#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [৮]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
লায়লা কমলার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ছেলেকে বলল,
-এক্ষুনি ফিরে আসবে দেখো। বেচারীর জন্য আমার মায়া হচ্ছে।”
আরিয়ান বাঁকা চোখে মা’র দিকে তাকালে লায়লা হাসতে হাসতে বলল,
-ঠিক মায়া না। সহানুভূতি।”
মৌরি ঘরে ঢুকে তাশফিনের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। দেখে মনে হচ্ছে এই লোক এখনও গভীর ঘুমে। অবশ্য দিনের বেলা ঘুমাবেই না বা কেন? রাতে কখন ফিরে তার কি কোন ঠিক আছে। মৌরি ভাবছে ডাকবে কি-না। ডাকলে যদি রাগ করে?
– রাগ করলে করুক। এটা কি এখনও পড়ে পড়ে ঘুমানোর সময়? আর আমি তো নিজে থেকে ডাকতে আসিনি। উনার মা পাঠিয়েছেন।”
মৌরি নিজেকেই সাহস দিল। দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে আস্তে করে তাশফিনকে ডাকল।
-শুনছেন? এইযে..! শুনছেন?”
উঁহু। এভাবে শুনছেন, শুনছেন করে কতক্ষণ ডাকা যাবে? এইযে শুনছেন বলে ডাকলে উনার ঘুমই ভাঙবে না। মৌরি মুখ বাঁকিয়ে ভাবছে। ওগো, হ্যাঁ গো শুনছো বলে ডাকার মতো সম্পর্ক এখনও তাদের মধ্যে তৈরি হয়নি। ভবিষ্যতে হবে কি-না এটাও জানা নেই। মৌরি এক কাজ করল,
-তাশফিন, উঠুন। আপনাকে মা ডাকছে। আর ঘুমাতে হবে না। উঠুন তাশফিন।”
তাশফিন ঘুমের মধ্যেই বিড়বিড় করে যেন কী বলল। মৌরি কিছুই শুনতে পেল না। একটু একটু শুনতে পেলেও কিছুই বুঝতে পারল না। তাই সে তাশফিনের দিকে ঝুঁকে গিয়ে আবার ডাকল।
-কী বলছেন? শুনিনি কিছু। আপনি কি উঠবেন?”
-খালা বিরক্ত করো না প্লিজ। আমি আরও ঘুমাবো।”
তাশফিনের মুখে খালা ডাক শুনে মৌরির চোখ কপালে উঠে পড়ল। হায় আল্লাহ! বলে কী এই লোক? নিজের আপন বউকে খালা বলছে! মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?
-আমি আপনার খালা না। আপনার বিয়ে করা বউ। বউকে খালা ডাকছেন, পাপ হবে পাপ।”
তাশফিন ভেবেছিল এবারও হয়তো খালাই তাকে ডাকতে এসেছে। কিন্তু মৌরির গলা ঘুমের মধ্যেও চিনতে পারল। তবুও উঠল না। মৌরিও নাছোরবান্দার মতো ডেকেই যাচ্ছে।
-মা আপনাকে ব্রেকফাস্ট টেবিলে ডাকছে। আপনার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। কিন্তু আপনার জাগারই নাম নেই। উঠুন তাশফিন।”
তাশফিন এবার মেজাজ হারিয়ে ফেলল। দিন দিন মেয়েটার সাহস বাড়ছে। কিছু বলছে না বলে মনে করেছে তাশফিন তাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছে। এই মেয়ের ভুল ভাঙানো উচিত। তাকে ডাকায় তাশফিন যতটা না রেগেছিল তার থেকেও বেশি রাগ দেখিয়ে শোয়া থেকে বসে পড়ে ধমকের সুরে বলল,
-বারণ করেছিলাম। একবার বললে শোনো না? আমার মনে হয় সোজা কথা তুমি সহজ ভাবে বুঝতে পারো না। মানুষের লাইফে দখলদারি করার অনেক শখ। একবার ডাকার পরেও যখন উঠছি না, তখন বারবার কেন ডাকতে হবে? বাবা মা সাধারণ ভদ্রতা শেখায়নি? কিছু বলছি না বলে নিজেকে অন্য কিছুই মনে করে নিয়েছ। শুনো মেয়ে, প্রতিদিন সকাল সকাল তোমার মুখ দেখার আমার কোন ইচ্ছা নেই। আমি তোমাকে এই বাড়িতে থাকতে বলিনি। তুমি চলে যাচ্ছ না কেন? কিসের জন্য এখনও পড়ে আছো এটাই তো বুঝতে পারছি না। নাকি বড়লোক শ্বশুরবাড়ি দেখে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না? তোমার থাকার ইচ্ছে হলে থাকো। যাওয়ার ইচ্ছে হলে চলে যাও। যা খুশি করো। কিন্তু পরের বার থেকে যেন আমার কোন ব্যাপারে নাক গলাতে না দেখি। তুমি আমার বউ না। কথাটা মনে রাখবে।”
তাশফিনের এতগুলো কথা শুনে মৌরির চোখ দিয়ে আপনাতেই পানি পড়তে লাগল। এভাবে কথাগুলো বলার মতো বড়ো কোন অন্যায় তো সে করেনি। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না সামান্য একটা ব্যাপারে এভাবে অপমান করল! ঘুম থেকে ডেকে তোলা কি খুব বড় অন্যায়? মৌরি তখনও ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। তাশফিন মৌরির দিকে না তাকিয়ে উল্টো পাশ ফিরে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। মৌরি ঝাপসা চোখে তাশফিনের দিকে তাকিয়ে আছে।
মৌরিকে ফিরে আসতে দেখেই লায়লা টেবিলের নিচে পা দিয়ে আরিয়ানকে ঠেলা দিল। চোখে ইশারা করে মৌরিকে দেখিয়ে বলল,
-মুখ দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছে তাশফিন এতটা অপমান করেছে। হাসি মুখে গিয়েছিল। কিন্তু চোখে পানি নিয়ে ফিরেছে।”
-জঙ্গলিটা ঠিক করেনি মম।”
-ঠিক ভুল আমাদের দেখার বিষয় না। এই মেয়েটাকে দিয়েই তোমার ভাষায় ‘জঙ্গলি তাশফিনকে’ শায়েস্তা করা যাবে।”
মৌরি চলে এলে লায়লা জিজ্ঞেস করল,
-তাশফিন আসেনি?”
মৌরি একটু আগে কান্না করেছে। এখন কথা বললেই মা এটা বুঝে যাবে। তাই সে মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ জানাল। লায়লা বলল,
-ঠিক আছে। তুমি বসো। তাশফিন ওরকমই। ঘুম, ফ্রেন্ডস আর ট্যুর ছাড়া ওর জীবনে কিছু নেই। ও পরে খেয়ে নেবে। আমরা শুরু করি।”
আরিয়ান আড়চোখে মৌরিকে দেখছে। মৌরির চোখের পাপড়ি এখনও ভেজা। চোখ জোড়া জলে টলমল করছে। জঙ্গলিটা মেয়েটাকে কাঁদিয়েছে কোন সন্দেহ নেই।
সবাই খাওয়া শুরু করলেও মৌরি কিছুতেই খেতে পারল না। মুখে নিয়ে চিবলোই শুধু। গলার নিচে কোন খাবার নামল না।
”
”
মৌরি যতই এ সম্পর্কটা গুছিয়ে নিতে চাচ্ছে তাশফিন ততই মৌরির চেষ্টা ব্যর্থ করে দিচ্ছে। তার একতরফা চেষ্টায় সম্পর্কটা কতদিন টিকবে মৌরি জানে না। কিন্তু তাশফিন নিজের করা আচরণ দিয়ে একটু একটু করে মৌরির মন থেকে উঠে যাচ্ছে। একটা মানুষ কত সহ্য করতে পারে? বারংবার আঘাতে পাথরও একসময় ভেঙে যায়। মৌরি তো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। একটা সময় যদি একটু ভালো ব্যবহার করত তবুও মৌরি মনকে বোঝাত। কিন্তু এই লোকের কাছে ভালো ব্যবহার আশা করাও নিজেরই মূর্খতার পরিচয় দেয়া।
তাশফিনের ঘুম ভাঙলে মৌরি ইচ্ছে করেই ওর সামনে পড়ল না। যতক্ষণ তাশফিন বাড়িতে থাকবে মৌরি ঠিক করেছে সে রুমে যাবে না। লায়লা তাশফিনকে দেখে বলল,
-ঘুম ভেঙেছে রাজপুত্র! তখন বৌমা ডাকতে গিয়েছিল। তুমি আসোনি।”
-আমাকে ছাড়াও আগে আপনার দিন ভালোই কেটে যেত।”
-এখন বৌমা এসেছে বলেই তোমাকে এতটা ইম্পর্টেন্স দেওয়া হচ্ছে। যাকগে সেসব কথা। তোমাদের বিয়ের তো অনেকদিন হলো। হানিমুনে কোথায় যাচ্ছ?”
-আপাতত আপনার সামনে থেকে যেতে পারলে বাঁচি।”
লায়লা হেসে তাশফিনের কথা উড়িয়ে দিল। কিন্তু সে মনে মনে জানে তাশফিন এসময় মোটেও ফান করার মুডে নেই। কিন্তু ছেলেটাকে জ্বালাতে পারলে তার আনন্দ লাগে।
-আমি ভাবছিলাম কী, বৌমাকে নিয়ে ওর বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে এসে পরেই কোথাও যাও।”
এসময় মৌরি সালেহা খালার দিকে যাচ্ছিল। মা ছেলের কথা শুনে সে দাঁড়িয়ে গেল। যদিও ওদের কথা শোনা উদ্দেশ্য ছিল না। তবুও কী মনে করে তাৎক্ষণাৎ চলে গেল না।
তাশফিন খুব কষ্টে রাগ চেপে মুখে হাসি টেনে বলল,
-ওহহো মিসেস চৌধুরী! আমাকে নিয়ে আপনাকে এত ভাবতে কে বলেছে? আমি নিশ্চয় বলিনি। আপনি বরং আপনার ছেলে, স্বামীকে নিয়ে ভাবুন। আমাকে নিয়ে বেশি ভেবে ফেললে আবার সমস্যা। মাথায় চাপ পড়বে। তার থেকে ভালো আপনি আপনার রাস্তায় খুশি থাকুন। আমাকে আমার মতো ছেড়ে দিন।”
মৌরির কপাল কুঞ্চিত হলো। কোন ছেলে তার মা’র সাথে এমনভাবে কথা বলে! লোকটা নিজের মা’কেই সম্মান করে না। তাকে কী সম্মান করবে! সালেহা মৌরিকে দেখে ব্যস্ত হয়ে বলল,
-তুমি আসতে গেলা কেন? আমাকে ডাকলেই পারতা?”
-আমি কি আপনার ঘরে আসতে পারি না?”
-পারবা না কেন? এইটা তো তোমারই বাড়ি।”
মৌরি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাবা আর সালেহা খালা এটাকে তার বাড়ি বললেই এটা তার বাড়ি হয়ে যাবে না। মৌরি নিজের মনের প্রশ্নগুলো কাউকে করতে পারছে না। সালেহা খালা এবাড়িতে অনেকদিন আছেন। তিনি হয়তো মৌরির প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন।
-খালা, আপনি কত বছর ধরে এখানে আছেন?”
-অনেক বছর গো মা।”
মৌরি জিজ্ঞেস করতে ইতস্তত করছে। কিন্তু জিজ্ঞেস না করেও তো উপায় নেই। এই বাড়ির মানুষ গুলো সম্পর্কে সে জানতে চায়। কিন্তু এদের আচার-আচরণ দেখে ভেতরের কথা বুঝতে পারছে না।
-খালা।”
-কী মা? কিছু বলবা?”
-এবাড়ির মানুষ গুলো এমন কেন? পরিবার কি এরকম হয়? এরা নিজেদের থেকে এত আলাদা কেন?”
সালেহা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেয়েটা এই প্রশ্ন করতে অনেক দেরি করেছে। সালেহা আরও আগেই মৌরির থেকে এমন কোন প্রশ্ন আশা করছিল।
-আমি কাজের লোক। মালিকদের ব্যাপারে কথা বলার অধিকার নাই। ভাবছিলাম তুমি নিজেই বুঝতে পারবা।”
-আমি বুঝতে পারছি না খালা। বাবার সাথে উনার রাগের কারণ বোঝা যাচ্ছে। কারণ বাবা উনাকে বিয়ে করতে জোর করেছে। কিন্তু নিজের মা’কে উনি কেন মিসেস চৌধুরী বলে ডাকেন? আমি একবারও উনাকে মা ডাকতে শুনিনি।”
-কারণ বেগম সাহেবা তাশফিন বাবার মা না।”
-মা না!”
এটা মৌরি জানত না। তার জন্য কথাটা সত্যিই অবিশ্বাস্য ছিল। মা উনাকে কত ভালোবাসেন। নিজের মা না হলে কি এমনভাবে উনার খেয়াল রাখত!
-হ্যাঁ গো মা। তাশফিন বাবার বয়স যখন বারো/তেরো বছর। তখন সাহেবের প্রথম স্ত্রী মানে তাশফিন বাবার মা মারা যান। ছেলের কথা ভেবে সাহেব দ্বিতীয় বিয়ে করেন। কিন্তু বেগম সাহেবা আমাকে এবাড়িতে এনে তাশফিন বাবার সব দায়িত্ব আমার হাতে তুলে দিলেন। তখন থেকেই আমি এখানে আছি। বাবার দেখাশোনা করছি।”
-তাহলে আরিয়ান! আরিয়ান উনার ভাই না?”
-সৎ ভাই। সাহেবেরও একটা ছেলে আছে। বেগম সাহেবারও একটা ছেলে আছে। তাই সাহেব ভাবছে বেগম সাহেবা হয়তো নিজের ছেলের মতোই তাশফিন বাবারেও আদর স্নেহ করবে।”
-উনার তো একটা বোনও আছে। সে কোথায়? সে কি আরিয়ানের বোন?”
-পিহুর কথা বলো? পিহু আরিয়ান বাবার বোন না। পিহু তাশফিন বাবার খালার মেয়ে। বড় বেগম সাহেবা মারা যাওয়ার তিন বছরের মাথায় তার ছোট বোন আর বোনের স্বামী গাড়ির নিচে চাপা পড়ে দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়। তার পর থেকেই পিহু এই বাড়িতে থাকে। তাশফিন বাবা ছোট থেকেই পিহুকে নিজের বোনের মতো আদর করত।”
মৌরি এবাড়ির মানুষ গুলো সম্পর্কে কিছুই জানত না। এদের সম্পর্কে যত জানতে পারছে ততই অবাক হচ্ছে। সে যাকে এতদিন আপন শাশুড়ী ভেবে আসছে সে তার স্বামীর সৎ মা। এজন্যই কি মা,ভাইয়ের সাথে তাশফিনের আচরণ ওরকম! পিহুকে সে এখনও দেখেনি। কিন্তু পিহুও তার আপন ননদ না। এবাড়িতে কি কেউ কারো আপন না?
চলবে