#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [৬]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
🌸
মাহিম বোনের সাথে দেখা করতে এসেছে। কিন্তু দারোয়ান তাকে কিছুতেই বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। মৌরিকে এবাড়িতে একা পাঠিয়ে মাহিম কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিল না। মৌরির জেদ তার শোনাই উচিত হয়নি। তাশফিন মৌরিকে ভালোবেসে নয় বরং বোনের প্রতিশোধ নিতে বিয়ে করেছে। যে ছেলে বিয়ের আসর থেকে মৌরিকে ফেলে গেছে। সে কি নিজের বাড়িতে মৌরির খেয়াল রাখবে? মৌরি যেতে না চাইলেও মাহিম আজ বোনকে নিয়ে যাবে। কিন্তু দারোয়ান তাকে ভেতরে ঢুকতে দিলে তো মাহিম বোনকে নিয়ে যেতে পারবে।
-দেখুন এবাড়িতে আমার বোনের বিয়ে হয়েছে। আমি আমার বোনকে দেখতে এসেছি। আমাকে ভেতরে যেতে দিন।”
-কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়ার অনুমতি নেই। আপনি যে-ই হোন এখন আসতে পারেন।”
-আপনি আপনার মালিককে জিজ্ঞেস করে আসুন। কেননা আমি আমার বোনের সাথে দেখা না করে এখান থেকে ফিরছি না।”
-কী মুশকিল! বললাম তো স্যারের আদেশ। কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না।”
-আপনার স্যার জানে না আমি কে। আমার বোন এবাড়িতে আছে। আর আমি ওর সাথে দেখা না করে কোথাও যাচ্ছি না।”
দারোয়ান কী করবে বুঝতে পারছে না। এ তো মহা যন্ত্রণায় পড়া গেল। স্যারই বলেছে অনুমতি ছাড়া কাউকে যেন ভেতরে যেতে না দেয়। কিন্তু এই লোক তো কোন কথাই শুনছে না৷ উল্টো ঝামেলা করে যাচ্ছে। দারোয়ান নিরাসক্ত মুখে স্যারের ধমক খাওয়ার ভয় নিয়ে ভেতরে এলো। তাশফিন তখন মাত্রই জিম থেকে ফিরেছে। তার গাড়ি গেট দিয়ে ঢোকার সময়ই দারোয়ানকে এই নির্দেশ দিয়ে এসেছিল। তাশফিন দারোয়ানকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
-কেউ এসেছে?”
-জি স্যার। ভেতরে আসতে চাচ্ছে।”
-তুমি কী বলেছ?”
-বলেছি স্যারের নিষেধ আছে। তবুও কোন কথাই শুনছে না।”
তাশফিন টিশার্টের উপরের জ্যাকেট খুলে আরাম করে সোফায় হেলান দিয়ে বসল। পায়ের উপর পা তুলে নাচাতে নাচাতে বলল,
-অপেক্ষা করতে বলো। আমার পরবর্তী আদেশ না পেলে ভেতরে আসতে দিও না।”
দারোয়ান তাশফিনের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল,
-স্যার উনি আপনার শালা। বউ মনির ভাই। বউ মনির সাথে দেখা করতে এসেছে।”
তাশফিন হাসছে। কারণ সে জানত মাহিম আজ আসবে। কিন্তু সকাল সকালই যে চলে আসবে এটা জানত না। বোনকে এখানে রেখে বেচারা মনে হয় রাতে ঘুমাতে পারেনি। তাইতো সকালবেলাই ছুটে এসেছে।
-আমার শালা হোক। বা তোমার শালা। ভেতরে আসতে কমপক্ষে এক ঘন্টা অপেক্ষা করাবে। বেশি ঝামেলা করতে চাইলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে। মনে থাকবে কথাটা?”
-জি স্যার।”
-যাও তাহলে।”
মাহিম অপেক্ষা করছে। দারোয়ান ব্যাটা সেই যে ভেতরে গিয়েছে এখনও ফেরার নাম নিচ্ছে না। ভেতরে গিয়ে ঘুমিয়ে টুমিয়ে পড়ল নাকি? এত দেরি হচ্ছে কেন? দারোয়ানকে ফিরে আসতে দেখে মাহিম দূর থেকেই জিজ্ঞেস করল।
-কী এবার অনুমতি মিলেছে তো?”
-স্যার অপেক্ষা করতে বলেছে।”
দারোয়ান মুখ কালো করে এমন একটা ভঙ্গি নিয়ে জবাব দিল যেন তার কথা বলতে ভালো লাগছে না। মাহিম আশ্চর্য হবে নাকি কষ্ট পাবে বুঝতে পারছে না। সে এতটা নিষ্ঠুরতাও আশা করেনি। তার সাথেই তাশফিন এমন করছে। না জানি তার বোনটার সাথে কেমন আচরণ করে!
তাশফিন ঘরে ফিরে মৌরিকে দেখতে পেল না। সে বেশি গুরুত্বও দিল না। আছে হয়তো কোথাও। তাশফিন ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোল। তার বাইরে যাবার প্ল্যান থাকলেও মৌরির ভাইকে দেখে তা বাদ দিয়েছে। আসল মজা তো একটু পর হবে।
মৌরি সালেহার সাথে কিচেনে সাহায্য করতে এসেছে। কিন্তু সালেহা তাকে কোনকিছু ছুঁতেও দিচ্ছে না। সে কিছু করতে নিলেই হৈহৈ করে উঠছে।
-এ কী! না, না। তোমার কোন কাজ করতে হবে না। তুমি কেন কাজ করবা?”
-কাজ করছি না। আপনাকে একটু সাহায্য করছি।”
-না। না। তুমি নতুন বউ। তোমার সাহায্য আমার লাগব না। তুমি রান্নাঘরে কেন আসছো মা? এবাড়ির বউরা কেউ রান্নাঘরে আসে না।”
-কিন্তু আমার তো কোন কাজ নেই। শুধু শুধু বসে থেকে কী করব?”
-তাহলে তুমি দেখো আমি কীভাবে কাজ করি। কিন্তু তোমারে আমি কিছু করতে দিব না।”
মৌরি হাসল। এই বাড়িতে থাকলে তার হাত পায়ে মরচে ধরতে বেশি সময় লাগবে না। এখানে তো তার করার মতো কোন কাজই নেই। সব কাজ চাকররা করে। সালেহা তাকে কোন কাজ করতে দিবে না বুঝতে পেরে মৌরি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ড্রয়িংরুমে এসেই সে আরিয়ানের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে বাঁচল। আরিয়ান তাড়াহুড়োয় বেরুচ্ছিল। তাই মৌরিকে লক্ষ করেনি। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে মৌরির দিকে তাকিয়ে বলল,
-সরি ভাবী। তাড়ায় ছিলাম। তাই দেখতে পাইনি।”
এই ছেলেটা কখন বাড়ি আসে, কখন বাইরে থাকে মৌরি বুঝতে পারে না। একবারই আরিয়ানের সাথে তার দেখা হয়েছিল। এই বাড়ির মানুষ গুলো যেন কেমন। সবাই নিজেদের মতো থাকে। পরিবার যেমন হয় এরা তেমন না। একই ছাঁদের নিচে থাকলেও এদের নিজেদের মধ্যে দূরত্ব অনেক বেশি।
-আপনি কি কোথাও বেরুচ্ছেন?”
-হুম।”
-ব্রেকফাস্ট করবেন না?”
আরিয়ান সামান্য একটু হাসি নিয়ে কৌতূহলী চোখে মৌরির দিকে তাকাল। কথাটা বলেও মৌরি মনে মনে ভাবতে লাগল, তার এই কথাটা বলা হয়তো উচিত হয়নি। আরিয়ানের বেরুনোর তাড়া থাকলেও সে ভুলে গেল। বলল,
-আপনি বললে অবশ্যই করতে হবে। ভাবীর হুকুম অমান্য করার স্পর্ধা আমার নেই।”
তাশফিন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মৌরিকে আরিয়ানের সাথে দেখল। দু’দিন হয়নি এবাড়িতে এসেছে। এর মধ্যেই অনেকের সাথে ভাব জমে গেছে দেখা যাচ্ছে। আরিয়ান তাশফিনকে আসতে দেখে মুখের হাসি চওড়া করে মৌরির সাথে আরও ফ্রিলি কথা বলতে লাগল।
-আজকের রান্না আপনি করেছেন?”
-না। সালেহা খালা কিছু করতেই দিচ্ছে না।”
-আপনার রান্নার হাত ভালো? তাহলে কিন্তু একদিন কষ্ট করতেই হবে।”
-রান্নার হাত ভালো কি-না জানি না। তবে চেষ্টা করতে পারি।”
-আপনি বলেছেন এটাই অনেক। আমি চাইব না আমার প্রিন্সেসের মতো ভাবী আমার জন্য রান্না করতে গিয়ে আগুনের তাপে কালো হয়ে যাক।”
আরিয়ানের কথা বলার ধরনটাই এমন ছিল মৌরি শব্দ করে হেসে ফেলল। ছেলেটাকে প্রথম দেখায় তার যতটা খারাপ মনে হয়েছিল এখন কথা বলে কিন্তু সেরকম লাগছে না। এজন্যই হয়তো কাউকে প্রথম দেখায় বিচার করতে নেই। মানুষের সাথে না মিশলে কখনোই বলা যায় না সে কেমন।
মৌরিকে হাসতে দেখে তাশফিনের কপালের মাঝখানে সুক্ষ্ম কয়টা ভাঁজ পড়ল। বোঝাই যাচ্ছে আরিয়ানের সাথে মৌরির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তাশফিনের ভালো লাগল না।
-সম্পর্কে আপনি আমার বড় ভাইয়ের বউ হবেন। কিন্তু বয়সে মনে হয় আপনি আমার থেকে ছোটই হবেন। তাই আপনাকে আপনি আপনি করে বলতে কেমন যেন লাগছে। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি কি আপনাকে তুমি করে বলতে পারি?”
মৌরি কোন উত্তর দেওয়ার আগেই তাশফিনের চিৎকার শোনা গেল। ভীষণ রেগে সে সালেহাকে ডাকছে।
-খালা! এই বাড়িতে কি ব্রেকফাস্টের নিয়ম উঠে গেছে? সকালে আমার রুমে চা-ও দেওয়া হয়নি। হয়েছে কী এই বাড়ির সবার? সব কয়টা কাজ চুরি করে এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে গল্প করে বেড়ায়। চাকরি গেলে তবেই এদের হুঁশ ফিরবে।”
আরিয়ান তাশফিনকে দেখিয়ে মৌরিকে বলল,
-আপনার হাসবেন্ড। মহাশয়ের মেজাজ সবসময় আসমানে উঠে থাকে। আমি ভেবে পাই না। বদমেজাজি ছেলে গুলোই কেন সুন্দরী বউ পায়? আমার মতো ভদ্র ছেলেরা বউ পাবে তো দূর, একটা গার্লফ্রেন্ডের অভাব নিয়ে জীবন পার করছে।”
আজ আরিয়ান নিজেও ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল। তাশফিনের সাথে তার সামনাসামনি অনেক কমই হয়। কিন্তু আজ মৌরির কথা রাখতে থেকে গেল। সালেহা তাড়াহুড়ো করে তাশফিনের সামনে গরম গরম পরোটা এনে রাখল। এই ছেলের তার হাতে বানানো পরোটা না খেলে সকালের খাবার অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ছোটবেলা থেকেই তাশফিন সালেহার হাতের পরোটা পছন্দ করে। আরিয়ানও সালেহাকে বলল,
-খালা, আমাকেও দুইটা পরোটা দাও তো।”
সালেহা শুধু তাশফিনের জন্যই বানিয়েছিল। আরিয়ানও খাবে তার জানা ছিল না। তাই সালেহা বলল,
-তুমি একটু বসো বাবা। আমি এক্ষুনি বানিয়ে আনছি।”
সালেহা যেতে নিলেও আরিয়ান তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
-বানিয়ে আনতে হবে না। এখান থেকেই দাও।”
তাশফিন চুপ করে খাচ্ছিল। আরিয়ান হাত বাড়িয়ে পরোটা নিতে চাইলে তাশফিন আরিয়ানের হাত ধরে ফেলল। হুশিয়ারী দেয়া গলায় বলল,
-আমার জিনিসে কেউ ভাগ বসাবে এটা আমার একদম পছন্দ না। নিজের জিনিস আমি কারো সাথে শেয়ার করি না।”
তাশফিন হাত ছেড়ে দিলে আরিয়ান হাত গুটিয়ে নিল। কিন্তু আজকের অপমান সে সহজে ভুলবে না। এই অপমানের বদলা অবশ্যই নিবে। মৌরি দুই ভাইয়ের মধ্যকার এই নীরব রেষারেষির কিছুই বুঝল না। সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে তাশফিন ভাইয়ের সাথে এমন করল! এই লোক সত্যিই কি এমন? নাকি মৌরিই বিয়ের আগে মানুষটাকে ভুল জেনেছিল। কারণ বিয়ের আগে যেই মানুষটার সাথে তার পরিচয় হয়েছিল। এই মানুষটার সাথে তো তার কোনই মিল নেই। আরিয়ান মনে মনে প্রতিশোধ নেওয়ার পণ করল।
-তোর জিনিসে ভাগ বসাব না। বরং তোর জিনিস পুরোটাই আমার করে নেব। নিজের জিনিস কারো সাথে শেয়ার করিস না, তাই না। তোর সবথেকে মূল্যবান জিনিসটাই আমার সাথে শেয়ার করতে হবে। আমাকে অপমান করে তুই ঠিক কাজ করিসনি তাশফিন।”
আরিয়ানের গাড়ি গেটের সামনে এসে থামলে দারোয়ানের গেট খুলে দিতে দেরি হওয়ায় আরিয়ান চরম রেগে গেল।
-টাকা দিয়ে তোকে কেন কাজে রাখা হয়েছে? গেট কি তোর বাপ খুলে দিবে?”
-সরি স্যার। ভুল হয়ে গেছে। এই লোকটা তখন থেকে জ্বালাচ্ছে। তাই গেট খুলতে দেরি হয়ে গেছে।”
-লোক ফোক যে-ই এসেছে বিদায় করে তাড়াতাড়ি গেট খোল।”
দারোয়ান গেট খুলতে চলে গেলে এই সুযোগে মাহিম ভেতরে চলে গেল। যেভাবেই হোক মৌরির সাথে দেখা করতে হবে তাকে। মৌরি ভাইকে দেখেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে ছুটে গেল। ভাইয়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়বে তার আগেই তাশফিনের গলা পেয়ে থেমে যেতে হলো।
-দাঁড়াও।”
চলবে