শ্রাবণ ঝরা মেঘ পর্ব-০৫

0
541

#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [৫]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

🌸
-কে আপনি? এটা কেমন অসভ্যতা!”

ছেলেটা কৌতূহলী চোখে মৌরিকে দেখছে। মৌরি চোখ ঘুরিয়ে একবার আশেপাশে দেখে নিল। কাছেপিঠে কেউ নেই। এই ছেলেটা কে? এর তাকানোর ভঙ্গি তার কাছে ভালো লাগছে না।

-আমি কে?’

ছেলেটা আহত ভঙ্গিতে বুকে হাত রেখে বলল,

-কষ্ট পেলাম ভাবি। একমাত্র আদরের দেবরকে আপনি চিনতে পারলেন না!”

দেবর! হ্যাঁ, মৌরি শুনেছিল। তাশফিনরা তিন ভাইবোন। কিন্তু কাউকেই সে চিনে না। কখনও দেখা হলে তো চেনার প্রশ্ন আসবে। বিয়ের আগেও শুধু তাশফিনের বাবা মা’ই তাদের বাড়িতে গেছে। এবাড়িতে এসেও দেবর, ননদ কাউকে দেখেনি। আরিয়ান মৌরিকে দেখে মনে মনে তাশফিনের উপর হিংসে করছে। ওই জঙ্গলিটা এত সুন্দর বউ পেয়ে গেছে! উঁহু, এটা রীতিমতো অন্যায়। আরিয়ান হালকা করে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

-এখনও চিনতে সমস্যা হচ্ছে ভাবী?”

মৌরি ছেলেটার সাথে এখানে বেশিক্ষণ থাকতে চাইল না। তাই না চিনলেও বলল,

-না। আমি আসছি।”

মৌরির একপ্রকার পালিয়ে যাওয়া আরিয়ান বেশ উপভোগ করল। তাশফিন বিয়ে করুক কিংবা জাহান্নামে যাক তাতে তার কিছু আসে যায় না। বিয়ের কথাটা সে শুনেছিল। কিন্তু বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। এখন দেখা যাচ্ছে গুরুত্ব না দিয়ে খুব বড় একটা ভুল করেছে। ভুলটা অবশ্য এখনও শুধরে নেওয়ার সুযোগ আছে। এখন এই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারলেই তার কার্য হাসিল হয়ে যাবে। আরিয়ান মুচকি হেসে মৌরির পেছনে যেতে যেতে বলল,

-ভাবি কোথায় চললেন? এখনও তো পুরোপুরি চেনাশোনা হয়নি।”

মৌরি এক সেকেন্ডও ছেলেটার সামনে দাঁড়াতে চাইল না। কিছু মানুষকে প্রথম দেখাতেই বলে দেওয়া যায় এই মানুষটা ভালো না। অনেক সময় চোখ মানুষের মনের কথা বলে দেয়। এই ছেলেটার চোখের দৃষ্টি মৌরির কাছে ভালো লাগেনি। মৌরি নিজেই নিজেকে বলল,

-না জানি একই বাড়িতে আরও কত প্রজাতির প্রাণী আছে!”
*
*
-মেয়েটার সাহস দেখে আমি জাস্ট অবাক হয়ে গেছি। কত বড় সাহস! আমার বাড়িতে এসে খুঁটি গেড়ে বসেছে। আর আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গাধা। ওই মেয়েটার সাথে রাগ করে নিজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি। আমার উচিত ছিল ওকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া। তা না করে নিজে সারাদিন বাড়ির বাইরে ছিলাম।”

তাশফিন কথাগুলো তার বোনকে বলছে। যদিও জানে না পিহু তার কথা শুনছে কি-না। তবুও তার সব কথা পিহুকেই বলতে হয়। তাশফিন পিহুর ডান হাতটা নিজের দু’হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে। সে জানে না পিহু কবে ঠিক হয়ে বাড়ি ফিরবে। কিন্তু তার বিশ্বাস পিহু শীঘ্রই আবার আগের মতো হয়ে যাবে। হাসবে, রাগ করবে, বায়না ধরবে।

-ওই মেয়েকে আমি এত সহজে ছাড়ব না। কী ভেবেছে ও? আমার বাড়িতে এসে জোর করে আমার বউ হয়ে যাবে! এত্ত সোজা! আমি ওর সাথে সংসার বাচ্চাকাচ্চা করার জন্য বিয়ে করিনি। বিয়ে করেছি ওর ভাইকেও সেই আগুনে পোড়াতে, যেই আগুনে আমি পুড়ছি।”

তাশফিন একা একাই বকবক করে যাচ্ছে। আসলে তার রাগ হচ্ছে। সেই রাগ প্রকাশ করার কোন মাধ্যম খুঁজে পাচ্ছে না। তাশফিন যাবার আগে ডক্টরের সাথে দেখা করে গেল। ডক্টর জানিয়েছে, পিহুর ব্যাপারে এখনও কিছু শিওর হয়ে বলা যাচ্ছে না।

-দেখুন তাশফিন, একজন রোগীর সুস্থতাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। আপনার বোন এমন একটা পর্যায়ে আছে সে হয়তো কালও সুস্থ হয়ে যেতে পারে। আবার উনার সুস্থ হতে এক মাস কিংবা বছরও লেগে যেতে পারে। এটার পুরোটাই কিন্তু রোগীর উপর ডিপেন্ড করে।”

তাশফিনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। একটা ছেলের জন্য পিহু বাঁচার ইচ্ছা ছেড়ে দিবে? তাদের ভালোবাসা কিচ্ছু না? পিহুকে সে কোনদিন বকেনি। ধমক দেওয়া বা চোখ রাঙিয়ে কথা বলেনি। ওর উপর হাত তোলা তো অনেক দূরের ব্যাপার। কিন্তু এবার পিহু সুস্থ হলে তাশফিন ওকে অনেক বকবে। ধমকও দিবে। বোনের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে মারতে ব্যর্থ হবে হয়তো। কিন্তু রাগ করে অনেকদিন কথা বলবে না।

-আমি তোর সাথে সত্যি সত্যিই অনেক রাগ করব। কথা বলব না। তুই আমার থেকেও অন্য কাউকে বেশি ভালোবাসিস! তার জন্য আমাকে কষ্ট দিচ্ছিস!”
*
*
এত বড় বাড়িতে মৌরি পুরোপুরি নিঃসঙ্গ। কথা বলার জন্যও একটা মানুষ নেই। তার এই বাড়িতে আসার একদিনও হয়নি। এর মধ্যেই মৌরির দম বন্ধ হয়ে আসছে। তাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি। তিন চাচা এখনও একসাথে থাকে। ফুপু সুযোগ পেলেই চলে আসে। কাজিনদের আড্ডায় ছোটবড় মিলিয়ে বারোজন হতো। এরকম একটা পরিবেশে এসে নিজেকে মানিয়ে নিতে মৌরির কান্না পাচ্ছে। তার শ্বশুর অফিসে যাবার আগে মৌরিকে ডেকেছিল।

-এখানে তোমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো বৌমা?”

মৌরি মাথা দুলিয়ে না জানিয়েছে। মানুষটা ভালো। তাকে আপন করে নিয়েছে।

-এখন থেকে এটা তোমারই বাড়ি। নিজের বাড়িতে যেমন ছিলে এখানেও তেমন থাকবে। কখনও মনে করবে না আমরা তোমার পর। তোমার কোনকিছু লাগলে সালেহাকে বলবে কেমন?”

সকালের পরে শাশুড়ির দেখা পায়নি মৌরি। ওইযে এবাড়িতে এসেই যে দেখা হয়েছিল। তারপর আর উনার সাথে কথা হয়নি। একঘন্টা পরপর সালেহা এসে মৌরির খোঁজ করে যাচ্ছে। তার উপর হয়তো এটাই হুকুম আছে। দ্বিতীয় বারের পর মৌরি বলল,

-খালা, আমার কিছু লাগলে আমি আপনাকে বলব। আপনি প্লিজ বারবার এটা সেটা নিয়ে আসবেন না।”

-বড় সাহেবের হুকুম গো মা। বড় সাহেব তোমারে খুবই পছন্দ করছে। সাহেবের তো কোন মেয়ে নাই। আমারে বলে গেল তোমার যাতে কোন অসুবিধা না হয়।”

-উনি কখন ফিরবেন?”

-সাহেবের তো অনেক কাজ। প্রায়ই নানান কাজে শহরের বাইরে দৌড়াদৌড়ি করেন। কিন্তু আজ মনে হয় দেরি করবেন না। তাড়াতাড়ি ফিরবেন।”

-আর আমার শাশুড়ি? উনি কি বাড়িতে নেই?”

-কাজের লোক হয়ে মালিকের কথা কী বলবো গো মা। ছোট মুখে বড় কথা শোভা পায় না। আছো তো এই বাড়িতে। নিজেই সবকিছু বুইঝা যাইবা। তুমি কিছু খাইবা মা?”

-একটু আগেই না দুপুরে খেলাম খালা।”

সালেহা হাসল। বৌমাকে তার ভীষণ ভালো লেগেছে। কেমন সুন্দর করে কথা বলে। আচার-আচরণ দেখেই বোঝা যায় নরম স্বভাবের। কিন্তু এই বাড়িতে টিকতে গেলে তো নরম স্বভাবের হওয়া যাবে না। মালিকদের ব্যাপারে কথা বলার অধিকার তার নেই। কিন্তু তাশফিন বাবাকে তার বলতে ইচ্ছে করে, এরকম ফুলের মতো মেয়েটাকে কষ্ট দিও না গো বাপ। তুমি জীবনে একটা কাজই ভালো করছো। তা এই মেয়েটাকে বিয়ে করে।

-বৌমা।”

-হুম খালা।”

-তোমার বাড়িতে কে কে আছে?”

মৌরি দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

-বাবা-মা, চাচা-চাচী, ফুপু, ভাইবোন সবাই আছে।”

-অনেক মানুষের মাঝে বড় হইছো, না?”

-হুম।”

-তাইলে তো এই বাড়িতে তোমার মন বইবো না। কথা বলবার মানুষ পাইবা না।”

মৌরি মৃদু হেসে বলল,

-আপনি আছেন তো খালা। আপনার সাথে গল্প করব।”

সাহেলা অদ্ভুত স্নেহভরা চোখে মৌরিকে দেখল। তবে কোনকিছু বলতে পারল না। মৌরিও মনে মনে বুঝতে পারছে এবাড়িতে তার মন বসবে না। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। এখন আর ফিরে যাবার উপায় নেই। কাটা ভর্তি পথেই তাকে হেঁটে যেতে হবে। গন্তব্যে পৌঁছতে পারলে তবেই থামবে।
*
*
ঘড়ির কাটা যখন বারোটা তেতাল্লিশের ঘরে তখন তাশফিন বাড়ি ফিরে। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। সবাই আজ এত জলদি ঘুমিয়ে পড়েছে? বাহ! কাউকে না জাগিয়ে তাশফিন সোজা নিজের রুমে চলে গেল। সে ভুলেই গিয়েছিল মৌরি এখনও এবাড়িতে আছে। রুমের লাইট অন করে বেডের দিকে চোখ পড়তেই তাশফিনের মাথা দপ করে জ্বলে উঠল। মেয়েটা এখনও ফিরে যায়নি? আচ্ছা ঘাড়ত্যাড়া তো। ঠিক আছে। সে-ও কম না৷ ঘাড়ত্যাড়া মানুষকে কীভাবে সোজা করতে হয় তার জানা আছে। তাশফিন বেডের কাছে এসে দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত মৌরিকে দেখল। ভ্রু জোড়া কুঁচকে বিড়বিড় করে বলল,

-আমার ঘুম হারাম করতে এসে নিজে আরামে ঘুমাচ্ছে!”

বিরক্তিতে এখনও তার কপাল কুঁচকে আছে। তাশফিন কোমরে হাত রেখে নিচের ঠোঁট কামড়ে এক সেকেন্ড ভাবল। বাড়িতে এসেই তার ঘর, বিছানা দখল করে নিয়েছে। তাশফিন এপাশে ওপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজলো। কপালে ভাঁজ পড়া বিরক্তির রেখা গুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি দেখা দিল।

-ঘুমাচ্ছ, না? ওকে ঘুমাও।”

কথাটা বলেই পাশ থেকে পানি ভর্তি গ্লাসটা হাতে নিয়ে পুরোটা পানি মৌরির মুখের উপর ঢেলে দিল। হঠাৎ চোখে মুখে পানির ঝাপটা পেয়ে মৌরি হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। বেচারি সাঙ্ঘাতিক ভয় পেয়ে গেছে। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চারিদিকে দেখছে। তাশফিন খালি গ্লাসটা হাতে নিয়ে মৌরির অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে। ঘটনাটা বুঝতে মৌরির কিছুটা সময় লাগল। তাশফিন মৌরিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাজখাঁই গলায় বলে উঠল,

-এই মেয়ে, আমার বিছানায় কী করছো তুমি? নামো। এক্ষুনি নামো বলছি।”

মৌরি ফ্যালফ্যাল চোখে বোকার মতো তাশফিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তাশফিনের কথাগুলো তার কানে গিয়েছে। কিন্তু সে যেন কথার অর্থ বুঝতে পারছে না।

-দেখো আবার তাকিয়ে আছে! নামতে বলেছি তোমাকে?”

-আমি আপনার বিছানায় শুয়েছি বলে আপনি আমার উপর পানি ঢেলে দিয়েছেন!”

কথাটা বলার সময় মৌরির গলা ধরে এসেছে। তার কন্ঠে অবিশ্বাসের সাথে বেদনার ছাপ স্পষ্ট। একটা মানুষ এতটা নিষ্ঠুর কীভাবে হতে পারে? মানুষটা তাকে বিশ্বাস করিয়েছিল, তাকে মানুষটা ভালোবাসে। অথচ আজ মৌরি এই মানুষটার চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা তো দূর করুণাও দেখতে পারছে না। মৌরির টলমলে চোখের দিকে তাকিয়ে তাশফিনের যেন কী হলো। সে চেষ্টা করেও কঠিন হতে পারল না। উল্টো মৌরির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে অস্বস্তি বোধ করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। ওয়াশরুমের বন্ধ দরজাটার দিকে তাকিয়ে মৌরির চোখ থেকে টুপ করে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে