শ্রাবণ ঝরা মেঘ পর্ব-০৭

0
568

#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [৭]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

🌸
মৌরি মাথা ঘুরিয়ে তাশফিনকে দেখল। তাশফিন মাহিমকে এখানে দেখেও রাগ হলো না। মাহিমের বুঝতে বাকি রইল না তাশফিনই তাকে এতক্ষণ অপেক্ষা করিয়েছে। মাহিম বোনের হাত ধরে বলল,

-চল আমার সাথে।”

পেছন থেকে তাশফিন বলল,

-হ্যাঁ নিয়ে যাও। দয়া করে পরের বার আর আসতে দিও না। ঘরে আটকে রাখবে।”

মাহিম রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাশফিনের দিকে তাকালেও কিছু বলল না। রাগটা ভেতরে ভেতরে হজম করে নিল। সে এখানে তার বোনকে নিতে এসেছে। তাশফিন বাধা দিচ্ছে না দেখে ঝামেলা করতে চাইল না।
কিন্তু মৌরি ভাইয়ের সাথে যেতে নারাজ। সে এখানে থাকতে চাইলে মাহিম বোনের উপরই রাগ করে বলল,

-এখানে কেন থাকতে চাচ্ছিস তুই? আমি তোকে নিতে এসেছি। তবুও তুই যাবি না?”

-কোথায় যাব ভাইয়া?”

-কোথায় যাবি মানে? নিজের বাড়িতে যাবি।”

-এখন থেকে এটাই আমার বাড়ি। নিজের বাড়ি ছেড়ে তোমাদের বাড়িতে বেড়াতে যেতে পারব। কিন্তু চিরদিনের জন্য যেতে পারব না।”

বোনের কথা শুনে মাহিম হতভম্ব। মৌরি এসব কেন বলছে? কোনটাকে সে নিজের বাড়ি বলছে? তাশফিন নিরব দর্শন হয়ে ভাই বোনের ড্রামা দেখছে। দেখতে ভালোই লাগছে। বেশ উপভোগ করছে।

-কার জন্য এবাড়িতে থাকতে চাচ্ছিস তুই মৌরি? যে সম্পর্কের দোহাই দিয়ে তুই থাকতে চাচ্ছিস সে সম্পর্কের সত্যতা কতটুকু? না। আমি তোকে এখানে রেখে যাব না। তুই আমার সাথে বাড়ি যাবি।”

মাহিম মৌরির হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চাইলে মৌরি জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিল। মৌরির চোখ টলমল করছে। ধরা গলায় সে ভাইকে বলল,

-ভাইয়া প্লিজ। আমাকে জোর কোরো না। আমি যাব না।”

-তুই যাবি না?”

মৌরি উত্তর দিতে পারল না। ভাইয়ের চোখের দিকে তাকালেই সে এখন দুর্বল হয়ে পড়বে। কেঁদে ফেলবে।

-ঠিক আছে। আমিও আর তোকে নিতে আসব না। তুই থাক এখানে। আমাদের থেকে এই জানোয়ারটা তোর বেশি আপন হয়ে গেছে না? থাক তুই এই জানোয়ার টার সাথে।”

তাশফিন এতক্ষণ চুপচাপ ওদের কথা শুনলেও এবার নিজের নামে এত বড় কথা শোনার পর চুপ থাকতে পারল না।

-ও হ্যালো। কী হচ্ছে এখানে? ভাই বোনের ভালোবাসা দেখতে ভালো লাগছিল। তাই চুপ ছিলাম। কিন্তু মাঝখানে আমাকে টেনে আনা হলো কেন? আমি তোমার বোনকে জোর করে এখানে আটকে রাখিনি। তোমার বোন আমার কাছে নিজের ইচ্ছেতে থাকতে চাচ্ছে। যদিও ওকে রাখব কি-না তা এখনও ঠিক করিনি। তাই বলছি, বোনকে নিয়ে যেতে পারলে যাও। নয়তো নিজেই ভদ্রলোকের মতো এখান থেকে চলে যাও। জানোয়ার বলেছ। এখনও কিন্তু আমি জানোয়ারের মতো কোন আচরণ করিনি।”

মাহিম নিজের বোনের কাছে অসহায় হয়ে পড়ল। মৌরি কেন বুঝতে পারছে না। এখানে থাকলে ওর সুখ হবে না। বরং তাশফিন তাকে ইচ্ছে করে কষ্ট দিবে। ভাই হয়ে মাহিম কিছুতেই বোনের কষ্ট সহ্য করতে পারবে না। তাই শেষ বারের মতো মৌরির সামনে অনুরোধ করল।

-মৌরি, সোনা বোন আমার। কেন জেদ করছিস? বাবা মা তোর জন্য চিন্তিত হচ্ছে। কেন আমাদের সবাইকে কষ্ট দিচ্ছিস। প্লিজ বাড়ি ফিরে চল।”

মৌরি খুব কষ্টে কান্না চেপে বলল,

-তুমি চলে যাও ভাইয়া।”

বুকভরা অভিমান নিয়ে মাহিম চলে গেল। বোনকে এই নরক থেকে নিয়ে যেতে এসেছিল। কিন্তু বোনই যদি যেতে না চায় তাহলে ভাই হয়ে তার আর কী করার থাকতে পারে?
মাহিম চোখের আড়ালে চলে যাওয়ার সাথে সাথে মৌরি কান্নায় ভেঙে পড়ল। তাশফিন অদ্ভুত চোখে আগ্রহের সাথে মৌরিকে দেখছে। মৌরির যাওয়ার সুযোগ ছিল। তবুও ও যায়নি। এখানে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেন?

-এখানে থেকে তুমি কী প্রমাণ করতে চাচ্ছ জানি না। কিন্তু তোমার সুবিধার জন্য বলে রাখছি, আমি তোমাকে তোমার পরিকল্পনায় কখনও সফল হতে দেব না।”

মৌরি কাঁদতে কাঁদতে তাশফিনের দিকে তাকাল। দু-হাতে চোখের পানি মুছে বলল,

-আমার পরিকল্পনা আপনার সাথে সংসার করা। আমি জানি, একদিন আমি সফল হবো। বিয়ে কোন ছেলেখেলা না। আপনার মন চাইল আর আমাকে বিয়ে করে ফেলে চলে এলেন।”

-তোমার সংসার করার স্বপ্ন অন্তত এ জন্মে সত্যি হবে না। এখানে থাকলে কষ্ট পাওয়া ছাড়া তুমি আর কোনকিছু পাবে না। সুযোগ ছিল। চাইলেই ভাইয়ের সাথে চলে যেতে পারতে।”

-চলে যাওয়ার জন্য তো আমি আসিনি।”

-তাহলে থাকো। দেখি কতদিন টিকতে পারো।”

তাশফিন মৌরির মধ্যে এতটা আত্মবিশ্বাস দেখে নিজেই কিছুটা ভড়কে গেল। তাহলে এই মেয়েকে চিনতে কি তার ভুল হয়েছিল? বিয়ের আগের পরিচয় দিয়ে মনে হয়নি এই মেয়ে এতটা জেদি হতে পারে। তাশফিন মৌরিকে ভালোবাসে এমন কোন বিষয় না। কিন্তু ঘৃণাটাও তো ঠিকঠাক মতো করতে পারছে না। এই মেয়ের চোখে পানি দেখলে সে কঠিন হতে পারে না। শত্রুর বোনের উপর সহানুভূতি দেখানো ঠিক কি-না তাশফিন জানে না।


মাহিম বাড়ি ফিরে সব রাগ ঘরের জিনিসপত্রের উপর দেখাতে লাগল। মুহূর্তে সবকিছু ভেঙেচুরে ফেলল। তার ঘর থেকে শব্দ পেয়ে বাবা মা ছুটে এসেছে। ছেলের এরকম আচরণ দেখে বাবা ধমক দিয়েও থামাতে পারলেন না।

-মাহিম! কী হয়েছে তোর? কেন ভাঙছিস এসব?”

মা জানতেন মাহিম মৌরিকে আনতে গিয়েছিল। তাকে একা ফিরতে দেখে জিজ্ঞেস করল,

-তুই একা ফিরেছিস কেন? মৌরি কোথায়? তুই তো ওকে আনতে গিয়েছিলি? মৌরি আসেনি?”

-তোমার মেয়ে আমার সাথে আসেনি মা। তোমার মেয়ে নাকি ওবাড়িতেই থাকবে। আমরা ওর কেউ না।”

-পাগলের মতো কী বলছিস এসব? আমরা কেউ না মানে কী? মৌরি আসেনি কেন?”

-কারণ তোমার মেয়ে তার শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আসবে না। সে তার স্বামীর সাথে সারাজীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

-মৌরি এই কথা বলেছে? ও এমন কেন করছে? না না। আমার মেয়ে এমন কথা বলতেই পারে না। নিশ্চয় ওরা মৌরিকে ভয় দেখিয়েছে। ওকে জোর করে ওই বাড়িতে আটকে রেখেছে। তুই কেন বোনকে নিয়ে এলি না বাবা?”


লায়লা তাশফিনকে জব্দ করার জন্য মৌরিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। মৌরির সাথে লায়লার ভালোবাসা দেখলে কেউ বিশ্বাসই করতে চাইবে না ওরা বউ শাশুড়ী। দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
লায়লা ঘুম জড়ানো চোখে হাঁটতে হাঁটতে মৌরির সাথে ধাক্কা খেল। মৌরি কিছু একটা ভাবছিল তাই খেয়াল করেনি। লায়লা মৌরিকে দেখে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,

-গুড মর্নিং ডার্লিং! তোমার লাগেনি তো?”

-না। লাগেনি।”

-কোথায় যাচ্ছ?”

-সালেহা খালার কাছে।”

-কেন? কিছু লাগবে তোমার? তুমি রুমে যাও। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

-আমার কিছু লাগবে না মম।”

-আচ্ছা চলো, আমরা বসে গল্প করি। তারপর বলো, এখানে তোমার ভালো লাগছে? সারাদিন বাসায় বসে বোরিং হচ্ছ না তো? তুমি চাইলে বন্ধুদের বাড়িতে ডাকতে পারো। আবার তুমিও যেতে পারো। এই মৌরি, তাশফিন তোমাকে শপিং করিয়ে দেয়নি? আজ আমার সাথে চলো।”

কথা বলতে বলতে ওরা ডাইনিং টেবিলে এসে বসেছে। তারেক চৌধুরী অফিসের কাজে শহরের বাইরে গেছেন। আজ তাশফিন, আরিয়ান এখনও ব্রেকফাস্ট টেবিলে আসেনি। লায়লা সালেহাকে ডাকল।

-সালেহা তাশফিন, আরিয়ান বাবাকে ব্রেকফাস্ট টেবিলে আসতে বলো।”

সালেহা ডাকতে চলে যাবার একটু পরেই এসে জানাল।

-তাশফিন বাবা না করে দিয়েছে, আসবে না। আরিয়ান বাবা আসতেছে।”

-আচ্ছা তুমি যাও।” লায়লা মৌরির দিকে ফিরল,

-এই দুই ছেলে আমাকে পাগল বানাবে। বিশেষ করে তোমার বর৷ আমার কোন কথাই শুনে না। তুমি চলে এসেছ। এবার ওকে ঠিক করবে। তোমার সবার প্রথম কাজ এখন ওকে ব্রেকফাস্টের জন্য ডেকে নিয়ে আসা।”

মৌরি যেতে নিলে আরিয়ান এসে পড়ল। মৌরির দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হেসে বলল,

-গুড মর্নিং বিউটিফুল লেডি।”

মৌরি জবাবে সামান্য হেসে তাশফিনকে ডাকতে চলে গেল। আরিয়ান চেয়ার টেনে বসলে লায়লা মৌরি চলে গিয়েছে কি-না দেখে বলল,

-তোমার বিউটিফুল লেডির গুড মর্নিং এখনই ব্যাড মর্নিং হয়ে ফিরবে।”

-মানে?”

-একবার সালেহা ডাকার পরেও তাশফিনকে ডাকতে গেছে।”

-সেটাও নিশ্চয় তুমিই পাঠিয়েছ।”

লায়লা হাসছে। তাশফিনের বারণ আছে। সকালে একবার ডাকার পর তাকে আর কেউ ডাকতে যাবে না। সকালে ঘুম না হলে এই ছেলে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে।

-তুমি এসব কেন করছো?”

-কী করছি? আমি তো জাস্ট ভালো মাদার-ইন-ল হওয়ার ট্রাই করছি।”

-সেটা তো দেখতেই পারছি। কিন্তু তুমি যতই চেষ্টা করো। জঙ্গলিটা তার বউয়ের উপর রাগবে না। ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে বিয়ে করেছে।”

লায়লা অবাক চোখে ছেলের মুখের দিকে তাকাল। এই ছেলে কোথায় বাস করে? দুনিয়ার কোন খোঁজ খবরই রাখে না।

-কোথায় থাকো তুমি? কোন খবরই দেখছি রাখো না!”

-মানে?”

লায়লা আরিয়ানকে সবটা খুলে বলল। সব শুনে আরিয়ান কতক্ষণ চুপ মেরে বসে রইল। ভেতরের উত্তেজনা প্রকাশ না করে বলল,

-তার মানে তাশফিন মেয়েটাকে পছন্দ করে না?”

-সহ্যই করতে পারে না। প্রথম দিন মৌরিকে এবাড়িতে দেখে এতটাই রেগে গিয়েছিল যে, ও নিজেই বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল। সারাদিন ফিরেনি।”

-কিন্তু তাশফিন তো ওকে ভালোবাসতো। এটাই তো বলেছিল আমাদের।”

-জানি না এই ছেলের মনে কী চলছে। ভালোবাসলে কি বিয়ের দিন বউ ফেলে রেখে চলে আসতো? এখানে আসার পরেও মৌরিকে অনেক অপমান করেছে। কোন কারণে মেয়েটাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল কে জানে? আমি তো শুধু তাশফিনকে জ্বালানোর জন্য মেয়েটাকে এখানে থাকতে দিয়েছি। নইলে কবেই বের করে দিতাম।”

আরিয়ান মনে মনে ভাবছে, তাশফিন মৌরিকে দেখতে পারে না। ওকে এবাড়িতে রাখতে চায় না। ওদের মাঝে সম্পর্ক ঠিক না থাকলেই তার কাজ সহজ হয়ে যাবে। অবশ্য এত সুন্দর একটা মেয়েকে জঙ্গলিটা ডিজার্ভও করে না। সেদিন মৌরিকে প্রথম দেখেই তার ভালো লেগে গিয়েছিল। বউয়ের দিকে নজর দিলে জঙ্গলি তাশফিন তার চোখ তুলে নিতে দু’বার ভাবত না এ ভয়েই এতদিন পিছিয়ে ছিল। কিন্তু এখন আর কোন ভয় নেই। তাশফিন ওদের বিয়ে অস্বীকার করেছে। মৌরিকে ও বউ মানে না। ভালোও বাসে না। আরিয়ান চাইলেই এখন নিজের প্ল্যান সাকসেস করতে পারবে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে