#শ্যামাপ্রিয়া
#পর্ব৪
#তামান্না_আনজুম_মায়া
সকালেই হসপিটালে হাজির দুই পরিবারের মানুষ। বেপারী বাড়ি থেকে এসেছেন জয়নাল বেপারী, জুলেখা বেগম,খোদেজা বেগম,আঁখি বেগম।সিকদার বাড়ির কর্তা সাত্তার সিকদার,সবীজ, সুরেখা।
কাঠের বেঞ্চিতে বসে আছে নেহাল,পাশে ফাহমিদ।তিথি দাঁড়িয়ে আছে আইসিই”উর সামনে।
নিশিতা এগিয়ে এসে বললো—,, বলো আমার মা কোথায়?আমি দেখবো।
নেহাল তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো মুখ তেঁতো করে বোনের দিকে এগিয়ে এসে বললো–,,কি সমস্যা চেঁচামেচি করছিস কেনো?এখানে তোর কোনো মা নেই!যেদিন তুই আমাদের মিথ্যা বলে সিকদার বাড়িতে গিয়ে থাকতে শুরু করেছিস সেদিন থেকেই তোর মা ম’রে গেছে!এখন কি লোক দেখানো কান্না করতে এসেছিস?তোর এসব করার কোনো দরকার নেই যেখান থেকে এসেছিস ওখানে চলে যা।তোর মতে তো আমরা ছোটলোক আমাদের সাথে তোর যায় না।তাই আমিও মনে করি আমার বোন তুই না তিথি!
তিথি রেগে এসে বললো–,,কি শুরু করেছিস নেহাল
এটা হসপিটাল।বাড়ি গিয়ে এসব কথা বলার অনেক সময় পাবি।
জয়নাল বেপারী এগিয়ে এসে বললো–,,বল বোন আমার মেয়েটা কেমন আছে?মেয়েটা শুধু কষ্টই পেয়ে গেলো এখানে আসার পর থেকে।
সাত্তার সিকদারের অনুশোচনা জাগলো মনে,অনুতাপে পু’ড়লেন,তিনি না জেনে বুঝে জয়নাল বেপারী কে কতো কি না বলেছেন।সে মানুষ টা তার মেয়েকে নিজের মেয়ের মতো করে রেখেছে!যেখানে মেয়ের জামাই তাকে ছেড়ে গেছে।বৃদ্ধর চোখ অশ্রুশিক্ত হলো,তিনি অপ’রাধী মেয়ের খারাপ সময় তিনি পাশে থাকতে পারেননি।এখন মেয়ের সামনে দাড়াবেন কোন মুখে।সুরেখা এগিয়ে গেলেন শ্বশুরের দিকে কাঁধে হাত রেখে বললো
–বাবা ভেঙ্গে পড়ছেন কেনো?নাজমা দেখবেন ঠিক তার বাবা কে মাফ করে দিবে।আবার বাবা বলে জড়িয়ে ধরবে!দোয়া করেন যাতে আপনার মেয়ে সুস্থ হয়ে যায়।
নেহালের দিক তাকিয়ে আছে সাত্তার সিকদার,ছেলেটি যেনো তাকে চিনেই না কতোটা ঘৃ’ণা করে তা যেনো স্পষ্ট চোখে।নিশিতা যখন এসেছিলো তখন তিনি না করেননি মেয়ের প্রতি রাগ থাকলেও নাতি নাতনির প্রতি তার কোনো দিনই রাগ ছিলো না।
মেয়েটাকে ওইদিন তাড়িয়ে দেওয়ার পর কতো মাস টানা ফোন করতো মেয়েটা সাত্তার সিকদার বার বার তাকে কথা শোনাতো।মেয়েটা অভিমান করে ফোন করা বন্ধ করে দিলো পরে কাটলো বছরের পর বছর,এতোদিন পর এসে মেয়ের কষ্টের কথা শুনে কি করে ঠিক রাখবেন নিজেকে?তিনি তো এক ব্যর্থ পিতা।
তিথি জয়নাল বেপারীর সাথে কথা বলছে।সকালেই ডাক্তার জানিয়েছে ছোট একটা অ”স্ত্র পা’চার করতে হবে।রোগীর কন্ডিশন তেমন ভালো না।
জয়নাল বেপারী ইতস্তত হয়ে বললেন
–,,টাকা কোথায় পেয়েছিস? এতো গুলো টাকা তুই দিবি কি করে?
–আমার কাছে অনেক টাকাই আছে দাদু।এই সামান্য টাকা কোনো বিষয় না আমার নিজের মা তো আমার কাছে নেই,যে মানুষ টা মায়ের ভালোবাসা দিলো তার বিপ’দে যদি পাশেই না থাকতে পারি তবে কেমন মেয়ে হলাম বলো!টাকা আসবে যাবে মানুষের জীবনটাই তো গুরুত্বপূর্ণ।
–তাই বলে তুই একা পাঁচ লাখ টাকা দিবি?আমি দেই কিছু!
–আমি পুরোটা দেওয়া মানেই তো তুমি দেওয়া দাদু।ভাই বোনে কোনো ভাগ হয় নাকি?আমি তোমার বোন না বলো!
জয়নাল বেপারীর চোখ ছলছল করে উঠলো,নিশ্চয়ই তার বড় ছেলে বড় কোনো পূণ্য করেছে যার জন্য আল্লাহ এতো ভালো একটা মেয়ে তাকে দান করেছে।
নিশিতা বলে উঠলো –,,দয়া করছো তুমি আমাদের?তোমার দয়া চেয়েছি নাকি।আমার ভাই মা কে কেঁ’ড়ে নিয়েছো তুমি!নিজের সৎ মা তো তোমাকে কোনো দিন এক ফোঁটাও পছন্দ করে না তাই আমার মাকে বশ করে নিয়েছো?এতো স্বার্থ লোভী কেনো তুমি!
নেহাল এসে একটা চ’ড় মারলো নিশিতা কে।
–,,কাকে স্বার্থ লোভী বলছিস নিশিতা?তুই স্বার্থ’পর,তুই ওই বড়লোক বাড়িটাতে গিয়ে নিজেও লো’ভী অহং’কারী হয়ে উঠেছিস।দিনে একবার মাকে কোনো দিন ফোন করতি?বাড়িতে দেখতে আসতি?আমার সাথে যোগাযোগ রেখেছিস?বাবার মতো হয়েছিস তুই! আর সিকদার বাড়ির কর্তার মতো যার অহং”কারে মাটিতে পা পড়ে না।এতোদিন তো খোঁজ নেয়নি কেউ এখনও কারো দরকার নেই আমার আর মায়ের।আর নিজেকে তিথির সাথে তুলনা করছিস কোন সাহসে।
এই যে মাস শেষে মোটা অংকের হাত খরচ তোকে দেয় কে দেয় জানিস?তোর বাপ তো আগেই ভেগেছে নিজের দায়িত্ব ফেলে।তাও তোর মন একটুও নরম হয়নি?ঝুঁকতে শিখিস নি,পরিবার কি জিনিস তুই এটা জানিসই না জানলে ওই বাড়িতে এক পা ও রাখতি না।
তিথি দেয় তোর মাস শেষের হাত খরচ,আমাকে কি বলে জানিস?আমার বোন তাই দেই তোর কি সমস্যা নেহাল। আর তুই কিনা আজ তার দিকে আঙুল তুলছিস?কতো টা নিচ তুই নিশি!
তিথির বাবা আছে দেখেই তো এতোটা শান্তিতে বাড়িতে থাকি মা আর আমি যা বাবা করেনি তা বড়আব্বু করে আমাদের জন্য।
এতো যখন তোর দয়া মনে হচ্ছে তবে নিজে দে টাকা!
তোর সামর্থ্য আছে দেওয়ার?ইনকাম করিস তুই!
সাত্তার সিকদার বললো–, আমি দিবো নিশির হয়ে!
এবার তিথি বলে উঠলো-,কিছু মনে করবেন না নানাভাই!পরিবার মানেই একে অন্যের পাশে থাকা আমাদের পরিবারের যথেষ্ট অর্থ সম্পদ আছে।আপনার থেকে নিতে হবে না আমাদের।আমার দাদুর মেয়ে আমাদের সব ভাই বোনের মা।আমাদের পরিবারে কেউ কারো থেকে আলাদা না তাই এক সাথে আছি এতো বছর পরেও থাকবো।আমার বাবা, ছোট চাচা আছেন কোনো অসুবিধে হবে না।আপনি ছোটদের কথায় কান দিবেন না টাকা দেওয়া হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। আপনার মেয়ে তাই আপনি দিতে চাচ্ছেন আপনার প্রতি রাগ নেই আমাদের।তবে যেহেতু পরিবার আমাদের মা ও আমাদের দায়িত্ব অধিকার সবই বেশি আমাদের।নিশি ছোট মানুষ ওর কথা না ধরাই উচিত।
নেহাল আবার কিছু বলতে গেলেই তিথি থামিয়ে দেয়
–,,হসপিটাল ভাই কখন থেকে বলছি চুপ কর।সিনক্রি’য়েট কেনো করছিস?
ফাহমিদ এসে বললো–,,হ্যাঁ দাদু তিথি ঠিক কথাই বলেছে।তর্ক করার সময় অনেক আছে আগে ফুপ্পি সুস্থ হয়ে উঠুক।সবার উচিত এখন আল্লাহ কাছে দোয়া করা।
————
নাজমা বেগম পরিপূর্ণ সুস্থ। হসপিটাল থেকে বাড়িতে নেওয়া হবে কাল।তিথি মোবাইল কানে দিয়ে কথা বলছে নিজের বাবার সাথে।
–,,মা সব ঠিক আছে তো নাজমা সুস্থ তো?
–,,হ্যাঁ বাবা সুস্থ দাঁড়াও আমি তোমাকে কথা বলিয়ে দিচ্ছি।
কেবিনের ভিতর বোনের সাথে কথা বলছেন সজীব সিকদার কতোদিন খুঁজেছেন লুকিয়ে কিন্তু বোনের খোঁজ পাননি।আজ কতো দিন পর ভাই বোনের মিল হলো সুরেখা মুগ্ধ চোখে দেখছেন পাশে দাঁড়িয়ে।
তিথি ভিতরে ঢুকে বললো
— স্যরি আপনাদের একটু বিরক্ত করলাম।আসলে বাবা কথা বলতে চাচ্ছেন মেজো চাচীর সাথে।
নাজমা হাত বাড়ালেন ফোন নেওয়ার জন্য!
তিথি পাশে বসে ফোন এগিয়ে দিলো।নাজমা ডাকলেন
–,,ভাইজান আপনি ভালো আছেন?
নুরুল বলে উঠলো –,,আর কি করে ভালো থাকি বলো, আমার বোনই তো অসুখ বাঁধিয়ে রেখেছে,ভাই কেও বলেনি পর হয়ে গেছি কিনা!
–ভাইজান এভাবে বলছেন কেনো?
–,,তো কিভাবে বলবো তোমাকে?ছোটদের মতো এসব কান্ড কেউ ঘটায়।বাড়ি আসি এর বিচার করবো আমি।
তিথি বলে উঠলো —-,বাবা তুমি আমার মাকে বকতে পারো না।আমি কিন্তু তার দলে বুঝলে আমাদের দল ভারী।
সুরেখা, সজীব দেখলেন মেয়েটিকে,তাদের মনে জেগে উঠলো এক উত্তম বাসনা!স্বামী স্ত্রী যেনো নিজেদের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে হাসলেন!
সজীব খুশি হলেন তার বোন সব কিছুই পেয়েছে শুধু স্বামীর সুখ পায় নি।যে মানুষ টাকে ভালোবেসে সেই ঠকিয়ে ছে বোন কে কিন্তু বাকিরা এতো এতো ভালোবাসায় আগলে রেখেছে বোন কে হয়তো তারাও এতো ভালো পারতো না।আসলেই সব সুখ কপালে সয় না।মানুষ কোনো না কোনো দিক দিয়ে অপূর্ণই থেকে যায়!
———–
বাড়িতে আনা হলো নাজমা বেগম কে,অবশেষে মান অভিমানের পালা শেষ হলো।সিকদার পরিবার, বেপারী পরিবার এক সাথে হয়েছে।সৌরভের বিয়েটাও ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
আজ পুরোদমে রান্না করছে খোদেজা,আঁখি, হাত লাগিয়েছে তিথি,বর্ষা,নিশিতা!সহকারী কাজের মহিলারা।
রান্না ঘর থেকে ঘামে লেপ্টে বেরিয়ে আসলো তিথি। ছুট লাগালো নিজের ঘরের দিকে।
পথিমধ্যে দেখা ফাহমিদের সাথে।তিথি ভড়কালো এই ছেলেটার হঠাৎ কি হলো কয়েক দিন ধরে খেয়াল করছে কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে!
ফাহমিদ কথা বাড়ানোর জন্য বললো–,,তিথি একটা সাহায্যে লাগতো!
তিথি নেহাল কে ডেকে বললো–,,আমি রুমে যাচ্ছি ভাই প্রচুর গরম তুই তোর ভাই কে একটু সাহায্য করে দে!
ফাহমিদ কি বলবে বুঝতে পারলো না মেয়েটা এমন কেন?কোনো ফিলিংস টিলিংস কি আদো আছে এর মাঝে!
নেহাল নিজের সাথে করে ফাহমিদ কে নিজেদের ঘরে নিয়ে গেলো।তিথি উঠে গেলো চিলেকোঠার ঘরটায়!
গোসল সেরে যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো।ছাদের এক পাশে দাড়িয়ে চুল ঝাড়তে ব্যস্ত তিথি আশেপাশে কাউকে খেয়াল করেনি।নেহালদের ছাদে দাড়িয়ে আছে ফাহমিদ মুগ্ধ চোখে দেখছে তিথি কে,মেয়েটা কতো স্নিগ্ধ! দিন দিন যেনো আকৃষ্ট হয়েই যাচ্ছে ফাহমিদ।
লম্বা চুল গুলো ঘুরিয়ে অপরপাশে সরাতেই মুখ দেখা গেলো এবার তিথি স্বযত্নে কানে গুঁজে দিলো চুলগুলো ।
নেহাল ফাহমিদের কাঁধে হাত রেখে বললো—,, ভাইয়া ভুল জিনিসে নজর দিতে নেই!পটাতে পারবে না,তার থেকে ভালো দাদু কে পটাও দাদু দিন বললে তিথিরও দিন রাত বললে রাত।বুঝছো!
ফাহমিদ গাল এলিয়ো হাসলো।মুখে বললো
–,,চেষ্টা করতে ক্ষতি কি!
ভাবছি ওর সাথে গিয়ে একবার কথা বলে আসি,ওর রুম কোন টা বলে দে তো!
–,,ছাদেই থাকে চিলেকোঠায়!তবে রুমে আজ অব্দি কাউকে ঢুকতে দেয়নি।আমরা ও যাইনি ওর চিলেকোঠার ঘরে।
–,,আমাকে যেতে দিবে। আপটারঅল মেহমান কিনা!
——-
দাওয়াত করা হয়েছিলো সৌরভদের পরিবার কে।
খাওয়া দাওয়া শেষে বড়রা নিজেদের মধ্যে আড্ডায় মেতে উঠলেন।
ছোট রা বসে ছে ঘাট পাড়। সিঁড়িতে বসেছে কয়েকজন সৌরভ আর বউ নিলি আড্ডার মধ্যে মনি।
সৌরভ এক ফাঁকে ফাহমিদ কে জিজ্ঞেস করে
–,,কিরে এখনো ফিরে যাচ্ছিস না কেনো?এখন কি গ্রাম ভালো লাগতে শুরু করলো নাকি!
ফাহমিদ মাথা চুলকে বললো–,,তিথি চাইলে সারাজীবনই এখানে কাটিয়ে দিবো আমি।
সৌরভ হেসে বললো–,,ফেঁসেছ মামা এবার বুঝবে তুমি কিভাবে বাঘে মহিষে এক ঘাটে জল খায়!যা গিয়ে ফ্রেন্ডশিপ কর আগে বন্ধুত্ব করাটা জরুরি পরে বাকিসব।
ফাহমিদ গলা খাঁকারি দিয়ে বললো–মিস তিথি আপনি আর আমি সেইম ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট মানে আমি
প্রাক্তন স্টুডেন্ট আপনি বর্তমান।
তিথি ভ্রু কুঁচকে বললো–,,তো কি হয়েছে।
অনু,ইসমা,নোহাল মিট মিট করে হাসছে।অনু ফিসফিস করে বললো–ভাইয়া আজ অব্দি কতো মেয়ে কে রিজেক্ট করলো আজ ভাইয়ার পালা!
ইসমা বলে উঠলো –তুই তো দেখছি নিজের ভাইয়ের বিরোধী।
অনু বলে উঠলো তো কি করবো।এখনো ভাবি পেলাম না ভাইয়ার এই মেয়ে পছন্দ হয় না শুনতে শুনতে।এবার একটু নাকানিচুবানি খেলে শিক্ষা হবে।তবে যাই বলো তিথি আপু ভাবি হিসেবে মন্দ না।
ফাহমিদ বললো–,,না মানে কিছু না।কিন্তু আমরা তো বন্ধুও হতে পারি!এতে দুজনেরই লাভ।
তিথি সবার দিকে তাকালো ফাহমিদের বাড়ানো হাত উপেক্ষা করে চলে গিয়ে বললো– ভেবে দেখবো।
ফাহমিদ মৃদু হাসলো ফের বললো
—বন্ধু না বানান এক কাপ কফি তো খাওয়াতেই পারেন।
তিথি পিছন ফিরে বললো–,,চলুন!
তিথি চলে যেতেই সবাই ফাহমিদ কে নিয়ে মজা করলো পরে একে একে অল দ্যা বেস্ট বলে পাঠালো!
চলবে,,,