরী কিছু না বলে একবার তাশফিনের দিকে তাকালেন। সকলে বসে গেলে তাশফিন এসে কাউকে কিছু না বলে চেয়ার টেনে বসেছে। ছেলের মাঝে এটুকু পরিবর্তন দেখেও তিনি খুশি হয়েছেন। বৌমা বাড়ি আসার পর এবাড়ির চেহারা অনেকটাই পাল্টে গেছে। তাশফিনের প্রতি লায়লার এই আন্তরিক ব্যবহার কখনও দেখেননি তিনি। হয়তো শাশুড়ির সাথে মৌরির ভালো সম্পর্কই তাশফিনের প্রতি লায়লার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে শুরু করেছে। মৌরি তাশফিনকে দেখিয়েই মূলত আরিয়ানের সাথে টুকটাক কথা বলছে। তারেক চৌধুরী ছেলের বউয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,

-এখানে তোমার ভালো লাগছে তো বৌমা? কারো আচরণে কষ্ট পাচ্ছ না তো?”

তারেক চৌধুরী খোঁচাটা ছেলেকেই দিয়েছেন। মৌরি একপলক তাশফিনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

-না বাবা। আমাকে কেউ কষ্ট দিচ্ছে না।”

-দেখো বৌমা। এটা কিন্তু এখন তোমার বাড়ি। কেউ তোমাকে কষ্ট দিলে তুমি আমাকে বলবে। আমি তার ব্যবস্থা করব।”

-খাবার টেবিলে শালিস বসা হয় জানলে প্রথমেই উঠে যেতাম।”

তাশফিন কাউকে নির্দিষ্ট করে বলেনি। তারপরও তারেক চৌধুরী বললেন,

-শালিসটা তো তোমার বসেনি। তাহলে তোমারও নিশ্চয় কোন সমস্যা হবার কথা না।”

-মানুষ খাওয়ার সময় অন্তত শান্তি চায়।”

-এবাড়িতে অশান্তি তৈরি করার মতো একজনই আছে।”

বাবার কথা শুনে আরিয়ান হেসে ফেলল। লায়লাও ঠোঁট টিপে হাসল। তাশফিন কঠিন চোখে আরিয়ানের দিকে তাকালে আরিয়ান হাসি গিলে নেওয়ার চেষ্টা করল। মৌরি আরিয়ানের এই অবস্থা দেখে অনেক কষ্টে হাসি চাপল।
তারেক চৌধুরী পুরোটা সময় মৌরির সাথেই কথা বললেন,

-তোমাদের বাড়ি থেকে কেউ আসে না? তোমার তো মনে হয় ওদের জন্য মন কাঁদে। আমি বলছিলাম কি কয়েকটা দিন বাবা মা’র কাছ থেকে ঘুরে আসো। মেয়েকে পেয়ে তাদেরও ভালো লাগবে। বাবা মা’কে দেখে তোমারও মন ভালো হয়ে যাবে।”

শ্বশুরের এই কথায় মৌরির মুখটা ছোট হয়ে গেল। তাশফিন এবার শব্দ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। তারেক চৌধুরী ছেলেকে বললেন,

-মৌরিকে ওর বাবার বাড়ি থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে এসো।”

-আমি কারো পায়ে শিকল পরিয়ে রাখিনি। যার যেখানে ইচ্ছা যেতে পারে। কয়দিনের জন্য কেন? একেবার চলে গেলেও আমার কোন আপত্তি নেই।”

তাশফিন চলে গেলে তারেক চৌধুরী বৌমার মুখের দিকে তাকালেন। মেয়েটাকে দেখলে তার নিজের ছেলের উপর রাগ বেড়ে যায়৷ এই ছেলেকে তিনি কোনদিনই মানুষ করতে পারলেন না।


মৌরি কথা দিয়েছিল আরিয়ানের সাথে বেরুবে। আরিয়ান জেদ ধরে বসে আছে আজকেই মৌরিকে তার সাথে যেতে হবে। মৌরিও অত বেশি ভাবল না। ছেলেটা এত করে বলছে।
তাশফিন বাড়ি ছিল না। মৌরি তাশফিনকে না জানিয়েই আরিয়ানের সাথে বেরিয়ে গেল।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে