#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ
#পর্ব_১
Jerin Akter Nipa
🌼
কিয়ৎক্ষণ পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা এখনও মৌরির কাছে দুঃস্বপ্ন বলেই মনে হচ্ছে। ভরা বিয়ের আসর থেকে বর উঠে যায় এরকমটা শুধু গল্প উপন্যাস বা টিভির পর্দায় দেখেছে। বাস্তবে যে এই ঘটনা তার সাথে হবে এর জন্য মৌরি কখনও প্রস্তুত ছিল না। আজ তার বিয়ে ছিল। পরনে লাল বেনারসি, গা ভর্তি গহনা পরে এখনও বধূ বেশে বসে আছে সে। কিন্তু যার সাথে তার বিয়ে হবার কথা ছিল, সে মৌরির কবুল বলার পরই স্টেজ থেকে উঠে জানিয়েছে, এই বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব না। মৌরির নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। মানুষটা কি তার সাথে ভীষণ রকম কোন রসিকতা করছে?
অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হলেও বিয়ের আগে যে কয়বার মানুষটার সাথে দেখা হয়েছে তাতে মানুষটাকে একটু হলেও জেনেছিল সে। তার দেখা সেই মানুষটার সাথে চোখের সামনে থাকা এই মানুষটার কোন মিল খুঁজে পেল না মৌরি। প্রথম যেদিন মৌরি মানুষটার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল, বাবা মা একপ্রকার জোর করেই তাকে পাঠিয়েছিল। কেননা বিয়ে করার কোন ইচ্ছেই তার ছিল না। মা তখন বলেছিল,
-একটা বার ছেলেটার সাথে দেখা তো কর। হতে পারে দেখা করার পর, কথা বলার পর ছেলেটাকে তোর পছন্দ হয়েও যেতে পারে। তোকে আমরা জোর করছি না। ছেলেটাকে দেখে অন্তত মতামত জানা। তোর পছন্দ না হলে আমরা কথা আগাবো না।”
মায়ের এত অনুরোধে ছেলেটার সাথে দেখা করতে রাজি হয়ে গেল মৌরি। কিন্তু দেখা করার আগে শর্ত দিল, পছন্দ না হলে এই বিষয় নিয়ে তোমরা আমার সাথে আর একটা কথাও বলবে না।”
মা-ও তার শর্ত মেনে নিয়ে বলেছিল, ‘ঠিক আছে বলব না।’
শহরের নামি-দামি একটা রেস্টুরেন্টে মৌরি বাবা মা’র পছন্দ করা ছেলেটার সাথে দেখা করতে এসেছে। মৌরি ভেবে এসেছিল, বাড়ি গিয়ে তো সে না-ই বলবে। শুধু শুধু সময় নষ্ট করছে। সে আগে পৌঁছে গিয়েছিল। দেখা করার সময় দিয়েছিল বিকেল চারটায়। মৌরি নিরিবিলি একটা টেবিলে বসেছে। হাতঘড়িতে সময় দেখছে। চারটা বাজতে এখনও দশ মিনিট। গুনে গুনে ঠিক দশ মিনিট দেখবে তারপর ছেলেটা না এলে চলে যাবে। অপেক্ষা জিনিসটা সে কারো জন্যই করতে পারে না। ওয়েটার এসে তাকে অরেঞ্জ জুস দিয়ে গেছে। ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে বাঁ হাতে জুসের গ্লাসটা নিল মৌরি। ফ্রেন্ড’স গ্রুপের চ্যাট গুলো পড়তে পড়তে আনমনে হাসছিল। কখন যে একটা ছেলে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এটা মৌরি খেয়াল করল না।
-এক্সকিউজ মি!”
ছেলেটার ভরাট কন্ঠে ডাক শুনে চোখ তুলে তাকাল মৌরি। লম্বায় প্রায় ছ’ফুট এর কাছাকাছি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী একটি যুবক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার চোখে কালো চশমা। পরনে কালো প্যান্টের সাথে ইন করা সাদা শার্ট। শার্টের হাতা কনুইয়ের কাছে গোটানো। পরিপাটি চুল। সব মিলিয়ে ছেলেটাকে সুদর্শন বলা যায়।
তাশফিন মৌরিকে দেখল। মৌরিকে দেখে তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি দেখা দিয়েছে। তবে তার হাসিটা চট করে ধরা যায় না। এটাই সে মেয়ে যাকে সে বিয়ে করবে। তাশফিন হাতঘড়িতে সময় দেখল। একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,
-চারটা বাজতে এখনও দুই মিনিট বাকি। তবুও অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত।”
মৌরি যখন বুঝল সে হাবলার মতো তাকিয়ে ছেলেটাকে দেখে যাচ্ছে তখন তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিল। মাথা নেড়ে জানাল সে-ও একটু আগেই এসেছে। তাই বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। তাশফিন মৌরির হাতে জুসের গ্লাস দেখে তবুও আরেক বার সরি বলল। এখানে আসার আগে মনে মনে অনেককিছু ভেবে এসেছিল মৌরি। কিন্তু ছেলেটার সামনে বসে এই মুহূর্তে তার সবকিছু কেমন উলটপালট হয়ে গেল। সবচেয়ে লজ্জাদায়ক যেটা হলো মৌরি ছেলেটার নাম ভুলে গেছে। শত চেষ্টা করেও নামটা মনে করতে পারছে না। মা’র মুখে কয়েকবার শুনেছিল। কিন্তু এখন মনে পড়ছে না। যাকে বিয়ে করবে বলে দেখতে এসেছে তার নামই ভুলে গেছে, কথাটা যদি অপর পাশের মানুষটা জানতে পারে তাহলে নিশ্চয় আশাহত হবে। কিন্তু মৌরি তো ইচ্ছে করে নাম ভুলে যায়নি। মনে পড়ছে না। এতে তার কী করার আছে?
তাশফিন আড়চোখে মৌরিকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। আজকের এই দেখা করার পরই জানা যাবে মৌরি বিয়েটা করবে কি-না। তাশফিন গলায় শব্দ করে মৌরির মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইল।
মৌরিও দমে না গিয়ে মনে মনে ভাবল, কথা চালিয়ে যেতে নাম মনে রাখতে হবে দেশে এমন তো কোন আইন নেই। সে তো নাম ধরে ডাকতে যাবে না। ‘আপনি’ দিয়েই কথা চালিয়ে নিবে। না ভয় কিসের? ছেলেটা তো বাঘ ভাল্লুক না। তাকে নিশ্চয় খেয়ে ফেলবে না। নার্ভাস হওয়া যাবে না। যতটা সম্ভব শান্ত থাকতে হবে।
-মৌরি, আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?”
ঝট করে মৌরি মানুষটার দিকে তাকাল। তার নিজের নামটাও যে কারো কন্ঠে এতটা মধুর শোনাতে পারে তা মৌরির ধারণা ছিল না। কিছুটা না, অনেকটাই অবাক হলো। সে ভয় পাচ্ছে এটা উনি কীভাবে বুঝলেন! তাশফিন মৌরিকে দেখে হাসল। বলল,
-আপনার হাত কাঁপছে।’ কথাটা বলেও তাশফিন বেশ মিষ্টি করে হাসল। মৌরি আরও একবার ছেলেটাকে হাসতে দেখে মুগ্ধ হলো।
-ভয় বা নার্ভাস হবার কারণ নেই। টেক ইট ইজি। আপনি না চাইলে আমরা কথা আগাবো না।”
সেদিন তাশফিন নিজের গোছালো কথাবার্তায়, ভদ্র আচরণে মৌরিকে অনেকটা কমফোর্ট ফিল করিয়েছিল। ওরা কথা বলতে বলতে কখন যে সময় গড়িয়ে পাঁচটা বেজে গেল সেদিকে কারো খেয়াল ছিল না। মৌরির ফোন বেজে উঠলে দেখল মা’র কল। ইশ! ত্রিশ মিনিটের কথা বলে এসে এখন কতটা সময় পেরিয়ে গেছে! মৌরি কল কেটে দিয়ে ফোন পার্সে রেখে বলল,
-এবার আমাদের ওঠা উচিত।”
-হুম।’
রেস্টুরেন্ট থেকে মৌরি আগে বেরিয়ে আসছিল। তাশফিন পেছন থেকে ওকে ডেকে উঠল।
-মৌরি!”
মৌরি দাঁড়িয়ে পেছন ফিরল। তার দৃষ্টিতে প্রশ্ন। কথাটা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে তাশফিন নিজেও এবার নার্ভাস ফিল করছে। তারপরও বুকে সাহস সঞ্চয় করে বলে ফেলল,
-আমাদের পরবর্তী দেখাটা কি বিয়ের দিন হবে? মানে আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে?”
মৌরি তাৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিল না। কিছুটা সময় নিয়ে ভাবল। তারপর ডান পাশে মাথা সামান্য কাত করে হাসল। তার এই হাসি প্রশ্রয়ের হাসি। তার হাসিতেই তাশফিন উত্তর পেয়ে গেল।
*
*
কনের কবুল বলার পর এবার বরের কবুল বলার পালা। মৌরির কাজিনরা ওকে পেছন থেকে ঠেলে দিয়ে ফিসফিস করে বলছে,
-সহজে কবুল বলিস না। সময় নিয়ে বলবি। দেখবি দুলাভাই তোর জন্য কতটা উতলা হয়। এটাই কিন্তু সুযোগ।”
মৌরি আজকের এই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটির কথা ভেবে কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে। একা একাই লজ্জা পেয়েছে। মানুষটাকে নিয়ে তার ছেলেমানুষী ভাবনা গুলোর কথা ভেবে বালিশে মুখ লুকিয়ে হেসেছে। আজ সমস্ত অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তার প্রিয় প্রহর তার দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে।
মৌরির বুক এমনভাবে ধুকপুক করছে, এই মুহূর্তে অন্য কারো কথা কানে আসছে না। সে নিজের মনকে শাসিয়ে বকে গলায় জোর এনে সাথে সাথেই কবুল বলে ফেলেছে। এতে রাগ হয়ে পেছন থেকে কয়েকজন চিমটি কেটেছে। বউ কবুল বলতে সময় নেয়নি। কিন্তু বর? কবুল বলার আগেই সে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার জায়গা ছেড়ে উঠে এসে বলল,
-দুঃখিত, এই বিয়েটা আমি করতে পারব না।”
বিয়ে বাড়ির আনন্দঘন পরিবেশ বিষাদময় রূপ নিতে বেশি সময় লাগল না। এখানে উপস্থিত প্রতিটা মানুষের মুখ থেকে হাসি সরে গেল। পরমুহূর্তে সবার মাঝে একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল। বর এসব কী বলছে! বিয়ে হবে না মানে কী!
মৌরির মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। মৌরি ফ্যালফ্যাল চোখে এক ধ্যানে মানুষটাকেই দেখে যাচ্ছে। তাশফিন তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। চারপাশ থেকে ধনুক থেকে ছোঁড়া তীরের ন্যায় নানান প্রশ্ন ছুটে আসছে। তাশফিন সবার প্রশ্নের জবাবে একটা কথাই বলল,
-বিয়েটা আমি করব না। এই মেয়েকে তো না-ই।”
মানুষটাকে চোখের সামনে এতটা পাল্টে যেতে দেখে মৌরির পৃথিবীটাই যেন অন্ধকারে ছেয়ে গেল। যে মানুষটা শুধুমাত্র ফোন কলেই তাকে এতটা সম্মান করতো, তার এত খেয়াল রাখত আজ সে মৌরির চোখে পানি দেখেও একটুও গলছে না। একটা বার মৌরির কথা না ভেবে তার সিদ্ধান্তে অটল হয়ে রইল। মৌরির বাবা, চাচা, ভাই সবাই নিজেদের মান-মর্যাদা বিসর্জন দিয়ে মানুষটার সামনে হাত পাতছে। আকুতি মিনতি করছে। বিয়েটা ভেঙে না দেওয়ার অনুরোধ করছে। কিন্তু কোনকিছুতেই তাশফিনের কোন ভাবান্তর হচ্ছে না। সে বরং মানুষ গুলোকে তার সামনে ঝুঁকতে দেখে বুকের ভেতরটায় প্রশান্তি অনুভব করছে। এতদিন ধরে বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা আগুনটা একটু একটু করে শীতল হচ্ছে। তার প্রতিশোধ আজ পূর্ণ হয়েছে।
চলবে_